মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৯
রূবাইবা_মেহউইশ
_________________
রাস্তারা কিনারা গমগম করছে মানুষে মানুষে। রাতের প্রথম প্রহরে এলাকার এপাশে এতোটাও মানুষ থাকার কথা নয় কিন্তু আজ জড়ো হয়েছে। একটু আগেই রিশাদ এখানে নীলিমাকে দেখতে পায় মেহউইশের সামনে। আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে কিছু বলছিলো বোধহয়। নীলিমাকে দেখতেই রাগে কপালের দু পাশের রগ দুটো আচম্বিতেই ফুলে উঠে। পুরো শরীর জুড়ে আগুনের হলকা লাগার মত তাপ উঠছিলো যেন পুরো শরীরে আর সেই তাপ তার রাগের গতি তীব্র হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে রাস্তা পার হয়েই গলা চেপে ধরে নীলিমার। মেহউইশ আচমকা এমন কান্ডে বুদ্ধিশূন্য হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু । কি করা উচিত কি বলা উচিত কিছুই যেন মাথায় এলো না। পথচারী দু একজনের চোখ পড়তেই দৌড়ে আসে তারা। আর এমন করেই দু,চার করে জমতে জমতে ভীড় লেগে যায় রাস্তায়। সাত,আটজন মিলেও যেন রিশাদকে ছাড়াতে পারছেনা এতোটাই অসুরে শক্তি ভর করেছে তার মধ্যে। রিশাদের মত নীলিমাও কোটিপতির মেয়ে৷ এখানে সে নিশ্চয়ই একা আসেনি। তার গাড়ি,ড্রাইভার কিংবা সেই প্রাক্তন প্রেমিক যে বর্তমান স্বামী তার সেও এসেছে। কিন্তু এখানেও কথা থাকছে, নীলিমাকে যখন রিশাদ খুন করতে উদ্ধত হলো তখন তারা কেউ বাঁচাতে এলো না কেন? রিশাদের মাথায় এত ভাবনা এলো না শুধু ভাবছে নীলিমা লোক লাগিয়েছে তার পিছনে নয়তো কি করে জানলো এখানে মেহউইশ আছে বা মেহউইশ কে! আর না চিনলে না জানলে সে মেহউইশের সাথেই কেন কথা বলছিলো? পাবলিক যখন নীলিমাকে ছাড়িয়ে নিলো তখনই রিশাদ গর্জে উঠে কিছু অকথ্য শব্দে গালি দিলো নীলিমাকে। সেই গালির শব্দে মেহউইশের দুটো কানই যেন ঝা ঝা করে উঠলো।আর উপস্থিত বাকিরা কেউ কেউ বুঝে গেল নীলিমা আর রিশাদের মধ্যকার সম্পর্ক কি হতে পারে আর কেউ কেউ ধারণা করলো রিশাদ একদমই জানোয়ার। নীলিমা রিশাদের হাত থেকে ছাড়া পেতেই উল্টো দিকে হাটতে লাগলো হয়তো ওদিকেই তার গাড়ি রাখা আছে। ভীড়ও আস্তে আস্তে কমে গেলে মেহউইশ রিশাদের দিকে তাকালো ভালো করে। নিয়ন বাতির হলদে আলোয় উসকোখুসকো চুল,ছেঁড়া শার্ট, শেভ করা গালের চামড়া ভেদ করে যেন হাড় বেরিয়ে আসবে। কি ভয়ংকর লাগছে এই লোকটাকে। এতোটা ভয়ংকর কাল রাতেও লেগেছিলো, লেগেছিলো বিয়ের রাতেও যখন তার গালে পরপর কয়েকটা চড় মেরেছিলো। রূপকথার গল্পের রাক্ষসের রূপই কি এমন ছিলো? থরথর করে কাঁপছে মেহউইশের হাঁটুদুটো। ভীষণ ভয় লাগছে এখন তার রিশাদকে দেখে। টানা হেঁচড়াতে কারো হাতে আঘাতও লেগেছে রিশাদের ঠোঁটের কিনারায়। সেখানটাতে রক্ত জমাট বাঁধছে একটু একটু করে। হঠাৎ করে মাথাটা ঘুরে পড়ে গেল রাস্তায়।
