#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৫
#সাহেদা_আক্তার
– সরি সরি। খেয়ে নিন। আপনার সাথে কিছু কথা আছে মিস মম।
– কি নিয়ে?
– আগে খেয়ে শেষ করুন তারপর বলছি।
দুইজনই চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো দ্রুত। রিয়ান জিজ্ঞেস করল, চা কফি? মম না করে দিয়ে বলল, বলুন কি বলবেন। রিয়ান এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে বলল, মিস ফারিজা বলেছে আপনি নাকি কাজ ঠিকমতো করছেন না। ফারিজার কথা শুনে মমর মুখ অন্যরকম হয়ে গেল। ও বলল, হঠাৎ এই কথা কেন বলল?
– তার অভিযোগ আপনি তাকে দিয়ে মাঝে মধ্যে কাজ করান। তার দেওয়া ফাইলের কাজ না করে নাকি আপনি নিজের কাজ করছেন।
– প্রথমত আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি। তাই তাকে দিয়ে কাজ করানোর কোনো মানে হয় না। আর যে ফাইল গুরুত্বপূর্ণ সেটির কাজই তো আগে করব। তাই না? সে আমাকে কয়েকমাস আগের অসমাপ্ত ফাইল ধরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার যতদূর মনে হয়েছে নতুন ডিলের কাজগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি ওগুলো রেখে আগে এই কাজগুলো শেষ করতে চেয়েছি।
রিয়ানের কফি এসে গেল। ফারিজার উপস্থিতি টের পেয়ে রিয়ান খাওয়ার আগেই মম কাপটা হাতে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে দিল। সাথে সাথে গরম কফি ওর ঠোঁট পুড়ে গেল। কিন্তু রিয়ানকে বুঝতে না দিয়ে বলল, বেশি গরম৷ আস্তে খাবেন।
– তা না হয় বুঝলাম। আপনার গরম লাগেনি? আগে বলতেন, দুই কাপ আনাতাম।
– না…… ঠিক আছে। আমি কাজে যাই।
বের হতেই ফারিজার চোখ গরম করা দৃষ্টি ওকে গিলতে লাগল। ও একটু হাসি দিয়ে কড়াইয়ে তেল গরম করতে লাগল। তেলটা গরম হলেই তো মাছটা ভাজা যাবে।
রিয়ানদের বাড়িতে বিয়ের আমেজ। আর দুটো দিন পরই বিয়ে। হাতে অনেক কাজ। দুপুরে খাবার টেবিলে বিয়ের কথা বলতেই সবাই আলোচনায় বসে গেল কে কি পরবে, কে কি করবে, খাবারের মেনু কি হবে এসব নিয়ে। ঘরোয়া বিয়ে হবে শুনে প্রথমে আনন্দে ভাটা পড়েছিল। পরে সবাই নিজের মতো ব্যাপারটা গুছিয়ে মেনে নিল। এই ঘরোয়া অনুষ্ঠানে যতটুকু আনন্দ করা যায় তার সবটাই ওরা করবে। ভাইবোনগুলো বিকালেই শপিংয়ে বেরিয়ে গেল। ফিরল দশটার পর। খাওয়া দাওয়া সেরে আড্ডা দিতে লাগল। রিয়ান অফিস থেকে ফিরতেই ঘিরে ধরল সবাই। টিজ করতে লাগল এটা ওটা নিয়ে।
রাতের সাড়ে বারোটা বাজে। নিচে এখনো হাসাহাসির আওয়াজ কানে আসছে। ফেরদৌসী শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাকিব হাসান বই পড়ছেন বিছানায় হেলান দিয়ে। ফেরদৌসী মাথার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললেন, আমার কত স্বপ্ন ছিল ছেলের বিয়েটা ধুমধাম করে দেবো। কিন্তু মেয়েটা দিল না।
– তাহলে কি বিয়ে ক্যান্সেল করে দেবো!?
