মন_বাড়িয়ে_ছুঁই লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা পর্ব-১৮ .

মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-১৮
.
পৃথুলা কিছু বুঝল না। আঞ্জুমানও কিছু বুঝলেন না। মনামী আঞ্জুমানকে বললেন,
“এই মেয়ে! এই মেয়ে অভ্রর বউ?”
“হ্যাঁ, কেন? কি হয়েছে?”
“তোর সর্বনাশ হয়েছে। তুই এই মেয়ের ব্যাপারে ভালোমত খোঁজ খবর নিয়ে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিস? ছিঃ! ছিঃ! এমন একটা মেয়ের সাথে অভ্রর বিয়ে দিলি কি করে!”
এবার আঞ্জুমানের চোখ মুখে কিছুটা রাগী ভাব ফুটে উঠল। গম্ভীর গলায় বললেন,
“ঠিক করে কথা বল মনামী। পৃথুলা আমার পুত্রবধু। আর কি হয়েছে তুই বলবি প্লিজ?”
মনামী পৃথুলার দিকে আঙুল তাক করে চেঁচিয়ে আঞ্জুমানকে বললেন,
“শি ওয়াজ রেপড।”

এক মুহূর্তেই পরিবেশটা থমকে গেছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের মাথার উপর অদৃশ্য বাঁজ পড়েছে। আঞ্জুমান, উৎস, অর্থি সবার চোখ বিষ্ফোরিত। সবার দৃষ্টি পৃথুলার দিকে। আর পৃথুলার অসহায় দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। ওর চোখ দুটো ছলছল করছে। চেঁচামেচির শব্দ শুনে ইতিমধ্যে অভ্রও হাজির সেখানে।

দিলারা বেগম ইংরেজী জানেন না৷ স্বভাবতই মনামীর কথাটা তার বোধগম্য হলো না। তিনি আঞ্জুমানকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আঞ্জুমান, হেতি কি কইলো?”
আঞ্জুমান শাশুড়ির কথায় জবাব দিলেন না৷ শান্ত্ব চোখে মনামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এইটা কি বললি মনামী!”
“আমি সত্যি বলছি আঞ্জুমান। এই মেয়ে চার বছর আগে রেপড হয়েছে। তুই ভালোমত না জেনে একটা রেপড মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে অভ্রর জীবনটাই নষ্ট করে দিলি!”
এবার অভ্র মুখ খুলল। বলল,
“আন্টি, আপনাকে কে বলেছে আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে! আমার জীবন নিয়ে আমাকেই ভাবতে দিন। প্লিজ ডোন্ট ইন্টারফেয়ার মাই পারসোনাল লাইফ।”
মনামী অস্থির হয়ে বললেন,
“তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছো না, তাইতো? বাট অভ্র ট্রাস্ট মি। এই মেয়ে ধর্ষিতা।”
উৎস তেঁতে উঠে বলল,
“হোয়াট’স রঙ উইথ ইউ আন্টি। কি আজেবাজে কথা বলছেন তখন থেকে।”
“বাজে কথা না। যেটা ঠিক সেটাই বলছি।”

অভ্রর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। তবু সিনক্রিয়েট চাচ্ছে না বলে শান্ত্বস্বরে বলল,
“আন্টি প্লিজ। আপনি আর একটা কথাও বলবেন না। আমার পারসোনাল ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না। ইট’স আ হাম্বল রিকুয়েস্ট।”
“অভ্র তুমি বুঝতে পারছো না, এই মেয়েটা তোমাদের কাছ থেকে ব্যাপারটা লুকিয়ে গেছে। তোমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছে। তোমাকে বোকা বানিয়ে তোমার গলায় ঝুলে পড়েছে।”
“পৃথুলা আমার কাছ থেকে কিছু লুকায়নি। আমি জানি সবটা। ইনফ্যাক্ট, আমি সব জেনেই বিয়েটা করেছি।”