রাত দু’টো বেজে বিশ মিনিট। খচখচ শব্দটা তীরের মত কানে বিঁধতেই পিটপিট করে চোখ খুলল মেহউইশ।ঘরে টিমটিমে আলো জ্বলছে। চোখ ঘুরিয়ে এপাশ ওপাশ তাকাতেই চোখে পড়লো তার ডানদিকে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে আছে। কি মায়াবী আর কত কোমল লাগছে মুখখানি এই মৃদু আলোতেই। বাচ্চা বলেই হয়তো এতোটা সৌন্দর্য তার এইটুকু মুখশ্রীতে ভর করে আছে৷ শব্দটা এবার আরো জোরালো হতেই সে কান চেপে ধরে অস্ফুটে আর্তনাদ করলো, ‘ আহ্।’ তৎক্ষনাৎ ঘরে আলো জ্বলে উঠলো গাঢ়। রিশাদ সুইচের পাশেই ছিলো৷ খচখচ শব্দটা তার লাগেজের চেইন লাগানোর জন্যই এমনভাবে আসছিলো। চেইনটা হয়তো জ্যামড তাই ঠিকঠাক লাগাতে পারছে না সে। আরেকটু ভালো করে তাকাতেই মেহউইশের চোখ ছানাবড়া। ফ্লোরে ছড়িয়ে আছে তার কিছু কাপড়চোপড়। এসব কাপড় সে হাসপাতালে চাকরি পাওয়ার পর কিনেছিলো। বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ না হলেও কিনে রেখেছিলো কখনও সুযোগ হলে খুব সেজেগুজে বের হবে। এই জামাগুলোর সাথে রঙ মিলিয়ে কানের দুলও কিনেছিলো চাদনী চক থেকে। ইভান কত শখ করে এক জোড়া ঝুমকাও দিয়েছিলো একটা জামার সাথে মিলিয়ে। ‘ইভান’ নামটা আবার বুকের খাঁচায় খুঁচিয়ে দিলো। মানুষটা কোথায়!
‘কল্পনা আর আরাম করা শেষ হলে এদিকে এসো।’ রিশাদের কথায় কল্পনারা ভয়েই পালিয়ে গেল৷ রাস্তায় যখন জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলো মেহউইশ তখন রিশাদ তাকে পাঁজা কোলে করে নিয়ে ঘরে এনে শুইয়ে দিয়েছিলো। ডাক্তারও ডাকা হয়েছে, জ্ঞানও ফিরেছিলো। কিছুই ঠিকঠাক মনে পড়ছে না মেহউইশের। দূর্বল শরীরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুই মনে নেই তার। অথচ নির্জনের খাওয়া,ঘুমানোর আগে ডায়াপার পরানো, ক্রিম মাখা সবকিছুই রিশাদ নিজ হাতে করেছে। এখন এই মধ্যরাতে সে মেহউইশের কাপড় গোছাচ্ছে কাল সকালেই শহর ছাড়বে বলে। এ কথা মেহউইশের অজানা। রিশাদ আবারও ডাকলো, ‘এ্যাই মেয়ে এদিকে এসো।’
মেহউইশ বিছানা ছেড়ে নেমে গেল রিশাদের সামনে। লাগেজের উপর বসতে ইশারা করলো রিশাদ। কপাল কুঁচকে গেল মেহউইশের, ‘এখানে কেন বসবো?’
‘ আমি বলেছি তাই।’
এ কথার পর আর কথা বলা চলে না। ভয়েই মেহউইশ লাগেজটার এক পাশে বসে পড়লো। তার শরীরের ওজনে লাগেজের মুখটা আরো চেপে বসলো৷ একটানে এবার সেটা লাগিয়ে নেওয়া গেল।
‘কাল সকালে কিছু কথা বলতে চাই আমি।’ রিশাদ কথাটা বলার সময় খুবই স্নেহ সহকারে তাকালো মেহউইশের দিকে। এই প্রথম! হ্যাঁ, এই প্রথমবার রিশাদ স্বাভাবিক স্বরে কোন কথা বলেছে বলে মনে হলো তার। সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হলো মেহউইশের। কি কথা বলবে! কৌতূহল যেন সাগরের ঢেউয়ের মত উপচে পড়ছে মেহউইশের মনে। কিন্তু রিশাদ আর মুখ খুললো না।
ভোরের আজান শেষ হতেই বিছানা ছাড়লেন জেবুন্নেসা। কাল রাতেই বাড়ি ফিরেছেন তিনি। বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন পরশুদিন একটা ফোনকল পেয়ে৷ অচেনা এক নম্বর থেকে অবিকল তার ভাবীর কন্ঠস্বরে বলেছিলো তার ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে৷ ‘ভাইয়ের এক্সিডেন্ট!’ কথাটা শুনেই যাচাই বাছাই করার কথা না ভেবেই ছেলেকে নিয়ে ছুটলেন বাপের বাড়ি। যাওয়ার পরই বুঝতে পারলেন এটা প্রানপ্রিয় সৎ ছেলে রিশাদের মিথ্যে একটা নাটক।নিশ্চিত নতুন বউটার ওপর অত্যাচার করবে বলেই হয়তো ষড়যন্ত্র করে আমাকে বাড়ি থেকে বের করেছ। ডোন্ট কেয়ার হয়ে বাবার বাড়িতেই থেকে গেল।