– আমি তা বলিনি। কিন্তু এতো মেয়ে থাকতে ঐ মেয়ে কেন? আরো তো কত ভালো ভালো মেয়ে আছে।
– তুমি আম্মাকে চেনো ফেরদৌসী। আম্মার উপর নিশ্চয়ই তোমার আস্থা আছে।
– তা আছে। আম্মা কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি জানি। মমকে আমারও ভালো লাগেনি যে তা নয়। মেয়েটা নম্র ভদ্র, রান্না, ঘর গোছানো সব পারে। দেখতেও ভালো। কিন্তু…
– তোমাকে কি ডিভোর্সি শব্দটা ভাবাচ্ছে?
ফেরদৌসী কিছু বললেন না। রাকিব হাসান বইটা রেখে চশমা খুলে বললেন, মেয়েটার কি দোষ এতে!? সে কি ইচ্ছে করে ডিভোর্স দিয়েছে? রায়হান সাহেবের কাছে সবটাই শুনেছি আমি। দোষ তো মেয়েটার ছিল না। ছিল ছেলেটার। কিন্তু আমাদের সমাজের ট্রেন্ড হয়ে গেছে সব সময় মেয়েদেরকে দোষী বানানো; দোষ ছেলের হোক বা তার নিজের৷ এটা নিয়ে ভেবো না। আর ঘরোয়া বিয়ের সিদ্ধান্তটা আমি মনে করি ভেবেই নিয়েছে মম। এখন যদি বিয়ের কথা সত্যিই সবাই জানে, ওকে গোল্ড ডিগার বলতে এক মুহুর্ত সময় নেবে না। ছেলের বউকে নিশ্চয়ই অসম্মানিত হতে দিতে চাইবে না তুমি। ফেরদৌসীর মাথার চুল বাঁধা শেষ। উনি এসে তাঁর পাশে বসে কাঁধে মাথা রেখে বললেন, আমার ছেলেটা ভালো থাকলেই হলো। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।
.
.
.
.
রায়হান সাহেবকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর অবস্থা ভালো। তাই বেশিদিন রাখতে হয়নি হাসপাতালে। এসেই কাজে লেগে পড়তে চাইলেন। মম বাঁধা দিয়ে বলল, সব কাজ করা হয়ে গেছে আব্বু। তুমি শান্ত থাকো। তোমাকে বিশ্রাম নিতে বলা হয়েছে। তুমি রুমে চুপচাপ বিশ্রাম করবে। ঠিক আছে?
– আমার মেয়ের বিয়ে আর আমি শুয়ে বসে থাকব?
– হুম থাকবে।
বর্ষার ডাক পড়ল রান্নাঘর থেকে। মম বেরিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। আজকে ওর বিয়ে। মমর ভেতরে কোনো উত্তেজনা কাজ করছে না। হবার কথাও নয়। দ্বিতীয় বিয়ে বলে নয়। প্রথম বিয়েতেও ভয় করেনি, হাত পা কাঁপেনি। না হয়েছে উত্তেজনা। ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর যখন অন্য কারো সাথে বিয়ে হয় তখন এসব হওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি মম। মনটা ঘৃণায় পাথর হয়েছিল। আজও বিয়েটা বাবার কথা রাখতেই করা। ভালোবাসা শব্দটা কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেছে ওর কাছে। ও রান্নাঘরে গিয়ে দেখল মাধুরী খালা আর বর্ষা মিলে অর্ধেক রান্না করে ফেলেছে। পঁচিশ ত্রিশ জনের রান্না। মম হাত লাগাতে যাচ্ছিল। বর্ষা মানা করে দিয়ে বলল, তুই না কনে? রান্নায় হাত দিচ্ছিস কেন? তোকে ডেকেছিলাম আর কি রান্না করা লাগবে সেজন্য। মম ওকে বলল, তাহলে তো তোমাকে আগে কাজ করতে দেওয়া উচিত না। তুমি না প্রেগনেন্ট?
