মন_গহীনের_গল্প পর্ব-৪৬ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৪৬
রূবাইবা_মেহউইশ
💞
বরফগলা নদীর মত জীবন চলছে রিশাদের। কখনও যে মানুষটা রুক্ষ আচরণ,কঠিন বাক্য আর ক্রোধহীন ছিলোই না সে মানুষটা এখন বরফের মত গলে কোমল হয়ে গেছে। ক্রোধের বাণ এখন আর আগের মত ধারালো নেই। মুখের বুলিও তীক্ষ্ণতা হারিয়ে ফেলছে দিনকে দিন। মেহউইশের দিকে রিশাদের মন পুরোপুরি ধাবিত হয়ে গেছে। কখন, কবে আর কি করে তা জানে না৷ হোটেলে আগুন লাগার ঘটনার প্রায় কয়েক মাস কেটে গেছে। সেই দূর্ঘটনায় কারো কোনো ক্ষতি হয়নি । আগুন লেগেছিলো হোটেলের পঞ্চম তলায় কোন পর্যটকের সিগেরেটের মাধ্যমে। রিশাদ আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানায় আজও সেই দিনের জন্য প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজে। আমূল বদলে গেছে এই রিশাদ । আজ মাসের শেষ দিন তাই একদিনের ছুটি কাটাচ্ছে সে। তিশমা আর ম্যানেজার বিয়ে করে নিয়েছে ক’দিন আগেই তারপরই তারা কক্সবাজারে চলে এসেছে। ম্যানেজার সাহেবের মা পছন্দ করেন না বউ পরপুরুষদের সাথে কাজ করবে কিন্তু তিশমা তার টিভির কাজ ছাড়তে নারাজ। নতুন দম্পতির প্রেম ঘন হওয়ার আগেই ক্লেশ মিশে তা পাতলা হয়ে গেছে অনেকটাই। ম্যানেজার আবারও হোটেলের কাজে ফিরে এসেছে কিন্তু তিশমা চাইছে ম্যানেজারি ছেড়ে দিক তার বর৷ রিশাদ খুব অবাক হয় তাদের প্রেমের সম্পর্ক দেখে। মেহউইশের সাথে তার সম্পর্কের যে স্বাভাবিকতা তার সিকি ভাগও নেই তিশমাদের অথচ মেহউইশের সাথে রিশাদের বিয়েটা ছিলো অস্বাভাবিক। এখানেও উপরওয়ালার শুকরিয়া তাই এই জোরজবরদস্তির বিয়ে এখনও টিকে আছে কোন শর্ত ছাড়াই। সত্যিই কি কোন শর্ত ছাড়া! কথাটা বহুক্ষণ মাথায় আটকে রইলো রিশাদের। আজ সে বাসায় থাকার পেছনে আরও একটি কারণ রয়েছে । কারণটি সেই পুরনোই শুধু এবারের পরিবেশ,পরিস্থিতি ভিন্ন৷ ক্ষমা চাইবো চাইবো করেও আর সঠিক কোন সময় পাওয়া হয়নি তার। ‘ভুল করেছি ক্ষমা করে দাও’ এভাবে বললে হয়তো ক্ষমা চাওয়াটা অনেক আগেই হয়ে যেত কিন্তু ; সে তো শুধু ভুল করেনি করেছে অন্যায় । দুজন মানুষের সাজানো,গোছানো জীবনটাকে ধ্বংস করছে, দুজন মানুষের অনুভূতিকে দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে আবর্জনার মত। জোর করে মেহউইশকে নিজের সাথে বেঁধে রেখেছে। মেহউইশ এখন খুব স্বাভাবিক সংসার করছে তার মানে তো এই না, মনে মনে সে রিশাদকে ভালবাসে কিংবা সম্মান করে! সে হয়তো শুধুই সামাজিকতা ঠিক রেখে তাকে সবটা দিচ্ছে,তার ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। সময়,সুযোগ করে তবেই নিজের সকল অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে রিশাদ। তাই আজও তার নতুন আয়োজন মেহউইশকে নিয়ে বাইরে কোথাও যাওয়ার। এবার আর কোন কোলাহলময় হোটেল,রেস্টুরেন্ট নয় বরং প্রকৃতির মাঝে যাবে। প্রকৃতি জীবন সহজ করে। প্রকৃতিতে মিশে গিয়ে দুঃখ, যন্ত্রণা সব দূর করা যায়। খোলা আকাশ, চারপাশে ঘেরা উঁচু পাহাড় আর সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের সাথে মিশিয়ে অন্যায়গুলো স্বীকার করলেই সহজ হবে সবটা। নিশ্চয়ই মেহউইশ তাকে ক্ষমা করবে মন থেকে! হাতে সময় আজকে দিনটাই তারপরই কাল রিশাদকে ঢাকায় যেতে হবে কিছু কাজের জন্য তারপরই এবোর্ড যাবে রিহান আর খালার কাছে। রাইমার বিয়ে নিয়েও আলাপ,আলোচনা করে আসবে। তানভীর অনুমতি চেয়েছে রিশাদের কাছে বিয়ের আর রিশাদও জানিয়েছে রাইমার অভিভাবক শুধু সে নয় তার খালা মানে রাইমার মা’ও আছেন। টানা পনেরোদিনের একটা সফর থাকবে কাল থেকে রিশাদের। এতগুলো দিনের জন্য বিয়ের পর এই প্রথম দূরে যাওয়া তাই হয়তো মনটা বড্ড উচাটন হয়ে আছে। একটা সেকেন্ডের যেখানে ভরসা নেই সেখানে পনেরোটাদিন অনেক বেশিই। কে জানে হয়তো তার কিছু হতে পারে,হয়তো মেহউইশের মনে পরিবর্তন আসতে পারে! আর সময় পিছিয়ে লাভ নেই যেখানে জীবনটা একসাথে কাটানোর প্রস্তুতি সে মন থেকে নিচ্ছে সেখানে মেহউইশের মনের ক্রোধ,ক্লেশ শুরুতেই মিটিয়ে দেওয়া জরুরি। আজ আর নির্জনকে সাথে নিচ্ছে না তারা৷ পায়ে পায়ে হেঁটে পাহাড় পেরিয়ে বিপরীত দিকে সুন্দর একটা ঝর্ণা বইছে। নিজেদের বাড়ির উল্টো দিকে হলেও জায়টা সুন্দর, কোলাহলমুক্ত আর নিরব। সেখানে পাহাড়ি মানুষ দুপুর পর্যন্তই ভীড় করে গোসল,কাপড় ধোঁয়া আরও অনেক কাজের জন্য । গৌধূলিতে কেউ থাকে না তেমন জানে রিশাদ। তাই তো আজ পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোয় পাহাড়ের পেছনে যাবে।

