মন_পাড়ায় পর্ব_১

মন_পাড়ায়
পর্ব_১
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

“তোর বিয়ে ভেঙে গেছে আর তুই আরামে বসে গান শুনছিস?”

“তো কী করব কেঁদে গঙ্গা যমুনা বানিয়ে ফেলব না’কি? বড় মা ও খালুরই দোষ তারা আগের থেকে বললেই হতো আমি তাদের আপন মেয়ে না। বড় মা’য়ের ছোট বোনের মেয়ে। যে বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট হয়েছে আর সন্তান জন্ম দিয়ে নিজের সুসাইড করে বসে আছে। মৃত্যুর আগে এটাও ভাবে নি তার মেয়ের কী হবে!”

রুহানি ঝিনুকের পাশে বসে বলল, “ঝিনুক এইভাবে বলা উচিত না। তোর সত্যি কিছু আসে যায় না? মানে নাদিমের সাথে তোর বিয়ে—-”

ঝিনুক বলল, “আমি তো ওর প্রেমে পড়ে বসে আছি না যে আমার খারাপ লাগবে। আর এখন এ প্রেম ভালোবাসার মতো ফালতু জিনিসে আমার বিশ্বাসও নেই।”

রুহানি ঝিনুকের এক হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “এভাবে বলিস না ঝিনুক, অতীতে যা হয়েছে তা ভুলে যা। সবাই একরকম হয় না। অর্ক ভাইয়াকেই দেখ না, প্রভা আপু বিধবা হওয়া সত্ত্বেও তার সাথে বিয়ে করছে। আরও দুই বাচ্চার মা। তাও এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলে নি।”

তাচ্ছিল্য হাসলো ঝিনুক। বলল, “ভালোবেসে না, ওয়াদা রক্ষার্থে।”

“গতবারও কেউ তোকে ভালোবাসায় বিশ্বাস দিয়েছিল, আবারও কেউ আসবে যে তোকে আবার ভালোবাসতে শিখাবে।”

ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুই যার কথা বলছিস, সেই আমার বিশ্বাস এমনভাবে ভেঙেছে যে এ মন পাড়ায় আর কারও কখনো জায়গা হবে না। শুধু বিশ্বাস না, আমার মনও ভেঙেছে।”

“ভুল করিস না ঝিনুক। ভালোবাসা জিনিসটা সুন্দর, শুধু ভালোবাসতে জানতে হয়।”

ঝিনুক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুহানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সুন্দর হলে আমার এত কাঁদতে হলো কেন? আমার মা’কে মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া হলো কেন? ভালোবাসা যদি সুন্দরই হয় তবে কেন আজ আমার মা বাবা কেউ আমার সাথে নেই? আজ পর্যন্ত ভালোবেসে কাউকে সুখে তো দেখলাম না, শুধু কষ্ট পেতে দেখেছি।”

“মিথ্যে বলিস নে ঝিনুক। তুইও জানিস ভালোবাসা কতটা সুন্দর। এর অনুভূতি তুই অনুভব করেছিস।”

“সাথে অনুভব করেছি দুঃখও। হাজারো দিনের দুঃখ এ কিছুদিনের সুখের কাছে তুচ্ছ। আমি যদি সময় পিছাতে পারতাম সে সুখকর অনুভূতিগুলো মিটিয়ে দিতাম যেন এই কষ্টগুলো ভোগ না করেই থাকতে পারি।”

রুহানি কিছু বলতে যাচ্ছিলো এর পূর্বেই দরজায় টোকা পরল। রুহানি উঠে দরজা খুলে দেখে বিনু এসেছে। বিনু প্রভার মেয়ে। বিনু ভিতরে ঢুকে বলল, “মিষ্টি’মা মিষ্টি’মা নানু না তোমায় ডেকেছে।”

ঝিনুক প্রশ্ন করল, “কেন?”

“জানি না তো। বলেছে তোমায় ও মা’কে ডাক দিতে ড্রইংরুমে। বিশেষ কথা আছে।”

“ঠিকাছে তুই যা, আমি আসছি।” বিনু যেতেই ঝিনুক চিন্তিত সুরে বলল, “আল্লাহ-ই জানে কী জন্যে ডেকেছে!”

