মন_গহীনের_গল্প
পর্ব ২৫
রূবাইবা_মেহউইশ
💞
বাবা-মায়ের ঝগড়া যখন তুমুল হয়ে গেল তখন আর রিহানের পক্ষে ঘরে থাকা সম্ভব হলো না। সে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাইমা অনেক চেষ্টা করলো বাবা মাকে থামানোর কিন্তু তারা কিছুতেই থামলো না উল্টো একসময় রাশেদ খান হাত উঁচিয়ে থাপ্পড় দিতে চাইলো জেবুন্নেসাকে৷ ঘটনাটা আর সহনীয় রইলো না রাইমার পক্ষে আর না জেবুন্নেসার পক্ষে । রাশেদ নিজেকে থাপ্পড় দেওয়া থেকে সামলে নিলেও রাগ সামলাতে পারলো না। রাইমা ঘর থেকে বেরুতেই সে বলে উঠলো, ‘আমার বোনকে বিধবা করেও তোমার স্বাদ মেটেনি তাই না? এজন্যই গিয়েছিলে চট্টগ্রাম এবার যেন তাকেই খুন করতে পারো!’ রাইমার পা থেমে গেল ‘ফুপু বিধবা!’
ঘরের ভেতর আবারও চিৎকার শোনা গেল তবে এবার জেবুন্নেসার।
‘খুনি আপনি, আপনি ধর্ষক আপনি প্রতারক। আর আপনারই ছায়ায় আমার বোনের শেষ চিহ্ন রিশাদটাকেও তেমনই বানিয়েছেন। আমার রাইমা, রিহানটাকেও এখন তেমনই করতে চাচ্ছেন? ডিভোর্স আমার চাই এবং সেটা যতদ্রুত সম্ভব।’ এই অব্ধি শুনে রাইমা আর দাঁড়াতে পারলো না। সে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। সহ্য হয় না তার এমন জীবন। ছোট থেকেই এমন দূরত্ব তাকে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড দূর্বল সত্তায় পরিণত করে দিয়েছে। ভয় পায় সে এ জীবনে সবরকম সম্পর্ককেই৷ নিজের প্রয়োজনে মাকে পায় না মায়ের আদর,শাষণ কিছুই পায় না আর না পায় বাবাকে কাছে। বাবার আদর আর আদরেভর্তি টাকাই তার প্রাপ্তির খাতায় আছে। এক দাদাভাই আছে যে কিনা আদরটাও শাষণের ভঙ্গিতে করে। তবুও স্বস্তি গত কয়েকটা মাস নির্জনকে পেয়েছিলো বাবার কারণে এখন সেও নেই। আর এত এত বছর পর জানলো একটা ফুপি আছে কিন্তু সেখানেও জানতে হলো মা আর ফুপির মধ্যকার সম্পর্ক বিষাক্ত। কিন্তু বাবা কেন বলল, ফুপির বৈধব্যদশা মায়ের কারণে! রাইমার মাথায় জট পাকিয়ে গেল যেন। ফুপুর বাড়িতে গিয়েও মনে হয়েছিলো মা ফুপুকে সহ্য করতে পারে না আর ফুপিও কেমন মাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলছিলো। যদি মায়ের কারণেই ফুপু বিধবা হয়ে থাকেন তবে তো মায়ের না ফুপুরই মাকে সহ্য করারই কথা না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। সব জানতে হবে তাকে মা বাবার বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য হলেও তাকে সব জানতে হবে, কোন উপায় বের করতে হবে।
‘শী ইজ মাই ওয়াইফ’ বলেই রিশাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। কথাটা শুনে তিশমার মুখ বিষ্ময়ে ‘হা’ হয়ে গেল।
‘কি বলো রিশাদ? তোমার বউ তো নীলিমা ছিলো তার চেহারা,,,,’
‘নীলিমা পালিয়ে গেছে তা তো অজানা নয় তোমার।’ মাথা নেড়ে জবাব দিলো তিশমা সে জানে।