‘চলুন।’ মেহউইশ বলল

একপলক দেখে নিলো রিশাদ তাকে৷ হাফ সিল্কের কামিজ পরেছে,চোখে গাঢ় কাজল এঁকেছে, ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক । গোলগাল ফর্সা মুখটাতে অপার্থিব এক সৌন্দর্য এসে চুয়ে চুয়ে পড়ছে যেন! রূপের ছটা প্রকৃতি থেকে ধার করে নেওয়া তার রক্তিম আলোয় মোহিত করছে রিশাদকে। সে অল্প করে হেসেই বলল, ‘ এত কেন সাজতে হলো!’ মনে মনে নিজেই জবাব ঠিক করলো সে বলুক ‘আপনার জন্য’। মেহউইশের জবাব এলো ভিন্ন, ‘ নিজের জন্য সেজেছি’।

‘আচ্ছা চলো। ফুপি গেলাম।’ দুটো কথা একই সাথে বলে রিশাদ এগিয়ে গেল গেইটের দিকে পেছন পেছন মেহউইশও গেল। নির্জন দেখলেই কান্না করবে তাই যতোটা দ্রুত সম্ভব তারা গেইট পেরুলো।

পাহাড় বেয়ে নিচে দিকে এগোতে লাগল রিশাদ আর তার হাত ধরে চলছে মেহউইশ। যেতে যেতে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। পাতার ঘ্রাণ,বুনোফুলের ঘ্রাণ, কাচা মাটির বুকে ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থাকা ছোট্ট চড়ুইয়ের ঘর ডিঙিয়ে যাচ্ছে আবার কখনও কান পেতে শুনছে বড় কোন গাছে বসে ডাকতে থাকা টিয়ার ডাক। এ জগতে সবচেয়ে সুখী কারা! মনে মনে ভাবছিলো আর তখনি এক ঝাঁক প্রজাপতির দেখা পেল মেহউইশ । কি দারুণ রঙ বেরঙের প্রজাপতির ঝাঁক বেঁধে একসাথে উড়ে বেড়ানো। ওরাই কি সুখী! শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় এ যে এক মন হারানোর দৃশ্য, মন ভাসিয়ে নিজেকে উড়িয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা এভাবেই বুঝি জাগে! পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে তারা নেমে এসেছে অনেক নিচুতে। নামতে নামতেই কানে আসছিলো ঝিরিঝিরি শব্দ। ঝর্ণা বেয়ে পানি এসে পড়ে ছোট বড় অসংখ্য পাথরের গায়ে। সেই পানি আবার গড়িয়ে গিয়ে পড়ছে পাশেই নদীর বুকে। কত চমৎকার সৌন্দর্য পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে আছে । মাটি,পানি,বাতাস , রোদ,বৃষ্টি সব কিছুতেই লুকিয়ে রয়েছে মহান স্রষ্টার মহত্ব। মেহউইশ মুগ্ধতায় বিভোর হয়ে গেছে, এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে লাগলো। ছোট্ট বাচ্চাদের মত কখনো ঝর্নার পানি ছুঁয়ে দেখছে, কখনো জংলী ফুল ছিঁড়ে কানের পিছে গুঁজে নিচ্ছে কখনো রিশাদকে বলছে একটু উপরে উঠবে, একটু বায়ে যাবে একটু ডানে। রিশাদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে পাগলামো দেখছে মেহউইশের। প্রায় এক বছর চার পাঁচ মাস পূর্ণ হয়েছে তাদের বিয়ের। কই আগে তো কখনো এতোটা চঞ্চল মেহউইশকে দেখেনি সে। তবে কি সে সুযোগই দেয়নি! তবুও আনন্দ হচ্ছে আজকের জন্য কারণ যাই হোক আজ প্রথমবার সে দেখতে পাচ্ছে মেহউইশের এই মুক্তোঝরানো হাসিমুখ । এমন একটা মুখ দেখার মাঝেও যে লুকায়িত কোন প্রশান্তি আছে আজ দ্বিতীয়বার জানলো সে। প্রথমবার এই প্রশান্তি সে খুঁজে পেয়েছিলো নির্জনের হাসিতে। মন প্রাণ ভরে গেল তার নিমেষেই। মেহউইশ হঠাৎ একটা প্রজাপতি দেখলো তার সামনে দিয়ে উড়ে যেতে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে সেটারই পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো।

‘মেহউইশ বসো এবার এদিকটায় আমার কিছু কথা আছে তোমার সাথে।’ রিশাদ একটা পাথরে বসে মেহউইশকেও বসতে বলল। পায়ের পাতা ছুঁয়ে তার কল কল করে বয়ে যাচ্ছে ঝর্ণার পানি। মেহউইশ শুনলো না রিশাদের কথা। সে প্রজাপতির পেছনেই হাঁটতে হাঁটতে এবড়ো থেবড়ো পাথরের উপর দিয়েই যাচ্ছে। রিশাদ আবারও ডাকলো তাকে সে ‘আসছি’ বলে ফিরেই উল্টোদিকে বড় একটা পিচ্ছিল পাথরে পা রাখলো।

‘মেবিশ সাবধানে’,,,,, কথাটা বলেই থেমে গেল রিশাদ। চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো এক অজানা ভয়ে।

