মন_পাড়ায় পর্ব_১৪

মন_পাড়ায়
পর্ব_১৪
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

প্রভা নির্বিকারে জিজ্ঞেস করল, “আপনিও তো তুলেছিলেন। আপনি পারলে তারা পারবে না কেন?”

মুহূর্তে যেন অর্কের মুখের ভাব ভঙ্গি পরিবর্তন হলো। নম্র থেকে শক্ত হলো। মুখে রাগান্বিত ভাবের আগমন। সে শক্ত করে প্রভার হাতটা আঁকড়ে ধরলো। রাগান্বিত স্বরে বলল, “তুমিও তো তাহলে সে মানুষগুলোর মতো। তারা যেমন তোমাকে বলেছে তুমিও তো নূহাকে বলেছ।”

ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে প্রভা। কাঁচের চুড়ি ভেঙে তার হাতে ঢুকে গেছে। সে বলল, “প্লিজ ছাড়ুন ভীষণ ব্যাথা করছে। প্লিজ।”
প্রভার ভেজা চোখ দুটো দেখে অর্কের হুশ ফিরল। সে প্রভার হাত ঢিল দিতেই তার হাতে চারটা রক্তে মাখা ভাঙা কাঁচের চুড়ি এসে পরলো।

অর্ক সাথে সাথে আতঙ্ক নিয়ে বলল, “সরি সরি আমি বুঝি নি যে—-” অর্ক প্রভার হাত ধরতে নিলেই প্রভা পিছিয়ে গেল। তার চোখে মুখে ভয়। সে কাঁপছে। ধরা গলায় বলল, “দয়া করে আমার কাছে আসবেন না।”
সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে গাড়ির দিকে এগোল প্রভা।

প্রভা আসলেই কাঁপছিল, ভয়ে কাঁপছিল। তার থেকে? অর্ক চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। তার হাতের মুঠোয় ছিলো সে ভাঙা কাঁচের চুড়িগুলো। মুঠোবন্দী করে জোরে চাপ দিতেই চুড়িগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

মেকানিক এসে গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছিলো। অর্ক বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। জানালা দিয়ে ভিতরে দেখছিল, প্রভা মাথা নিচু করে বসে ছিলো। হাতের যে স্থানে কেটে গিয়েছিল সে স্থান অন্য হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিল।

গাড়ি ঠিক হবার পর মেকানিককে টাকা দিয়ে বিদায় করে গাড়িতে উঠে বসলো অর্ক৷ প্রভার দিকে তাকিয়ে দেখল প্রভা অন্যদিকে সরে যাচ্ছে। দরজাতে বাহু ঠেকে পড়া সত্ত্বেও সে সরেই যাচ্ছে। অর্কের তখন কার উপর রাগ উঠছিল সে নিজেও বুঝতে পারছিল না। প্রভার উপর না তার নিজের উপর?

প্রভা ভয়ে তখনো কাঁপছিল। সে বুঝতে পারছে অর্ক ইচ্ছে করে তখন এমনটা করে নি, হয়ে গেছে। কিন্তু মনকে একবার ভয় কাবু করে নিলে তাকে তো বুঝানো যায় না। আর তার ভয় তো অহেতুক নয়, অতীতে এমন অনেক মার খেয়েছে সে। বিনয় শান্ত মাথার মানুষ ছিলো কিন্তু রাগ ছিলো ভয়ানক। রাগ উঠলে মার দিতো। বিয়ের পরেরদিন যখন প্রথম বিনয় তার উপর হাত তুলে সারাটারাত কেঁদেছিল সে। আদরে পোষা পাখি যখন এমন কটু বাস্তবতার মুখোমুখি হয় সহ্য করতে পারে না। তার আজও মনে আছে একদিন মার দেওয়ার পর যখন আলমারিতে মাথা লেগে তার মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল তখনও বিনয় একটি ছোট টেবিল উঠিয়ে নিয়েছিলো তাকে মারার জন্য। সেদিন তার ননদ ফাতেমা এসে তার ভাইকে ধরেছিল। সেদিন পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিলেন সেখানে আর কেউ এগিয়ে আসে নি।

এমনটা চলতে থাকে দশমাস। যখন সে দশমাসের গর্ভবতী তখন আস্তে আস্তে বিনয়ের আচরণ পাল্টাতে থাকে তার প্রতি। কিন্তু সে মার গুলো আজও সে ভুলতে পারে না। সে ভয় বুকে ঢুকে গেছে। আজও চোখ বন্ধ করে সে দিনগুলোতে মনে করতে বুক কাঁপে।

বিনয় তো ছিলো শান্ত স্বভাবের মানুষ তাতেই এত বড় কাজ করতে পারে আর অর্ক তো স্বভাবতই রাগী। তাকে দেখে সবাই ভাববে প্রচন্ড শান্তশিষ্ট অথচ তার রাগ উঠতে এক মুহূর্তও লাগে না। তার থেকে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিকও কিছু না।

প্রভা ভয়ে ভয়ে একপলক অর্কের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মুহূর্ত খানিকের পর আবার তাকালো চোখ দুটো বড় বড় করে। তার হাত দিয়ে সমানে রক্ত পড়ছে। হাতের রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার হাত দিয়ে, মিশে যাচ্ছে তার মেরুর রঙের পাঞ্জাবির সাথে। প্রভা আতঙ্কিত স্বরে বলল, “আপনার হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে সমানে।”

অর্ক উওর দিলো না। প্রভা হাত ধরতে নিলেই সে বলল, “তুমি আমার স্পর্শ থেকেও ভয় পাও তাহলে এখন কী হলো?”