‘ওর নাম মেবিশ না মানে মেহ উইশ’ ভেঙে ভেঙে বললো রিশাদ মেহউইশের নামটা। তারপর আবার বলল, ‘ মেবিশকে আমি জোর করে বিয়ে করেছি৷ আসলে নীলিমা যাওয়ার পর নির্জনকে আমিই সামলেছি কিন্তু কাজ তো আর ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয় আবার নির্জনকে মায়ের যত্ন দিতে গেলে কাজ করাও সম্ভব নয়। আব্বু ফোন করে করে পাগল করে দিচ্ছিলো বিয়ের জন্য আর এবারও তার পছন্দের কোন এক ব্যবসায়ীর মেয়ে। বিয়ের কথা শুনলেই তো মাথায় আগুন ধরে যায় তার ওপর আব্বুর মতের দাম দিতে গিয়েই আমি আজ ছেলে মানুষ করতে কাজ ছাড়তে বসেছিলাম। রাগে মাথা কাজ করছিলো না তার ওপর নির্জনের অসুখ হলো। এই অসুখে আমার ছেলেটা কান্না করতো প্রচুর। হাসপাতালে যাওয়ার পর মেহউইশ চোখে পড়ে তার কোলে নির্জন যেতেই চুপ হয়ে যায়। আর বাড়িতেও খালামনি কোন না কোন কটু কথায় বিয়ের কথা তুলতে থাকতেন। সব মিলিয়ে রাগ,জেদ আর সমস্যার সল্যুশন আমার তখন শুধু মেবিশকেই মনে হয়েছিলো।’ এ পর্যন্ত বলেই থামলো রিশাদ। তিশমা এতক্ষণ মনযোগ দিয়ে রিশাদের কথা শুনছিলো এবার প্রশ্ন করলো, ‘যদি মেহ উইশ বিবাহিত হতো? তখন কি করতে তুমি!’
তিশমা যেন মেহউইশ নামটা উচ্চারণ করতে পারলো না ঠিকঠাক । রিশাদ আবার জবাব দিলো, ‘তাতে কি? সে বিবাহিত না হলেও কারো প্রেমিকা তো ছিলোই৷ আমার জন্য সে তার প্রিয় মানুষকে হারালো।’ শেষের কথাটা বলতে গিয়ে রিশাদের গলা কাঁপলো। সে ব্যথিত নিজের কর্মের জন্য কিন্তু ব্যথিত হওয়ার বাইরে সে কিছু করতেও চায় না। এদিকে তিশমা অপলক চেয়ে আছে রিশাদের দিকে৷ হঠাৎ ম্যানেজার এসে দাঁড়ালো রিশাদের সামনে৷ গলা খাঁকড়ি দিয়ে সে প্রশ্ন করলো, ‘ স্যার সব রুম কমপ্লিট হয়ে গেছে আজ। চাইলে কাল থেকেই আমরা ফোর্থ ফ্লোরের বুকিং নিতে পারি৷ শীত তো এখন ভালোই জমছে ট্যুরিস্টও বেশ আসছে।’ ম্যানেজারের কথার কোন জবাব দিলো না রিশাদ। সে এখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পাশ থেকে তিশমা বলল, ‘ এই যে মিস্টার হাংকি পাংকি এখানে কি আপনার? এখন আমরা কথা বলছি পরে আসুন।’
তিশমাকে প্রথম দেখে যতখানি আপ্লুত হয়েছিলো সে এই মুহূর্তে ততোটাই বিরক্তিবোধ করলো৷ কত বড় রকমের খারাপ হলে মানুষ এমন বিচ্ছিরি নামে ডাকতে পারে! মেজাজ খারাপ হলো ম্যানেজারের কিন্তু এই সেলিব্রেটি টাইপ মানুষ তার একদম পছন্দ না। ম্যানেজার দাঁড়িয়ে আছে বলে তিশমা আবারও বলল, ‘ এই যে হাংকি পাংকি কথা কি কানে যায় না?’ তারই মাঝে রিশাদ বলল, ‘ আমার রুমটাও গুছিয়ে রাখবেন তো, কাল আমার পরিবার আসবে এখানে। আর শুনুন আমার পুরনো রুমটাকে ট্যুরিস্ট রুম করার ব্যবস্থা করান আমি কালকে থেকে দ্বিতীয় ফ্লোরে থাকবো। আর ঘরের পর্দা সব ল্যাভেন্ডার কালারের রাখবেন৷ওহ হ্যাঁ রুম দুইটা লাগবে আমার ফুপিও এখানেই থাকবে যতদিন আমি থাকবো।’ কপাল কুঁচকে, নাক ফুলিয়ে ম্যানেজার চলে গেল চুপচাপ। মেজাজ চড়ে গেছে খুব তার কিন্তু বসের সামনে কারো সাথে তর্কে জড়ানোটা পছন্দ নয় বলেই চুপ ছিলো সে। তাছাড়া ওই মডেলকে সে দুই পয়সার দামও দেয় না। হুহ,
‘বাহ্, তোমার ম্যানেজার তো দেখি তোমার মতোই নাক উঁচু লোক।কি ভাব দেখিয়েই না গেল।’ তিশমা অবাক হয়ে বলল।
‘কেন খামোখা ওসব বললে? ‘
‘কিসব বলেছি!’