সকাল সকাল মেহউইশকে ঘুম থেকল ডেকে তুলল রিশাদ।হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দশ মিনিট সময় দিচ্ছি তৈরি হয়ে নাও। এরপরই আমরা বের হবো।’ চোখভর্তি ঘুম আর শরীর ভর্তি দূর্বলতা নিয়ে মেহউইশ অবাকও যেন হতে পারলো না। কয়েক মিনিট ঝিম ধরে বসে রইলো। দু হাতে মাথা চেপে ধরেছে। ইতোমধ্যে ঘরে মেহউইশের মা আর ভাইও এসে হাজির৷ ক’টা বাজে! জানে না সে। মোবাইল ফোনটা নেই এ ঘরে কোন ঘড়িও চোখে পড়েনি। মাথা থেকে হাত সরাতেই মা এগিয়ে এলো তার কাছে।
কিরে,মাথা ব্যথা লাগছে?
‘না’ ছোট্ট করে জবাব দিলো মেহউইশ।
উঠে মুখ হাত ধুয়ে তৈরি হ, আমি চা বসিয়েছি আর পরোটা ভেজেছি৷
মায়ের কথায় মেহউইশের মধ্যে কোন পরিবর্তন এলো না। সে আগের মতোই বসে রইলো। মা এবার আলতো করে তার মাথায় হাত দিতেই ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো সে। শুধু কান্না, এ কান্নায় কোন শব্দ নেই,বিলাপ নেই শুধু ঈষৎ গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। এমন কেন হলো তার সাথে! মাইমুনা মেয়ের কান্না বুঝতে পেরেই বুঝি জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। এবার তার চোখেরও বাঁধ ভাঙলো। কান্না করছেন একসাথে দুজনেই আর পাশেই দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে মিহাদ। মনে মনে এক প্রতিজ্ঞা করে বসলো সে। সুযোগ পেলেই খুন করবে রিশাদকে। রিশাদ সারারাত ঘুমায়নি মধরাত পর্যন্ত বাবার সাথে বাকযুদ্ধ চলেছে তার। সে যুদ্ধে বাবা জয়ী সে আজই চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম শহরে।এবার সেও দেখবে বাবা কি করে সামলায় বিদেশ বসে দেশের ব্যবসা সামলায়! রাশেদ খান যতোটা ধূর্ত ঠিক ততোটাই তার ছেলেও এবার রিশাদ সেটাই বোঝাবে তার বাপকে। টাকার আদর অনেক হয়েছে এবার রক্তের আদরের বাইরে আর কোন কথাই হবে না।
সকালের নাশতা ঠিক সাতটায় করা হয়ে গেছে রিশাদ,মেহউইশের। আটটায় রওনা দিবে তারা। মেহউইশ কোনমতেই আর এক পাও আগাতে চায় না রওশাদের সাথে কিন্তু এ বাড়িতে এসে বুঝতে পারলো তার পালিয়ে যাওয়ার পথ সব বন্ধ । মা আর ভাই এখন রিশাদের হাতের মুঠোয় তার করা যে কোন ভুলের মাশুল তাদেরও গুণতে হতে পারে। খাওয়া শেষে মেহউইশ তার পুরনো কাপড় থেকেই খুঁজে বেছে ভালো দেখে একটা সেলোয়ার-কামিজ পরে নিলো। কাল এ বাড়িতে আসার আগে ব্লাউজ নিয়ে যা হলো তা মনে পড়তেই সেই শাড়িটাকে ক্লজেট থেকে নামিয়ে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। যেন সকল রাগ এই শাড়িটাতে ঝাড়তে পারলেই তার শান্তি লাগতো৷ রিশাদ যখন পিঠের অংশে ব্লাউজটাকে টেনে ছিঁড়ে ফেলল তখন ভেবেছিলো ভালো হয়েছে এটা আর পড়তে হবে না। কিন্তু দূর্ভাগ্য, রাইমা এসে সবটা দেখে নিজেরই একটা ব্লাউজ এনে দিলো রঙ মিলিয়ে। একটু লুস হলেও শেষ অব্ধি সেটাই গায়ে চড়লো তার৷ আটটা বাজার ঠিক পনেরো মিনিট আগে রিশাদ বসার ঘরে বসে মেহউইশকে ডাকলো। মেহউইশ আসতেই আবার চেঁচিয়ে ডাকলো, ‘শ্বাশুড়ি আম্মা এদিকে আসেন একটু।’ রিশাদ একবার ডাকতেই মাইমুনা দৌড়ে এলেন সেখানে।