প্রভা ভেজা কন্ঠে বলল, “আপনার হাত থেকে সমানে রক্ত ঝরছে।”

“ঝরতে থাকুক। তোমাকে যতটা ব্যাথা দিয়েছি আমিও পেয়েছি। হিসাব বরাবর। তাতে কী?”

“আপনি ব্যাথার হিসাব রাখছেন?”

“ব্যবসায়ী আমি। হিসাব রাখাটা আমার কাজ।”

“টাকা পয়সার। অনুভূতি বা সুখ দুঃখের নয়। গাড়ি থামিয়ে হাত দিন আমার কাছে। আমি দেখব।”

প্রভা আবারও হাতটা ধরতে নিলে অর্ক গাড়িটা থামাল সাথে সাথে। প্রভার হাত সরিয়ে তার বাহু আঁকড়ে ধরে বলল, “কী সমস্যা এত জ্বালাচ্ছ কেন?”

প্রভা ভেজা চোখে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অর্ক একবার হাত হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ হয়ে স্টেরিং এ জোরে এক ঘুষি মারল। আর সেখানে মাথা রেখে বলল, “তুমি আমাকে খুব বেশি জ্বালাও।”

প্রভা অর্কের রাগ দেখে আবারও ভয় পেল কিন্তু তবুও অর্কের সে হাতটা নিজের হাত নিল। পুরো হাতে কাঁচ ঢুকে পরেছে। মুহূর্তে শিউরে উঠলো সে। অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি এই কী অবস্থা করলেন নিজের হাতের?”

অর্ক উওর দিলো না। প্রভা বলল, “জলদি হাস্পাতালে চলুন।”

“প্রয়োজন নেই।”

“আছে। এখনই চলুন, নাহয় আমি এখনই গাড়ি থেকে নেমে কাওকে ডেকে আনব।”

অর্ক মাথা তুলে তাকালো প্রভার দিকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলিল, “তুমি আমার এত চিন্তা করছ কেন? তুমিই তো বলেছিলে এই সম্পর্ক শুধুমাত্র লোক দেখানোই থাকবে। এইখানে তো কেউ নেই তাহলে এত চিন্তা কেন?”

“মানবিকতা বলেও একটা কথা আছে। ইশশ আমি আপনার সাথে কথা বাড়াচ্ছি কেন? দ্রুত চলুন।”
অর্ক গাড়ি চালানো শুরু করতে নিলেই প্রভা তার শাড়ির আঁচলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এইটা হাতের নিচে রেখে দিন। প্রচুর রক্ত পরছে।”

হাস্পাতালে থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিল অর্ক। আর প্রভার হাতের যে অংশ কেটেছে সে অংশে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেস লাগিয়ে দিলো। অর্ক যখন ফেরার পথে গাড়ি চালাচ্ছিল তখন প্রভা চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করল, “আপনার হাতের ভিতরে কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল। যখন কাঁচ উঠাচ্ছিল আমিই ভয়ে শেষ আর আপনার মুখে একটা কষ্টের ছাপও দেখলাম না। আর এখন এত সহজে গাড়ি চালাচ্ছেন। আপনার ব্যাথা লাগে নি? আপনার জায়গায় আমি থাকলে কেঁদেই দিতাম।”