– আরে, এখন তো কাজ করতেই পারব। সমস্যা হবে না আমার। এখন বল আর কি রান্না করা লাগবে।
– যা করছো তাও এনাফ।
– তাহলে সুন্দর করে গোসল সেরে নে। দুপুর তো হতে চলল। সবাই চলে আসবে।
মম নিজের রুমে চলে এল। আলমারি থেকে কাপড় নিতে গিয়ে কোটটার দিকে নজর পড়ল। প্রত্যেকবার কাপড় নেওয়ার সময় চোখ পড়ে। আজকেও পড়ল। কোটের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল, রিয়ান জানতে চাইলে কি বলবে!?
বারোটার দিকে কলিংবেল বাজল। বৃষ্টি ভেবেছিল বরযাত্রী এসে গেছে। খুলে দেখল আদ্রিতা এসেছে প্রিয়ান্তুকে নিয়ে। বর্ষা ওকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল, তুমি একলা? বাকিরা কোথায়?
– বাকিরা আরো পরে আসবে। আমি আগে আগে চলে এসেছি। কনে কোথায়?
– রুমে, গোসল করছে। তুমি আসো।
– হুম গিয়ে বসি ওর রুমে।
বৃষ্টি প্রিয়ান্তুকে কোলে নিল। আদ্রিতা মমর রুমে গিয়ে বসল। মম বের হচ্ছে না দেখে বিছানায় বসে ফোন টিপতে লাগল। হঠাৎ ওর পাশে কিছু একটার উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে তাকিয়ে চমকে উঠে ছোটখাটো একটা চিৎকার মারল। বর্ষা তাড়াতাড়ি এসে বলল, কি হয়েছে?
– বিড়াল।
– ও, নিনি? তোমাকে ভয় দেখিয়েছে?
– নিনি কে? বিড়ালটা?
– হ্যাঁ, মমর বিড়াল। আদর করে নিনি ডাকে।
– ঐদিন তো দেখিনি। সেরেছে; আজকের জন্য ওকে এই বাসা থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যান।
– কেন?
– আমার ভাইয়ের বিড়ালে এলার্জি। বিয়েতে হাঁচতে হাঁচতে বিয়ে না করেই চলে যাবে।
– আচ্ছা আমি দেখছি।
বর্ষা নিনিকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তখনই মম বের হলো ওয়াশরুম থেকে। ওকে দেখে মাথার চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বলল, কাউকে দেখছি না যে? শুধু তুই এলি!?
– এলাম আর কি। আমার বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা। আগে আগে চলে এলাম তাই। বোস তো।
মমকে পাশে বসিয়ে বলল, হলুদ দিয়ে গোসল করলি নাকি? সুন্দর সুন্দর লাগছে। মম হালকা লজ্জা পাওয়া স্বরে বলল, তোকে বলেছে……
– দেখ, দেখ গাল লাল হয়ে গেছে। এখন আমার ভাইটা থাকলে কি যে ভালো হতো!
– ওই চুপ কর তো। খালি ফাইজলামি। প্রিয়ান্তু কোথায়?
– বৃষ্টির কাছে। বসার রুমে।
– ও।
মম চুল ছড়িয়ে দিয়ে ফ্যানের নিচে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এক মনে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর প্রাক্তনের বউ ওর পাশে বসে আছে। ভাবতেই হাসি পেল ওর। আদ্রিতা দেখে জিজ্ঞেস করল, হাসছিস যে? মম ওর দিকে না তাকিয়ে বলল, এমনি। একটা হাসির কথা মনে পড়েছিল তাই। আচ্ছা আদ্রি, তুই কি জন্য আমাকে তোর ভাইয়ের জন্য পছন্দ করলি?
