মন_পাড়ায় পর্ব_১৭

মন_পাড়ায়
পর্ব_১৭
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

পরেরদিন রাতে, ঝিনুক বসে ছিলো সেই ছাদের ছোট পুকুরের সিঁড়িতে বিষন্নতা নিয়ে। তার পায়ে আলতা মাখা। সে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। আবারও পা ডুবিয়ে দিবে সে এই জলে। আলতা মিশে যাবে জলের সাথে। সে জলে পায়ের পাতা জলে ডুবাতে নিবে আর সৈকতের কন্ঠে থেকে গেল, “কী করছ?”

ঝিনুক চোখ তুলে তাকালো। আকাশের জ্যোৎস্নায় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সৈকতকে। সে কমলা রঙের সোয়েটার পরে আছে, তার উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণে এই রঙ মানিয়েছে বটে কিন্তু তার কাছে সৈকতকে সাদা রঙে ভালো লাগে। ভালো লাগে বললে কম হবে। যখনই আগে সে সাদা রঙের শার্ট পরে তার সামনে আসতো সে নিজেই বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতো সৈকতের দিকে। তার মনে হয়, এত কিছুর পরও যদি সৈকত এখনো সাদা রঙের শার্ট পরে তাহলেও সেভাবেই বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকবে।

সৈকত আবারও জিজ্ঞেস করল, “কী করছ?”

“তোমাকে বলার প্রয়োজনবোধ করি না।”

সৈকত এসে বসলো ঝিনুকের সামনে। বলল, ”
জাদুময় প্রেমের ধ্বনি
তোমার আলতা মাখা চরণ দেখিয়া হয় প্রাণ হানি।
এই কথাটা বলেছিলাম তোমাকে কয় বছর আগে। তাই বলে বারবার আলতো মেখে জলে ভেজাও তাই না? লাভটা কী হয়?”

“আমার মাঝে তোমার পছন্দের সব কিছু নিজের চোখে মিটতে দেখে তৃপ্তি পাই আমি।” বলেই ঝিনুক জলে পা ডুবিয়ে দিলো।

জলে ভিজে যখন আলতা উঠে গেল তখন সে পা উঠিয়ে বলল, “আবারও মিটিয়ে দিলাম। সাথে মিটাতে চাই তোমার স্মৃতিগুলোও।

সৈকত মৃদু হাসলো। মাথা ঝুঁকিয়ে আলতো করে চুমু খেল ঝিনুকের পায়ে।
সাথে সাথে ঝিনুক চোখ বন্ধ করে নিলো আবেশে।
সৈকত বলল, “তোমার সবটাই আমি ভালোবাসি। ভালো, খারাপ সব। তুমি নিজেকে মিটিয়ে দিলেও আমি তোমাকেই ভালোবাসবো।”

ঝিনুকের বুকের মাঝারে আজব এক শিহরণ উঠলো। সে জানে কথাগুলোর মূল্য শূন্য। সৈকতের কাছে হয়তো কথাগুলো বলাটা সহজ, কিন্তু তার কাছে অনেক মূল্যবান। সে জানে, মানে, বুঝে কিন্তু মনটার কী? এই মন তো বুঝতে চায় না। এই মানুষটা যে তার মন পাড়ায় সম্পূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে।

ঝিনুক পা সরিয়ে নিলো। উঠে যেতে নিলেই সৈকত বলল, “ইকবাল কল করেছিলো, আগামীকালই ভার্সিটির কোনো কাগজে তোমার সই লাগবে। আমাদের আজই বের হতে হবে। প্রভা ভাবিরা আগামীকাল বা পুরশু আসবে। তৈরি হয়ে নেও। রাতের খাবার খেয়েই রওনা দিব।”
ঝিনুক কিছু না বলেই চলে গেল।

সৈকত পুকুরটার দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

রাতের নয়টার দিকে সৈকত ও ঝিনুক বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলো। একটা রিকশায় ঠিক করলো। ঝিনুক শুধু নিজের ব্যাকপ্যাকটা নিলো। তার কাপড়-চোপড় সব প্রভা আসার সময় নিয়ে আসবে। খালু তাদের বাসস্ট্যান্ডে ছাড়তে যেতে চেয়েছিলো সৈকতেই মানা করে দিলো। তার থেকে বিদায় নেওয়ার পর বাহিরে এলো। ঝিনুকও বিদায় নিলো। বাহিরে এসে দেখে প্রভা ও অর্ক দাঁড়িয়ে আছে। প্রভা সৈকতকে বলল, “পৌঁছে গিয়েই কল কর আর ঝিনুকের খেয়াল রেখ।”