“চিন্তার প্রয়োজন নেই সম্ভবত নাদিমের কথা বলার জন্য।”

“আমার ভয় হচ্ছে, যদি আমার জন্য প্রভা আপু আর অর্ক জিজুর বিয়েতে সমস্যা হয়?”

ঝিনুকের চিন্তা দেখে রুহানি বলল, “অর্ক ভাইয়া এমন না। উনি এই কথায় কখনো বিয়ে ভাঙবে না।”

“কিন্তু উনার পরিবার তো ভাঙতে পারে। দোয়া কর শুধু যেন কোনো সমস্যা না হয়।”
.
.
ঝিনুক ডাইনিংরুমে ঢুকত নিবে তখনই সৈকতের সাথে তার দেখা। সৈকতকে দেখে তার মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল। সে তাকে না দেখার ভান করে ভিতরে যেতে নিলেই সৈকত তার রাস্তা বন্ধ করে। বলে, “শুনলাম তোমার বর না’কি পালিয়েছে।”

ঝিনুক বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। বলল, “তাহলে তোমার এতো চুলকায় কেন?”

সৈকতের মেজাজ প্রথমে খারাপ হলেও পরে নিজেকে শান্ত করে বলে, “বেয়াইন হন আপনি আমার চুলকাবেই তো, বিয়ের দিন আপনার বর পালিয়ে গেছে। লজ্জাজনক ব্যাপার তো বটে।”

“তাইলে চুলকানির মলম লাগিয়ে বসে থাকেন। আমার মাথা খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন যাও এখান থেকে তোমার এখানে কাজ নেই।”

সৈকত দরজার উপর হাত রেখে বলল, “মেডাম আপনার রাজ্যে আমি আসি নি যে আপনার রাজত্ব চলবে।”

ঝিনুক হেসে নিজের হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে বলল, “আপনি আমার রাজত্বের এসেছেন। ভুলে যেয়েন না বাসাটা আমার, তোমার না। যেখানে সেখানে টৈ টৈ করতে করতে ঢুকে পড়ে। ফালতু একটা।”

সৈকত কেশে তার গলা পরিষ্কার করে তার হাত দরজা থেকে সরিয়ে বলল, “আমি নিজের থেকে আসি নি। দাদিমা ডেকেছে আমাকে।”

ঝিনুকের কপালে ভাঁজ পড়ল। তার বুক হঠাৎ কেঁপে উঠলো। সে বলল, “তোমাকে আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটারে কেন ডাকবে।”

প্রভা এলো তখনই। সে সৈকত ও ঝিনুককে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা ভিতরে না যেয়ে এখানে কী করছ?”

ঝিনুক তাকালো প্রভার দিকে। প্রভা বধূবেশে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। আবারও। গতবার যখন প্রভার বিয়ে হয়েছিলো তখন সে এগারো বছরের ছিলো। তার ঠিক মনেও নেই কেমন দেখাচ্ছিলো তাকে। ছবিতে দেখেছে। কিন্তু ছবিতে দেখা ও সামনা-সামনি দেখায় অনেক পার্থক্য। অসাধারণ লাগছে প্রভাকে। মানুষ বলে কালো বর্ণের মানুষকে গাড় রঙে মানায় না। এটা তার ভুল মনে হয়, কারণ প্রভাবে আজ লাল রঙে অসাধারণ লাগছে। হয়তো প্রভার আজ দ্বিতীয় বিয়ে তবুও ঝিনুকের মনে হয় সে প্রভাকে আজ থেকে বেশি সুন্দর আর কখনও লাগে নি।

ঝিনুক যেয়ে প্রভার হাত ধরে বলল, “আপি আপি আমাদের কীজন্য ডেকেছ জানো তুমি?”

“ভিতরে ডুকলেই জানতে পাব ময়না।”

ঝিনুক কাঁদোকাঁদো চেহেরায় বলল, “আমার না ভয় করছে আমার জন্য তোমার বিয়ে না ভেঙে যায়।”

সৈকত তার ভ্রু নাচিয়ে বলল, “মানুষ কীভাবে এত জলদি এক্সপ্রেশন পাল্টায় তা আজ লাইভ দেখলাম।”

ঝিনুক আবারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। বলল, “জুতার বাড়ি খেতে কেমন লাগে তা লাইভ অনুভব করবে?”