‘আরেহ কি হলো আপনার! চোখ খুলুন ব্যথা পাইনি তো।’ মেহউইশের কন্ঠস্বর শুনে রিশাদ চোখ খুলল। বড় কোন ব্যথা পায়নি সে তবে পরনের কাপড় অনেকাংশ ভিজে গেছে আর অমসৃণ পাথরে লেগে চামড়া উঠে গেছে কিছু কিছু জায়গায়। মনে মনে গোছানো কথা রিশাদের আজও বলা হলো না। সন্ধ্যা নেমেছে পাহাড়ের গায়ে । ভেজা শরীরে মেহউইশ অসুস্থ না হয়ে পড়ে ভেবেই বাড়ি ফিরলো তারা। রেহনুমা তাদের মেহউইশের অবস্থা আর রিশাদের ফ্যাকাশে মুখ দেখে বুঝলো আজও রিশাদ যে কাজে গেছে তা হয়নি। রাতের খাবারের পর রিশাদ তার লাগেজ গোছাতে বসলো। মেহউইশও হাতের কাজ শেষ করে নির্জনকে দিলো রেহনুমার কাছে। এই ফাঁকে সে রিশাদের কাজে সাহায্য করবে বলে ঠিক করেছে। একে একে আলমারি থেকে কাপড়চোপড় বের করে সে বিছানায় রাখছে আর তা নিজ সুবিধামত লাগেজে রাখছে রিশাদ। দুজনে মিলে করায় মোটামুটি দ্রুতই শেষ হলো গোছানো। কিন্তু এই গোছানোর পুরোটা সময়ে রিশাদ লক্ষ্য করেছে মেহউইশকে। চুপচাপ কাজ করেছে একটি কথা বলেনি তার সাথে এমনকি মুখটাও কেমন যেন গম্ভীর ছিলো খুব। কারণ কি! কাজ শেষ করে নির্জনকে আনতে যাচ্ছিলো মেহউইশ কিন্তু রিশাদ আটকে দিলো। মেহউইশের হাতটা ধরে টেনে নিজের কাছে আনলো, পাশে বসালো। এবং খুব আলতো করে তার ঘাড়ে চুমুও খেল।

‘ খালা বলছিলেন পনেরো দিন থাকতে। কিন্তু আমার তো নিজের কাজ আছে এদিকটায় আবার তুমি,নির্জন, ফুপি তোমাদের ছেড়ে থাকতেও কষ্ট হয়। আবার কয়েকদিনের মধ্যে তোমাদের পাসপোর্ট, ভিসাও সম্ভব হবে না নয়তো তোমাদের সাথে নিয়েই যেতাম৷ ফুপির পাসপোর্ট থাকলেও সেটা কার্যকরী নয় এখন আর তোমার তো সম্পূর্ণ নতুনই করতে হবে৷ বোঝোই তো ইচ্ছে করে একা ছেড়ে যাচ্ছি না তোমাদের । বিশ্বাস করো।’ বড্ড কোমল আর আকুতি মেশানো গলায় বলল রিশাদ যেন সে মেহউইশের কাছে কোন প্রিয় জিনিসের আবদার করছে। মেহউইশ জবাবে কিছু বলল না শুধু চুপ করে আবদ্ধ রইলো রিশাদের দু হাতের মাঝে। রিশাদ আবারও বলল অনেক কথা সেই সাথে উষ্ণ ছোঁয়ায় ভরে দিলো মেহউইশের কাঁধ এবং গলায়, অবাধ্য হাত ছুঁয়ে দিলো মেহউইশের মেদহীন পেট। আদরে আদরে শিহরণ যখন চোখের পাতা কাঁপায়,পায়ের তালুতে শিরশিরানি জাগায়, প্রতিটি লোমকূপে যখন নিষিদ্ধ বাতাসের বিচরণ রিশাদকে তখন জোর করে সরিয়ে দেয় নিজের কাছ থেকে ; পাগল করা অনুভূতিরা সোচ্চার হয়ে রিশাদকে ধমকায় অসভ্য বলে৷ এই ধমকের সুর রিশাদের কানে পৌঁছায় না তবে চোখাচোখি হলে ঠিক বুঝে যায়। লজ্জারুণ হয়ে মেহউইশ ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে নিঃশব্দে হাসে।

