মন মুনিয়া পর্ব-৯

0
1786

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -০৯

এরইমধ্যে সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেছে। এখন মনি আর নিয়ানের বন্ধুত্বটাও আগের চেয়ে বেশি গভীর হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই প্রাইভেট ছুটির পর এক সাথে বেশ খানিকটা রাস্তা গল্প করতে করতে আসে ওরা। মনির বাড়ির কাছাকাছি এসেই দুজন দু’প্রান্তে চলে যায়।

চালে ডালে এক সাথে বসিয়ে চুলায় আগুন ধরানোর চেষ্টা করছে মনির মা। বাড়ি পৌঁছে মাকে রান্নায় দেখে কিছুটা কপাল বাকালো মনি। এখনো চুলায় আগুন ধরেনি মানে রাতের আগে তার খাওয়া হবেনা। এদিকে খিদেও পেয়েছে প্রচুর।

মনি কিছুটা অসহায় মুখ করে মায়ের লাছে গিয়ে বললো
-ও মা, অহনো রান্ধো নাই? খিদা লাগছে তো।
-বেশি খিদা লাগলে আমারে খা।
মায়ের কথায় মুখ কাচুমাচু করলো মনি। নিরীহ গলায় বললো
-কি হইছে তোমার, রাগ হইয়া রইছো কেন?
-আমিও একটা মানুষ, তাই রাগ হইছি। সর এইখান থেইকা।

মনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
-কি রান্ধো?
-ডাইল চাইলে বওয়াইছি।
মনির মুখে হটাৎই খুশির ঝলকানি দেখা গেলো। সে উৎসাহিত গলায় বললো
-খিচুরি রান্ধো?
-নামের খিছুরি। ঘরে কিচ্ছু নাই, কয়ডা দিন ধইরা তোর বাপেরে কইতাছি কিছু আননের লাইগা, কোনো কথা কান দিয়া ঢুকেনা। সারাদিন ওই জুয়া খেলার আড্ডায় পইরা থাকে। আমার তো কোনো ঠ্যাকা নাই সারাদিন পরের বাড়ির কাম কইরা আইন্নে তার লাইগা রান্ধন বাড়ন, শুধু তোর লাইগা আমার বিপদ।

মনির মুখটা আবারও ছোট হয়ে গেলো মায়ের কথায়। সে বিপরীতে আর কোনো কথা না বলে নিশ্বব্দে উঠে চলে এলো ঘরে। রাতের পড়াশোনা শেষ করে খেয়েদেয়ে শুয়ে পরলো বিছানায়। আজ ঘুম আসছেনা তার। যার দরুন বিছানায় বার বার এপাশ ওপাশ করতে লাগলো সে।

একটা সময় ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলো মনি।
খুব ভোরে ঘুম ভাংলে হাই তুলতে তুলতে বিছানায় উঠে বসে সে। কিছুক্ষণ শরীর মোচরিয়ে এদিক ওদিক বিছানা থেকে নেমে পরে সে। পুরোনো চাঁদরটা গায়ে জরিয়ে বাইরে বেরিয়ে বাড়ির পিছন দিকের রাস্তার দিকে যেতে থাকে সে। ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো আছে চারপাশটা। মাত্র কয়েক হাত দুরের কিছুও নজরে আসছেনা মনির। প্রচন্ড ঠান্ডায় হাত পা অবশের মতো হয়ে আসছে। তবে বেশ ভালোও লাগছে তার। সকাল বেলা হাটার মধ্যে যে একটা আনন্দ আর ভালো লাগা কাজ করে, সে ভালো লাগাটা দিনের শেষ বেলা অব্দি অন্য কোনো সময় পাওয়া যায়না।

কিছুক্ষণ হাটাহাটির পর মনি বাড়ির দিকে আসার জন্য পা বাড়ায়। কয়েক পা এগোতেই হটাৎ পিঠে কারো হাতের ছোয়া পায় মনি। মুহুর্তেই সে থমকে যায়। শীতের ভোরে এই কুয়াশাচ্ছন্নতার ভীরে কারো শীতল হাতের স্পর্শে মুহুর্তেই বুকের ভিতরে ধক করে উঠে।

মনি চমকে পিছনে তাকায়।
কালো ব্লেজার পরিহিত নিয়ানকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। মাথায় শীতের টুপিটাও বেশ মানিয়েছে। এক কথায়, কোনো রাজপুত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম লাগছেনা।

মনি হতবম্ভ হয়ে বললো
-আপনে!!
এতো সকালে এইখানে কি করেন?
-আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি বান্ধবী।
ছোটখাটো একটা সাধারণ কথা মনির বুকে হটাৎ বড়সড় একটা ধাক্কা দেয়। কেন জানি, এই কথাটা বেশ ভারী লাগছে তার কাছে। সে অবাক হয়ে বললো