অর্ক তার চোখজোড়া সামনে রেখেই বলল, “তুমি একটু আগে বলেছিলে না আমি খুব ভাগ্যবান? জানো ছোট থেকে শুনে এসেছি ছেলেরা কাঁদে না। যত যাই হোক কাঁদে না। আমার মা’য়ের মৃত্যুতেও কাঁদতে পারি নি আমি। তুমি বলেছিলে বিনয়ের মৃত্যুতে তুমি কাঁদো নি বলে আশেপাশের লোকেরা অনেক কিছুই বলেছে। মা’য়ের মৃত্যুর পর যখন কাঁদছিলাম, বাবা আমাকে বলেছিল ছেলেরা কাঁদে না। কাঁদলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। আর ছেলেদের দুর্বল হতে নেই। যখন কান্না বন্ধ করলাম তখন লোকেরা পাষাণ বলতে শুরু করলো। বাবার খুব স্বপ্ন ছিলো আমায় নিয়ে। তার স্বপ্নগুলো আমার উপর চাপিয়ে দিলো। আমার স্বপ্ন ছিলো আর্মিতে ভর্তি হওয়ার। দেশের সেবা করার। হলো না। বাবার চাইতেন তার ছোট ব্যবসাটা আমি বড় করি। অনেক বড় করি৷ সে হিসেবে পড়াশোনা করতে শুরু করলাম। ভাদ্র বাবার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য সুস্থ ছিলো না আর সৈকতকে আমি আমার জীবন বাঁচতে দিতে চাই নি। দিন রাত ভুলে শুধু পড়তাম। কলেজে থাকতে যেখানে সব বন্ধুরা আড্ডা দিত আমি বাবাকে সাহায্য করতাম কাজে। এক সময় সে পরিশ্রমের ফলও এলো। আমাদের ব্যবসা অনেক বড় হলো। জানো সংগীত আমার ভীষণ পছন্দের ছিলো। সৈকত পিয়ানো বাজাতো ও আমি ভায়োলিন। আমার মা উপহার দিয়েছিলেন আমায়। মা নিজেই শিখাতেন। অনেক সুন্দর করে বাজাতেন তিনি। কিন্তু বাবার সে ধ্বনি শুনে বেশ কষ্ট হতো। মায়ের কথা মনে পড়তো। সে ভায়োলিন আজ কই জানি না।সৈকত আমাকে খুব মানতো ছোট বেলায়। আর আজ দুই চোখে সহ্য করতে পারে না। ওর দোষ দিব না। দোষ আমার ছিল। ওর ঢাল হয়ে কখনো ওর সামনে দাঁড়াতে পারি নি আমি। বাবার সামনে কিছু বলার কখনো সাহসই ছিলো না আমার। এমন না তাকে ভয় লাগতো শুধু তাকে কষ্ট দিতে চাইতাম না। আরেকটা কারণ ছিলো ওর দূর হওয়ায় ওর মা’কে কখনো মা’য়ের স্থান দেই নি আমি। এমন না দিতে চাইতাম না। যেদিন বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে সেদিন আমার খালা বলেছিল, ‘কখনো উনাকে মা মানবি না আর ডাকবি না। তোর মা মারা গেছে। ও শুধু তোদের দেখাশোনা করার লোক। কখনো নরম হবি না ওর সামনে। তুই যেদিন নরম হয়ে পড়বি সেদিন থেকে ও তোদের মাথায় চড়ে নাচবে। এই ঘরে তোদের মূল্য থাকবে না আর। তোর উপর শুধু নিজের না ভাদ্রের দায়িত্বও আছে। সবসময় মনে রাখবি ও তোর সৎ মা আপন মা না।’ আমি তাই মনে রাখলাম। এমন না যে সৈকতের মা আমাদের ভালোবাসে নি। অনেক বেসেছে কিন্তু খালার কথাগুলো আমি ফেলতে পারি নি। যদি হঠাৎ সে পাল্টে যায়? আমার যাই হোক ভাদ্রের কী?
একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম আমি। বেড়াতে গ্রামে গিয়েছিলাম। সে সকালে কুয়াশার চাদরে ঢেলে ছিলো চারপাশ। কিন্তু সে শীতের মাঝে বসন্তের হাওয়ার মতো ছিলো হাসি। ওর চোখদুটোয় ছিলো অজানা উষ্ণতা। ওর মাঝে এমন কী ছিলো আমি আজও বের করতে পারি নি। অতি সাধারণ ছিলো মেয়েটা, তবুও অসাধারণ। সে প্রথম প্রেম নামক পাখি মনের দরজায় টোকা দিয়েছিল অথচ সে পাখিটা কখনো রইলো না মন পাড়ায়। পি এইচ ডি করতে গিয়েছিলাম সেখানে যেয়ে শুনি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। সেদিনও কাঁদি নি। নিজেকে দুর্বল করার মতো সাহস ছিলো না আমার। এরপর অনেক মেয়ে এলো গেল আমার জীবন থেকে কাউকেই ভালোবাসতে অয়ারি নি। না ভালোবেসে সম্পর্কেও জড়াই নি।
তারপর আমার জীবনে এলো নূহা। ও আমাকে পাল্টে দিলো। সে মেয়েটাকে ভুলাতে সাহায্য করলো। আবারও ভালোবাসতে সাহায্য করল কিন্তু ওকে ভালোবাসার পর ও নিজেও চলে গেল আমার জীবন থেকে।”

অর্ক কথাগুলো বলে তাকাল প্রভার দিকে। গাড়িতে ব্রেক কষলো। প্রভা কাঁদছে। সে প্রভার দিকে ঝুঁকে আলতো হাতে প্রভার গালের নোনাজল মুছে দিলো আর চোখে চোখ রেখে বলল, “সবারই গল্প থাকে। কারও জানা তো কারও অজানা। সবার জন্য তুমি কাঁদতে পারবে না তাই আমার জন্যও কেঁদোনা।”

অর্ক সরে এলো। সামনে তাকিয়ে আবারও গাড়ি চালু করে বলল, “একটা কথা বলি?”

প্রভা ভেজা কন্ঠে বলল, “বলুন।”

“তোমার চোখদুটো ভীষণ সুন্দর, মায়াময়।”

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-১৩ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1200499080319669/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here