মন_পাড়ায়
পর্ব_৩১
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
প্রভা চিন্তিত সুরে বলল, “দাঁড়াও মা কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি সেখানে গিয়েছে নাকি?” প্রভা যেতে নিলেই সৈকত তাকে থামিয়ে বলল, “না ভাবি আমি ফোন দিয়ে দেখেছি ঝিনুক সেখানেও নেই।”
অর্ক জিজ্ঞেস করল, “ঝিনুককে কল দিয়েছিস?”
সৈকত অর্কের দিকে তাকালো। একটু ইতস্ততভাবে বলল, “ওর ফোন বন্ধ পাচ্ছি।”
আজ অনেক বছর অর্কের সাথে এমন স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে সৈকত, নাহয় তাকে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কথাই হয় না সে কতবছর ধরে।
অর্ক সাথে সাথে বিছানা থেকে তার গাড়ির চাবি নিয়ে বলল, “ভার্সিটি যেয়ে আবার খোঁজ নেই চল।”
প্রভা আতঙ্কিত স্বরে বলল, “আমিও আসি।”
“না তুমি বাসায় থাকো। ঝিনুক আসলে কল করবে।” অর্ক বলেই সৈকতের সাথে রওনা দিলো। ভার্সিটি থেকে বাসায় আসার রাস্তায় দেখলো। ঝিনুকের খালামণি কল দিয়ে জানালো সে ঝিনুকের বান্ধবীদের কাছে খোঁজ নিয়েছে অথচ কোথাও পায় নি। ভার্সিটি দারোয়ানকে দিয়ে সব রুম খুলে দেখল তবুও পেল না। দারোয়ান যখন ঝিনুকদের ডিপার্টমেন্টের টিচারকে কল দিয়ে জানাতে গেল তখন অর্ক সৈকতের কাঁধে হাত রেখে বলল, “চিন্তা করিস না ঝিনুকের কিছু হবে না। আমরা ওকে খুঁজে বের করব। আমি আগে ছিলাম না কিন্তু এইবার আছে তোর কাছ থেকে আবার ঝিনুককে হারাতে দিব না আর।”
সৈকত চোখ তুলে একবার তাকালো। তার চোখে মুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। সারাটা রাস্তায় এমন আতঙ্ক তার মুখে বিদ্যমান ছিলো। সৈকত কাঁপছিল বরাবরের মতো। সে এমন এক কাজ করল যার আশা অর্ক বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছিলো। সৈকত আচমকায় অর্ককে জড়িয়ে ধরলো। ভেজা কন্ঠে বলল, “ভাইয়া আমার প্রচুর ভয় লাগছে। ওর সাথে যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায়? এই পৃথিবীর কোনো স্থানেই মেয়েরা সুরক্ষিত নেই। সেখানে আমি কীভাবে না ভয় পাই?”
অর্ক সৈকতের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো তবে কিছু বলতে পারল না। তার মনে পড়লো তাদের ছোট বেলার সে দিনগুলোর একটা ঘটনা,
অর্ক তার বই পড়ছিলো নিজের রুমে। তার টেবিলের সাথেই জানালা। সে জানালা দিকে দেখল সৈকত এক গাছের নিচে বসে আছে তার কনুই ধরে কাঁদছে। সাথে সাথে সে উঠে গেলো। দৌড়ে নিচে যেয়ে সৈকতের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার চুলে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
ছোট সৈকতটা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলে, “ভাইয়া দেখ আমি গলিতে খেলতে গিয়েছিলাম সেখানে ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফালিয়ে দিয়েছে। ব্যাথা পেয়েছি আমি। দেখ কত রক্ত বের হচ্ছে।”
অর্ক সৈকতের কনুই ধরে দেখলো। একটু রক্ত বের হচ্ছে কনুইয়ের সে অংশ থেকে। সে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু তারা এমন করেছে কেন?”
“জানি না তো ভাইয়া। সত্যি আমি কিছু করি নি। তারা বলেছে তাদের মা বলেছে আমার সাথে খেলতে না। আমার মা ভালো না তাই আমিও ভালো না। কিন্তু তারা এমন কেন বলেছে ভাইয়া?”