আঞ্জুমান হতবাক হয়ে তাকালেন ছেলের দিকে। বললেন,
“তুই জানতি?”
অভ্র নতমুখে বলল,
“হ্যাঁ আম্মু।”
মনামী হতভম্ব গলায় বললেন,
“তুমি জানতে? জেনেশুনে একটা ধর্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করলে! আঞ্জু তোর ছেলের কথা শোন। ছেলে তো তোর মান সম্মান কিছুই রাখল না। তা কি দেখে বিয়ে করলে এই কলঙ্কিনিকে? রূপ দেখে? আর তো কিছু বাকিও নেই এই মেয়ের মধ্যে।”

অভ্র চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“মুখ সামলে কথা বলুন আন্টি। বাইরের লোকের মুখে আমার ওয়াইফকে নিয়ে কোনো বাজে কথা টলেরেট করব না।”
“বাহ্! ওয়ান্ডারফুল! একটা ধর্ষিতা মেয়েকে নিয়ে বড় বড় কথা বলছো! আর আমাকে বলছো বাইরের লোক। ভুলে যেও না আমি তোমার মায়ের বান্ধবী হই।”
“সে জন্যই তো এখনো আপনার সাথে ভদ্রভাবে কথা বলছি। কিন্তু আপনি যদি পৃথুলাকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলেন তাহলে আপনার সম্মানের ছিটেফোঁটাও আমি বাঁচিয়ে রাখব না।”

মনামী মেহনাজ দাঁত কটমট করে পৃথুলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাঁজখাই গলায় বললেন,
“এই মেয়ে, মুখে কুলুপ এঁটে আছো কেন? ভালোই তো ঘোল খাইয়েছো আমার বান্ধবীর ছেলেকে। এখন এমন ভাব করে দাঁড়িয়ে আছো যেন ভাঁজা মাছটাও উল্টে খেতে জানো না।”
প্রত্যাশা এতক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার আর থাকতে পারল না। বলল,
“আর একটাও বাজে কথা বলবেন না আমার বোনকে নিয়ে। সমস্যা কি আপনার, হ্যাঁ? অভ্র ভাইয়া সব জেনেশুনেই আপিকে বিয়ে করেছে। তার তো আপিকে নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। আপনি কোথা থেকে আসছেন অন্যের বাড়া ভাতে ছাই দিতে। ফালতু মহিলা!”

পৃথুলা প্রত্যাশার হাত চেপে ধরল। চোখের ইশারায় কিছু বলতে বারণ করল। প্রত্যাশা আরো কিছু বলতে গিয়েও বোনের চোখের ভাষা উপেক্ষা করতে পারল না, দমে গেল।
মনামী বললেন,
“চোরের মায়ের বড় গলা। দুই বোন একই ক্যাটাগরির। একটা তো বাজারি, আরেকটা উচ্চ মাত্রার বেয়াদব। ইশ্, কেন যে আমি বিয়েতে থাকলাম না। নয়তো এই নষ্টা মেয়ের সাথে অভ্রর বিয়ে কিছুতেই হতে দিতাম না।”
পৃথুলার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। মাহিমা বেগম শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কাঁদছেন। আনিসুল ইসলাম থম ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ আজ তাদের এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে এটা তারা কল্পনাও করেননি।

অভ্র পৃথুলাকে সরিয়ে নিজে মনামীর মুখোমুখি দাঁড়াল৷ শান্ত্ব একইসাথে কঠিন মুখ করে বলল,
“আপনি থাকলে বিয়েটা হতে দিতেন না, তাই না? বিয়ে ভাঙার আপনি কে? নিজেকে অতোটা ইম্পরট্যান্ট ভাবার কিছুই নেই মিসেস মনামী মেহনাজ।”
মনামী একটা ঝটকা খেলেন। সম্বোধন আন্টি থেকে একেবারে মিসেস মনামী মেহনাজ!

