মন_পাড়ায় পর্ব_৩

মন_পাড়ায়
পর্ব_৩
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

অর্ক হেসে বলল, “ওয়েলকাম টু হেল, সুইটহার্ট।”
প্রভা তাকালো অর্কর দিকে। সাথে সাথেই ছবি তোলা হলো।
.
বাড়ির নাম স্বপ্নপুরী। কিন্তু বাড়ির পরিবেশটা স্বপ্নলোকের মতো নয়। বাড়িটা বাহির থেকে একটি সুন্দর পরিবার দেখালেও চার দেয়ালের মাঝে বিষন্নতা ভরা। বাড়ির কর্তা মাহমুদ হাবিবুল। তার তিন ছেলে অর্ক, ভাদ্র ও সৈকত। অর্ক ও ভাদ্র তার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। অর্ক তার সবচেয়ে পছন্দের ছেলে। সেই তার সকল কাজে সহয়তা করে। পরিবারের দায়িত্ব পালনে যেমন গাফলতি নেই তেমনি অফিসের প্রতিটি কাজ সাফল্যের সাথে করে। অর্ককে তিনি অনেক আদর করলেও ভাদ্রের প্রতি তার যত্ন সবচেয়ে বেশি। কারণ সে অস্বাভাবিক। আল্লাহ তাকে প্রতিবন্ধী করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। তার প্রথম স্ত্রী অসুখে মারা যাবার দুই বছর পর তার বাচ্চাদের সামলানোর জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করে রোমার সাথে। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে তার সবচেয়ে ছোট সন্তান সৈকত। বিয়ে করলেও কখনো সে তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী না মর্যাদা দিতে পেরেছে আর না সে ভালোবাসা। অর্কের মা’কে সে যে ভালোবাসা দিয়েছে তা অন্য কাউকে দিতে পারার কথা সে ভাবতেও পারে না। তাকে সঠিক মর্যাদা না দেওয়ার আরেকটি কারণ হলো তার ছোট ছেলে সৈকত। যেমন বেখেয়ালিপনা তেমন বেয়াদবি করে ছেলেটা। এইজন্য সৈকতের সাথে তার কথা তেমন হয় না। সৈকতের সাথে তার বাবা ও বড় ভাইয়ের সম্পর্ক ভালো না হলেও ঘরের সবাই তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তার দাদিমা, মা, ভাদ্র ভাইয়া। এমনকি অর্কও। একসময় অর্ককে সে মনে প্রাণে সম্মান করলে এক অজানা কারণে এখন আর অর্কের সাথে এখন তার ভালোমতো কথা বলে না। আর এ ঘরের সবচেয়ে বড় দাদিমা। যার কথা কেউ অমান্য করে না। এবং আজ আরও চারটি সদস্য যুক্ত হতে যাচ্ছে। এ ঘরের দুই বউ প্রভা ও ঝিনুক এবং প্রভার আগের ঘরের দুটো ছেলে-মেয়ে বিনু ও অদিন।

অনুষ্ঠান শেষে রাতে বাসায় এলো সবাই। ঘরে মানুষ ভর্তি। সবাই নতুন বউদের দেখতে ব্যস্ত। বিশেষ করে ঝিনুককে। কেননা সবাই শুনেছে মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর। দাদিমা পরে ঝিনুক ও প্রভাকে এক রুম দিলো আর ব্যবস্থা করে দিলো যেন সেখানে কেউ না যায়। তাদের সাথে তাদের এক খালাতো বোনের আসার কথা ছিলো শেষ মুহূর্তে এলো না। রুহানি অবশ্য এসেছে তবে সে বাহিরে।

ঝিনুক বিছানায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপি মানুষ কেন যে বিয়ে এত ধুমধাম করে করতে যেয়ে এত মানুষকে ডাকে। সবার সাথে হেসে কথা বলতে বলতে আমার চাপা ব্যাথা হয়ে গেছে। এর উপর এত ভারী লেহেঙ্গা মনে হচ্ছে লোহা দিয়ে তৈরি করে আনলো, ধ্যুর!”

প্রভা হেসে বিছানার পাশে সাইড বাক্সের উপর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঝিনুককে দিয়ে বলল, “পানি খেয়ে নে ভালো লাগবে।”

ঝিনুক তাই করলো। ক্লান্ত সুরে বলল, “আমার সেই ঘুম ধরেছে।”

“এইখানে ঘুমিয়ে পর।”

“একদম না। তোমার ও দুলাভাইয়ের আজ বাসররাত আমি কি নষ্ট করব না’কি?”
কথাটা শুনা মাত্র প্রভার মুখের হাসি মলিন হয়ে গেল।

ঝিনুক তা দেখে প্রভার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতের উপর হাত রেখে বলল, “আপি তুমি কী এখনো বিনয় ভাইয়ার কথা ভাবছ?”

প্রভা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে মাথা ডানে বামে নাড়ালো। ঝিনুক আবারও বলল, “মিথ্যে বলোনা আপু তোমার মুখ বলছে তুমি এখনো ভাবছ বিনয় ভাইয়ার কথা। আর কত আপু? দুই বছর হতে এসেছে তার মৃত্যুর। এখন সে নেই, তবে তাকে মনে রেখেছ কেন?”

