মন_পাড়ায়
পর্ব_১৬
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
অদ্ভুত এক ব্যাপার আছে এই মেয়েটার মাঝে। যা তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যায়। নিজের থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে। তার জীবনের সব প্রথম ভুলের কারণটি বোধহয় এই মেয়েটিই।
খাবার শেষ হওয়ার পর প্রভা প্লেট নিয়ে উঠে যেতে নিলেই অর্ক বলল, “আরেকটু খাব।”
তার খিদে মোটেও ছিলো না। কিন্তু প্রভা নিজ হাত থেকে আরেকটু খেতে ইচ্ছে করছিল তার। তার মায়ের মৃত্যুর পর এই প্রথম সে কাওকে নিজের যত্ন নিতে দিচ্ছে।
প্রভা গেল আরেকটু খাবার আনতে।
কিছু মুহূর্তে গড়াতেই অর্ক দেখে বিনয়ের মা’য়ের কল আসছে। সে প্রতিদিন একবার হলেও রাত নয়টার মধ্যে তাকে কল দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। আজ ভুলেই গিয়েছিল সে। কল ধরে সালাম দিলো। ওপাশ থেকে বিনয়ের মা বললেন, “বাবা আজ কী এই মায়ের কথা ভুলে গিয়েছিলে?”
অর্কের নিজের প্রতি অপরাধবোধ হচ্ছিলো। বিনয়ের মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত অর্ক তাদের খোঁজ নিতে ভুলে নি অথচ আজ ভুলে গেল? সে ইতস্তত করে বলল, “খালা মাফ করে দিয়েন আসলে একটু প্রভার আত্নীয়দের বাসায় যেতে হয়েছে তো তাই।”
“ওহ বাবা বুঝেছি। তুমি কত কষ্ট করছো আমার ছেলের অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। সাবধানে থেকো বাবা ওই মেয়েটাকে যত ভালো দেখা যায় ততটা ভালো না।” কাঁদোকাঁদো কন্ঠে আবার বলল, “আমরাও তো এক নমনীয় মেয়েই এনেছিলাম, বছর না গড়াতেই তার আসল রূপ দেখানো শুরু করে দিলো। আমাদের এত গোছালো পরিবারকে এলোমেলো করে দিলো। পুরো এলাকা জানে ওর অত্যাচারের কথাগুলো। বলেছিলাম যৌথ পরিবার ভালো না লাগলে আলাদা হয়ে যেতে তাও যেন আমার ছেলেটা সুখে থাকে। তাও হলো না। একা থাকলে তো কাজ করতে হবে। সব কিছু ঠিক ছিলো বাবা, সব সহ্য করেছি। পরে যেয়ে আমার ছেলেটার নামে কলঙ্ক লাগিয়ে দিলো। বিনয় তো তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু তুমি তো চেনো ওকে। কোনো মেয়ের পিছনে ঘুরেছে কখনো? আর অবশেষে আমার ছেলেটাকে আমার থেকে এত দূরে নিয়ে গেল। আমার ছেলেটা চলে গেল পিছনে ফালিয়ে গেল এত বড় পরিবার। সারাক্ষণ চিন্তা আর চিন্তা। ফাতেমার বিয়ে কীভাবে দিব সে চিন্তাতেই ঘুম হয় না। আমার ছেলেটা থাকলে এত চিন্তা করতে দিত আমাকে?” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো বিনয়ের মা।
অর্ক তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “খালা আমিও তো আপনার ছেলের মতো। আর ফাতেমার বিয়ের চিন্তা কেন করছেন? আমি তো বলেছি আপনাকে ওর বিয়ে আমি দিব। আপনি এইসব নিয়ে চিন্তা করেন না।”
“তোমার দয়াতেই তো বেঁচে আছি বাবা, নাহয় বিনয় যাওয়ার পর—-” এতটুকু বলেই আবারও কেঁদে উঠলো বিনয়ের মা।
অর্ক বলল, “খালা কান্না করা বন্ধ করুন। বিনয় থাকলে অবশ্যই আপনাকে কান্না করতে দেখে কষ্ট পেত। প্লিজ খালা কাঁদবেন না।”
“আচ্ছা বাবা তুমি এখন আরাম কর তাহলে।”
“খালা একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো। প্রভা কোন ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করেছে? না মানে ওর সম্পর্কে কিছু তথ্য লাগতো।”
“বাবা আমি তো এইসবের খোঁজ খবর রাখি না। কিন্তু ও ওদিকের ভার্সিটির কথাই তো বলতো। সেখানে যাওয়ার কথা বলেছিলাম একবার। যে আজেবাজে কথা বলা শুরু করেছিল আমার কান থেকে রক্ত বের হওয়াটা শুধু বাকি। ওসব আর শুনতে পারি নি তাই আর জিজ্ঞেস করি নি কখনো। ওর জীবন ও নিজের মতোই চলতো।”
“ওহ, আচ্ছা ঠিকাছে খালা। আপনি ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।”
“ঠিকাছে বাবা।”
অর্ক ফোন রেখে দিলো। চোখ বন্ধ ঘাড়ে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলো। সে বুঝতে পারছে না কী করবে? একদিকে প্রভা অন্যদিকে বিনয়, নূহা ও তাদের পরিবার। যাদের সাথে তার অনেক বছরের পরিচয়। আর প্রভা—-তার সাথে তো বিয়েটাও তাদের জন্য করা। তাহলে কেন তার পথ থেকে সরে যাচ্ছে সে?
