মন_পাড়ায় পর্ব_৪৬

মন_পাড়ায়
পর্ব_৪৬
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

প্রভা বারবার জিজ্ঞেস করল অর্ককে কোথায় যাচ্ছে তারা? অর্কের ফেরত উওর এলো না। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। তার মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। প্রভা বুঝতে পারছিলো না যে অর্ক ঠিক কী করতে চাচ্ছে! অন্তত ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না ঠিক আগের সেন্টারের সামনে অর্ক গাড়িটা এনে থামলো। প্রভা বলল,
“দয়া করে এই মুহূর্তে কোনো তামাশা করেন না। আপনার বিজনেসের সাথে যুক্ত অনেকেই আছে। আপনার পরিবারের নাম নিয়ে কথা হবে।”
কথাগুলো যেন অর্কের কানেই পৌঁছাল না। সে গাড়ি থেকে নেমে নিজের কোর্টটা খুলে গাড়ি দিকে ছুঁড়ে মারলো আর টাই’টা ঢিলা করে খুলে মাটিতেই ফেলে দিলো। এগিয়ে গেল সেন্টারের দিকে।

প্রভা অর্কের এমন রাগান্বিত রূপ দিয়ে ছুটে যেয়ে তার হাতটা নিজের ধরে বলল,
“কী করছেন? এইখানে উল্টাপাল্টা কিছু হলে আপনাদের পরিবারের নামে মানুষ উল্টাপাল্টা কথা বলবে সাথে আপনার বিজনেসেও সমস্যা হবে।”
অর্ক রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল প্রভার দিকে। সে দৃষ্টি দেখতেই বুক কেঁপে উঠলো প্রভার। এর আগেও প্রভা রাগে অর্ককে দেখে কিন্তু কখনো এতটা ভয় পায় নি সে। কিন্তু আজ অর্ককে এমন রাগান্বিত অবস্থায় দেখে সে নিজেই কাঁপতে শুরু করল।

অর্ক দাঁতে দাঁত চেপে প্রভাকে বলল,
“তোমার সম্মান আমার পরিবারের নাম ও ব্যবসা থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?”
প্রভা ভয়ে অর্কের হাত নিজেই ছেড়ে দিলো। এই অর্ককে যেন সে চিনতেই পারছে না। যে অর্ক তার পরিবারের নাম ও বিজনেস সঠিক রাখার জন্য কত কিছু করেছে। দিন না রাত না শুধু কাজ করে নিজের পরিবারের এক আলাদা মর্যাদা বানিয়েছে এই সমাজে। তার কাছে আজ এই মর্যাদাটা তুচ্ছ হয়ে গেল শুধুমাত্র তার সম্মানের খাতিরে। ভাবতেই প্রভার চোখে জল ভেসে উঠলো। তার বুকে এক উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল। ভীষণ শান্তি লাগছিল তার। ভীষণ। এতটা যত্ন যে আর কখনো কেউ নেয় নি তার। সে যখন ছোট ছিলো তখন থেকেই তার বাবার সাথে কখন কোয়ালিটি টাইম কবে ব্যয় করেছিলো তার মনে নেই। তার বাবা ভীষণ ব্যস্ত থাকতেন। সাপ্তাহে একটি দিনও বাড়িতে থাকতেন না। শুধু কাজ করতেন। যখন থাকতেন তখন কথা বলতেন কম। যখন কথা বলতেন রাগে থাকতেন এইজন্য তার সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলো না প্রভা। এমন নয় যে তার মা তাকে অবহেলা করতেন কিন্তু গায়ের রঙের কারণে চিন্তার কারণে হলেও কিছু কথা বলতেন যা শুনে বেশ কষ্ট লাগতো প্রভার। যার কারণে সে তার মা’য়ের কাছে বেশি ঘেঁষত না। পরিশ ভাইয়াও তার প্রতি এত যত্নশীল ছিলো না। ঝিনুক তার ভীষণ কাছের হলেও সে ছিলো ভীষণ ছোট, সে এই পৃথিবীটাকেই বুঝত না তাকে কী বুঝবে? এরপর বিয়ের পরের কথাটা আর কী ভাববে সে! তার বুকে ছিলো শুধু অবহেলার কষ্ট আর কষ্ট। তার মনে হচ্ছে তার সারাটা জীবনের আফসোস আজ মিটে গেল।

