মন_বাড়িয়ে_ছুঁই লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা পর্ব-২২

মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-২২
.
ওরা যখন খামারবাড়ি থেকে বের হলো তখন বিকেলে গড়িয়ে সন্ধ্যে। পরিষ্কার আকাশটা হঠাৎ করেই ছাইরঙা মেঘে ছেয়ে গেছে। খামারবাড়ি থেকে বেরিয়ে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে সামনে বাইক থামাল অভ্র। পৃথুলা বলল,
“এখানে থামালেন কেন?”
“কিছু খেয়ে নিই চলো।”
“আকাশের অবস্থা দেখেছেন? বৃষ্টি নামতে পারে।”
“কিছু হবে না। চলো।”
অভ্র পৃথুলার হাত টেনে রেস্টুরেন্টের ভেতরে নিয়ে গেল।

পৃথুলার কথাই ঠিক হয়েছে। ওরা রেস্তোরাঁয় ঢোকার পাঁচ মিনিটের মাথায়ই বৃষ্টি নেমেছে অঝোড় ধারায়। পৃথুলা বলল,
“আমি বলছিলাম না বৃষ্টি নামবে? দেখলেন তো!”
“তাহলে তো রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভালোই হইছে। রওনা হলে এখন তো ভিজতে হতো।”
পৃথুলা চুপ মেরে গেল। অভ্রর কথাই ঠিক।

সেই যে সন্ধ্যায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে এখনও থামাথামি নেই। এদিকে রাত আটটা বেজে গেছে। ওরা এখনো রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে পারেনি। রাত গড়াচ্ছে কিন্তু বৃষ্টি থামছে না।

“ইশ্ সবটা আমার জন্য হয়েছে। আমিই বললাম বাইক নিতে। গাড়ি নিয়ে আসলে এখন আমাদের এভাবে বসে থাকতে হতো না! ধ্যাৎ! আমি যে কি একটা।”
অভ্র স্বাভাবিক গলায় বলল,
“নিজেকে দোষ দিচ্ছো কেন? তুমি কি জানতে এমনটা হবে?”

আরো কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। পৃথুলা উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“যাক, অবশেষে বৃষ্টি কমেছে৷ এখন বাড়ি যেতে পারব।”
অভ্র চিন্তিত গলায় বলল,
“কিন্তু আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি কমেছে ঠিক। কিন্তু আবার নামতে পারে। তাছাড়া, অলরেডি রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। বাসা থেকে অনেকটা দূরে এসেছি। রাতের বেলা এতটা পথ, তার উপর যদি আবার বৃষ্টি নামে, কেমন হবে ভেবেছো?”
পৃথুলার উৎসাহে ভাটা পড়ল। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুঁটে উঠল। বলল,
“তাহলে এখন কী হবে?”
“আমার মনে হয়, রাতটা এখানেই কোনো হোটেলে কাটিয়ে দেওয়া উচিৎ। যদি তোমার আপত্তি না থাকে।”
“আপত্তি থাকলেই কি? এমন একটা সিচুয়েশনে পড়লাম, আর তো কোনো উপায়ও নেই। যাহোক, বৃষ্টিটা যেহেতু একটু কমেছে এখনি বের হই চলুন।”
“হুম চলো।”

রেস্টুরেন্টের বিল পে করে পৃথুলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অভ্র। সৌভাগ্যবসত রেস্তোরাঁর কাছাকাছিই একটা হোটেল ছিল। একটা রুম বুক করে উঠে পড়ল ওরা। অভ্রর কথাই সত্যি হয়েছে। অর্ধঘণ্টা পর আবারও তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
.
“ছবিগুলো দারুন হয়েছে। আপনি তো খুব সুন্দর ছবি তোলেন। আপনি ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে ফটোগ্রাফি করেন। সেটা ভালো হবে।”
বিছানায় বসে কোলের মধ্যে বালিশ নিয়ে মোবাইলে বিকেলের তোলা ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলল পৃথুলা।
অভ্র হাসল পৃথুলার কথায়। কিছুক্ষন পর অভ্র বলল,
“সাড়ে এগারোটা বাজে। ঘুমাবে না?”
“উহু, ঘুম আসছে না।”

