মন_পাড়ায়
পর্ব_৫
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
“সবে এক হুরপরীর দর্শন করলাম। যদি হুরপরীটা স্বপ্নে এসে থাকে তাহলে আমি এই স্বপ্ন থেকে আর জাগতে চাই না। এত সুন্দর স্বপ্ন আর কখনো দেখা হবে কি’না কে জানে?”
“পাগল হয়ে গেলি না’কি কী আবল তাবল বকছিস?”
অর্ণব ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “সাবেক বিলিভ মি, শী লুকস লাইক আ এঞ্জেল।”
“এখন এঞ্জেল’স ওয়াল্ড থেকে বের হয়ে ক্যান্টিন ওয়াল্ডে চল। আমার খিদায় পেটে ইন্দুররা কুস্তি খেলতাসে।”
অর্ণব না নড়ায় সাবেক তার কলার ধরে টানতে টানতেই ভার্সিটির ভিতরে নিয়ে গেল।
ঝিনুক আশেপাশে অফিস খুঁজছিল আর বিড়বিড় করে কতগুলো গালি দিচ্ছিল সৈকতকে। তখনই আবার অর্ণবের কন্ঠ পেল ঝিনুক। ঝিনুক পিছনে ফিরে তাকালো। অপেক্ষা করল অর্ণব আসা পর্যন্ত। অর্ণব তার সামনে এসে বলল, “আপনি কী কিছু খুঁজছেন? সাহায্য করতে পারি?”
ঝিনুক একটু চিন্তা করে বলল, “অফিস খুঁজছি। আসলে আমার কিছু ফরমালিটি বাকি ছিলো। আর কিছু মানে অনেক। দেরিতে ভর্তি হচ্ছি তো তাই এইসব ঝামেলা।”
সাবেক অর্ণবের কানের কাছে যেয়ে বলল, “এই মেয়ের কথা তুই বাহিরে বলেছিলি? সুন্দর আছে কিন্তু আমার চিকেন পিজ্জা থেকে বেশি না। ইয়াম…ইয়াম।”
অর্ণব তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কনুই দিয়ে তার পেটে জোরে মারল। বলল, “নিজের গার্লফ্রেন্ডের কথা বললেও বুঝতাম। অবশেষে পিজ্জা! তোর মতো গাঁধার মাথায়তেই এইসব আসতে পারে। তোকে মাঠে ফালিয়ে উসঠানো উচিত।”
দুইজনের ফিসফিসানি দেখে ঝিনুক বলল, “আসলে আমার একটু তাড়া ছিলো।”
অর্ণব বলল, “সো সরি। সাবেক অঞ্জলিকে একটা কল দিয়ে বল যেন এইখানে আসে।” আবার ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “অঞ্জলিও প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আরও ভালোভাবে আপনার সাহায্য করতে পারবে। ততক্ষণে আমরা অফিসে যাই চলুন।”
সাবেক বলল, “আমার পেটের ইন্দুররা সে কুস্তি খেলতাছে তার কী?”
“তোর পেটে সারাক্ষণই এই কুস্তি খেলা চলে।” অর্ণব ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “আমার সাথে আসুন।”
সৈকত প্লে কোর্টের পাশের পার্কিং লটে তার বাইকের উপর বসে ছিল। তার পাশের বাইকে বসা একটি ছেলে বলল, “এই চাম্পুগুলা এতো একটা সুন্দর মেয়ের সাথে কী করে? হোয়াট দ্যা হেল ম্যান!”
সৈকত তার বন্ধু নিহানের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো। সে দেখলো ঝিনুক অর্ণবের সাথে কোথাও যাচ্ছে। মুহূর্তে তার ভ্রু কুঁচকে গেল। সৈকতের আরেক বন্ধু ইকবাল বলল, “আরে এই মেয়েকে তো কোথাও দেখছি মনে হইতাছে। সৈকত, মেয়েটা তোর এক্স না?”
সৈকত উওর দিলো না ঝিনুকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে না ঝিনুক অর্ণবকে কীভাবে চিনে? আর এইখানে এত হেসে হেসে কথা বলার কী আছে? সে সোজা উঠে সেদিকে গেল। ইকবাল বলল, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কোনো ড্রামা হতে যাচ্ছে।”
নিহান বলল, “মনে পড়ে করিস আগে ক্যামারা বের করে ভিডিও শুরু কর। ধামাকাদার কিছু হলে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছাইড়া দিমু।”
.
.
