মন_গহীনের_গল্প পর্ব-১৩ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১৩
রূবাইবা_মেহউইশ

💞
গাল বেয়ে গলায় নেমে এলো উষ্ণ আদুরে এক স্পর্শ। শীতের রাতে কোমল মোলায়েম হাত যতোটা আরামদায়ক লাগছিলো ঠিক ততোটাই যন্ত্রণাদায়ক হয়ে গলায় চেপে বসেছে মেহউইশের। ক্রমশ সেই যন্ত্রণা মৃত্যুর দিকে টেনে নিতে লাগলো তাকে।হাত-পা ছুড়াছুঁড়ি করতে করতে একটা সময় নিস্তেজ হয়ে এলো দেহ,শিথিল হলো গলায় চেপে বসা হাত দুটো।দম ফুরিয়ে গেল মেহউইশের যমদূত মুঠোয় পুরে নিয়ে গেল মেহউইশের জান। আঁধারে মিলিয়ে গেল অদেখা সেই মুখ যা যম হয়ে সামনে এসেছিলো।

‘মেবিশ! এ্যাই মেবিশ, চোখ খোলো৷ কি হয়েছে তোমার? ফুপু! ফুপু একটু আসো এদিকে ফুপু!’ এক নাগাড়ে চিৎকার করে একবার ফুপু তো একবার মেহউইশকে ডাকতে লাগলো রিশাদ৷ রাত তখন কত হবে তার জানা নেই। মধ্যরাত কি শেষরাত পাহাড়ে শীতের তীব্রতা আর ঘন অন্ধকারে বোঝার উপায় নেই। দূর থেকে তখন ভেসে আসছিলো হুতুমের মন ভাঙা আর্তনাদ মিশ্রিত ডাক। রিশাদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে ছোট্ট নির্জনের সেও ভয় পেয়েছে বোধহয়। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে ছেলেটা। বিছানায় শুয়ে থাকা মেহউইশ কাঁপছে থরথরিয়ে।তার হুঁশ নেই কিছুতেই। রিশাদের চিৎকার কিংবা নির্জনের কান্না কোনটাই তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। রিশাদের ফুপু লাঠিতে ভর করে কোনমতে এসে পৌছুলেন দরজায় তার সাথে আনতুংও। আনতুং রাতে এ বাড়িতেই থাকে রিশাদের ফুপু একা থাকেন বলে। রিশাদের ডাকে তারা দুজনেই ভয়ে এসেছেন কিন্তু রিশাদ ঘুমন্ত মেহউইশের আচমকা থরথরিয়ে কাঁপা দেখে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলো৷ দরজা খোলার কথাটুকুও মাথায় আসেনি। ফুপুর ডাক আর দরজার করাঘাত শুনে দরজা খুলে দিলো। ততক্ষণে গেইটের দাড়োয়ানেরও ঘুম ভেঙে গেলে সেও এগিয়ে এলো বাড়ির ভেতরে।

-‘কি হয়েছে রিশাদ?’

-‘ফুপু, মেবিশ হঠাৎ করেই কাঁপছে,গোঙাচ্ছে আর কিছুক্ষণ আগে হাত-পাও ছোড়াছুঁড়ি করছিলো খুব। দেখো তার চোখ মুখ এই শীতেও ঘেমে গেছে৷ আমার ভয় লাগছে মেয়েটার কিছু হয়ে যাবে না তো!’ শেষের কথাটা বলতে গিয়ে রিশাদের গলার স্বর নরম হয়ে এলো৷

‘আচ্ছা, তুই এত অস্থির হয়ে পড়িস না। নির্জন কাঁদছে ওকে একটু কোলে নিয়ে হাট আমি নীলিমাকে দেখছি।’ কথাটা বলেই ফুপু মেহউইশের সামনে গেলেন। তার পেছন পেছন আনতুংও আগালো কিন্তু সে সন্দেহি নজরে তাকিয়ে রইলো মেহউইশের মুখের দিকে৷