আপনাদের দুজনকে আমি কিছু কথা বলবো। আসলে বলা দরকার যেহেতু আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করেছি।
‘জোর করে করেছেন’ রিশাদের কথার মাঝে বলে উঠলো মিহাদ। ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেটা একেবারেই অবুঝ নয়। বিরক্ত বোধ করলো রিশাদ এভাবে কথার মাঝে কথা বলায়।
‘আহ্, তুমি কেন কথা বলছো কথার মাঝে? হ্যাঁ যা বলছিলাম, আমার প্রাক্তন স্ত্রী নীলিমা মানে কাল যাকে রাস্তায় ওভাবে গলা চেপে ধরেছিলাম।’ শেষের বাক্যটা মেহউইশের দিকে তাকিয়ে বলল। মেহউইশ মনযোগে শুনছে রিশাদের কথা।
‘নীলিমার সাথে আমার ডিভোর্সটা এখনও হয়নি। হওয়ার প্রসেস চলছে। আরো নাকি মাস খানেক সময় লাগবে কোর্ট নোটিশ অনুযায়ী। এবং এরই মাঝে আমাদের সিদ্ধান্তও নিতে হবে নির্জনের কাস্টডি নিয়ে। আমি কোনভাবেই আমার ছেলেকে ওই কাল নাগিনীর কাছে দিবো না।তাকে আমি একাই মানুষ করতে যথেষ্ট কিন্তু সমস্যা হলো আমার কাজ। আর বাড়িতে ওই মহিলা’ বলেই একটু সময় থেমে রইলো রিশাদ। শুকনো মুখে ফাঁকা ঢোক গিলে আবার বলতে শুরু করলো, ‘ মানে আন্টি দিনরাত কটুকথা বলতেই থাকে এখন আমাকে শোনায় বলা যায় না ভবিষ্যতে আমার ছেলেকেও শোনাতে পারে। তারওপর কিছু ব্যপার তো আছেই যা মা ছাড়া অন্যকেউ নাকি শেখাতে পারে না।’ বলতে বলতেই রিশাদের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মাইমুনা ভীষণরকম চমকালেন,অবাক হলেন। এই রিশাদই কি চার দিন আগের দেখা রিশাদ? কত গম্ভীর কত ভয়ংকর রাগী ছেলেটাই এটা কি করে হতে পারে? মেহউইশ ভাবছে লোকটা কি কান্না করছে! রিশাদ মাথা উঁচিয়ে গলা খাঁকড়ি দিয়ে আবার বলল, ‘ ম্যানারস নাকি মা ছাড়া কেউ শেখাতে পারে না কিন্তু নীলিমা তো সন্তানের চেয়ে প্রেমককেই বেশি ভালোবাসতো। কিন্তু আমার ছেলের কেন দূর্ভাগ্য হবে ওই কালনাগিনীর জন্য!’
-আর তাই আপনি নিজেই কাল নাগ হয়ে অন্যের সুখের জীবনে ছোবল মেরেছেন! অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজের ছেলের সুখ কিনবেন? এতোটাই সহজ! আমি তো আপনাকে ডিভোর্স দেব আজ না হয় কাল৷ প্রয়োজনে পালিয়ে যাবো আপনার প্রাক্তনের মতোই।ইভান,,,,,,
‘একদম চুপ’ বলেই বসা থেকে উঠে মেহউইশের গালে একটা থাপ্পড় মারলো রিশাদ৷ ছিটকে একেবারে মায়ের কাঁধের ওপর পড়লো মেহউইশ। মাইমুনা ভয়ে মেয়েকে জাপটে ধরলেন। ওদিকে মিহাদও দৌড়ে এসে রিশাদের কলার ধরলো। আর চারদিকের হৈ চৈ শুনে ভয়ে কেঁদে উঠলো সোফায় শুইয়ে রাখা নির্জন৷
চলবে
(এডিট করা হয়নি ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)