অর্ক কিছু বলল না। সে সৈকতকে বাসায় নিয়ে কাটা অংশটায় পরিষ্কার করে সেখানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। সৈকত ম্লানমুখে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া কেউ আমার সাথে না খেলতে চাইলে আমি কার সাথে খেলব?”
“আমি আছি না? আমার সাথে খেলবি।” অর্কের উওর শুনে সৈকত প্রথমে উৎসুক দেখালেও পরে মলিন চেহেরা নিয়ে বলল, “কিন্তু বাবা তো বকা দিবে। বাবা বলেছে যেন তোমায় পড়াতে বিরক্ত না করি। বিরক্ত করলেই মাইর দিবে। আর আমাদের বাসা তো ছোট খেলব কীভাবে?”
অর্ক হেসে বলল, “বাবা যখন থাকবে না তখন আমরা খেলব। আর আমরা কালকে ছাদে উঠে ক্রিকেট খেলব এখন আমাদের সবচেয়ে পছন্দের কাজটা করি।” কথাটা শুনতেই সৈকত উঠে দৌড়ে যেয়ে অর্কের ভায়োলিন ও তার খেলনা পিয়ানো নিয়ে এলো। অর্কের দিকে ভায়োলিন এগিয়ে দিলো। অর্ক দাঁড়িয়ে ভায়োলিনটা নিলো এবং সৈকত বসে তার পিয়ানো সামনে রাখল। দুইজনে একসাথে সুর ধরল। বাজাতে শুরু করল। যদিও সৈকতের খেলনা পিয়ানোটার সুরটা অশোভন শুনাচ্ছিল কিন্তু তা ঢেকে যাচ্ছিলো অর্কের মধুর বেহালার সুরে সুরে। সৈকত অর্কের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল। ফেরতে অর্কও মৃদু হাসি ফিরিয়ে দিলো।
সৈকত ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রাত জেগে পড়তে শুরু করল। এরপর যতদিন না পর্যন্ত সৈকত তার খেলার জন্য অন্যান্য সাথী পেল ততদিন এমনই চলতে থাকলো।
তারপর অনেক বছর কাটলো। সৈকত স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পরলো আর অর্ক তার বাবার ব্যবসায়ে সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। অথচ তাদের সম্পর্কে এর বিন্দুমাত্র প্রভাব পরে নি। কিন্তু তখন প্রভাব পড়ল যখন অর্ক তার বিদেশে যাওয়ার কয়দিন আগে বাসায় এলো এবং দেখলো বাসায় ঝামেলা চলছে। তার বাবা সৈকতকে বলছিলেন “তোর মতো বেয়াদব ছেলে থাকা থেকে না থাকা ভালো। তোর বাবার সাথে এত উঁচু স্বরে কথা বলতে লজ্জা লাগে না তোর?” আবার সৈকতের মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “নিজের মতো তো ছেলেটাকে বানিতে চাচ্ছো? নিজে যেমন বস্তি থেকে উঠে আসছো ছেলেকেও তেমন বানাচ্ছো? নিজের বাপেরবাড়িতে ভরে ভরে টাকা পাঠাও আর ছেলের কানে আমার বিপক্ষে কথা দেও? তোমাকে তো এই ঘরেই রাখা উচিত না।”
সৈকতও উঁচু স্বরে বলল, “মা আমাকে কিছু বলে না কিন্তু আমার তো চোখ আছে। আপনি আমার মা’য়ের সাথে কী ব্যবহার করেন দেখি না আমি? উঠতে বসতে সব কিছুতে খোঁটা মারেন। একটু আগে যে মা’য়ের গায়ে হাত তুলেছেন তাও দেখেছি আমি। এমন কাপুরুষের মতো ব্যবহার করতে হলে বিয়ে করলেন কেন আমার মা’কে?”
তখনই অর্ক এসে সৈকতের পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “বাবার সাথে এমন কথা বলার সাহস কোথায় পেয়েছিস তুই?”