সৈকতের কিছুক্ষণ ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে ভেতর ঢুকে পড়লো।

ঝিনুক প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু বল না বিয়ে টিয়ে ভাঙবে না তো?”

প্রভা মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল, “অর্ক এই বিয়ে কখনো ভাঙতে দিবে না।”

ঝিনুকের ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে এলো। প্রভা বলল, “এইবার ভিতরে চল।”

ঝিনুক ও প্রভা ভিতরে ঢুকে দেখে দুই পরিবার বসে আছে। পরিস্থিতি গম্ভীর। প্রভা আড়চোখে তাকালো অর্কের দিকে। অর্ক তার দিকে তাকাতেই সে চোখ নামিয়ে নিলো।

ঝিনুক চিন্তায় ভুগছিল। তাকে কেন ডাকা হয়েছে তা সে ধরতে পারছে না। ঝিনুকের খালু গম্ভীর গলায় বলল, “কী ব্যাপার তুমি তোমার বউয়ের পোশাক কেন খুলেছ?”

ঝিনুক তার খালুকে ভীষণ ভয় পায়। তার সামনে সে বেশি কথা বলে না। সে মাথা নিচু করে বলল, “ঐ’যে–ঐ’যে খালু নাদিমের পরিবার বিয়ে ভে—ভেঙে দিয়েছে তাই।”

“তোমাকে আমি বা তোমার খালামণি একবারও বলেছে বিয়ে হবে না তাই পোশাক পরিবর্তন করে ফেলো।”

ঝিনুক উওর দিলো না। মুখ নিচু করে রাখল। অর্কের দাদি তখন বলল, “আরে আজিজুল চুপ কর তো। এত মিষ্টি মেয়েকে কেউ বকে না’কি? দেখি ঝিনুক দাদির কাছে এসে বস তো।”

ঝিনুক যেয়ে বসলো দাদিমার কাছে। দাদিমা বলল, “মন খারাপ করে না। চিন্তা কর না আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। তোমার বড় মা ও খালু রাজি। তোমার অনুমতি লাগবে।”

ঝিনুক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো দাদিমায়ের দিকে। দাদিমা বলল, “তোমাকে আমি অনেক পছন্দ করি, তুমি আমার ছোট নাতির সাথে বিয়ে করবে?”

ঝিনুক দাঁড়িয়ে পরল। ঝিনুক ও সৈকত একসাথে বলল, “অসম্ভব।”

একে অপরের দিকে তাকালো দুইজন। সৈকত বলল, “দাদিমা তুমি আমাকে এই ঝগড়ালুর সাথে বিয়ে দিতে চাও? ও আমার ব্রেনের কিমা বানিয়ে দিবে।”

ঝিনুক হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে বলল, “ওহ প্লিজ। ব্রেনের কিমা বানানোর জন্য ব্রেনও থাকা লাগে।”

“ঝিনুক—” খালু ভারী ও রাগান্বিত স্বরে বলল। ঝিনুক সাথে সাথে তার হাতের ভাঁজ খুলে মাথা নিচু করে রইলো।

প্রভা অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আপনার সাথে কিছু কথা আছে একটু আমার সাথে আসবেন?”

প্রভা উওর না নিয়েই পিছনে ফিরে হাঁটতে শুরু করল। অর্ক রুমের সকলের দিকে একবার তাকিয়ে প্রভার পিছনে গেল। প্রভা অর্ককে নিয়ে তার মা বাবার রুমে গেল। কেননা অন্য সব রুমে মেহমান আছে। দরজা ভেজিয়ে বলল, “আপনি কী ঝিনুক ও সৈকতের বিয়ের জন্য হ্যাঁ করেছেন?”

“না করার কী আছে?”

প্রভা অনুরোধের সুরে বলল, “আমি আপনার শর্ত মেনে আপনাকে বিয়ে করছি। আপনার আমার সাথে সমস্যা আমার বোনকে মাঝখানে টানছেন কেন?
আপনার রাগ আমার সাথে, প্রতিশোধ আমার উপর নিন। দয়া করে আমার পরিবারকে মাঝে টানবেন না।”

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here