মন_পাড়ায় পর্ব_১৫

মন_পাড়ায়
পর্ব_১৫
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

প্রভা ভেজা কন্ঠে বলল, “বলুন।”

“তোমার চোখদুটো ভীষণ সুন্দর, মায়াময়।”
প্রভা আড়চোখে একবার অর্কের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। চোখজোড়া নামাতেই তার চোখ আটকে গেল নিজের রক্তভেজা শাড়ির আঁচলে। সে মৃদু কন্ঠে বলল, “আপনার নিজের রাগ কমানো উচিত। রাগের মাথায় আমরা কখন কী করে ফেলি তা নিজেও বুঝতে পারি না।”

“তুমি কীভাবে জানো? তোমাকে আমি কখনো রাগে দেখি নি।” পরের মুহূর্তে আবার অর্ক বলল, “ওহ–দুইবার দেখেছি।”

প্রভা হেসে বলল, “ঝিনুকের রাগ প্রচুর। ও রাগের মাথায় কখন কী করে নিজেও জানে না। পরে অনুতাপ করে।”

” আমি কখনো ওকে রাগে দেখি নি।”

প্রভা হেসে দিলো। বলল, “ও রাগের মাথায় একবার আপনার উপর গরম চা ঢেলে দিয়েছিলো।”

অর্ক চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো প্রভার দিকে। বলল, “ওয়েট, তোমাদের বাসায় যখন আমি গিয়েছিলাম একটা বাচ্চা আমার উপর চা ঢেলে দিয়েছিল শুধুমাত্র আমি ওকে ‘বাচ্চা ছেলেটা দেখি অনেক কিউট’ বলে গাল টেনে দিয়েছিলাম এইজন্য। আমি বুঝেছিলাম ও কোনো ছেলে। ওই বাচ্চা—মানে মেয়েটা ঝিনুক ছিলো।”

প্রভা এবার খিলখিল করে হেসে দিলো। অর্ক প্রভার দিকে তাকালো। প্রভার হাসিটা অদ্ভুত দারুণ। ঠিক বসন্তের ভোরের মতোই মুগ্ধতার ছায়া সে হাসিতে। বসন্তের সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গে কোকিলের ‘কুহু’ ডাকে আর সকালের বাতাসের সাথে ভেসে আসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ। তখন একরাশ মুগ্ধতা এসে যেমন কাবু করে মনকে তেমনি মোহমুগ্ধময় মেয়েটার হাসি।
.
.
ঝিনুক রুমে এসে দেখে সৈকত বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটি ছবি দেখছে। সে পাত্তা না দিয়ে নিজের ফোন নিয়ে বারান্দায় যেতে নিলো। তখনই সৈকত বলে উঠলো, “তুমি যে আগে টম বয়ের মতো থাকতে কখনো বলো নি কেন?

ঝিনুক থেমে গেল। পিছনে তাকালো বড় বড় চোখ দুটো করে। সৈকত শব্দ হেসে বলল, “আমি ছবিটা দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এইটা তুমি। আমি তো আকাশ থেকে পড়েছিলাম যেন। আগে এসে আমি তোমার সাথে খেলতাম সম্ভবত। তখনও বুঝি নি। তোমাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম ছেলেটার কথা তুমিও কিছু বলোনি। আমিও তো বলি ছেলেটা কোথায় গেল আর হঠাৎ করে এই মেয়ে কীভাবে আসলো? এখন বুঝতে পারছি।”

ঝিনুক সৈকতের সামনে যেয়ে ছবিটা নিতে নিলেই সৈকত হাত পিছনে সরিয়ে ফেলল। সৈকত বলল, “আজকে খালামণি এলবাম না দেখালে তো জানতেই পারতাম না। বুঝার উপায় ছিলো না তুমি ছেলে না মেয়ে। শার্ট, প্যান্ট, চুলও ছেলেদের মতো। হঠাৎ করে কী জাদু ছড়ি ঘুরলো যে এমন পরী হয়ে গেলে।”

“বিরক্ত কর না তো। ছবি দেও।” ঝিনুক ছবি ফেরত নিতে নিলেই সৈকত ঝিনুকের পিঠে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে নিলো। ঝিনুক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এখন কোনো লুইচ্চামি করলে মাথা ফাটায় দিব।”

“আমার প্রেমকে লুইচ্চামি বল কেন জান? বুকে লাগে তো।”

“তাই না? লাগাচ্ছি দাঁড়াও।” বলেই ঝিনুক কতগুলো ঘুষি মারতে শুরু করল সৈকতের বুকে।

“হ্যাঁ দেও দেও আরাম লাগছে। ম্যাসাজ হয়ে যাচ্ছে ফ্রীতে।”