পৃথুলা খাট থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আকাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে মেঘ ডাকছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টিটা এখনো থামেনি৷ একটানা পড়ছে। বৃষ্টি বোধহয় আজ থামবে না বলেই পণ করেছে। শহরের দোকানপাট সব ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় রাতের বৃষ্টিভেজা শহরটাকে দেখছে পৃথুলা।

অভ্র বাসার ল্যাণ্ডফোনে কল দিল। ফোন ধরল দিলারা বেগম।
“হ্যালো।”
“দাদী…”
“কে? অভ্র?”
“হ্যাঁ, দাদী।”
“কই তোরা? কুনসময় আইবি? বাইরে বিষ্টি হইতাছে। এহনো আয়োসনা ক্যান?”
“আসলে দাদী, আমরা বৃষ্টির কারণে আটকে পড়েছি। আজ ফিরতে পারব না।”
“কস কি? তাইলে থাকবি কই?”
“এখানে একটা হোটেলে উঠেছি। কাল সকালে বাসায় আসব ইনশাআল্লাহ। আম্মুকে জানিয়ে দিও, কেমন?”
“আইচ্ছা। আমার নাতবউ কই?”
অভ্র বারান্দায় পৃথুলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সে বৃষ্টিবিলাশ করছে। যাহোক, চিন্তা করো না, কাল সকালে পৌঁছে যাব। রাখছি।”

কল কেটে ধীরপায়ে পৃথুলার পাশে এসে দাঁড়াল অভ্র। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো থেকে থেকে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে পৃথুলাকে। অভ্র বলল,
“এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিজে যাচ্ছ তো।”
পৃথুলা জবাবে কিছু বলল না। অভ্রও আর কিছু বলেনি৷ তাকালো সম্মুখে।

কয়েকমিনিট কাটল নিরবতায়। নিরবতা ভেঙে পৃথুলা বলল,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
অভ্র পিচঢালা রাস্তার দিকে তাকিয়েই বলল,
“হুম করো।”
“আপনার কি কখনো আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে না?”
অভ্র অবাক হয়ে তাকালো পৃথুলার দিকে। বলল,
“মানে?”
“আমাদের বিয়ে হয়েছে অনেকগুলো দিন হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক এখনো হয়নি। আপনি চেষ্টাও করেননি করার।”
“হঠাৎ এসব বলছো কেন পৃথা?”

পৃথুলা এবার সরাসরি অভ্রর চোখের দিকে তাকাল। সোজাসাপ্টা উত্তর দিল,
“দেখেন, আপনি আমার স্বামী। আমার উপর পুরোপুরি অধিকার আপনার আছে। আপনি চাইলে আমার উপর অধিকার খাটাতেই পারেন। আপনার জায়গায় অন্য পুরুষ হলে সেই কবেই আমার উপর স্বামীত্ব ফলাতো।”
“ভালোবাসো আমাকে?”

পৃথুলা তাকালো অভ্রর দিকে। কয়েক সেকেণ্ড পর আবার চোখ নামিয়ে নিল। হ্যাঁ, অভ্রর সাথে থাকতে থাকতে ওর প্রতি মায়া জন্মেছে ঠিকই। কিন্তু ভালবাসা! সেকি ভালবাসতে পেরেছে অভ্রকে? নিজেই প্রশ্ন করল নিজের মনকে।

