মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-৩
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পরদিন দুপুরে,
খাবার টেবিলে বসে আছেন আনিসুল ইসলাম, মাহিমা বেগম, প্রত্যাশা আর পৃথুলা।
“আজ আমার একটা ফ্রেন্ডের বার্থডে। সন্ধ্যায় ওদের বাসায় অনুষ্ঠান হবে। আমি কি যাব ওখানে?”
সংকোচ নিয়ে কথাটা বলে সবার মুখের দিকে তাকালো পৃথুলা।
পৃথুলার বাবা, মা, প্রত্যাশা সবাই অবাক। কারণ, পৃথুলা সচরাচর কারো জন্মদিন, বিয়ে এসবে যায় না। রিলেটিভস কারো বিয়ে হলে পরিবারের সবাই গেলেও পৃথুলা যায় না। এইতো দুদিন আগে ওর মামাতো ভাইয়ের বিয়ে ছিল। বাড়িশুদ্ধ সবাই গেছে। শুধু পৃথুলাই যায়নি। ও সবসময় বাসাতেই থাকে। পৃথুলা চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। নাচ-গান, হৈচৈ পছন্দ না ওর। তাছাড়া পৃথুলা আগুন সুন্দরী। যেখানেই যায় ছেলেরা তার জন্য পাগল হয়ে যায়। এসব একদম বিরক্ত লাগে পৃথুলার। তাই সে সাধারণত কোনো অনুষ্ঠানে যায় না।
মাহিমা বেগম বললেন,
“তুইতো কখনো এসব অনুষ্ঠানে যাস না। আজ যেতে চাইছিস যে?”
পৃথুলা ইতস্তত করে বলল,
“আসলে ও আমার বেস্টফ্রেন্ড। অনেক রিকুয়েস্ট করেছে যাওয়ার জন্য, তাই ফেলতে পারলাম না।”
প্রত্যাশা বলল,
“কার কথা বলছিস আপি? তোর বেস্টফ্রেন্ড তো তিষাম আপু আর অপর্ণা আপু। অপর্ণা আপুর জন্মদিন গতমাসে গেল। তোকে অনেক রিকুয়েস্ট করা সত্ত্বেও তুই গেলি না। আর তিষাম আপুর বার্থডে আসতে তো আরও দেরি আছে। তবে তুই কার কথা বলছিস?”
পৃথুলা আমতা আমতা করে বলল,
“বিভা।”
“বিভা নামে তোর কোনো বেস্টফ্রেন্ড আছে। জানতাম না তো।”
আনিসুল ইসলাম বললেন,
“ওকে এত জেরা করছিস কেন প্রত্যাশা? হতে পারে বিভা ওর নতুন বান্ধবী। তাই এখনো আমাদের সাথে বিভার পরিচয় করায়নি।”
পৃথুলা বলল,
“হ্যাঁ বাবা। তুমি ঠিক বলেছো। আচ্ছা, আমি কি যাব?”
“এমনিতে তো কোথায় যেতে চাস না। এখন যখন নিজে থেকেই যেতে চাচ্ছিস, আমি না করব না। যাস। অনুষ্ঠান শুরু হবে ক’টায়?”
“রাত আটটার দিকে।”
“ঠিক আছে যাস। প্রত্যাশার সামনে পরিক্ষা। ওকে তো পড়তে বসতে হবে। নইলে প্রত্যাশাকে তোর সাথে দিয়ে দিতাম।”
মাহিমা বেগম বললেন,
“যাচ্ছিস যা। কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস মা। দিনকাল মোটেও ভালো না। দেশের যা অবস্থা!”
“তুমি ভেবো না মা। আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসব।”
পৃথুলার খুব খারাপ লাগছে বাবা মাকে মিথ্যে কথা বলায়।
সন্ধ্যেবেলা আলমারি খুলে জামা বের করতে গিয়ে মনে পড়ল বিভোর নীল শাড়ি পরার কথা বলেছিল। আলমারিটা বন্ধ করে মাহিমা বেগমের কাছে গেল পৃথুলা।
“মা, তোমার নীল শাড়িটা দেবে?”