ঝিনুক আরও জোরে মারতে শুরু করল। সৈকত ঝিনুকের এক হাত ধরে বলল, “এমন নরম তুলতুলে হাত দিয়ে মারলে আমি ব্যাথা পেতে পারি জান? আরও আরাম লাগে।”

ঝিনুক বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখ ফুলিয়ে বলল, “জাহান্নামে যাও।”

“যেখানেই যাই না কেন তোমাকে নিয়ে যাব।”

“বিরক্তিকর!”
ঝিনুক বিছানার অপর প্রান্তে যেয়ে বসলো। সৈকত আবারও জিজ্ঞেস করল, “না সিরিয়াসলি, হঠাৎ করে একবছরে এমন পরিবর্তন হলো কীভাবে?”

ঝিনুক ঝাঁজালো গলায় বলল, “জানি না। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো হঠাৎ কী যেন হলো পরীশ ভাইয়া ছোট মা’কে বলল আমি যেন মেয়েদের মতো চলাফেরা করি। সাথে এলাকার সবার সাথে খেলাধুলাও বন্ধ করিয়ে দিলো। আমি আগে ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন ছিলাম বুঝলে? কিন্তু ভাইয়া পরে আর খেলতে যেতে দিত না।”

হঠাৎ করে সৈকতের মুখের ভাব ভঙ্গি পাল্টে গেল। সে ছবিটা ঝিনুকের পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো। বারান্দায় যেতে নিলো। আবার হঠাৎ দাঁড়ালো। ঝিনুকের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, “তোমার খবিশ ভাই কী জানে তোমার বিয়ের কথা?”

“ভাইয়ার নাম পরীশ। উল্টাপাল্টা কিছু বললে আগামীকাল খবরের কাগজের হেডলাইন থাকবে ‘স্ত্রী করল স্বামীকে হত্যা, কারণ স্বামী ছিলো বদমাশ, শয়তান, —–” সৈকত ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে তার কথা কেটে বলল, “প্রথমত, এমন হেডলাইন শুনে মনে হচ্ছে জার্নালিজম পড়া ছেড়ে দেই৷ আর দ্বিতীয়ত, তুমি উওর দিতে পারবে কেন তোমার প্রিয় ভাই জানে না তোমার বিয়ের কথা?”

“খালু মানা করেছে তাই।”

সৈকত বুকের উপর তার হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করল, “আর তা কেন?”

ঝিনুককে একটু বিভ্রান্ত দেখাল। কিন্তু সে নিজেকে সামলে অসংশয়িত ভাবে বলল, “সম্ভবত ভাইয়াকে টেনশন দিতে চাইছিল না। এমনিতে প্রভা আপুকে নিয়ে চিন্তায় ছিলো।”

“কিন্তু প্রভা ভাবির বিয়ের কথা তো সে জানে।”

“আমার বিয়ে হঠাৎ করে ডিসাইড হয়েছিল তাই।”

সৈকত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার সমস্যা কী জানো? তুমি তাই বুঝো আর মেনে চলো যা তুমি বুঝতে চাও আর মানতে চাও। তোমার সামনে সব পরিষ্কার থাকলেও তুমি তাকে ঘোলাটে করে নেও নিজ থেকেই।”

ঝিনুকের রাগ উঠলো প্রচন্ড। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ যেমন তোমার বিশ্বাস ঘাতকতা আমার চোখে পড়ে নি। তোমার মতো জঘন্য মানুষের প্রেমে পড়ে নিজের সময় নষ্ট করেছি যে একটা মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করে তাকে ফালিয়ে রেখে চলে গেছে। আমার সাথেও তোমার এমনটাই করার ইচ্ছা ছিলো তাই না? আর পরীশ ভাইয়াকে তুমি দেখতে পারো না কারণ সে তোমার প্লান নষ্ট করে দিয়েছে।”

সৈকত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। সে চোখ বন্ধ করে এক ছোট নিশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে গেল।

ঝিনুক সাথে সাথে বসে পরলো। দুই হাতের কনুই হাঁটুর উপর ভার দিয়ে কপালে হাত রাখলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরের মুহূর্তে পাশের টেবিলে থাকা কাঁচের গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে।
.
.
প্রভা আসার পর থেকেই তার ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত। সারাটাদিন তাদের দেখে নি তাই এসেই তাদের কাছে চলে গেল। একদম রাতে তাদের ঘুম পারিয়ে এলো। এসে অর্কের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি না’কি মা’কে বলেছেন আপনি রাতে খাবেন না?”