ভিতর থেকে বিকট শব্দ শুনে দৌড়ে গেল প্রভা। ভরা হলটার মাঝে অর্ক রাহানের শার্টের কলার ধরে একে একে ছয় ঘুষি মারলো। অবশেষে নাকে এত জোরে একটা মারলো সে তার নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেল। আর কতগুলো অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে বলল,
“শুয়োর একটা তোকে নর্দমায় যেয়ে চোবাব। চোখদুটো খুলে ওখানে ভাসায় দিব। লজ্জা লাগে না অন্য মেয়ের দিকে নজর দিতে কুত্তা, জানোয়ার। বালের শিক্ষা নিসোস? মানুষ হওয়ার শিক্ষা না নিয়া এই স্কুল কলেজে পইড়া লাভ কী? আজ তোর একদিন কী আমার একদিন।”

প্রভা সামনে এগোতে নিয়েছিলো অর্ককে থামানোর জন্য। কিন্তু অর্কের মুখে এমন বাজে ভাষা শুনে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মুখ আপনা-আপনি হা হয়ে গেল। সে অর্ককে প্রায় ছয় বছর ধরে চিনে। কখনো তার মুখে গালি শুনে নি। উল্টো সে এমন বাজে ভাষা সহ্যই করতে পারে না। তার সাথে দুর্ব্যবহার করার সময়ও সে কখনো অর্কের মুখ থেকে গালি শুনে নি। আজ এমন গালি শুনে বিভ্রান্তিতে তার চোখদুটো বেরিয়ে আসতে চাইছে।

