মন মুনিয়া পর্ব-৪৭

0
1529

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৪৭

অবশেষে সকলের মায়া ত্যাগ করে, মনির কাছ থেকে শুকনো হাসিমাখা বিদায় নিয়ে চলে গেছে নীল। যাওয়ার আগে মুনিয়াকে কোলে নিয়ে বেশ করে আদর দিয়ে গেছে সে। সকলের আড়ালে মনিকে নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার কথা বলতেও ভুলে নি মানুষটা।
যে মুহূর্তে নীল বিদায় নিচ্ছিলো, সে মুহূর্তে বুক ফাটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছিলো মনির মন থেকে। সকলের সামনে সে সেটা প্রকাশ করতে পারেনি। এ তীব্র ব্যাথা সে মুখ বুজে হজম করেছে।

নীল চলে গেছে আজ দুদিন। ও যাবার পর থেকে রাবেয়া কেমন মনমরা হয়ে থাকে। ছেলের জন্য মনটা খুব কাঁদে উনার। ঠিকমতো খায় না। আশা কিংবা হিমা কেউই উনাকে খাওয়াতে পারছেনা টাইম মতো। না খেয়ে থেকে উনার শরীরটাও দুর্বল হয়ে পরছে। এমতাবস্থায় সকলে উনার জন্য চিন্তায় পরে। রেগুলার নীলের সাথে কথা হচ্ছে। ভিডিওতে নীলকে দেখছে৷ তাও মন ভরছে না উনার।

আশা নিরাশ হয়ে রুমে গিয়ে বসে থাকে। এদিকে মায়ের এ হাল। অন্যদিকে তাকে আগামীকাল ঢাকা ফিরে যেতে হবে। অনেকদিন ধরেই সে বাড়িতে আছে। অনেক গ্যাপে পরে গেছে সে। আর মিস দেওয়া যাবেনা। মাকে এ অবস্থায় রেখে যাই কি করে।
মনি মুনিয়াকে গোসল করিয়ে হিমার কোলে দিয়ে এসেছে। আশাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে সে বুঝে গেছে এ মন খারাপের কারণ। সে ধীরপায়ে আশার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর ঘাড়ে হাত রাখলো। আশা হতাশ চোখে মনির দিকে তাকালো। মনমরা হয়ে বললো
-ভাইয়া তো মাত্র দুটো বছরের জন্য গেছে বল। তাও লেখাপড়ার খাতিরে। মা কেন এমন করছে। আর ভালো লাগে না কিছু।

মনি মুচকি হেসে বললো
-মা তো মা ই হয় আশাপু। ছেলে এতোটা দূরে গেছে যে ইচ্ছে করলেই আর কাছে পাবেনা এ দুই বছরের মধ্যে। তাই মন খারাপ হচ্ছে উনার।।
-সেটাতো বুঝেছি। তাই বলে না খেয়ে থাকবে? এভাবে যে শরীর খারাপ করছে।
-তুমি চিন্তা করোনা আশাপু। আমি আন্টিকে খাওয়াবো।।
-খাওয়াতে পারবি?
-চেষ্টা করে দেখি।
-তাই কর। দেখ কিছু খাওয়াতে পারিস কিনা। আমরা তো মায়ের জেদের কাছে হেরে গিয়ে বসে আছি।
মনি হাসলো। সে আশাকে সাথে করে রাবেয়ার কাছে এলো।

আশা গিয়ে বারেয়ার কাছে বসলো। মাকে এক হাতে জরিয়ে ধরে নরম গলায় বললো
-তুমি কি খাবে না মা?
-ইচ্ছে করছে না রে।
-এভাবে যে শরীর খারাপ করবে তোমার।
-করলে করুক।