‘ওই যে হাংকি পাংকি। ও আসলে তার নামের ব্যাপারে খুবই পজেসিভ।ওকে দুটো গালি দিয়ে কথা বললেও জবাব দিবে না কিন্তু নাম নিয়ে মজা করলে খুব লাগে তার।’
‘ এই এটা কি তোমার ঘরের বউ! এত গভীর খবর মানুষ তো নিজের বউয়েরও রাখে না।’ ব্যঙ্গ করলো তিশমা সেও দেখে নেবে এই ফালতু ম্যানেজারকে। এক সপ্তাহ থাকবে এই এক সপ্তাহে ওই ম্যানেজারের ঘুম যদি হারাম না করে তবে তার নামও তিশমা নয়।
‘আচ্ছা পরের কাহিনি কি?’ তিশমা কৌতূহল মেটাতে আবার প্রশ্ন করলো।
‘কিসের কাহিনি?’
হাঁটতে হাঁটতে বলি, চলো বিচের দিকে। বিকেলের শুরু সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে হাওয়া আসছে পাল্লা দিয়ে৷ শীত নেই এ সময়ে এখানে অথবা আজ সূর্যের তাপ বেশি। বেগুনি রঙের ফুল স্লিভ টপ আর হোয়াইট লেগিংস পরনে তিশমার পিঠ পর্যন্ত চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে আছে। লনের সামনে দাঁড়ানো কালো কোট পরিহিত ম্যানেজার অগ্নি দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছে লন ছাড়িয়ে গেইটের দিকে পা বাড়ানো তিশমার দিকে। পাশাপাশি রিশাদ এক হাত চুলে বুলিয়ে পা মেলাচ্ছে তিশমার সাথে। তিশমার প্রশ্ন মেহউইশ যদি তার বউ হয় তবে কেন সে বেবিসিটার বলে পরিচয় দিলো!
‘আমি কল করে বলেছিলাম নির্জনকে নিয়ে সে যেন ভিডিও কলে আসে। সে কি করলো ফুপির কোলে নির্জনকে দিয়ে দিলো। ফুপিকে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিলো দু হাতে নির্জনকে ধরে রেখেছ!’