ঝিনুক বলল, “আপু আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি। আমার আর বাচ্চা না।”

প্রভা হেসে ঝিনুকের গালে হাত রেখে বলল, “এত বড়ও তো না।” আবারও সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও শীত লাগলেও না সোয়েটার পরে, আর না শাল জড়িয়ে নেয়। আরও জানালা খুলে রাখে এরপর ঠান্ডা লেগে যায়। এমনটা করতে দিও না।”

“জানি ভাবি। আপনার বোন অনেক জেদি। আপনি বলে দিন পরে তো আমার কথা শুনবে না। একবার জ্বর উঠলে এক সাপ্তাহের আগে তো কমে না আরও মুখ পুরো লাল হয়ে যায়। আরও ঔষধ খেতেও ওর হাজারো অজুহাত।”

প্রভার হাসিটা উড়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল, “তুমি কীভাবে জানো? বিয়ের আগে তো তোমার সাথে দেখা হওয়ার সময় তো ও কখনো অসুস্থ ছিলো না।”

সৈকতকে অস্বস্তিতে ভুলতে দেখা গেল। ঝিনুক ভীতিকর দৃষ্টিতে একবার সৈকতের দিকে তাকিয়ে আবার প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি বলেছি আপু।”

“ওহ আচ্ছা। সাবধানে থাকিস কিন্তু।” ঝিনুককে বলে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর তুমিও। ওর খেয়াল রাখতে যেয়ে নিজের খেয়াল নিতে ভুলবে না।”

সৈকত একগাল হাসি নিয়ে বলল, “যা হুকুম আমার ভাবি।”
প্রভা হাসলো।

অর্ক সৈকতের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমি বলেছিলাম তোদের বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে আসি শুনলি না তো।”

সৈকত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার অর্কের হাতের দিকে তাকালো। নিজে পিছিয়ে গেল। কাঠখোট্টা কন্ঠে বলল, “আপনার আমাদের কথা চিন্তা করতে হবে না। আমরা এখন আর ছোট নেই যে আমাদের দিয়ে আসতে হবে।”

ঝিনুক বলল, “এইটা কোন ধরনের কথা সৈকত?”

সৈকত উওর না দিয়ে উঠে রিকশায় বসলো। বলল, “দেরি হয়ে যাচ্ছে উঠে আসো, পরে বাস ছুটে যাবে।”

ঝিনুক অর্ককে বলল, “জিজু আপনি আমার আপিকে সময় দিন বুঝলেন, আমরা একাই যেতে পারব।”
অর্ক জোরপূর্বক হাসলো। এরপর ঝিনুকের খালামণি এলো। জোর করে তাদের কিছু খাবার ধরিয়ে দিলো রাস্তার জন্য। বিদায় নিয়ে চলে গেল সৈকত ও ঝিনুক।

প্রভার মা বলল, “আল্লাহ আমি চুলা জ্বালিয়ে রেখে এসে পড়লাম।” বলেই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।

অর্ক বাসার ভিতরে যেতে নিলেই প্রভা বলল, “আজকের রাতটা ভীষণ সুন্দর। সামনেই অনেক সুন্দর একটা জায়গা আছে। সকালে তা ভীষণ সুন্দর লাগে, রাতে কখনো দেখি নি। আমার সাথে যাবেন একটু?”

“রাতেও তোমার এইসব শেষ হয় না? রাতের অন্ধকারে তুমি কী দেখবে? আমি কোথাও যেতে পারব না। বাসার ভিতরে যাও।”

প্রভার মুখ মলিন হয়ে গেল। সে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল, “ঠিকাছে।” আর মেইন গেইটের ভিতরে ঢুকলো।

অর্কের প্রভার এমন মলিন মুখটা অপছন্দ হলো। সে নিজেকে বহু আটকানোর চেষ্টা করলো। যাই হোক ডাকবে না—ডাকবে না সে প্রভাকে। তবুও লাভ হলো না। প্রভা যখন দরজার কাছে অর্ক তখনই ডাক দিলো, “প্রভা……”

প্রভা ফিরে তাকালো। অর্ক রাস্তার দিকে চোখ রেখে ঘাড়ে এক হাত দিয়ে আমতা-আমতা করে বলল, “আন্টিকে বলে আসো তুমি আমার সাথে সামনে ঘুরতে যাচ্ছ।”

“সত্যি?”