“ভাইয়া তুমি জানো না এই উনি কী করেছে!”
“আমি জানতেও চাই না। তুই এক্ষুণি ক্ষমা চাবি বাবার কাছ থেকে।” সৈকত কথাটা শুনতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অর্কের দিকে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি শুনেছ যে উনি আমাদের মা’কে মেরেছে?”
অর্ক একটু সময় চুপ থাকলো। সে তার ভাই ও বাবা দুইজনকে ভালোবাসে কিন্তু এই সময় সে যদি বাবার বিপক্ষে যায় তাহলে পরিবারের প্রধান ও বড় হওয়া সত্ত্বেও কোনো না কোনো জায়গায় হারিয়ে যাবে বাবার সম্মানটা। তাই আলাদাভাবে এই বিষয়ে কথা বলাটা শ্রেয় মনে করল অর্ক। তাই একটু ইতস্ততভাবে বলল, “এইটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোর বা আমি বলার কেউ না।”
সৈকত ভ্রু কুঁচকে বলল, “একজন আমাদের মা মেরেছে আর তুমি বলছ আমি এই বিষয়ে কথাও তুলব না? তুমি সহ্য করতে পারবে যে কেউ আমাদের মা’য়ের সাথে এমন ব্যবহার করছে?”
অর্ক উওর দিলো না। নিচে তাকিয়ে রইলো। সৈকত কিছুক্ষণ কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। তারপর তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “সরি আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমাদের না আমার মা হবে। আর আমি তোমার সৎ ভাই।” অর্ক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো সৈকতের দিকে। কিছুক্ষণের জন্য যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এত বছরে তার ও সৈকতের মাঝে এমন কোনো কথাই হয় নি। লোকে বললেও তাদের এতে কিছু আসতো যেত না। তার সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ফাটল আসে নি কখনো। আর আজ এত বড় কথা!
অর্ক কাঁপানো কন্ঠে বলল, “এইসব কী বলছিস তুই সৈকত? তুই আমার ভাই আর আমি তোকে অনেক আদর….” অর্ক সৈকতের কাঁধে হাত রাখতে যেতেই সৈকত পিছিয়ে গেল। কঠিন কন্ঠে বলল, ” আজকের পর থেকে আপনি আমার কেউ না। আমি আপনার মতো মানুষ আমার জীবনের কোনো অংশে চাই না।”
সৈকতের মা তখন বলল, “বাবা এইসব বলতে নেই। ও তোর বড় ভাই।”
“যে তোমাকে নিজের মা হিসেবে সম্মানও দিতে পারে না সে আমার ভাই কীভাবে হয় মা? সে আমার সৎ ভাই এবং আজ তা অনুভব করিয়েও দিলো।” বলেই সৈকত চলে গেল সেখান থেকে। অর্ক তাকিয়েই রইলো সৈকতের যাওয়ার দিকে। তার সে ছোট বেলার সৈকতের কথা মনে পড়ছিল, সবসময় মনে পড়ে, আজও মনে পড়ে। আপন মানুষ জীবন থেকে চলে যেতে পারে মন পাড়া থেকে না।
.
.
ঝিনুক চোখ খুলতেই নিজেকে পায় এক অন্ধকার রুমে। তার মনে আছে সে পরিশের সাথে গাড়িতে উঠেছিলো। অনেকটা রাস্তা তাকে অনুরোধ করল যেন তাকে বাসায় দিয়ে যায়। সে শুনল না। এরপর হঠাৎ কখন সে ঘুমিয়ে গেলো নিজেও বুঝলো না। আর পরিশ ভাইয়া আর আদিল ভাইয়াই বা কোথায়? আর সে নিজেই বা কোথায়? এটা তো তার বাসা না। হঠাৎ আতঙ্কের ছাড়া ঝিনুককে ঘিরে বসলো। দরজা খোলার শব্দে সে আতঙ্ক হাজারোগুণ বেশি বেড়ে গেল।
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
পর্ব-৩০ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1230739930628917/