মনি কোনো কথা না বলে সোজা রান্নাঘরে ঢুকলো। একটা প্লেটে অল্প ভাত নিয়ে তাতে কিছুটা সবজি আর মাছের ভাজা নিয়ে ফিরে এলো রাবেয়ার কাছে। মনিকে ভাত নিয়ে আসতে দেখে রাবেয়া অন্যদিকে মুখ ফিরালো। মন মরা কন্ঠে বললো
-আমি খাবো না মনি। ওগুলো রেখে দিয়ে আয়।
মনি হাসলো। সে হাতটা ভালো করে ধুয়ে সবজি দিয়ে ভাত ভালো করে মাখিয়ে রাবেয়ার মুখের সামনে লোকমা ধরলো। রাবেয়া কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকালো মনির দিকে। এক সময় দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললো
-আমার যখন ইচ্ছে হবে আমি খেয়ে নিবো মনি। তোকে খাইয়ে দিতে হবে না।
-আমার আজ ইচ্ছে হয়েছে আপনাকে খাইয়ে দিতে আন্টি।
-রেখে দে মনি। জোর করিস না।।ভালো লাগছে না কিন্তু।

মনি মুচকি হেসে বললো
-আমি যখন কোনো কারণে মন খারাপ করতাম, আমার মা আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতো। আজ আপনাকে মন খারাপ করতে দেখে আমার মায়ের কথা মনে পরছে আন্টি।
রাবেয়া উদ্বেগ নিয়ে তাকালো মনির দিকে। আজ কেন জানি মনির প্রতি একটা অজানা মায়া কাজ করছে তার। বরাবরই মনিকে তিনি স্নেহ করেন, তবে আজ মায়াটা একটু বেশিই কাজ করছে। মনির বলা কথাটা উনার মনে বেশ দাগ কেটেছে।

রাবেয়া যখন ছোট ছিলো তখন উনার মাও উনাকে খাইয়ে দিতো। কোনো কিছু নিয়ে মুখভার করলে নানা রকম অনুনয় করে মা তাকে আদরের সহিত মুখে তুলে খাওয়াতো। মা মারা গেছে আজ অনেক বছর। মা চলে যাবার পর থেকে কেউই উনাকে খাইয়ে দেবার কথা মাথায় আনেনি। এমনকি উনিও এই চিন্তাটা করেনি কখনো। বয়স হয়ে গেছে, বুড়ো বয়সে অন্যের হাতে খাওয়ার আবদার করাটা কেমন যেনো হাস্যকর। তবে মনিকে আজ নিজের মায়ের রুপে দেখছেন উনি।

হটাৎ মনিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বসালেন রাবেয়া। উৎফুল্লতার সাথে বললেন
-আমাকে খাইয়ে দে মনি। আমার খিদে পেয়েছে খুব।
মনির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আশাও অবাক হয়ে তাকালো মনির দিকে। সে উৎকন্ঠে হিমাকে ডাকলো। হিমা দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো
-কি হয়েছে আশা?
-দেখো ভাবী, মনি কি মিরাকেল করলো। আমরা এতো জোরাজোরি করেও খাওয়াতে পারলাম না, আর মনি খুব সহজেই মাকে খাওয়াতে পারছে।
হিমা অবাক হয়ে বলল
-তাইতো। কিভাবে মায়ের মন খারাপ দূর করলে মনি?

মনি হাসিমুখে উত্তর দিলো,
-আসলে আন্টির মনে অনেক মায়া ভাবি। তাই আমার আবদার ফেরাতে পারেন নি।
-তোর মতো মেয়ের আবদার বোধহয় কেউই ফেরাতে পারবেনা রে মা।
রাবেয়ার কথায় মনি চমকে উঠলো। হটাৎ মায়ের বলা “মা” ডাকটার কথা মনে পরে গেলো। মা তো এভাবেই মনিকে মা বলে ডাকতো।

________
পরের দিন সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে রেডি হলো আশা। কিছুক্ষনের মধ্যেই বেরিয়ে পরবে সে। ১০ টার ট্রেনে করে সে যাত্রা করবে। চাইলেই সে বাসে করে যেতে পারতো, তাতে সময়ও কম লাগতো। তবে বাসের মধ্যে মাথা ঘুরিয়ে বমি করাটা ওর ছোট বেলাকার অভ্যাস। সে এক বেলা না খেয়ে থাকতে রাজি আছে, কিন্তু বাসে চড়তে রাজি না। যদিও এর আগে একবার সে বাসে চড়েছিলো, যখন মনিকে নিয়ে ওদের কলেজ গিয়েছিলো। সেদিনও নিতান্ত দরকারে গিয়েছিলো। তবে বাসে উঠার আগে বমির ট্যাবলেট খেয়ে উঠেছিলো তখন। তবুও মাথা ঘুড়েছিলো সারা রাস্তা। এবার আর সেই রিস্ক নিবেনা সে। বরাবরের মতো এবারেও রেল পথেই হবে তার যাত্রা।।।

