মন_গহীনের_গল্প পর্ব-২১ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২১
রূবাইবা_মেহউইশ
💞

ঘাড়ে পাওয়া শীতল স্পর্শটা প্রথমে চেনা মনে হলেও স্মৃতির ঘোর কাটতেই বোঝা গেল এ স্পর্শ অচেনা। এক রাতের জবরদস্তির স্পর্শ যা মনে থাকার কথা না। এই মানুষের স্পর্শ সে মনে রাখতেও চায় না। পাহাড়ে ঘুরতে বের হওয়ায় মন ভালো হয়ে গিয়েছিলো মেহউইশের। চারপাশে জংলী পোকার ঝি ঝি স্বর গাছের পাতায় বাতাসের ঝিরিঝিরি কাঁপন আর দূর থেকে ভেসে আসা সমুদ্রের গর্জন । সব মিলিয়ে অর্ধমাসে জীবনের ঘটে যাওয়া দুঃসময় ভুলে তার হঠাৎ সুখানুভব হচ্ছিলো। কিন্তু রিশাদের এই স্পর্শ আর ডাকে নিমেষেই সব হারিয়ে গেল। এই পাহাড়ের জঙ্গলে এসেও স্বস্তি নেই দানবের জন্য পেছন পেছন ঠিক এখানেও এসে হাজির।

‘জঙ্গলে আসতে ভয় লাগেনি তোমাদের?’ রিশাদ যথেষ্ট কোমল সুরে জিজ্ঞেস করলো। মেহউইশের মনে মনে কয়েকরকম জবাব তৈরি থাকলেও মুখে বলার সাহস তার হলো না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো আগের জায়গায় অন্যদিকে রাইমা বাকিদের সাথে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে। মনে তিক্ততার পর্যায় অনেক বেশি মেহউইশের। লোকটা সত্যিই অসভ্য নয়তো কাউকে এভাবে স্পর্শ করা রুচিতে বাঁধলো না কেন। হোক তারা কথিত স্বামী স্ত্রী কিন্তু তাদের তো কোন স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই। মেহউইশের মুখ দেখে আর নিরুত্তর থাকা দেখেই বুঝলো মেয়েটা জবাব দিবে না তাই সেও আর জবাবের অপেক্ষা করলো না। আলতো করে একটা হাত ধরে সামনে আগাতে থাকলো আর মেহউইশও চুপচাপও আগালো। হোটেলে আজ যাওয়ার পরই রিশাদের মনে হলো খালা আর ফুপু বাসায় একসাথে থাকবে। কোন প্রকার ঝামেলা না তৈরি হয়ে যায় তাদের মধ্যে ভাবতেই রিশাদের আর কাজে মন বসলো না। আজ একাউন্টস আর স্টাফদের বিল চেকও উইথড্র করার কথা ছিলো। কিন্তু কি করে করবে এত কাজ সারাদিন সময়ের ব্যপার। তারওপর বাড়িতে কোন প্রকার অঘটনের লেশমাত্র চাচ্ছে না সে। বাধ্য হয়েই ম্যানেজারকে কিছু কাজ বুঝিয়ে টাকার ব্যাপারটা আনক্লিয়ার রেখেই বেরিয়ে এসেছে সে। কক্সবাজার থেকে বাড়িতে আসতে তার ঘন্টার বেশি সময় লাগে। এখানে সমতল রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তায় আসতেই মনে পড়লো ফুপু কাল বাজার করানো নিয়ে আফসোস করছিলো সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায়। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে এপাশে বাজারে এসে আন্দাজ মত মাংস আর কিছু মশলাদি কিনেছে সে৷ ঘরে কি লাগবে বা লাগতে পারে সঠিক জানা নেই তার তবুও নিজের বুঝ মতোই অনেক বাজার করেছে। ফেরার পথেই পাহাড়ের উপর দিকে পায়ে চলা রাস্তায় চোখ আটকায় তার। ড্রাইভিং বন্ধ রেখে গাড়ি থেকে বের হয়ে লক্ষ্য করে যা দেখছে তা চোখের ভুল কিনা! পরক্ষণেই কনফার্ম হয় ভুল দেখেনি সামনে রাইমা আর কিছু পাহাড়ি মেয়ে আর সবার পেছনের মেয়েটি মেহউইশ৷ ট্রেকিং করে বহু পাহাড় ঘুরে বেরিয়েছে রিশাদ ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়েই তাই এইটুকু পাহাড় বেয়ে উঠতে মোটেই সময় লাগেনি। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো রিশাদ উপরে আসতে আসতে পাতার শব্দ, পায়ের শব্দ কত শব্দই হলো অথচ মেহউইশ এক ধ্যানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো যেন কোন কিছুই তার কানে পৌঁছায়নি। মেহউইশের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে তার খোঁপা করা চুলের নিচের অংশে চোখ যেতেই রিশাদের ঘোর লাগে। মন কেমন করে আবার মনের মাঝে হঠাৎ একটু দুষ্টুমিও চড়ে বসে তাই অতকিছু না ভেবেই আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মেহউইশের ঘাড়। আর সকল দুষ্টুমি তার পালিয়ে যায় মেহউইশের ফিরে তাকানো দৃষ্টি দেখে। মুখে রা না থাকলেও দৃষ্টিতে ছিলো অজস্র ধারমাখা ক্ষোভ।নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলো রিশাদ সেই দৃষ্টিতে আর সেই অস্বাভাবিকতা লুকাতেই বুঝি প্রশ্ন করেছিলো, ‘জঙ্গলে আসতে ভয় লাগেনি তোমাদের? ‘

মেহউইশকে নিজেদের মাঝে না দেখে রাইমা থেমে যায়।

‘মেহউইশ কোথায়? ইয়ে মানে ভাবী কোথায় আনতুং?’