“এখন বুঝবি না ময়না পাখি, কাউকে যখন ভালোবাসবি তখন বুঝবি।”

ঝিনুক ম্লান হাসলো। মনে মনে বলল, “তোমাকে যদি বলতে পারতাম এই ভালোবাসার বিষ আমিও পান করেছি — শুধু যদি বলতে পারতাম। কিন্তু তোমার ধাঁধার মতো জীবনটাকে আর পেঁচাতে চাই না। এত কষ্টের পর এক মুঠো সুখ পেয়েছ তার আবারও দুঃখে পরিণত করতে চাই না আপি।”

প্রভা ঝিনুকের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় হারিয়ে গেলি?”

ঝিনুক তাকালো প্রভার দিকে। মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, কোথাও না।”

প্রভা ঝিনুকের গালে হাত রেখে বলল, “সৈকতের কথা ভাবছিস? চিন্তা করিস না, সৈকতের মাঝে হয়তো একটু বাচ্চামি আছে এখনো। বেখেয়ালিভাবে জীবন বাঁচে তবে মনের অনেক ভালো।”

“কচু ভালো। একদম একটা শয়তানের হাড্ডি।”

প্রভা হেসে বলল, “এভাবে বলতে নেই। আমরা সবসময় চোখের সামনে যা দেখি তা হওয়াটা জরুরি না।” পরক্ষণেই গম্ভীর মনোভাব নিয়ে আবারও বলল, “কখনো আমরা পাথরকে হিরা ভেবে তার যত্ন নিই আর হিরাকে পাথর ভেবে অবহেলা করি।”

“আমি কিছুই বুঝি নি আপি।”

“সহজ কথা। মানুষ বাহির থেকে যেমন দেখতে ভিতর থেকে তেমন হবে এমনটা প্রয়োজন নয়। অনেকসময় বেখেয়ালি দেখায় এমন মানুষও যত্নবান হয় আর অনেকসময় যত্নবান দেখায় এমন মানুষও অবহেলা করে।”

“জিরাফের মতো দামড়া। মাথা তুইলা তাকাইতে তাকাইতে আমার ঘাড় ব্যাথা হয়েছে।” ঝিনুক কথা বলার দরজা খুলে ঢুকলো অর্ক।

অর্ক ভিতরে ঢুকে বলল, “দুই বোনের কথা শেষ।”

প্রভা ও ঝিনুক অর্কের দিকে তাকাল। ঝিনুক অর্কের সামনে যেয়ে দুষ্টুমি করে বলল, “কেন জিজু আমাকে ভাগানোর তাড়া আছে না’কি?”

“দাঁড়াও চিন্তা করতে দাও।” অর্ক কিছু সেকেন্ড চিন্তার ভান করে সাথে সাথে বলল, “একদম।”

ঝিনুক হেসে বলল, “চিন্তা করেন না দুলাভাই, আমি সারারাত তো থেকে আপনাদের বাসররাত নষ্ট করব না। আমাকে মেহমানদের রুম দেখিয়ে দেন আমি চলে যাচ্ছি।”

“মেহমানদের রুম মানে! তুমি এ ঘরের বউ তুমি মেহমানদের রুমে কেন থাকবে? সৈকতের রুম সাজানো হচ্ছে। আমি আগেই ফোন করে বলে দিয়েছিলাম যেন ওর রুমটা সাজিয়ে দেয় আর তোমার জিনিস ওর রুমে রেখেও এসেছি।”

ঝিনুককে এতটা খুশি দেখাল না। সে মুখ মলিন করে বলল, “কিন্তু ভাইয়া আমি সৈকতের সাথে থাকতে চাই না।”

“তুমি না চাইলেও সৈকত তোমার স্বামী। আর এখন তোমার এটা মেনে নেওয়া উচিত।” অর্ক ঝিনুকের মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে বলল, “দেখো তুমি আমার ছোট বোনের মতো। সে ছোট থেকে তোমাকে দেখে আসছি। আমি তোমার জন্য খারাপ চাইব না। তোমার বিয়েতে যখন আমার মত দাদিমা চেয়েছিলেন আমি তখন ভেবে চিন্তেই হ্যাঁ বলেছি। সৈকতকে হয়তো বাহির থেকে বেখেয়ালি দেখায় কিন্তু ও সবাইকে অনেক ভালোবাসে। সবার যত্নও নেয়, শুধু দেখায় না।”

ঝিনুক তার হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে বলল, “বাহ ভাইয়া আপনার ও আপির চিন্তা ভাবনায় কত মিল। আপুও একটু আগে এই কথাই বলছিলো।”

অর্ক প্রভার দিকে একপলক তাকিয়ে ঝিনুককে বলল, “দাঁড়াও আমি রুহানিকে ডেকে দিই যে ও তোমাকে সৈকতের রুমে নিয়ে যায়। নতুন বউয়ের একা যাওয়া ঠিক দেখাবে না বোধহয়।”
ঝিনুক মৃদু হাসলো।