অর্ক নিচে পরে যাওয়া রাহানকে কলার ধরে উঠাতেই রাহান অর্কের মুখেও জোরে ঘুষি মারলো একটা। অর্ক ফেরতে রাহানের বুকে সজোরে এক লাথি মেরে আবার নিচে ফালিয়ে দেয়। নিচে বসে তার কলার ধরে আবার মারতে শুরু করেছে। অভিজিৎ ও কয়জন তাকে ছাড়াতে গেলে তাদেরও দুই একটা মেরে দিলো। রাহানের স্ত্রী তার একজন পরিচিত এর সাথে কথা বলছিলো। সে সম্পূর্ণ হলের লোকদের একত্রিত দেখে প্রথমে অবাক হলো সেদিকে যেয়ে এমন এক দৃশ্য দেখে ছুটে গেল রাহানের কাছে। সে অর্ককে সরানোর চেষ্টা করে বলে,
“কী করছেন আপনি? ছাড়ুন রাহানকে। ছাড়ুন বলছি।”
অর্ক রাহানের স্ত্রীকে দেখে ছেড়ে দিলো। সে তো আর কোনো নারীর উপর হাত তুলতে পারে না। রাহানের স্ত্রী অর্ককে এক ধাক্কা দিকে সরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাহানের মাথা কোলে তুলে বলল,
“আপনি কী মানুষ? মায়া দয়া নেই আপনার মধ্যে? কী অবস্থা করেছেন আপনি ওর সাথে?”
“আপনার স্বামী কী করেছে এটা আপনি জানেন? আর মায়া দয়া? মায়া দয়া মানুষকে করা যায়, পশুকে করা যায়, জড় পদার্থকে করা যায় এমন অমানুষকে নয়। আপনার স্বামী অন্য নারীর সম্মানে হাত দেয় কোন সাহসে? আমার স্ত্রীর সাথে জোরাজোরি করার চেষ্টা করেছে ও। ওকে এই মুহূর্তে আমি খুন করে কবর দেই নি এইটা ওর ভাগ্য। আর আপনি সে ওর জন্য এইখানে কাঁদছেন না? ও আপনাকে কী ভাবে জানেন? সম্পত্তি। মানুষ না, নিজের সম্পত্তি ভাবে ও আপনাকে।”
কথাটা শুনে রাহানের স্ত্রী মুখ নামিয়ে নিলো। তার মুখে বিস্ময় না বেদনা দেখা গেল। এই দৃশ্যটা দেখে বিভ্রান্ত হলো অর্ক। তার রাগ আরও বাড়লো। সে উঁচু স্বরে বলল,
“আপনি এইসব জেনে শুনে এমন মানুষকে শাস্তি না দিয়ে রক্ষা করছেন ওকে? আপনি নিজেই এক নারী নামে কলঙ্ক। আপনার মতো নারীরা এই সমাজ নোংরা করতে সাহায্য করেন, কতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করতে অংশীদারী হন। আপনাদের মতো নারী নিজের সংসার বাঁচানোর জন্য চুপ থেকে নিজের জীবন নষ্ট করেন সাথে অন্য কতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দেখেন। থু আপনাদের মতো নারীদের উপর যে জেনেশুনে অন্য মেয়েদের জীবন নষ্ট হতে নীরবে দেখে।”
প্রচন্ড রাগে কথাগুলো বলতে যেয়ে তার গলা কেঁপে উঠলো। পরের কথাগুলো বলল নরম ও ভেজা কন্ঠে, “আপনি জানেন ওর এক কান্ডে আমার প্রভা আজও শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। সেদিন ও সাহস করে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে পালিয়েছিলো তবুও সে ঘটনাটা ওর বুকে এমন কালো ছাপ রেখে গিয়েছে যে ও এখনো ভয়ে কাঁপতে থাকে। আর চিন্তা করেন তাহলে আর যারা ওর থেকে বাঁচতে পারে নি তারা কী অবস্থায় আছে। নিজের জন্য না হলেও অন্যের জন্য মায়া বোধ করুন।”
বলে অর্ক এগোতেই রাহান বহু কষ্টে উঠে বসে বলল,
“আর তুই কত সাধু হলে তোর বন্ধুর বউকে বিয়ে করতে পারিস হ্যাঁ?”
অর্ক থেমে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিয়ে করেছি। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ আছি দুইজন। তোর এত জঘন্য কাজের সাথে আমাদের পবিত্র বন্ধনকে মিলাতে যাবি না খবরদার। আর আমার বন্ধুর কথা বলছিস তাই না? বিনয় তখন এইসব জানলে তোর অবস্থা খারাপ করে দিত।”
আজব ভাবে হাসলো রাহান। বহু কষ্টে হাতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করেও পারলো না। সে বলল,
“তোর বউ তোকে এত কিছু বলসে এটা বলে নাই ওই হারামজাদা এইসব জানতো। ওই তো আমার ভুল লুকাতে ওর বউকে পাগল বানিয়ে দিসে।”
অর্ক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলো রাহানের কথার কিন্তু কিছু বলতে পারছিলো না। সে পিছনে ফিরে প্রভার দিকে তাকাল। আর প্রভা মুখ নামিয়ে নিলো। বড়সড় এক ধাক্কা খেলো অর্ক। তার এত বছরের বন্ধুর ব্যাপারে এমন এক কথা জানার পর সে কী বলবে ভাবতে পারলো না।

রাহান আবারও বলল,
“এই শালী যখন আমার মাথায় মেরে পালিয়েছিল তখন ওরা এসেছিলো। বিনয় আমাকে মারতে নিয়েছিলো কিন্তু তোর বন্ধু ও তোর হবু বউয়ের পরকীয়ার কথা সবাইকে জানানোর হুমকি দেওয়ার সাথে সাথে ওর ব্যবহারই পালটে গেল। নূহা এসে ওকে ভাগালো আর আমাকে হাস্পাতাল নিয়ে গেল দুইজনে। আর এই ব্যাপার ঢাকতেও ওই সাহায্য করলো।”
বলেই শব্দ করে হাসতে শুরু করে রাহান। আরও বলে,
“আর এই কালীর প্রতি আমার এত ইন্টারেস্ট আসছে কেমনে জানিস? তোরা দুই বন্ধু যে এক মেয়ের পিছনে পাগল হইছিলি আমি দেখতাম ঠিক কী আছে ওর মধ্যে।”
কথাটা শুনতেই চকিতে প্রভা তাকাল রাহানের দিকে। আবার অর্কের দিকে। সে সময় তার অর্কের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না তাহলে এইসবের মাঝে অর্ক এলো কোথা থেকে?