“পৃথুলার চার বছর আগের কাহিনি মনে রেখেছেন, আপনার মেয়ের মাত্র কয়েক মাস আগের কাহিনি মনে রাখেননি? আপনার মেয়ে তার বয়ফ্রেণ্ডের সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভ হয়ে প্রেগন্যান্ট হয়েছে, সেটা ভুলে গেছেন? অন্যের দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকে তাকান।”
মনামী অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“হোয়াট আর ইউ সেয়িং? তুমি আমার মেয়ের সাথে এই মেয়েটার তুলনা করছো?”
“প্রশ্নই ওঠে না৷ আমার কি মাথা খারাপ যে আপনার মেয়ের মত নষ্টা মেয়ের সাথে আমার স্ত্রীর তুলনা করব?”
“কি বললে তুমি!”
“ভুল কিছু নয়। পৃথুলা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাতেই আপনি ওকে নষ্টা বললেন৷ আর আপনার মেয়ে নিজের ইচ্ছেয় তার প্রেমিকের সাথে ইন্টিমেট হয়ে নোংরামি করেছে। তাহলে আপনার মেয়েকে কি বলব মিসেস মনামী? ধোঁয়া তুলসী পাতা? অবশ্য যার নিজের চরিত্রেই দোষ আছে তার মেয়ে ভালো হবেই বা কিভাবে!”

পুরো হলরুমের সবাই হতভম্ব হয়ে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্রকে বরাবরই সবাই শান্ত্ব, ভদ্র হিসেবে জানে। বড়দের সাথে উচ্চবাচ্য দূরে থাক, কখনো কটাক্ষ করেও কথা বলেনি সে। বড়দের সাথে সর্বদাই সম্মানের সাথে কথা বলে। কিন্তু আজ যেন সবাই অভ্রর অন্য রূপ দেখছে।

মনামী বিষ্ফোরিত গলায় বললেন,
“কিহ? আমার চরিত্রে দোষ আছে?”
“আপনাকে মাঝে মাঝেই একজন ভদ্রলোকের সাথে দেখা যায়৷ সেদিন শপিংমলেও দেখেছি। ভদ্রলোকের সাথে আপনার ঘনিষ্ঠতা দেখলে যে কেউ ভাববে আপনারা স্বামী-স্ত্রী। ওনার সাথে যে আপনার পরকীয়া চলছে সেটা কি আঙ্কেল জানে?”
এবার দ্বিতীয় বোম্বটা ফাটালো উৎস। বলল,
“আরে হ্যাঁ। ওই কালো, পেটমোটা, ভুড়িওয়ালা লোকটা না ভাইয়া? আন্টি, আপনাকে কয়েকদিন আগে রাত ন’টার পরে ওই লোকের সাথে হোটেলে ঢুকতে দেখেছিলাম। অতো রাতে ওনার সাথে হোটেলে গিয়ে কি করছিলেন আন্টি?”
দিলারা বেগম দুই গালে হাত রেখে চোখ বড় বড় করে বললেন,
“নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ!”
অভ্র বলল,
“আসলে নষ্টা, বাজারী এই ওয়ার্ডগুলো পৃথুলার সাথে যায় না। যায় আপনার আর আপনার মেয়ের সাথে।”

কান গরম হয়ে গেল মনামী মেহনাজের। গটগট করে হেঁটে আঞ্জুমানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
“কিরে কিছু শুনতে পাচ্ছিস না তুই? ওই ধর্ষিতা মেয়েটার জন্য তোর ছেলে আমাকে কিভাবে ইনসাল্ট করছে দেখছিস না তুই? চুপ করে আছিস কেন?”
দিলারা বেগম গজগজ করে বললেন,
“হেয় কি কইবো? তোমার শরম করে না? তোমার খাসলত এর লাইগ্যা তোমারে কোনো কালেই আমার পছন্দ হয়নায় মাতারি। তোমার মাইয়াডায় তোমার লাইগ্যাই খারাপ হইছে। ছিঃ ছিঃ! মাইয়া একটা বিয়ার আগেই পোয়াতি হইছে। এহন হুনি নিজেও ব্যাডা থুইয়া মাইনষের লগে আকাম করে৷ থু থু। আঞ্জুমানডায় যে কিল্লিগ্যা তোমার মতন খবিশ মাতারির লগে সই পাতাইলো বোঝবার পারতাছি না।”
মনামী দম খিঁচে আঞ্জুমানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আঞ্জুমানের কিছু বলার আশায়।
.
চলবে______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here