অভ্র পৃথুলার উত্তরের অপেক্ষা না করে হালকা হেসে বলল,
“আমি আগে তোমার মন ছুঁতে চাই পৃথা, তারপর শরীর। হ্যাঁ, আমি চাইলে তোমার উপর অধিকার খাটাতেই পারি। কিন্তু সেটা করলে তখন আমার মনে হবে আমি যা করছি ভালবাসার খাতিরে করছি না, অধিকারের খাতিরে করছি। জোর করে স্বামীত্ব ফলানো যায় কিন্তু সেখানে আন্তরিকতা, ভালবাসা থাকে না। আর যেখানে ভালবাসা থাকে সেখানে অধিকার আপনা আপনি আদায় হয়ে যায়। আমি চাই তুমি আমাকে ভালবেসে তোমার উপর অধিকার আদায়ের অনুমতি দাও, নিজের উপর জোর করে নয়। আমি মন বাড়িয়ে তোমার মন ছুঁতে চাই পৃথা। যেদিন ছুঁতে পারব সেদিনই নাহয় তোমাকে কাছে টানার সাহস দেখাব।”

এটুকু বলে অভ্র আবার সামনে তাকাল। পৃথুলা একমনে তাকিয়ে রইল অভ্রর শ্যামবর্ণ মুখপানে। বিভোর সবসময় পৃথুলাকে ছোঁয়ার বাহানায় থাকত। আর এই মানুষটা! বাহ্যিক দিক থেকে বিভোর অভ্রর চেয়ে অনেক সুন্দর, স্মার্ট। কিন্তু মনের দিক থেকে অভ্রর সাথে তুলনাই চলে না বিভোরের। বিভোর ছিল সৌন্দর্যের পূজারী আর অভ্র ভালবাসার, পবিত্রতার।

“কী দেখছো?”
ভাবনার সুতো ছিঁড়ল পৃথুলার। চোখ সরিয়ে নিল সে। পরক্ষনেই আবার অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমারটা বাদ দিন৷ কিন্তু আপনি তো আমাকে ভালবাসেন না। তাহলে?”
অভ্র হেসে বলল,
“তুমি লাভ এট ফার্স্ট সাইট এ বিলিভ করো?”
“নাহ।”
“আমিও করতাম না। কিন্তু তোমাকে দেখার পর বিশ্বাস হলো। প্রথম দেখার সেই মাথা নিচু করে বসে থাকা লাজুকলতা মেয়েটাই আমার মনটা দখল করে নিয়েছে।”
..
সকালে নাশতা করে বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল দুজন। এখান থেকে গিয়ে অভ্রর অফিস ধরতে হবে। রাস্তার পাশে ফুচকার দোকান দেখে পৃথুলা বলল,
“থামেন থামেন।”
অভ্র বাইকের ব্রেক কষে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে?”
পৃথুলা আঙুল দিয়ে ফুচকা দেখিয়ে বলল,
“ফুচকা খাব।”
পরক্ষণেই আবার বলল,
“না থাক৷ আপনার অফিসে লেট হয়ে যাবে।”
“নামো।”
“হুম?”
“ফুচকা খাবে না? নামো।”
“কিন্তু আপনার অফিস…।”
“নামো।”

অভ্র বাইকটা সাইডে রেখে ফুচকাওয়ালার কাছে গেল৷ পৃথুলা ফুচকাওয়ালাকে বলল,
“মামা, একপ্লেট ফুচকা দিন।”
অভ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
“একপ্লেট কেন? আমি খাব না?”
পৃথুলা অবাক হয়ে বলল,
“আপনি খাবেন?”
“হুম।”
“কিন্তু ফুচকা তো মেয়েদের খাবার। ছেলেরা সাধারণত ফুচকা খায় না।”
“কে বলেছে তোমাকে?”
“আমি জানি।”
“আমি খাই। আমি একটু অন্যরকম কিনা!”
পৃথুলা হেসে বলল,
“একটু না, পুরোটাই অন্যরকম।”

দিনকয়েক পর অভ্র পৃথুলাকে নিয়ে শের ই বাংলা বাংলা মেডিকেল কলেজে যায়। চার বছর আগে এই কলেজেই পড়ত ও৷ ফার্স্ট টার্ম দেওয়ার পরই ওর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অভ্র প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে চার বছরের বেতন পরিশোধ করে দেয়। পৃথুলার পড়াশুনা আবার শুরু হয়।
.
চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here