রাহান তার কথা সম্পূর্ণ করল,
“বিয়ের কথা পাকাপাকি হওয়ার আগ পর্যন্ত তো বিনয় তো ওকে বিয়েই করতো না কিন্তু যখন জানসে তুই এই মেয়েকে ভালোবাসিস তখন ও বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলসে। যেন তুই ওকে না পাস।”
কথাটা শুনতেই প্রভা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল অর্কের দিকে।
রাহান শব্দ করে হেসে বলল,
“আমি বুঝলাম না যে তুই এই কালীর মধ্যে কী দেখলি যে না চিনে জেনে ভালোবেসে বসে ছিলি? আর বিনয় বিয়ের পর খুশি না থাকলেও পরে ঠিকই ওর প্রেমের পড়ে গেছিলো তাই আমিও একটু দেখতাম যে ঠিক কি আছে ওর মধ্যে? তোরা দুইটায় তো ঠিকই পাইলি আমি পাইতে গেলেই আমার পাপ হইয়া গেল? কী ঝটকা খাইলি তো? তোর এতগুলো মাইরের জবাবে এই কথাগুলোই যথেষ্ট ছিলো। তোর এত বছরের বন্ধুত্ব গর্ব আজ শেষ একদম শেষ।”
রাহানের শব্দ করে হাসি দেখে প্রথমে অর্কের ভীষণ রাগ উঠলেও। পরের মুহূর্তে সে নিজেও তাচ্ছিল্য হাসলো। তার হাসি দেখে রাহানের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো অর্কের দিকে।
অর্ক বলল,
“আমাকে ঝটকা দিতে যেয়ে সবার সামনে নিজের গুনাহ কবুল করে ফেললি সাথে সবার সামনে নিজের সম্মান শেষ করে দিলি।”
রাহান কথাটা শুনতেই আশেপাশে তাকাতে শুরু করলো। যেন সে সবার কথা থা ভুলেই গিয়েছিলো।

অর্ক পিছনে ফিরে যেতেই রাহান বলল,
“আমার কোনো ক্ষতি হলে আমি তোকেও ছাড়ব না। না তোকে আর না এই শালীকে যার জন্য আমার এত……”
কথা শেষ করার পূর্বেই অর্ক ঘুরে রাহানের কাছে দ্রুত যেয়ে তার নাক বারবার লাথি মারলো একটা। আর বলল,
“ওর নাম প্রভা। অসম্মান করে ওর নাম নিলে এরপর আর রক্ষা পাবি না।”
বলে পিছনে ফিরে নিজের শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে এগোল। এক মুহূর্তও না থেমে প্রভার হাত ধরে তাকে সাথে নিয়ে গেল।

গাড়িতে উঠে বসে অনেক সময় স্থির রইলো সে। তার হাত কাঁপছিলো। সে সম্পূর্ণ নিজে কাঁপছিল। তার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রভা বলল,
“আপনি ঠিক আছেন?”
অর্ক স্ট্রারিং -এ হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,
“প্রভা সত্যিই কী বিনয় কী নূহার সাথে…….এইসব কোনো ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে তাই না?”
অর্কটা প্রশ্নটা শেষে প্রভার দিকে তাকাল।
প্রভা উওর দিলো না। মিথ্যে কোনো উত্তর দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। সে শুধু বলল,
“আমি টেক্সি নিয়ে আসছি একটা। আপনি গাড়ি চালানোর অবস্থায় নেই।”