স্টেশনে যখন পৌছুলো তখন বাজে সকাল ৯:৩০। ট্রেন আসবে ঠিক দশটায়। সে তারাতাড়ি করে টিকিট কাউন্টারে গেলো। টিকিট পাবে কি পাবে না সেই চিন্তা তার মাথায় কাজ করছে। এমতাবস্থায় ডানে বামে, সামনে পিছনে না তাকিয়ে সে কাউন্টারের জানলার কাছে যেতে নিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে আবারও এক প্রচন্ড ধাক্কা খেলো কারো সাথে। মেজাজটা বিগড়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে থাকা মানুষটাকে স্যরি বলতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে দেখতে পেলো খাম্বামার্কা লোকটা তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

আশা কপাল কুচকে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো
-তাই তো ভাবি, আমাকে কে ধাক্কা দেয়। এ তো দেখি মিস্টার খাম্বা মশায়।
-তুমি এখানে কি করছো? ভ্রু বাকিয়ে বললো শ্রাবণ।
-আপনার জন্য বউ দেখতে এসেছি। শাকচুন্নি মার্কা বউ।
-শাকচুন্নি তো তুমি। খাঁটি কেউড়া গাছের শাকচুন্নি।
আশা রেগে গিয়ে বললো
-ফালতু লোক একটা। আরেক বার শাকচুন্নি শাকচুন্নি করলে সত্যি সত্যিই কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।।
-তুমি বললে দোষ নেই, আর আমি বললেই দোষ।
-দেখুন, প্রফেসর প্রফেসরের মতো থাকবেন। নিরীহ মেয়েদের সাথে ঝগড়া করতে আসবেন না বলে দিলাম।
-তুমি নিরীহ?
-অভিউসলি!
শ্রাবণ হেসে বললো
-পাগল।

আশা রেগে গেলো শ্রাবনের কথায়। কিন্তু কিছু বলার সুযোগ সে পেলোনা। শ্রাবণ মুহুর্তেই সে যায়গাটা ত্যাগ করে চলে গেছে। আশা নিজের রাগ টা ঝাড়তে না পেরে নিজের উপর আরো রেগে গেলো। কিন্তু রেগে থাকলে তো হবেনা। টিকিট করতে হবে। সে মাথা থেকে সমস্ত কিছু ঝেড়ে টিকেট কাউন্টারের সামনে এগিয়ে গেলো।। তবে আশানুরূপ সিট সে পেলো না। জানলার কাছে সিট পাবার প্রচন্ড আকাঙ্খা থাকলেও সে আকাঙ্ক্ষায় পানি ঢেলে কাউন্টারে বসে থাকা লোকটি ওকে বললো
-একটামাত্র সিটই বাকি আছে। নিলে নিতে পারেন, না নিলে অন্য কেউ নিবে। আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
শেষে বাধ্য হয়ে সেই টিকিটটাই নিতে হলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এলো স্টেশনে। ট্রেন এসে থামা মাত্রই হুড়মুড়িয়ে লোকজন নামতে থাকলো।
আশা নির্দিষ্ট বগির দরজার সামনে এসে দাড়ালো। লোকজন নামা শেষ হলে সে জলদি করে উঠে গেলো ট্রেনে। ওর সিটের কাছে গিয়ে দেখলো জানলার কাছের সিটটা এখনো ফাঁকা। কেউ এসে বসেনি। আশা নিজের সিট খালি রেখে জানলার কাছের সিটটাতে গিয়ে বসে পরলো। সিটের লোক এসে যদি ঝামেলা করে তাহলে দিয়ে দিবে। আর যদি কিছু না বলে তাহলে তো ভালোই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জানলার পাশের সিটধারী লোকটা চলে এলো। আশা সবেমাত্র সিটে হেলান দিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলো। সেই মুহূর্তে কেউ বলে উঠলো
-নিজের সিটে গিয়ে বসো। এটা আমার সিট।
আশা তাকালো লোকটার দিকে। আবারও সেই খাম্বা। শ্রাবণ ততক্ষণে আবারও বলে উঠলো
-কি বলছি ম্যাডাম, আমার সিটটা আমাকে দিয়ে উদ্ধার করো। আমি বসবো।
আশা রেগে বললো.
-এখানে আপনার নাম লেখা আছে?
-আছে।
-কোথায়?
-এই সিটের টিকিট আমার কাছে। আর টিকিট আমার কাছে আছে মানে সিটের দলিলটাই আমার কাছে।
-দলিলের উপর বসে থাকুন না। আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না তো।
শ্রাবন ভ্রু বাকিয়ে বললো
-এ কেমন মেয়ে রে বাবা। এই মেয়ে, তুমি উঠবে, নাকি কোলে নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিবো।
আশা চোখ বড় করে তাকালো শ্রাবণের দিকে। খানিক তেজ নিয়ে বললো
-ফেলে দেখান দেখি। যদি ফেলতে পারেন, তাহলেই সিট পাবেন। নয়তো এ সিটে বসার কথা ভুলে যান। আমি বসেছি মানে এটা আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আপনার যায়গায় যদি অন্য কেউ এই সিটের মালিক হত, আমি সসম্মানে দিয়ে দিতাম। কিন্তু আপনাকে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসেনা।