অর্ক তাকালো প্রভার দিকে। প্রভার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে আছে। প্রভাকে এই মুহূর্তে কোনো কিশোরীর মতো লাগছে। এতটুকু কথায় এত আনন্দ কেউ পায় তার জানা ছিলো না। সে নিজে বড় বড় খুশিতেও এত আনন্দ পায় না। প্রভার খুশি দেখে তার নিজের ঠোঁটের কোণে হাসিও এঁকে এলো। সে বলল, “হ্যাঁ। দেখ তো বিনু আর অদিন আসবে না’কি?”

“আমি এক্ষুনি আসছি।”

অর্ক নিজেও বুঝতে পারলো না কেন প্রভার হাসিটা এত গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে। এটা তো তার সবচেয়ে বেশি অপছন্দের হওয়ার কথা ছিলো। অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। প্রভা ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর। বলল, “অদিন কার্টুন দেখছে আর বিনু পড়ছে। ও আসবে না। শালটা জড়িয়ে নিন। বাহিরে ঠান্ডা আর সেদিকটা খোলামেলা বাতাস আরও বেশি বইবে।”

বাতাস বইছিল তীব্র বেগে। শুকনো পাতাগুলো উড়ছে ভীষণভাবে। দুপাশে গাছের সারি। মাঝে ইটের রাস্তা। যেখান দিয়ে হাঁটছে এক সাদা পাঞ্জাবি পরা পুরুষ ও হাল্কা গোলাপি রঙের সুতি শাড়ি পরা নারী। আকাশের সকল জ্যাৎস্না যেন তাদের উপরই পরছে। অর্ক তার পিছনে দুই হাত নিয়ে একটুখানি কেশে বলল, “ভুল বলো নি জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর।”

প্রভা নিজের শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। সে ভাবতে পারি নি এত ঠান্ডা পরবে আজ, নাহয় এত পাতলা শাল নিয়ে আসতো না। সে বলল, “আজ একটু বেশিই সুন্দর। সম্ভবত পাতা সব ঝরে পরেছে তাই বলে।”

অর্ক প্রভার দিকে একপলক তাকালো। হেসে আবারও সামনে তাকিয়ে বলল, “আকাশের চাঁদটাও আজ সুন্দর।”

“তা আর বলতে? চন্দ্রমা যেন আজ আমাদের উপরই তার সকল জ্যোৎস্না লুটিয়ে দিচ্ছে।”

“একটা গান গাও।”

প্রভা বিস্ময় নিয়ে তাকালো অর্কের দিকে। বলল, “আমি তো গান গাইতে পারি না। কখনোই গাই নি।”

“আজ গাইতে সমস্যা কোথায়? আমি তোমার আবদার পূরণ করেছি তুমি করবে না?”

প্রভা রাস্তার দিকে তাকালো। এক হাত দিয়ে অন্য হাতের কনুই ধরে গান ধরলো…..

‘কেন রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না
এই মন কেমনের জন্মদিন
চুপ করে থাকা কঠিন
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন
নতুন সকাল গুলো কপাল ছুঁলো তোমারই
দূরে গেলেও এটাই সত্যি তুমি আমারই
শুধু আমারই
রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না……’

এতটুকুতেই দম বন্ধ হয়ে এলো প্রভার। শেষের লাইনগুলো ভেজা কন্ঠে মনে হচ্ছিলো। অর্ক তাকিয়ে রইলো প্রভার দিকে। বেদনা, অস্বস্তি, বিরক্ত মিশ্রিত তার দৃষ্টি। এই গানটা যে বিনয়ের জন্য ছিলো তা বুঝতে বাকি নেই তার। অর্ক মুখ ফিরিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেললো।

প্রভা ভেজা কন্ঠে বলল, “আমার মনে নেই আর।”

অর্ক দাঁড়িয়ে পড়ল।
প্রভা অর্ককে পাশে না পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পিছনে ফিরে অর্ককে দেখে আবার তার কাছে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?”

অর্ক এক পা এগিয়ে এলো। নিজের শালটা খুলে প্রভার মাথায় রাখলো। প্রভা বলল, “কী করছেন?”

অর্ক প্রভার চোখে চোখ রাখল। বলল,
‘রোদের মতো হাসলে
বৃষ্টি হয়ে ছুঁতে পারব না যে তোমায়,
তোমার কাছে আসলে
ফিরে যেতে পারব না যে আবার,
দূরে গেলেও তো আমি তোমারই
কাছে থেকেও যে বলতে পারিনি মনের কাহিনী,
দূর থেকেই জানাব তোমায় হৃদয়ের আখ্যান
মেঘের খামে লিখে পাঠাবো ভালোবাসার উপাখ্যান।’

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-১৬ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1204605546575689/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here