রাতের আঁধার পুরোপুরি কাটেনি তখনও। রিশাদের ফ্ল্যাইট সকাল ছয়টায়। বোর্ডিং পাস এর জন্যই মূলত এয়ারপোর্টে আগে পৌঁছাতে চায় রিশাদ। রাতের আঁধার তখনও ঘন রিশাদ বেরিয়ে পড়েছে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। আজও সে ড্রাইভার ছাড়া বেরিয়েছে। আজও সে গাড়ি এয়ারপোর্টে রেখে যাবে সেখানেই তার অফিসের একজন ড্রাইভার আসবে। মেহউইশ, রেহনুমা দুজনেই গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো অনেক্ক্ষণ । কারোই যেন এভাবে রিশাদের যাওয়াটা ভালো লাগলো না। দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট দুজনেরই চোখে মুখে। পাহাড়ে বেয়ে চলছে রিশাদের সাদা রঙের গাড়িটি৷ পাহাড়ি এ পথটা আঁকাবাঁকা হলেও এবড়োথেবড়ো নয় বলে এই অন্ধকারেও তার পথ চলায় ততোটাও কষ্ট হচ্ছে না। কিছুটা সমস্যা তো বরাবরই হয় আজও তার বেশি নয়। রাত যত ভোরের দিকে যাচ্ছে গাড়ির সংখ্যাও তত বাড়ছে ধীরে ধীরে। এ পথে ট্রাক চলাচল একদমই নেই বললেই চলে কিন্তু প্রতি দশ,বারো মিনিটে একটি দু,টি মাইক্রোবাস অথবা ছোট পিকআপ ভ্যান চোখে পড়ছে৷ বেশিরভাগই কাঠ,বাঁশ আর অন্যান্য জিনিসপত্রের । যাত্রীবাহী গাড়ি খুবই কম তবুও রিশাদ যথেষ্ট সতর্কভাবে চালিয়ে গেছে অনেকটা পথ। পাহাড় ছেড়ে সমতলে নামার আগে শেষ বাঁকে মোড় নিতেই হঠাৎ চোখের সামনে বড় বড় দুটো চোখ ঝলসানো আলো তীব্র গতিতে ছুটে এলো তার দিকে৷ চোখ দুটো আচমকা এমন অসহ্যরকম আলোয় চোখ বুঁজে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে এক্সিলেটরে চাপ দিলো সে। কয়েক সেকেন্ডে ঝড়ের গতিতে কোন দানব হানা দিলো তার গাড়িতে । চোখের পলকে রিশাদের গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল আর রিশাদ সে ছিটকে পড়ছে খাঁদে৷ শেষ রক্ষা আর হওয়ার ছিলো না তার। প্রকৃতির অমোঘ খেলায় কখনো তো বিরতি আসারই ছিলো রিশাদেরও তাই এলো। ভাগ্যের চাকা গড়িয়ে তখনো শেষ সীমায় পৌঁছায়নি।

রেহনুমা আর শোবে না বলে ওজু করে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে পড়লো। মেহউইশ ঘুমন্ত নির্জনের পাশে হাতে মাথা রেখে চোখ বুঁজেছিলো। ভেবেছিলো জেগেই থাকবে বাকিটা রাত কিন্তু তার আর হলো কই! কখন যে চোখ লেগে গেছে তা বুঝতেই পারেনি সে৷