টেক্সিতে দুইজন বসে ছিলো। প্রভা তাকিয়ে ছিলো অর্কের দিকে। সে এখনো কাঁপছে। এত বড় ঝটকা সে সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু অর্ক আগের থেকে তাকে ভালোবাসতো এই কথা মানেটা কী?
এখন এই প্রশ্ন কথার অর্থ হয় না।
প্রভা অর্কের হাতের উপর নিজের হাত রাখলো।
অর্ক তার দিকে তাকাল না। শুধু শক্ত করে তার হাতটা ধরে রাখল।

বাসায় এসে আরেকটা ঝামেলার সাক্ষী হলো দুইজন। বড়সড় ঝগড়া চলছে এইখানে। দরজার বাহির থেকেই ঝগড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। মাহমুদ সাহেব বলছে,
“এই ঘরে কী শান্তি মতো খাওয়াও যাবে না না’কি? খেতে বসলাম আর তামাশা শুরু করে দিয়েছে এই বেয়াদবটা।”
কলিংবেল দেওয়ার পর ঝিনুক দরজা খুলল। তাদের দেখতেই বলল,
“আপি, দুলাভাই ভালো হয়েছে তোমরা চলে এসেছ। বাসায় যা হচ্ছে।”
“কী হয়েছে?”
“আংকেল সম্ভবত ভাদ্র ভাইয়ার সাথে আমার বান্ধবী অঞ্জলির বিয়ে ঠিক করেছিলো। এই নিয়ে মা বাবাকে বোঝাচ্ছিল কিন্তু কোনো কিছু হলো আর সৈকত এসে ঝগড়া শুরু করল।”
অর্কের মাথা আজ এমনিতেই ঠিক নেই। এর উপর দরজাতে দাঁড়িয়ে সৈকতের কথা শুনেই তার মাথা আরও নষ্ট হয়ে গেল। সৈকত বলল,
“আপনার মতো মানুষের ঘরে জন্ম নেওয়াটাই আমার দুর্ভাগ্য। আপনাকে আমার বাপ বলতেও ঘৃণা হয়। আপনি মানুষ নামেও কলঙ্ক একটা।”

প্রভা অর্কের দিকে তাকাল। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। সে এগোতেই প্রভা থামাতে চাইলো পারলো না। অর্ক দ্রুত যেয়েই সৈকতের গালে চড় বসিয়ে দিলো। উঁচু স্বরে বলল,
“তুই জানিস তুই কার সাথে কথা বলছিস? কাকে বলছিস তুই এইসব কথা? এখনই ক্ষমা চাবি তুই।”
“একদম না। এমন মানুষের কাছে আমি মোটেও ক্ষমা চাইব না। উনি না এক ভালো স্বামী, না ভালো বাবা আর না ভালো মানুষ। উনি ভাদ্র ভাইয়ার এই অবস্থা জেনেও…..”
“সেটা নিয়ে পরে বুঝানো যেত না বাবাকে? তুই এত বেয়াদবি করার সাহস কোথায় পেলি?”
সৈকতেরও গলার স্বরে উঁচু ও রাগান্বিত,
“মা তো বোঝাচ্ছিলই উনাকে। উনি আমার মা’কে কী বলছে জানেন? আমার তো মুখে আনতেও ঘৃণা হচ্ছে। আমার তো আফসোস হচ্ছে আমার শরীরে উনার রক্ত আছে বলে।”
“তোর আফসোসের প্রয়োজন নেই তাহলে কারণে তোর দেহে আমার বাবার রক্ত নেই।”
কথাটা শুনতেই সবাই চমকে উঠলো। বিশেষ করে সৈকত। মুহূর্তে তার রাগান্বিত চেহেরাটা নির্বিকার হয়ে গেল। আশ্চর্যজনক চেহেরা নিয়ে সে রুমে উপস্থিত সবার দিকে তাকাল। অর্ক আরও বলল,
“আমি মানা করেছিলাম সবাইকে যেন তোকে কখনো না জানায় যে তুই আমাদের অংশ না। কিন্তু ভুল ছিলো আমার। দিনদিন তুই শুধু বাবার অপমান করে যাচ্ছিস। তোর মতো বেয়াদবকে লাই দিয়ে আমিই মাথায় তুলেছি। যখন তোকে বাসায় এনেছিলো তখন ফিরিয়ে দিলেই…….”
কথাগুলো বলতে যেয়েই থমকে গেল অর্ক। নিজ অজান্তেই কত কিছু বলে ফেলল টেরই পেল না সে। রাগের মাথায় তার হুশ থাকে না কখন কী বলে। কিন্তু এত বড় কথা সে বলতে পারে সে নিজেই জানতেই পারে নি।