রাইমার কথায় আনতুংও থেমে পেছনে তাকায়। নেই তাদের সাথে মেহউইশ আর তা দেখে কিছুটা ভীত হয় আনতুং। রাইমা ভয়ে ভয়ে বলে, ‘ সে কি পালিয়ে গেল!’

‘কি বলেন? কই যাইবো!’ আনতুং অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো । রাইমার ভয় হচ্ছে সুযোগ পেয়ে মেহউইশ পালিয়ে গেল নাতো! দাদাভাই তো তাহলে তুলকালাম করে ফেলবে বাড়িতে৷ ভয় নিয়েই কাঁপা কাঁপা গলায় জোরে চিৎকার করে ডাকলো রাইমা, ‘ভাবী! মেহউইশ’ পরপর দু বার ডাকতেই জবাব এলো।

‘নিচে আয় রাইমা। আমরা নিচে আছি। ‘

‘দাদাভাইয়ের গলা না আনতুং?’

আনতুংও খেয়াল করেছে জবাবটা রিশাদ দিয়েছে। আবার তড়িঘড়ি নিচে নেমে এলো রাইমা আর বাকিরা। উপর থেকে ঝোপের পথ পেরিয়ে নিচের পথে আসতেই দেখলো গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিশাদ তার পাশেই মেহউইশ।

‘দাদাভাই, তুমি এই পথে কি করে? হাইওয়েতে তো ওদিক থেকে যেতে হয়। ‘ কৌতূহলী হয়ে রাইমা জানতে চাইলো।

‘ এ পথে বাজার আছে পাহাড়ি। মাছ,মাংস পাওয়া যায় ভালো তাই এসেছিলাম৷ আর তোকে কে বলল হাইওয়েতে শুধু ওদিক থেকেই যায়। এই পথেও চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে যাওয়ার পথ আছে।আর তোরা এই অসময়ে ঘুরতে বেরিয়েছিস কেন? বারোটার বেশি বাজে এত প্রখর রোদে কেমন করে ঘুরবি?’ কথাটা বলেই রিশাদ আঁড়চোখে মেহউইশের দিকে তাকালো। ফর্সা ঘর্মাক্ত মুখ হালকা গোলাপিবর্ণ ধারণ করে আছে। রোদ সয় না আবার রোদে ঘুরতে বেরিয়েছে! অতঃপর রিশাদের গাড়ি করেই মেহউইশ, রাইমা আর আনতুং বাড়ি ফিরলে। বাকিরাও কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় চলে গেল নিজেদের মত করে।

রিহান ঢাকায় একদম একা আছে বাড়িতে। ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেটা মহলের মত বিশাল বাড়িটাতে সম্পূর্ণ একা। কাজের লোকগুলো নিয়ম করে তিনবেলা খাওয়ার খেয়ালটাই রাখছে তার এর বেশি কেউ কিছুই দেখছে না। মা বাবার সম্পর্ক সে আগে তেমন একটা বুঝতে না পারলেও ইদানীং তার বুঝে আসছে। দুজনের মধ্যে কিছু একটা আছে সে এবার খুব করে টের পেয়েছে। মায়ের ঘর আলাদা, বাবার ঘর আলাদা । বাবা দেশে এসেছে এক সপ্তাহ হয়ে গেছে অথচ বাড়িতে ছিলো মাত্র দুদিন৷ আর সেই দু দিনের একদিন ছিলো রাইমা আপির জন্মদিন বলে হয়তো দেশে আসার কারণটাও আপির জন্মদিনই ছিলো। এছাড়া বাবা কখনো তার কিংবা দাদাভাইয়ের জন্মদিনে কাজ ফেলে আসেনি আর না হাসিমুখে দুটো কথা বলেছে। বাবা সর্বদাই স্পেশাল আর খুব দামী কোন গিফট দেওয়া ছাড়া জন্মদিনের উইশ কি জানেইনা বোধহয় তাদের ক্ষেত্রে । এবারে আপির ইচ্ছে ছিলো সে সারাদিন বাবার সাথে ঘুরবে, নুহাশপল্লীতে যাবে। আর তাই তারা বাবা মেয়ে সেই কাজটাই করেছে। দ্বিতীয় দিন সে দেখেছিলো বাবা বাড়িতে এসে মায়ের সাথে বন্ধ দরজা কোন বৈঠক করেছে এবং তারপরই মা তার লাগেজ গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে। তারপর আজ দুদিন হলো রাইমা আপিও চলে গেছে কক্সবাজারে। রিহান একা এইটুকুনি বয়সেই। মাঝেমধ্যে হিংসা হয় খুব তার আপিকে নিয়ে। বাবা ভালোবাসে আপিকে খুব, দাদাভাইও আপিকেই ভালোবাসে। আপির উপর রাগ করলেও আদর বেশি আপিকেই করে সবাই । তার কথা কারো মনেই আসে না। মন খারাপ হলো তার , চোখ ঘোলাটে হলো।কেউ নেই তার কারো খেয়াল নেই তার প্রতি মা দাদাভাইকে হাজারটা কটুকথা শোনালেও মনে মনে দাদাভাইয়ের কথা ভেবেই আফসোস করে। সে চলে যাবে এই দেশ ছেড়ে আর আসবে না। দূরে কোথাও একা একা থাকবে সে এখনও তো পাশে কেউ নেই। মনের কোণে অভিমানের পাহাড় সৃষ্টি হয়ে গেছে তার শূন্য ঘরে নিজেকে পেয়ে।