প্রভা চিন্তায় ভুগছিল। তার নিজের বিয়ের প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। তার রঙ কালো বলে তাকে জলদি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মা ভাবে আর এত ভালো সম্পর্ক পাবে না তার জন্য। তাই বিয়ে করিয়ে দেয় এমন এক পরিবারে যে পরিবার কখনো তাকে মেনেই নেয় নি। তার তখন আঠারো বছর। বিয়ের পর পড়ানোর কথা ছিলো পড়ায় নি। মা’কে বলায় মা বলে, “সংসারই তো করবি পড়াশোনা লাগবে না। শশুড়বাড়ির লোকেরা বলছে তো ভেবেচিন্তেই বলছে গো মা।”
অথচ তার স্বপ্ন ছিলো শিক্ষিকা হবার। প্রথমে যৌতুকে অর্থ নেওয়ার পর আবারও তাকে চাপ দেওয়া হয়—- আবারও— আবারও— আবারও—-
স্বপ্নগুলো মিশে গেল দীর্ঘশ্বাসে…….
কিন্তু সে চায় না ঝিনুকের সাথে এমনটা হোক। সে চায় ঝিনুক নিজের স্বপ্নগুলো বাঁচুক। তাই অর্কের সাথে কথা বলতে যাচ্ছে সে। অর্ক তাকে আবার খোঁটা শুনাক বা মারুক কিছু আশে যায় না। অনেক বছরের অভ্যাস আছে। এখন আর এইসব কিছু মনে হয় না।
প্রভা রুমের ভেতর ঢুকে দেখে অর্ক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়েই চুল আঁচড়াচ্ছে। প্রভা ঢুকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। অর্ক আয়নার দিকে প্রভার প্রতিচ্ছবি দেখেই ভারী কন্ঠে বলল, “কী প্রয়োজন?”
প্রভা মাথা নিচু করে বলল, “ওই—ওই’যে ঝিনুকের পড়া—শোনার কথা বলার ছিলো। প্লিজ ওর পড়াশোনা বন্ধ করাবেন না।”
“পড়াশোনা বন্ধ করাব কেন? ওর সাথে সৈকতের বিয়ের কথা হওয়ার সাথে সাথেই আমি সৈকতের ভার্সিটির প্রিন্সিপালকে কল দিয়ে ওর এডমিশনের কথা বলেছিলাম।”
প্রভা মাথা উঁচু করে হাসিমাখা মুখে বলল, “সত্যি!”
অর্ক উওর দিলো না। সে আলমারির সামনে যেয়ে ড্রয়ের থেকে একটি ঘড়ি বের করে পরতে পরতে বলল, “আমারও কিছু কথা ছিলো।”
“জ্বি বলুন।”
“অদিন ও বিনুর থেকে দূরে থাকো।”
প্রভা ঠিক মতো কথাটা বুঝতে পারল না। সে ভাবল হয়তো ভুল শুনছে। বলল, “আমি হয়তো ভুল কিছু শুনেছি।”
“একদম ঠিক শুনেছ। আমি বলেছি বিনু ও অদিন থেকে দূরে থাকও।” [পর্ব-৪ এ আমি ভুলে প্রভা ও অদিনের কথোপকথনে বিনুর জায়গায় নূহা লিখে ফেলেছিলাম। ‘রাণী নূহা আপু’ শুধু এই অংশে। অর্ক ও প্রভার অংশে তা নূহাই হবে। ভুলের জন্য ক্ষমা করবেন।]
প্রভার চোখে মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো। সে বলল, “আমি আমার নিজের সন্তানদের থেকে দূরে থাকব?”
“তাহলে তোমার কী মনে হয় আমি তোমার সাথে বিয়ে করেছি কেন? তোমার শাস্তির পর যেন আমি অদিন ও বিনুর কাস্টাডি পেতে পারি। আর ওরা তোমার থেকে বেশি এই পরিবারকে আপন করতে পারে। যেন তুমি ওদের জীবন থেকে যাওয়ার পর ওরা নিজেকে সামলাতে পারে। ওরা আমার প্রিয় বন্ধু বিনয়ের শেষ স্মৃতি। তুমি আমার বন্ধু ও আমার নূহাকে আমার কাছ থেকে অলরেডি ছিনিয়ে নিয়েছ আমি তোমাকে বিনু ও অদিনের সাথে এমনটা করতে দিব না। ওদের আমি আমার সন্তানের মতো মানুষ করব।”
প্রভা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমি আজ শুধু জীবিত আছি আমার বাচ্চাদের জন্য আর আপনি বলছেন আপনি ওদের আমার থেকে দূরে করে দিবেন।”
“তুমিও তো আমার ভালোবাসার মানুষকে আমার থেকে দূর করেছ।”
প্রভা এইবার উঁচু স্বরে বলল, “আপনি সে চরিত্রহীন মেয়ের সাথে আমার সন্তানদের মিলাতে যাবেন না।”
অর্ক থেমে গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার সাহস কী করে হয় তুমি আমার নূহাকে চরিত্রহীন বলেছ!”