“কেন?”
“শাড়ি পরে যেতে চাইছিলাম। অপর্ণা আর তিষামও শাড়ি পরে আসবে। তাই আমিও..।”
“ঠিক আছে। ওয়্যারড্রোব থেকে নিয়ে যা।”
“আচ্ছা।”
পৃথুলা শাড়িটা পরল। চুলগুলো আঁচড়ে বেণী করে নিল। চোখে মোটা করে কাজল লাগালো আর ঠোঁটে হালকা লিপগ্লস।
বিভোর বলেছিল একটু সেজে যেতে। আর পৃথুলার কাছে সাজ বলতে কেবল এটুকুই। তবুও দারুন লাগছে পৃথুলাকে।
প্রত্যাশা স্টাডি টেবিলে বই পড়ছে। পাশ ফিরে পৃথুলার দিকে তাকাল। ওকে একবার আপাদমস্তক দেখে বলল,
“তোকে ভীষন সুন্দর লাগছে আপি। একেবারে পরী। বিভোর ভাইয়া তোকে দেখে তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।”
পৃথুলা চমকে তাকালো প্রত্যাশার দিকে৷
প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিরে ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? শোন, আমাকে মিথ্যে বলে লাভ নেই। আমি সব জানি।”
পৃথুলা অবাক হয়ে বলল,
“কী জানিস?”
“প্রথমত, বিভা নামে তোর কোনো বান্ধবী নেই। দ্বিতীয়ত, আজ বিভোর ভাইয়ার জন্মদিন। তৃতীয়ত, তুই এখন শাড়ি পরে সেজেগুজে বিভোর ভাইয়ার বাসায় যাচ্ছিস।”
পৃথুলা থতমত খেয়ে গেল। প্রত্যাশা এসব জানলো করে? উত্তরটা প্রত্যাশা ই দিল।
“শোন, একটু আগে বিভোর ভাইয়া আমাকে ফোন দিয়েছে। বলল, আমিও যেন তোর সাথে যাই।”
“ওহ। ঠিকাছে তাহলে তুইও সাথে চল।”
“পাগল হয়েছিস নাকি! সামনে পরিক্ষা। পড়েই কূল পাই না। আমি যাব তোর বয়ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টিতে! অসম্ভব। তাছাড়া তুই-ই তো সবসময় বলিস আমি ঠিকমত লেখাপড়া করি না। ফাঁকিবাজি করি। তাহলে এখন তোর সাথে যেতে বলছিস কেন? তাছাড়া, আমি বিভোর ভাইয়াকে না করে দিয়েছি। যাহোক, অলরেডি সাতটা বাজে। যেতে হলে এখনি বের হ।”
বাসা থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিল পৃথুলা। বিভোর ওর বাসার ঠিকানা দিয়েছিল। রিকশা ওয়ালাকে বলল সেদিকে যেতে। এই প্রথম বিভোরের বাসায় যাচ্ছে পৃথুলা। এর আগে বিভোর তার বাসায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পৃথুলাকে যাওয়ার জন্য রিকুয়েস্ট করেছে। কিন্তু পৃথুলা কখনোই যায়নি।
অনেকসময় পর বিভোরের দেওয়া ঠিকানায় রিকশা থামলো। ভাড়া মিটিয়ে বিভোরকে ফোন করল পৃথুলা। কয়েকবার রিং বাজার পর রিসিভ করলো বিভোর।
“হ্যাঁ পৃথুলা কোথায় তুমি?”