-এতো ভোরে ঢাকা যাইতেছেন, আমারে তো কাইল কিছু কন নাই।
নিয়ান হাসলো। মনি পুলকিত হয়ে তাকিয়ে রইলো সেন হাসির দিকে। নিয়ান মুখের হাসিটা অটুট রেখে বললো
-কোনো প্ল্যানিং ছাড়াই যাচ্ছি আজ। আসলে একজন আমার উপর বেশ রেগে আছে। তাকে তারাতাড়ি গিয়ে মানাতে হবে।

মনি বিস্ময়ে বললো
-কারে?
নিয়ান আবারো মনির মনে এক অজানা ঝংকার তুলে হাসলো। ফিসফিসিয়ে বললো
-আমার গার্লফ্রেন্ড।
মনির বিস্ময় যেনো কাটছেই না। সে অবাকের উপর অবাক হয়ে যাচ্ছে। নিয়ান মনিকে এভাবে নিশ্চুপ থাকতে দেখে বললো
-কি ব্যাপার বান্ধবী, কথা বলছোনা যে?
-আপনের প্রেমিকা আছে?
-আছে তো। তোমায় একদিন বলেছিলাম বোধহয়।
-আমি ভাবছিলাম এমনিতেই দুষ্টুমি করতাছিলেন। তা ঢাকা যাইবেন, এইখানে আইলেন কেন?

-তোমাকে বলতে এসেছি। আমার একাকিত্ব সময়ের বান্ধবী তুমি তাই।
-ওহ!

-তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বান্ধবী, আমাকে সময় দেবার জন্য। বিশ্বাস করো, আমি কখনো বাড়িতে লম্বা সময়ের জন্য আসিনি। আসলেই বোর লাগত। তবে এবার আমি একটুও বোরিং ফিল করিনি। সেটা সম্ভব হয়েছে তোমার জন্য। তার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি পরবর্তীতে যখন আসবো, তখনও আমাকে এভাবেই সঙ্গ দিবে বান্ধবী।

মনি হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো নিয়ানের দিকে। এই নিয়ানকে বেশ অচেনা লাগছে তার কাছে। এক সময় নিজের মনের ভাবনাচিন্তা থেকে বের হয়ে এসে মনি হাসিমুখে বললো
-অবশ্যই সঙ্গ দিবো। কারণ আমি সত্যি সত্যিই বন্ধু ভাবছি আপনারে, কোনো বিশেষ সময়ের জন্য না। সারাজীবনের জন্য। সাবধানে যাইবেন।

মনি কোনো উত্তরের অপেক্ষা করলোনা আর। সে ছুটতে ছুটতে চলে এলো বাড়িতে। আজ খুব কান্না পাচ্ছে তার। বুক ভাঙ্গা কান্না। তবে কাঁদতে পারবেনা সে ইচ্ছে করলেও। মা বাবা আছে যে। ওদের নজরে যদিও একবারও সেটা আসে তবে হাজারটা প্রশ্ন উঠবে। তার চেয়ে ভালো যত কান্না আর কষ্ট আছে সেটা বুকেই চাপা থাকুক ।

স্কুলে না যাওয়ায় মনির মা কিছুটা চিন্তিত মনে মনির কাছে গেলেন। মনি সেই ভোরে বাইরে থেকে এসে যে শুয়েছিলো, এখনো উঠছেনা। বার বার ডাকার পরেও সে কোনো সারাশব্দ করছেনা। স্কুলে যাবার কথা বললে শুধু বলেছিলো আজ সে যাবেনা।

মেয়ের অসুখ হয়েছে কিনা সেটা ভেবে চিন্তায় পরলেন মনির মা। সচরাচর তার মেয়ে এমনটা করেনা। আজ হয়তো তার শরীরে কোনো রোগই ঢুকেছে। তিনি চিন্তিত মনে রহিম মিয়ার কাছে গেলেন। দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছিলেন রহিম। মনির মা উনার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন
-মাইয়াডার বোধহয় অসুখ হইছে।
-আমি কি করতাম? বিড়ি টানতে টানতে জবাব দিলেন রহিম।

মনির মায়ের চোখেমুখে সুক্ষ্ম রাগের ছিটেফোঁটা দেখা গেলো। তিনি সামান্য চেচিয়ে বললেন
-অহন আপনের কিছু করনের থাকবোও না। অহন করতে গেলে টেকা খরচ হইবো তো। যদি টেকা কেউ দিতে তাইলে মাইয়া বেচতেও দুইবার ভাবতেন না।
-বাড়াবাড়ি করবিনা মনির মা।
-করলে কি করবেন? আপনে বাড়াবাড়ির মতো কাম করবেন, আর আমি বাড়াবাড়ি করলেই খুব লাগে কেন।