শ্রাবণ সিটে বসার আশা ছেড়ে দিলো। এ মেয়ের সাথে সে পারবেনা। সেই আশার কাছে নত স্বীকার করে বললো
-মাফ চাইছি আপা, আমায় মাফ করেন। আমি এ সিটে বসার কথা ভুলে গেছি।
আশা দুষ্টু হাসি হেসে বললো
-গুড বয়।
শ্রাবণ কপাল বাকালো। কিন্তু কথা বললো না কোনো।

নির্দিষ্ট সময় ট্রেন ছেড়ে দিলো। ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। সমস্ত ঘর বাড়ি, গাছপালা পেছনে ফেলে ট্রেন নিজ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর। আশা মনোমুগ্ধের মতো জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। বেশ উপভোগ করছে সে। স্বাভাবিক নিয়মে ট্রেনে এটা ওটা নিয়ে ফেরিওয়ালারা উঠছে। বিভিন্ন ডায়লগ দিয়ে তারা তাদের সাথে করে নিয়ে আসা জিনিসগুলো বিক্রি করে যাচ্ছে। ওদের এই ভাবে ফেরি করার ধরণ টা বেশ ভালো লাগে আশার কাছে। একটা সময় ঝালমুড়িওয়ালা আসলে আশা সেখান থেকে ঝালমুড়ি কিনে খেতে থাকে। ব্যাপারটা জঘন্য লাগে শ্রাবনের কাছে।। সে ইশারায় আশাকে বলে
-এইসব খাবার খুবই অস্বাস্থ্যকর। শরীরের জন্য অনেক খারাপ।
-আপনার কোনো সমস্যা?
-আমার সমস্যা হবে কেন। ভালোর জন্য বলছিলাম।
-আমার ভালো আমি বুঝি। এগুলো খেতে আমার বেশ লাগে। আমি খাবোই।
-শাকচুন্নিরা আবর্জনাই খেয়ে থাকে। আমি শুনেছিলাম। আজ নিজের চোখে দেখলাম।
আশা রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে শ্রাবণের দিকে তাকালো। শ্রাবণ নির্বাক। না আছে মুখে কোনো কথা, আর না আছে মুখের অবয়বে কোনো পরিবর্তন। ভাবটা এমন, যেনো এতোক্ষণ উনি নয়, আশার সাথে অন্য কেউ কথা বলছিলো।

চলবে….
[ছোট হয়েছে বলবেন না কেউ😪 আব্বু ভীষণ অসুস্থ। আপনাদের কথা চিন্তা করে একতোটুকু লিখলাম।আব্বুর এতো কষ্ট দেখে লিখার মানসিকতা ছিলোনা আজ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here