“তোমার বাসার সামনে।”
“ওখানে কি করছো? ভেতরে আসো।”
“আসলে…”
“ঠিক আছে। তুমি থাকো ওখানে, আমি আসছি।”
বলেই ফোন কেটে বাহিরে বের হলো বিভোর। গিয়ে দেখলো নীল শাড়ি পরিহীতা এক নীল পরি দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ফেরানোটা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ মনে হলো বিভোরের। বিভোরের এমন চাহনি দেখে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করল পৃথুলা।
“উফ্ মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। ড্রিংকেও বোধহয় এতটা নেশা নেই, যতটা তোমার রূপে আছে। ইউ লুক লাইক আ ফেইরি।”
বিভোর বলল মুগ্ধ হয়ে। পৃথুলা কিছু বলল না। বিভোর হাত বাড়াল। পৃথুলা মৃদু হেসে বিভোরের হাতে হাত রাখল। তারপর এগিয়ে গেল বাসার ভেতরে।
ড্রয়িংরুমে মানুষের সমাগম চলছে। লাউড মিউজিক হচ্ছে। এত মানুষ, এত হৈ চৈ এর মধ্যে পৃথুলার একটু অস্বস্তি লাগছে। তবু কিছু বলল না।
বিভোরদের ড্রয়িংরুমটা অনেক বড়। বাসায় আধুনিকতার ছোঁয়া পুরোটাই লেগে আছে। ড্রয়িংরুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বিভোর পৃথুলার হাত ধরে একজন মধ্যেবয়স্ক পুরুষের সামনে নিয়ে যায়। লোকটার চেহারার সাথে বিভোরের চেহারায় অনেকটা মিল আছে। পৃথুলার বুঝতে বিলম্ব হলো না যে ইনিই বিভোরের বাবা। পৃথুলা সালাম দিল আসাদ হককে। আসাদ হক হাসিমুখে সালামের জবাব দিলেন।
“আব্বু, ও ই হলো পৃথুলা। যার কথা কাল রাতে তোমাকে বলেছিলাম।”
বিভোর পরিচয় করিয়ে দিল তার বাবা আসাদ হকের সাথে। আসাদ হক বললেন,
“হ্যাঁ বলেছিলে তো। তবে মিথ্যে বলেছিলে।”
বিভোর ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মিথ্যে বলেছি?”
“হুম। তুমি বলেছিলে তোমার গার্লফ্রেন্ড সুন্দরী। এতো সুন্দরী নয়, আমার হবু পুত্রবধু তো আগুন সুন্দরী দেখছি।”
বিভোর হাসল। হাসলেন আসাদ হকও। পৃথুলা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রইল। আসাদ হক পৃথুলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“বাসায় কে কে আছো তোমার?”
“আব্বু, আম্মু, ছোট একটা বোন।”
“তোমার বাবা কি করেন?”
“কলেজের টিচার।”
আসাদুল হকের মুখের হাসি এক মুহূর্তেই কর্পূরের ন্যায় উবে গেছে। তাঁর এতক্ষনের হাসিমাখা মুখটা ফ্যাকাশে, আমষেটে হয়ে গেছে।
আসাদুল হক, দেশের শীর্ষ শিল্পপতিদের মধ্যে যিনি অন্যতম। তার ছেলে কীনা পছন্দ করে এমন একটা মেয়েকে যার বাবা সামান্য একজন টিচার! আসাদ হকের একমাত্র ছেলের শ্বশুর হবেন একজন কলেজ টিচার! এ কথা সমাজে জানাজানি হলে তার স্ট্যাটাস কোথায় থাকবে! গতরাতেই বিভোর বলেছিল পৃথুলার কথা। তখন জিজ্ঞেস করেনি মেয়ের বাবা কি করে। কারণ, বিভোরের উপর তার ভরসা ছিল। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো বিভোর নিশ্চয়ই তার স্ট্যাটাসের কোনো মেয়েকেই লাইফ পার্টনার হিসেবে চুজ করবে। কিন্তু সে পছন্দ করল কিনা একজন শিক্ষকের মেয়েকে!
আসাদুল হকের এমন গম্ভীর চেহারার মানে বুঝতে অসুবিধা হলো না পৃথুলার। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। এত ধনী পরিবারে বউ হয়ে আসার যোগ্যতা হয়তো পৃথুলার নেই।
.
চলবে…
গল্পটা যারা পড়েন, মন্তব্য করবেন প্লিজ।