‘হ্যাঁ তাই তো দেখলাম।’ তিশমা জবাব দিলো।
‘ফোনের পেছনে মেহউইশ ছিলো তা বুঝতে পেরেছি তখনই। কিন্তু এতেও সমস্যা নেই কিন্তু সে কেমন তোমার কন্ঠ শুনতেই ঘাড় বাড়িয়ে দেখে নিলো তোমায়।’
‘হুম, আমি বেশ অবাকই হয়েছি। আমি কথা বলার সাথে সাথেই অমন করলো কেন? ‘
‘কারণ, ও আমার সাথে সংসার করবে। নীলিমা হলেও এমন করতো তবে নীলিমা করতো নিজের প্রয়োজনে।’
কোন কথাই মাথায় ঢুকছে না রিশাদ কি বলছো এসব? তিশমা যেন এবার বিরক্তই হলো। রিশাদ দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দিলো। এলোমেলো চুল বাতাসে দোল খাচ্ছে খুব সেই সাথে কপালে ঠেকছে বারবার। আনমনা দৃষ্টি তার সামনেই সমুদ্রের জলরাশিতে সে আবার বলল, ‘ মেবিশকে বিয়েটা আমি জোর করে করলেও সে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো। আর সেটাই স্বাভাবিক কারণ সে কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু তার দ্বায়িত্ব, তার মা আর ভাইয়ের সুখ তার কাছে নিজের চেয়েও বেশি। ও প্রথমে আমাকে দেখলে যতোটা অসহ্যবোধ করতো এখন তা করে না। আমি টের পাই সে আমার প্রতি কোমল হচ্ছে একটু একটু। সে নির্জনকেও আদর করে , আগলে রাখে যা নীলিমা তার আপন মা হয়েও করেনি। ওই তো এসেছিলো ছেলের প্রতি দরদ দেখাতে কিন্তু সে দরদ কতটুকু দেখালো? নতুন জামাই যেই ওকে অবহেলা করলো অমনি ছেলেকে ফেরত দিয়ে গেল। পনেরো দিনের জায়গায় সাত দিনেই নির্জনকে তার বাপের কাছে দিতে হলো। আর মুখে কি বড় বড় ডায়লগ দিয়েছিলো জানো? সে নাকি সারাজীবনের জন্য কেড়ে নেবে নির্জনকে আমার কাছ থেকে হুহ। ‘ কথাটা শেষ করেই অস্পষ্ট স্বরে গালি দিলো একটা৷ তিশমা হাত ধরলো রিশাদের, হাঁটতে হাঁটতে হাতটা ছাড়লো না৷ আশ্বাস দিলো যা হয় ভালোর জন্যই হয়।
‘মেহহউইশ এর পরিবারের দ্বায়ভার আমি নিজের কাঁধে নিয়েছি। তার মা ভাই খুব খুশি আর সেই খুশি সে প্রতিদিন একবার করে নিজের মায়ের কথা শুনেই বুঝতে পায়। এ কারণেই মেহউইশ নিজেকে আমার সাথে সারাজীবন আটকে রাখবে। আমাকে স্বামীর মর্যাদাও দিবে আবার নির্জনের মা’ও হবে। তার প্রথম ধাপই ছিলো বোধহয় ওভাবে তোমাকে দেখা।’ রিশাদের কথা শেষ হতেই তিশমা তার হাত ছেড়ে মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।
‘তার মানে বলতে চাইছো তোমার বউ তোমাকে সন্দেহ করে আমাকে দেখেছে? রিয়্যালি! মানে তার বরের সাথে কোন নারী কন্ঠ শোনা গেছে বলেই সে ওরকম হুট করে ক্যামেরার সামনে এসে দেখে নিলো মেয়েটা কে! Are you sure Rishad?’
ভীষণরকম অবাক হয়ছে তিশমা। ভালো না বেসেও স্বামীর উপর সন্দেহ করা যায়? কই সে তো দেড় বছর প্রেম করেছিলো তৈমুরের সাথে কিন্তু তৈমুরের অন্য আরো একটি সম্পর্কের কথা জানার পরও তো সে এমন করে তাকায়নি তৈমুরের ওই গার্লফ্রেন্ড এর দিকে যেভাবে মেহ উইশ তাকিয়েছিলো তার দিকে! হঠাৎই মন খারাপ হলো তিশমার। তৈমুরের সাথে প্রেম করেছে ব্রেকাপ করেছে তার তো মন একটুও কেমন করেনি বরং আজ রিশাদের কথা শুনে মেহউইশের তীক্ষ্ণ সেই কয়েক সেকেন্ডের চাহনি দেখে নতুন করে প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে খুব। কারো সাথে বাঁধা পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগছে। মিল নেই, ভালোলাগা নেই তবুও রিশাদের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে এখানেই লুকিয়ে আছে গভীর কোন প্রেমের কাহিনি।
চলবে