নির্জনকে বুকে চেপে পাতলা একটা কম্বলকে দু পরতে ভাজ করে ডেকে নিলো৷ বাইরে প্রচণ্ড শীত যা এই বাচ্চার পক্ষে অসহনীয় হবে৷ নিজের ঘর ছেড়ে কড়িডোরে হাঁটতে লাগলো সে ছেলেকে জড়িয়ে । মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আজকে দিনের ঘটনা। মেহউইশ কি ট্রমা থেকে এমন করলো! আজ যখন সে জানতে পারলো ইভান বিয়ে করেছে তখনি বেঁহুশ হয়ে পড়েছিলো।রিশাদ তখন প্রয়োজনীয় কিছু কাজে বাড়ি ফিরেছিলো এবং তখনি দেখেছে ফুপু মেহউইশের মাথায় পানি ঢালছে। আনতুং তেল মালিশ করছিলো হাতে পায়ে। এরপর যখন তার হুঁশ এলো তখন থেকে গুমোট মেঘের মত চাপা মুখে বসেছিলো নির্জনকে নিয়ে। দুপুর এবং বিকেল না খেয়ে থাকলেও রাতে রিশাদের সাথে বসে খাবার খেয়েছে। নির্জনকে যত্ন করে খাইয়ে রাতে ক্রিম,ময়েশ্চেরাইজার মাখিয়েছে। ডায়াপার পরিয়েছে রাতের জন্য এমনকি তাকে নিজের বুকে আগলে ধরে ঘুমও পাড়িয়েছে।এরপর যখন সেও ঘুমিয়ে পড়লো তখন রিশাদ বসে থেকে কিছু কাজকর্ম করলো ল্যাপটপে। দিনে এখানে নেটওয়ার্ক খুবই দূর্বল তাই কিছু কাজ রাতেই করতে বসেছিলো। সেই কাজে কখন যে রাত থেকে মধ্যরাতে গড়ালো সময় তা টের পায় নি। এখন বিছানায় এসে শোয়ার পরই চোখ গেল নিজের বিপরীত পাশে ঘুমন্ত মেহউইশের দিকে। খোলা গাল এবং গলা বাতির আলোয় অন্যরকম এক আকর্ষণে আকৃষ্ট করছিলো তাকে৷ তাই সে নিজের আকর্ষণকে সক্রিয় রেখেই একটু ছেঁয়েছিলো মেহউইশের গাল ধীরে ধীরে গলা। তারপর কি হলো! মেহউইশের ওইরকম কেঁপে উঠা,ছটফটানো ভয় পাইয়ে দিলো রিশাদকে। সে কোন ক্ষতি করতে চায়নি এখন মেয়েটার। শুধু একটু স্পর্শ করেই সরে যেত। মেয়েটা কি ঘুমের মধ্যেও ভয় পেল তাকে! পাশের কোন পাহাড় থেকে ভেসে আসছে বাঁশির করুণ সুর। এ সুরে কান্না ভাসছে,কারো গল্প ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। শীতগন্ধি শিশির ফোঁটায় ফোঁটায় এ সুরের মোহে জমে যাচ্ছে পত্রপল্লবে অভিমান করে। এই প্রথম রিশাদের বুকে রাগের পাহাড়ে ভয়ের মেঘ এসে জড়ো হলো। এ ভয় কিসের? বাবার ক্ষমতা মাথা থেকে সরে যাওয়ার নাকি নির্দোষ কারো জীবনে শাস্তি হয়ে বর্তে যাওয়ার!

ভোরের আলে ফুটতেই পাহাড়ের গায়ের অন্ধকার পাতার ফাঁকে একটু একটু করে লুকিয়ে পড়ছে। পুরো একটা নির্ঘুম রাতের পর মাত্রই চোখের পাতা এক হয়েছে রিশাদের। পাশেই নির্জন জেগে গিয়ে হাত পা ছুঁড়ে খেলছে। এখন শীত কেটে রোদের উম গায়ে লেগে আরামদায়ক অনুভূতি দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফুপুর ঘরের জানালা খোলা থাকলে দারুণ বাতাস আসে পাল্লা দিয়ে রোদের আলেও৷ পূর্ব দিকের এ জানালাটা সাইজেও বড় হওয়ায় অধিক আলো বাতাসে গ্রীষ্মের মধ্য দুপুরে না চাইতে ঝিমুনি দিয়ে ঘুমের আনাগোনা দেখা যায় যে কোন ব্যক্তির। অথচ আজ এই মৃদুমন্দ শীতের ভোরেও বাতাসটা ঘুমের পক্ষে যথেষ্ট কোমলতা দেখাচ্ছে। রিশাদ ঘুমে ভেসে গেল এতোটাই যে পাশে থাকা নির্জনের কল কল হাসিটাও শুনতে পাচ্ছে। কাল রাতে ফুপু আর মেহউইশকে ছেড়ে নিজের ঘরে আসেননি। জোর করেই রিশাদকে নিজের ঘরে পাঠিয়েছিলেন নির্জনকে নিয়ে ঘুমানোর জন্য; তার ঘুম আসেনি একটুও। আনতুং নিজেও থেকেছে রিশাদের ঘরের ফ্লোরে তবে সে সারারাত ঘুমায়নি ভয়ে। বারবার মনে হচ্ছিলো মেহউইশকে পাহাড়ের জংলী ভূতে ধরেছে। সে বাংলা ভালো বলতে পারে৷ রিশাদের ফুপুকে ভোর হতেই বলেছে, ‘তোমার পুতবউয়ের(ছেলের বউ) ভূতে ধরছে।’ ফুপু ধমকে দিয়েছিলেন তাকে। সে জানে মেহউইশ কাল দিনে কোন এক ফোন কলে বেহুঁশ হয়েছে হয়তো সেই ব্যপারটাতেই সে রাতেও ভয় পেয়েছে। ঘুমের মধ্যে হয়তো ভয়ের কারণেই ওভাবে কেঁপেছে। একন তো মেয়েটা একদম স্বাভাবিক। ঘুম ভাঙতেই যেচে পড়ে চা বানাতে গেল। এক কাপ ফুপু আরেক কাপ আনতুং কে দিয়ে নিজের জন্যও নিলো এক কাপ। হাসি হাসি মুখে দুজনকে শুভ সকাল জানিয়ে পাশেই বসলে চা নিয়ে। ফুপু খেয়াল করলেন মেয়েটা আসার পর থেকে এতোটা স্বাভাবিক মোটেই ছিলো না৷ আজকের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে এই ভিন্ন আচরণটাই যেন তিনি আশা করছিলেন। চা খেতে খেতে ফুপু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নামটা যেন কি?’