সৈকতের মনে হচ্ছে তার বুকের ভেতর অনেক বড় একটা পাথর কেউ রেখে দিয়েছে। সে তার মা’য়ের দিকে তাকাল। এই আশায় যে সে বলবে এ-সব মিথ্যে কথা। কিন্তু এমন কিছু হলো না। মা উল্টো মাথা নামিয়ে নিলো।

অর্ক সৈকতের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
“সরি ভাই…সরি। আমি এভাবে বলতে চাই নি। মাফ…….. ”
সৈকত পিছিয়ে গেল। নিজের মা’য়ের হাত ধরে বলল,
“মাফ করবেন এত বছর আপনাদের উপর বোঝা হয়ে থাকার জন্য। আপনাদের দায় একসময় ফিরিয়ে দিব আমি।”
সৈকত সামনে যেতে নিলেই অর্ক তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল,
“আমার মাথা ঠিক ছিলো না ভাই। আমি তোর কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাচ্ছি। তোর বড় ভাইকে মাফ করে দে। আমার ভাইটা না ভালো। আমরা আবার ছোটবেলার মতো হতে পারি না ভাইটা আমার। সব ভুলে যাবি একসময়। যাস না প্লিজ।”
সৈকত তার অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে তাকালো অর্কের দিকে। বলল,
“সব ভুললেও আমি এইটা ভুলতে পারব না যে এই বাসাতেই আমার মা’য়ের গায়ে হাত তোলা হয়েছে আর তাকে বৈশ্যার উপাধি দেওয়া হয়েছে।”
অর্ক থমকে গেল কথাটি শুনে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল নিজের বাবার দিকে।
অন্যদিকে সৈকত তার মা’কে নিয়ে বের হতে নিলেই মা বলল,
“বাবা এমন করে না। এইটা আমাদের পরিবার। তোর বাবা রাগে ছিলো। তোর ভাদ্র ভাইয়ার কী হবে? তোর দাদিমাও নেই বাসায়। তোর পরিবার….”
সৈকত কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো মা’য়ের দিকে। বলল,
“মা তুমি এই মুহূর্তে আমার সাথে না এলে আমি সারাজীবনে তোমাকে আমার চেহেরা দেখাব না। মনে রেখ। আর আমি শুধু কথার কথা বলি না।”

দরজাতে যেয়েই ঝিনুক সৈকতের হাত ধরে বলে,
“আমিও তোমার সাথে যাব।”
সৈকত ঝিনুকের তাকাতেই তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠে তার চোখের জল দেখে। কিন্তু সে নিজেকে সামলায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“কেন? তুমিই তো মুক্তি চাইতে আমার থেকে। পেয়ে গেলে। তোমার ইচ্ছাই তো পূরণ হলো।”
সৈকত ঝিনুকের হাত সরিয়ে নিজের মা’কে নিয়ে চলে গেল। অর্ক দৌড়ে গেল তার পিছনে। ঝিনুক দরজার কাছেই বসে পরলো। সে সমানে কাঁপছে। প্রভা ঝিনুকের কাছে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“চিন্তা করিস না সোনা। অর্ক আছে না, অর্ক সৈকতকে মানিয়ে আনবে।”
“ও আসবে না আপি। ও আর ফেরত আসবে না।”
আবার ঝিনুক বুকের বা’পাশে হাত রেখে ওড়নাটা আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমার বুকে ভীষণ ব্যাথা করছে আপি। নিশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”

চলবে…..

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-৪৫ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1259905297712380/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here