কেন?
প্রভা এসে তার পাশে আবারও বসলো। বলল, “খাবার নিয়ে এসেছি। মুখটা তুলুন, খাইয়ে দিচ্ছি।”
“আমি খাব না। তুমি এইখান থেকে যাও।”
“কিন্তু আপনিই তো বলেছেন খাবেন। একটু খেয়ে নিন।”
“বলছি না যাও এইখান থেকে।”
“কিন্তু—–” এর পরে কিছু বলতে যাবে আর অর্ক হাত দিয়ে খাবারের প্লেটটা ফেলে দিলো। আবারও চিৎকার করে বলল, “মানা করেছি কানে যায় না? আমার সামনে এইসব নাটক করতে আসবে না। যাও এইখান থেকে।”
প্রভা ঠিক বুঝতে পারলো না হঠাৎ কী হলো অর্কের। সারাটাদিন তো ঠিকই ছিলো। সে দুর্ঘটনার পর আজ প্রথম অর্ক তার সাথে ভালোভাবে কথা বলছিলো। তাহলে আবার হঠাৎ করে কী হলো?
“আপনার কী হয়েছে? ঠিকাছেন?” প্রভা মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো। অর্ক তার হাতটা জোরে আঁকড়ে ধরলো। বলল, “তুমি আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়ে জিজ্ঞেস করছ আমি ঠিকাছি কি’না? না ঠিক নেই কারণ তুমি আমায় ঠিক থাকতে দিচ্ছো না। তুমি আমাদের কারও জীবনে না থাকলে কোনো সমস্যাই হতো না। আজ বিনয় ও নূহা দুইজনই আমার কাছে থাকতো। তুমি সব বরবাদ করে দিয়েছ, সব। দয়া করে আমার চোখের সামনে আর এসো না।”
অর্ক প্রভার হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
প্রভা তার হাতের দিকে তাকালো। ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ একটু আগে খুলে ফেলেছিল, সে কেটে যাওয়া স্থান থেকে আবার একটু রক্ত বের হচ্ছে। যা সে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে উঠে সামনে গেল। মেঝের উপর থেকে খাবার উঠাতে শুরু করল প্লেটে। সে তার কাজ করতে করতে বলল, “রাগ কখনো খাবারের উপর দেখাতে নেই। এই পৃথিবীতে হাজারো মানুষ দু’বেলার খাবার পায় না। আপনি নিজেও আজ বলেছিলেন এই পর্যায়ে আসতে কষ্ট করেছেন। এই কষ্ট সে কষ্ট থেকে অনেক বেশি। খাবারের অনাদর করতে নেই। এইটা আল্লাহর দান।”
প্রভা প্লেটটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। এসে ফ্লোর মুছে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল। সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আজ অর্ক তাকে আর ডাকল না।
প্রভা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো। সে ভেবেছিলো সে অদিন ও বিনুক কাছে ঘুমাবে অথচ মা তাদের সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে। মা’য়ের যদি একটুও সন্দেহ হয় যে তার ও অর্কের মাঝে কিছু সমস্যা আছে তাহলে চিন্তা করে করে নিজের শরীর খারাপ করবে। তাই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো।
অর্ক এপাশ ওপাশ হচ্ছিলো শুধু। তার ঘুম আসছিলো না মোটেও। চোখ বারবার যাচ্ছিলো বারান্দার দিকে। আবার ঘড়ির দিকে। বারোটার বেশি বাজে, তারপরও মেয়েটা আসছে না। এতক্ষণ ধরে কী করছে বারান্দায়?