অর্ক দ্রুত এসে প্রভার হাত মুচড়ে ধরলো। সে রাগে গর্জে উঠে বলল, “নূহার ব্যাপারে আরেকবার কিছু বললে আমি তোমাকে—–”
প্রভা তার কথা কেটে চোখে চোখ রেখে বলল, “কী মারবেন? আপনাদের মতো কাপুরুষরা আর পারেই বা কী? আপনি আপনার বন্ধুর থেকে কোনো অংশেই আলাদা না। আপনাদের মতো পুরুষ দেখলে আমার পুরুষ জাতিকেই ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয়।” প্রভা একটু থেকে গভীর নিশ্বাস ফেলল। তার বুক কাঁপছে। সে নিশ্বাস ফেলছে ঘন ঘন। তার কান্না আসছে খুব কিন্তু তা চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তবুও যেন নোনপানি তার চোখের পাতা ছুঁয়ে যাচ্ছে। সে আবারও বলল, “আর বলছেন আপনার নূহা চরিত্রহীন নয়? কোনো মেয়ে জেনে শুনে বিবাহিত পুরুষের সাথে প্রেমের বা শারীরিক সম্পর্ক রাখলে তাকে চরিত্রহীনই বলে। পরকীয়া কোনো চরিত্রবান মানুষ করে না।”
“তোমার এত সাহস তুমি আমার চোখে চোখ রেখে এ-সব বলছ!”
“বলছি। আরও একশো বার বলব। সত্যি বলতে আমার ভয় নেই। কী করবেন? বেশি হলে মেরে ফেলবেন তাই তো। আমার শুধু এই দেহটাই বাকি, নাহয় আত্নাটা তো শতবার মরে গেছে। আমি চুপ করে থাকি বলে এই নয় যে কেউ আমার থেকে যা চাইবে তা ছিনিয়ে নিবে।” প্রভার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তার কান্না এসেই পরল। গালে বয়ে যেতে শুরু করলো একধারা নোনাপানি। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠেই বলল, “যখন বিনয় আমাকে ছুঁতে আসতো আমি বুঝতাম ও আমার আগে অন্য কোনো মেয়েকে ছুঁয়ে এসেছে। আমি বুঝতাম যখন ও—ও মধ্যরাতে আমাদের রুমের বারান্দায় যেতে মুঠোফোনে গল্প করতো। ও তো এসে আরামে ঘুমিয়ে পড়তো আমার নির্ঘুম রাত কাটতো শুধু। যখন আমি ওকে ভালোবাসি বলতাম, আমি বুঝতাম ওকে অন্যকেউ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ তুলেছে। আমি বুঝতাম। আমার আত্মা তখন আহত হয়েছে যখন আমার স্বপ্ন চুরমার হয়েছে, আমার আত্না তখন আহত হয়েছে যখন আমাকে অমানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, আমার আত্না তখনও নিহত হয়েছে যখন আমার বিশ্বাস ভেঙে গেছে। আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি শুধুমাত্র আমার দুইটা বাচ্চার জন্য। আর আপনি বলছেন আপনি তাদেরকেও নিয়ে নিতে চান আমার কাছ থেকে? আপনি জানেন আমি বিনয় থেকে কাউকে বেশি ভালোবাসি নি আর ওর থেকে বেশি ঘৃণাটাও কাউকে করি নি। দয়া করে আপনি এমন কিছু করবেন না যে আপনাকেও ঘৃণা করতে বাধ্য হই। মনে রাখবেন, মুখ থেকে অভিশাপ দিতে হয় না, কষ্ট পেতে পেতে একসময় মনটাই অভিশাপ দিয়ে দেয়। আর এক স্ত্রীর থেকে মায়ের অভিশাপ অনেক বেশি ক্ষতিকর।”
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]
পর্ব-৪ঃ
https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1187298754973035/