বাবা মায়ের চেচামেচি শুনে উঠে বসলো মনি। আর শুয়ে থাকা যাবেনা। এবার নির্ঘাত বড়সড় একটা ঝগড়া বেধে যাবে। মনি ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে বাইরে গিয়ে দাড়ালো। বাবা মাকে লক্ষ করে বললো
-উফফ, তোমরা চিল্লায়ো না তো। আমার কিচ্ছু হয় নাই।
-কিচ্ছু হয় নাই তয় তোর মায়েরে উস্কানি দিলি কেন আমার লগে কাইজ্জা করতো?
-আমি উস্কানি দিছি? বাবার কথায় চোখে পানি এসে গেলো মনির।

রহিম মিয়া আবারও তেজ দেখিয়ে বললো
-উস্কানি না দিলে তোর মায় আমার লগে এমন করতাছে কেন? মাইয়া মাইয়ার মতো থাকবি। দুই অক্ষর পইড়া নিজেরে সেড়ের উপরে সোয়াসেড় ভাবিস না।
মনির মা মনির দিকে তেড়ে এসে ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো। রহিম মিয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে মনিকে বলতে লাগলো
-ওই জুয়াখোরের কথায় কান দিস না মনি।।নির্ঘাত জুয়ায় হেরে আইছে, অহন যত রাগ তোর আর আমার উপ্রে দেখাইতাছে।

মনি মায়ের কথা শুনলো, কিন্তু কোনো হেলদোল হলোনা তার। মনিকে নিঃশব্দে দেখে মনির মা আবারও বললেন
-তোর শরীরে কোনো অসুখ করে নাই, তয় ইস্কুলে গেলি না কেন?
-আইজ ভালো লাগতাছেনা মা।

_______
সারাদিন শুয়ে বসে না খেয়ে পার করলো মনি। আজ খেতেও ইচ্ছে করছেনা তার। কিছুই ভালো লাগছেনা। শুধু বার বার মনে হচ্ছে নিয়ান তাকে বিশেষ কয়েকটা দিনের জন্য বন্ধু বানিয়েছিলো। মনির মাথায় এই কথাটা কিছুতেই ঢুকছেনা, কয়েক দিনের জন্য কি কাউকে বন্ধু বানানো যায়? হয়তো যায়। বড়লোকদের বড় কারবার। মনি বুঝেনা এইসব।

সন্ধ্যের পর বাবার বকবকানি আবারও শুরু হয়েছে। সারাদিন কোথা না কোথা থেকে এসে মনিকে শুইয়ে থাকতে দেখে তিনি মেজাজ খারাপ করে ফেললেন আবার। যাবার সময়ও দেখে গেছেন মনি শুইয়ে আছে, এখনো শুইয়ে আছে।

মনির মা এবার বিরক্ত হয়ে বললেন
-আপনের আইজ হইছেডা কি? সেই সকাল থেইকা মাইয়াডারে কথা শুনাইতাছেন?
-তোর মাইয়ারে কো আমার বাড়িত নবাবজাদীর মতো শুইয়া বইয়া থাকন যাইতোনা। গরুডারে একটু পানিও খাওয়াইতে পারতো, তা না কইরা ঠ্যাং এর উপরে ঠ্যাং তুইলা শুইয়া থাকন, তোরা মা মাইয়ার জ্বালায় আমার বাড়ি ছাড়া লাগবো দেখতাছি।
-কি করছি আমরা? রক্তচক্ষু নিয়ে বললো মনির মা।
-তুই আমার বাড়া ভাতে ছাই দিছোস। আইজ জয়নালের লগে আমার দেখা হইছে। সে আমারে সব কইছে। কেন করলি এইসব?

মনির মা কিছুটা ভড়কে গেলেন রহিমের কথায়। তার মানে উনি সত্যটা জেনেই গেছেন। মনির মা বললো
-করছি ভালা করছি, আমার মাইয়ারে জাইনাশুইনা কোনো আগুনে আমি দিতে পারমুনা। কোনো ভন্ড বদমায়েশের হাতে তুইলা দিতে পারমুনা।
-তোর মাইয়া কি ধুয়া তুলসিপাতা? জয়নাল আগুন হইলে তোর মাইয়া সেই আগুনের ফুলকি। জয়নাল ভন্ড বদমায়েশ হইলে তোর মাইয়াও কোনো সতীসাধ্বী নারী না। তোর মাইয়ার মইধ্যেও ভেজাল আছে। জয়নাল ওরে এক পুলার সাথে দেখছে।

মনির মা এবার ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। প্রচন্ডভাবে হুংকারে বললেন
-মুখ সামলাইয়া কথা কন। নিজের মাইয়া নিয়া এইভাবে কোনো বাপে কথা কইতে পারেনা।
-আমারও তাই মনে হয়, মনি আমার মাইয়া হইলে এইরকম আকাম করতে পারতো না। হেয় সত্যি সত্যিই আমার মাইয়া নাকি তাতে আমারও সন্দেহ হইতাছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here