অর্ক যাবে না যাবে না বলে উঠে পড়লো। বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “সমস্যা কী ঘুমাতে আসছ না কেন?”
প্রভা পিছনে ফিরল। বিস্মিত দেখালো তাকে। সে বলল, “আপনিই তো বললেন আপনি আমাকে দেখতে চান না। অদিন ও বিনুর সাথে মা ঘুমাচ্ছে, অন্যকোথাও জায়গা নেই তাই এইখানে দাঁড়িয়ে আছি।”
অর্ক কী বলবে বুঝতে পারলো না। কেউ বিশ্বাস করবে এই মেয়েটাই কতগুলো জীবন নষ্ট করেছে? অন্যকেউ কেন তার নিজেরও মাঝেমধ্যে বিশ্বাস হয় না। বহু কষ্টে নিজেকে বিশ্বাস দেওয়াতে হয়।
অর্ক জিজ্ঞেস করল, “তুমি তাহলে চিন্তা করেছ সারারাত এইখানে কাটাবে না ঘুমিয়ে?”
“আমার সাধারণত ঘুম বেশি হয় না। তিন থেকে চার ঘন্টা হয়। আবার মাঝেমধ্যে ঘুমই হয় না। তাই আমার সমস্যা নেই।”
“এইটা কোনো ভালো লক্ষ্মণ না সে এমন হেসে বলছ। বাসায় যেয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। এখন ঘুমাতে আসো।”
প্রভা কথা না বাড়িয়ে অর্কের পিছনে রুমে গেল। দুইজন দুইদিকে পিঠ করে শুয়ে পড়ল। প্রায় দশ মিনিট পর অর্ক প্রভার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, “তোমার ঘুমের সমস্যা কবে থেকে?”
প্রভার উওর এলো না। অর্ক আবারও জিজ্ঞেস করল, “ঘুমিয়ে পড়েছ?”
প্রভার মৃদু কন্ঠে উওর দিলো, “না।”
“তাহলে উওর দিচ্ছো না কেন? কবে থেকে এই সমস্যা?”
প্রভা সাথে সাথে উওর দিলো না। কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে উওর দিলো, “যখন থেকে রাতের নিরবতায় আর শান্তি খুঁজে পাই না।”
অর্ক আর কোনো প্রশ্ন করল না।
.
.
সৈকত বারান্দা থেকে এসে দেখে ঝিনুক বিছানার এক কোণে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে। সে কিছু না বলে মেঝে থেকে কাঁচের টুকরোগুলো পরিষ্কার করে নিলো। তারপর ঝিনুকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “সরি পরী আমার তোমার সাথে এইভাবে কথা বলাটা উচিত হয় নি। প্লিজ মাফ করে দেও।”
সৈকত একহাত দিয়ে ঝিনুকের হাত ধরতেই ঝিনুক এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে ফেললো। ভেজা গলায় বলল, “তুমিও আমার বাবার মতো। পার্থক্য এতটুকুই তাকে আমি ঘৃণা করি কিন্তু তোমাকে ঘৃণা করতে পারি না। এইজন্য নিজের প্রতি ঘৃণা হয় আমার।”
সৈকত কিছু না বলে উঠে লাইট বন্ধ করে নিলো। এরপর আবারও বিছানায় উঠে ঝিনুকের হাত ধরলো আর ঝিনুক দ্বিতীয়বার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে নিলো।
তৃতীয়বার। চতুর্থবার। পঞ্চমবার।
ষষ্ঠবার আর বাঁধা দিল না। সৈকত ঝিনুকের হাত ধরে তাকে বুকে টেনে নিলো। তাকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। ঝিনুক এইবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। সে ভেজা গলায় বলল, “আমি তোমাকে খুব করে ঘৃণা করতে চাই কিন্তু পারি না কেন?”
সৈকত ঝিনুকের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। মৃদু হেসে বলল, “ভালোবাসো যে তাই।”
ঝিনুকের পিঠে হাত রেখে তাকে আরও কাছে টেনে নিলো সৈকত। ঝিনুক বাঁধা দিল না, তাকে ফিরে জড়িয়েও ধরলো না। শুধু তার কান্না বাড়তে থাকলো সময়ের সাথে।
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
পর্ব-১৫ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1202804286755815/