অর্ক যাওয়ার পর ঝিনুক প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু তুমি কত ভাগ্যবতী জিজুর মতো জীবনসঙ্গী পেয়েছ বলে। জিজু তোমার অনেক যত্ন নিবে এবং অনেক ভালোবাসবে, দেখে নিও।”

প্রভা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো। সে বিড়বিড় করে বলল, “যে মানুষ বেঁচে থাকাটা সহ্য করতে পারে না সে আবার ভালোবাসবে!”
প্রভা এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
.
.
ঝিনুককে সৈকতের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। রুহানির সাথে সৈকতের দুটো কাজিন ছিলো। তাকে রুমে দিয়ে খিলখিল করে হেসে দরজা লাগিয়ে চলে গেল। ঝিনুক দেখে রুমটা ফুল দিয়ে সাজানো। ঝিনুক পুরো রুমটা ঘুরে দেখল। তার চোখ যেয়ে আটকালো দেয়ালে লাগানো সৈকতের ছবির উপর। সাদা শার্টের উপর ব্রাউন রঙের জ্যাকেট পরা। তার মা’কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে চোখ টিপ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিনুক মুচকি হাসলো। তার মনে পড়ে গেল সে তাদের প্রথম দেখা,

রুহানির বিয়ের ছিল সেদিন। রুহানি ও ঝিনুকের বান্ধবীদের সাথে ঝিনুক গেট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো মিষ্টি, শরবত এইসব নিয়ে। বরসহ ছেলেপক্ষ আসতেই ঝিনুক ও তার বান্ধবীরা মিষ্টি খাইয়ে বলে, ‘দুলাভাই এইবার বিশ হাজার বের করেন, নাহয় বিয়ে ভুলে যান।’

ভিড়ের মাঝেই একটা ছেলে বলল, ‘মিষ্টি বিশ টাকার হলে না, এই মিষ্টি খাইয়ে আসছে বিশ হাজারের ডিমান্ড করতে।’

ঝিনুক এক কোমড়ে হাত রেখে ভাব নিয়ে বলল, ‘ আমার অমূল্যবান বান্ধবীকে দিয়ে দিচ্ছি আর এইখানে বিশ হাজার টাকা দিতে এত কথা, লজ্জা লাগা উচিত।’

‘মেডাম আপনার জন্য জান দিতে রাজি আছি বিশ হাজার চাইছেন মাত্র।’ ঝিনুক তাকালো কালো রঙের পাঞ্জাবি পরা ছেলেটার উপর। সেই ছেলেটিই ছিলো সৈকত।

ঝিনুক বলল, ‘আপনার জান দিয়ে কী করব? আপনার জান দিয়ে তো আর শপিং করতে পারব না।’

সৈকত আরেকটা ছেলের কাঁধে হাত রেখে চোখ টিপ মেরে বলল, ‘আমার জান হয়ে গেলে ঠিকই করাতে পারব।’

ঝিনুকের তখন ছেলেটাকে এত আজব লাগলো যা বলার মতো না। সবার সামনে এমন কথা কীভাবে বলতে পারে?”

ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসার হলো। ঝিনুক ছবিটার দিকে তাকিয়েই রইল। হাত বাড়িয়ে ছবিটা ছুঁতে নিলেই দরজা খোলার শব্দ এলো। ঝিনুক পিছনে ফিরে দেখে সৈকতকে। সৈকত একটুখানি হেসে দরজা বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ঘৃণা কর।”

ঝিনুক অসংশয়ভাবে বলল, “ভেবেছিলে? আমি তোমাকে ঘৃণা করি তা তোমার জানা উচিত।”

“তাহলে বিয়ের জন্য হ্যাঁ করলে কেন?”

“বাধ্য ছিলাম।”

“আমার ছবির দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন?”

“ছবিতে নিজের সর্বনাশ দেখছিলাম।”

সৈকত ঝিনুকের কাছে এলো। তার কোমর ধরে এক ঝটকায় তাকে কাছে টেনে নিলো। কপালে আলতোভাবে চুমু খেয়ে বলল, “তোমার চেহেরার ভঙ্গি অন্যকিছু বলছে।”

ঝিনুক আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। নড়ল না। অনুভব করলো শুধু সৈকতের স্পর্শকে। আজ এত বছর পর তাকে কাছে পেয়ে পৃথিবীটা ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সৈকতের করা বেইমানির দৃশ্য। সে সে চোখ দুটো খুলে সৈকতের হাত সরানোর চেষ্টা করলো। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ছাড় বলছি, নাহয় ভালো হবে না।”

“এমনভাবে বলছে কেন যেন প্রথম এত কাছে এসেছি। আগেও হাজারোবার তোমাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করেছি।”

ঝিনুক কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমি সে হাজারোবারে অনুতাপ করি। যদি সে হাজারোবারটা ভুলতে পারতাম।”

সৈকত হেসে বলল, “আমি সে স্বভাবের মতো যাকে একবার ধারণ করলে না ভুলা যায় না ছাড়া যায়।”

চলবে……

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-২ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1185522975150613/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here