গমগমে রোদ্দুরে সবুজ পাতায় চকচকে রঙ৷ বাহারি রঙের প্রজাপতিরা ওড়াউড়ি করছে ফুলে ফুলে। কিছু ফুল আজ রান্নাঘরের সামনের করিডোরে রাখা ডাইনিং টেবিলে সজ্জিত। এই বুনো ফুলগুলো এতোটাই সুগন্ধি যে পাহাড়ে থাকা অজস্র প্রজাপতি উড়তে উড়তে এখানেই চলে এসেছে। রেহনুমা বাড়ির পাশেই কোন গাছ থেকে তুলে এনে সাজিয়েছে এগুলো। মেহউইশ রান্নাঘর থেকে তরকারির বাটিগুলো আনতে আনতে প্রজাপতিদের খেলাও দেখছে মুগ্ধ হয়ে। এই মুগ্ধতায় বিভোর হয়ে সে খেয়ালই করেনি তরকারির বাটি টেবিলে না রেখে চেয়ারে বসা রিশাদের হাতে দিয়েই চলে গেছে। রেহনুমা মাত্রই গিয়েছে রান্নাঘর থেকে আর যেতে যেতে বলে গেছে খাবারগুলো টেবিলে এনে রাখতে। সে কাজ পেয়ে খুশি হয়েই করছিলো কিন্তু এই রংবাহারি প্রজাপতি তার মনকে এলোমেলো করে দিলো আরো একবার। সকালে যে ভুলটা করেছিলো আবারও তাই করছে। রিশাদকে ইভান ভেবেই যেন সে একের পর এক বাটি এনে তার হাতে দিচ্ছে । আর রিশাদও চুপচাপ প্রতিটা বাটি নিয়ে টেবিলে রাখছে। সর্বশেষ ভাতের বোলটা এনে রাখতেই রিশাদ তার হাতটা ধরলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এবার এবং খুবই মোহমত্ততায় মেতে কোমল স্পর্শে মেহউইশের গাল ছুঁলো। এতেই যেন বিভোরতা কেটে হুঁশ এলো মেহউইশের। কি করছে সে! ইভানকে ভুলে যাওয়া দরকার! নাকি এখান থেকে পালানো? তার মনপ্রাণ একনিষ্ঠভাবে ইভানেই আটকে আছে এখনো। তার চোখ রিশাদের মাঝেও ইভানকে খুঁজে পায় কেন! রিশাদ লক্ষ্য করেছে মেহউইশের আদলখানি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে আচানক। মেহউইশের গালটাতে নিজের হাত বড্ড বেমানান লাগলো তার তাই নিজেই আবার সরিয়ে নিলো। কি হয়েছে তার! এত কেন নরম হয়ে যাচ্ছে মেহউইশের প্রতি? ভালো সে নীলিমাকেই তো ঠিকঠাক বাসতে পারেনি এখন কি আবার মেহউইশের মোহে আটকাবে? নীলিমাকে শুধু বিয়ে করতে হয়েছে বলেই যথেষ্ট সম্মান দিয়ে নিজের করতে চেয়েছিলো। সন্তানের মা হিসেবে আপন ভাবতে চেয়েছিলো। সকল সম্মান সকল আদর উপেক্ষা করেই তে চলে গেল মেয়েটা। আর এই মেয়েকে তো জোর করেই অর্ধাঙ্গিনী করেছে এই মেয়েও আর সম্মান পেলেইবা থাকবে কেন! নিজের নরম হতে থাকা ব্যক্তিত্বকে কঠিনই রাখতে হবে ধরে নিলো রিশাদ। ডাইনিং ছেড়ে হুট করেই ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। কিছু সময় চাই তার। কিছু ভুল আছে শুধরে নেওয়ার কিছু কাজ বাকি নিজেকে মুক্তি দেওয়ার। কিছু প্রয়োজন আছে সন্তানের খুশি নতুন করে গুছিয়ে নেওয়ার।

চলবে
(দুঃখিত, এ পর্বে একদমই আগাতে পারিনি লেখাটাকে ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্বে ভালো কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here