পাহাড়ের নিচুতে খুব বড় একটা গাছ। চারপাশে ছড়ানো তার অসংখ্য ডালপালা। সে ডালপালার কোন এক মরা আর মোটা ডালের মাথায় আটকে আছে রিশাদের সাদা শার্ট। শার্ট নয় আসলে শার্টের কলার। ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে আঘাত পেয়ে ছিটকে পড়া রিশাদের এ ডালের মাথায় শার্ট আটকে যায়। কিন্তু তার দেহের ভার সইতে না পেরেই হয়তো শার্টটা মুহুর্তেই ছিঁড়তে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তা কলারে আটকে থাকে। আহত, রক্তাত রিশাদের কিছু সময় গেল বেহুঁশ অবস্থায়। রাতের আঁধার তখন সূর্যমামার ভয়ে পাহাড়ের খাঁজে মুখ লুকানোর পায়তারা করছে৷ দেহের রক্ত বোধহয় অর্ধেকই পড়ে গেল দেহের বাইরে। মাথাটা প্রচণ্ড ঝিমঝিম করছে আর সেই সাথে পায়ের পাতা থেকে মাথার তালু তীব্র ব্যথায় অবশ করে দিচ্ছে তাকে। বন্ধ চোখে বারবার ভেসে উঠছে নির্জনের মুখটা। ছেলেটা কি তার এতিম হয়ে যাবে! জীবন মৃত্যুর মধ্যক্ষণে ঝুলে মনে পড়লো মেহউইশের কাছে তার ক্ষমা চাওয়া হয়নি। ভুলের ক্ষমা না চেয়েই সে পরপারে চলে যাবে তবে কি তার সন্তানের মাথার উপর মেহউইশও থাকবে না সারাজীবন? মৃত্যু ভয় মানুষকে একাল,ওকাল সব কিছুই ভাবিয়ে তোলে৷ নিস্তেজ একটা হাত চেষ্টা করলো উঠানোর। একবার,দু’বার পরপর অনেকবার৷ মনের শক্তি অসীম থাকলেও শরীরের শক্তি শূন্যের ঘরে৷ আবারও চেষ্টা করলো সে আর এবারে হাতটা ঠিক ঠিক ফোনটাতেই লাগলো। চোখ ঝাপসা, চারদিকে ভোরের রক্তিম আকাশের রক্তমাখা আলো পরিস্ফুট হচ্ছে। ফোনটা অক্ষত কি করে রয়ে গেল! ভাববার সময় নেই। আঙ্গুল চালিয়ে ধীরে ধীরে মেবিশ লেখা নাম্বারটাতে ডায়াল করলো। কানে এলো পটপট করে শার্টের কলারের । হয়তো এবার কলারটা ছিঁড়ে সে নিচে পড়বে৷ মাটি থেকে বেশি উপরে তো নয় তবুও কি বাঁচবে সে! মনের যে শক্তি বাঁচিয়ে ফোন সে করতেই পারলো মেহউইশকে৷ ওপাশে কল পৌঁছে গেছে। আশ্চর্যজনকভাবেই হয়তো আজ নেটওয়ার্ক কূটিল মজা করেনি। নইলে সেখানে প্রথমবারেই কল কি করে গেল! চোখের পাতায় মাত্র জেঁকে বসা ঘুমটা মেহউইশের ধড়ফড়িয়ে পালিয়ে গেল কোথাও। স্ক্রীণে রিশাদ নামটা দেখেই সে কানে দিলো ফোনটা রিসিভ করে।

‘মেহউইশ! শুনতে পাচ্ছো? আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি নির্জনের মা ,,,,’ শেষের বাক্যটা অস্পষ্ট হয়ে মেহউইশের কর্ণকুহরের অগোচরেই রয়ে গেল। পড়ে গেল রিশাদ কলারের শেষ অংশটা ছিঁড়ে। স্তব্ধ হয়ে গেছে ফোনের ওপাশ। কাছেই কোথাও কা কা স্বরে ডাকতে লাগলো কাকের ঝাঁক। পাহাড়ে কাক এলো কোথা থেকে! আগে তো কখনও কাকের ডাক শোনা যায়নি।

চলবে

(অন্নেক বড় করে লিখছি। রিচেক করার সুযোগ পাইনি ভুল ত্রুটির জন্য দুঃখিত। মন্তব্য আশা করছি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here