-মেহউইশ

-‘এ কেমন নাম? মুসলিমদের নাম!’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন ফুপু।

-জ্বী, মা বলেছিলো এটা নাকি পাকিস্তানিদের নাম। মানে সে দেশেই বেশি ব্যবহৃত।

মেহউইশের কথা শুনে রিশাদের ফুপু হায় হায় করে উঠলেন। বললেন, তোমার মা রাজাকার নাকি? ‘

মেহউইশের মুখের চা পিচিক করে সব পড়ে গেল সামনে থাকা আনতুংয়ের গায়ে। বিষম খেল সে এবং কাশতে কাশতে গলায় ব্যথা অনুভব করলো। ফুপু নিজের চায়ের কাপটা কাঠের চেয়ারের সমান্তরাল হাতলে রেখে উঠে দাঁড়ালেন মেহউইশের সামনে। পিঠে মালিশ করে শান্ত করলেন। কয়েক মিনিট স্থির থেকে মেহউইশ জবাব দিলো, আমার মা অতোটা বয়স্ক নয় যে যুদ্ধের সময় রাজাকার হবেন। আমার নাম মেহউইশ যার অর্থ সুন্দর। আমার নাম মা রেখেছিলেন কোন এক উপন্যাসের এক বিদ্রোহী চরিত্র পড়ে। সেই চরিত্রটি পাকিস্তানি ছিলো। মায়ের ভালো লেগেছিলো নামটা তাই রেখেছিলো৷ আর নামের অর্থটা কিছুদিন আগে আমি ইন্টারনেটে সার্চ করে পেয়েছিলাম। রাজাকারদের সাথে আমাদের কোন যোগসাজশ নেই। চায়ের পর্ব ভালোরকমে না শেষ হলেও নাস্তা বানানোর পর্বটা খুব জমলো তিনজন নারীর গল্পকথনে। নির্জন খেলতে খেলতে আরো এক দফা ঘুমিয়ে গেল। ফুপু এবার মেহউইশকে বললেন নির্জনের কাপড় বদলে দুধ খাইয়ে আসতে। তখনি মনে পড়লো মেহউইশের আজ সে ঘরে একা ছিলো কেন? ফুপু এক চিলতে প্রসন্নতার হাসি হেসে বললেন, ‘রাতে তো আমার বাপটাকে ভয় পাইয়ে ঘরছাড়া করেছিলে তাই সে তার ফুপুর ঘরে ঘুমিয়েছে৷ আর ফুপু বসে বউমার সেবা করেছে। মেহউইশের বিষ্ময় হলো শুনে তবে তা প্রকাশ করার আগেই কানে এলো নির্জনের কান্না। তড়িঘড়ি সে ছুটলো ফুপুর ঘরের দিকে। ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই চোখে পড়লো রিশাদ দাঁড়িয়ে আছে নির্জনকে কোলে নিয়ে। পরনে তার পাহাড়ি খাদি কাপড়ের লুঙ্গি যার আর উদোম গা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here