অর্ক কাজ করছিল ফোনেই। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে প্রভা মুখটা ক্লান্তিতে ভরে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, “তোমার এই অবস্থা কেন?”

“অনুষ্ঠানের বাহানা পেয়ে অদিন এই কয়দিনে কোনো পড়াশোনাই করে নি। ওকে পড়াশোনা করানো ও যুদ্ধ করা একই কথা। যেহেতু বাচ্চা তাই ধরে ধরে শিখাতে হয়।”

“ওহ।” অর্ক আবার কাজে মনোযোগ দিলো। প্রভা আবারও বলল, “খাবার খেয়ে নিন। আসুন।”

অর্ক এইবার রাগান্বিত স্বরে বলল, “মেজাজ খারাপ করবে না প্রভা। বলেছি তো খাব না। আর কাজ করছি দেখতেই পারছ তাও এসে তোমার মাঝখানে কথা বলতেই হবে। যাও তো এইখান থেকে।”

প্রভা কিছু বলল না। মাথা ঝুঁকিয়ে এগিয়ে এলো। আলমারি থেকে একটি শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে নিলেই থেমে যায়। পিছনে ফিরে একপলক তাকিয়ে দেখে অর্ক শুধু বাম হাত দিয়ে মোবাইলে কাজ করছে। তার ডান হাতে আজ ব্যাথা পেয়েছে, ব্যান্ডেজ করা। তার মাথা থেকেই চলে গিয়েছিল ব্যাপারটা। সে ছোট এক নিশ্বাস ফেলে ভিতরে ঢুকলো। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য গোসল করে নিলো। বাহিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝাড়তে শুরু করল।

অর্কের মন তো কাজেই ছিলো কিন্তু প্রভা যখন খোলা চুলে বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে তখন তাকে দেখেই তার সব মনোযোগ যেন মুহূর্তে উড়াল দেয়। এমনটা আগে কখনো হয় নি।

সে কাজ বাদ দিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রভার দিকে। প্রভা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝাড়ছিল। আর সে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রভাকে দেখছি। সে তো চায় নি প্রভা যেন তাকে এমন বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখুক। এতে তার ভাব হাওয়ায় মিশে যাবে না বুঝি?
তবুও তার চিন্তার বিপরীতটা ঘটল।

প্রভা চুল মুছতে মুছতে আয়নার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। আয়নায় দেখা যাচ্ছে অর্কের প্রতিচ্ছবি। অর্ক তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার তাকানো দেখেই বোধহয় সে চোখ ফিরিয়ে নিলো বা হয়তো হঠাৎ করে এদিকে তাকিয়েছিলো আর তখনই প্রভাও তাকালো। প্রভা ভাবছে, হয়তো তারই ভুল অর্ক কেন তার দিকে তাকিয়ে থাকবে?

প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় তোয়ালে মেলে দিয়ে বাহিরে চলে গেল রুমে। ফিরে এলো এক প্লেটে খাবার নিয়ে। এসেই অর্কের পাশে বসে বলল, “আপনি একটু সোজা হয়ে বসুন। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

অর্ক সে রাগান্বিত ভাব নিয়েই তাকালো প্রভার দিকে। বলল, “আমি তোমাকে বলেছি?”

“আপনার হাতে ব্যাথা পেয়েছেন।”

“চাইলে তো চামচ দিয়েই খেতে পারতাম তাই না? আমার খিদে নেই তাই খাই নি। যাও এইখান থেকে।”

অর্ক এমনটা বললেও প্রভা এক লোকমা বিরিয়ানি এগিয়ে দিলো তার দিকে। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটি হাসি নিয়ে বলল, “তাও অল্প একটু খেয়ে নিন।”

অর্ক যদিও বকা দেওয়ার জন্য মুখ তুলেছিলো কিন্তু এমন মিষ্টি হাসি দেখে তার মন গলে গেল। সে এক ঢোক গিললো। মনের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো যে মোটেও সে এই মেয়ের হাসিতে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাবে না। সে পরাজিত হয়, জিতে যায় তার মন। আনমনেই উঠে বসে প্রভার হাত থেকে খেতে শুরু করল।

অদ্ভুত এক ব্যাপার আছে এই মেয়েটার মাঝে। যা তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যায়। নিজের থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে। তার জীবনের সব প্রথম ভুলের কারণটি বোধহয় এই মেয়েটিই।

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-১৪ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1201247803578130/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here