– আমি কিছু করিনি। উপর থেকে কানেকশান দিয়ে দিয়েছে আমি শুধু সাহায্য করছি।
এবার মম ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কি কানেকশান? আদ্রিতা রহস্য করে বলল, সিক্রেট কানেকশান। পরে জানতে পারবি। এখন উঠ। সবাই চলে আসবে। তোকে তৈরী করে দেই। রেডি হতে হতে চুল শুকিয়ে যাবে।
বলতে না বলতে দরজার কলিং বেলের আওয়াজ কানে এসেছে। বর যাত্রী এসে গেছে। বৃষ্টি এসে রুমের দরজা মেরে দিয়ে বলল, সবাই তোকে তৈরী করে নিতে বলেছে। নামায পড়ে আসলেই বিয়েটা হয়ে যাবে। মম উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আজকে আবার মুক্ত পাখি বন্দি হতে চলেছে। এবার কি করবে? সোনার খাঁচায় সোনার শিকল পরিয়ে গান গাইতে বলবে নাকি এখনের মতোই আকাশে উড়ে গান গাইতে দিবে? ভাবতে ভাবতে চুপচাপ বারান্দা থেকে গিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। বেসিনে মুখ ধুতে গিয়ে হুট করে কেমন কান্না পেল। বাবাকে ছেড়ে মোটেই যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তিনিই তো ওকে রাখতে চাইছেন না। এত বড় মেয়ে বাড়িতে থাকলে নাকি নানা লোক নানা কথার মেলা বসাবে।
মম মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এল। বর্ষা সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিল। শাড়িটা বেশ ভারি। গায়ে জড়াতেই ভার অনুভব হলো। এই ভার একটা সংসারের। অনেক বড়ো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার। আগেরবার এটা মাথায় আসেনি। এখন মম জানে খুব ভালো করে।
শাড়ি পরানো শেষে বৃষ্টি মেকআপ করাতে বসল। গাঢ় খয়রী শাড়িটার সাথে মিলিয়ে ওকে সাজিয়ে দিল সুন্দর করে। এর মাঝে শেম্পু করা চুলটাও শুকিয়ে গেছে। আদ্রিতা ওর মাথায় সুন্দর করে একটা খোঁপা বেঁধে দিল। সাজ কমপ্লিট হয়ে গেলে গয়না পরানো শুরু করল। এর মাঝেই বাইরে বেশ কথা শোনা যাচ্ছে। ছেলেরা জুম্মার নামায থেকে চলে এসেছে। শব্দ শুনে বর্ষা আর বৃষ্টি রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নাস্তার আয়োজন করতে হবে। মাধুরী খালাকে হেল্প করতে হবে হাতে হাতে। আদ্রিতা মমর কাছে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর নিক্কণ আর তুলি ভাবি এসে রুমে ঢুকল৷ ওকে দেখে তুলি ভাবি বলল, মা শা আল্লাহ, কত সুন্দর লাগছে তোমাকে! নাবিল তুলিভাবির কোলে ছিল। সেখান থেকে তাঁর কথা শুনে বলল, তুদর। আদ্রিতা জিজ্ঞেস করল, এনেছো? তুলি ভাবি ওর হাতে একটা থলে ধরিয়ে দিল। থলে থেকে বকুল ফুলের মোটা একটা গাজরা বের করল। মম অবাক হয়ে বলল, এটা কোথায় পেলি?
– বানিয়ে এনেছে।
– এত ফুল পেল কোথায়?
– আমাদের বকুল গাছ বেল করে। দাঁড়া তোকে এই গাজরাটা লাগিয়ে দেই।
নিক্কণ বলল, এই গাজরাটা আমার ভাই বানিয়েছে আজ সকাল থেকে বসে বসে। শুনে মমর মুখে লালিমা দেখা দিল। না চাইতেই লজ্জা পেয়ে গেল। নিক্কণ আর আদ্রিতা মুচকি হাসল। গতকাল রাতে সব ভাই বোন মিলে রিয়ানকে দিয়ে জোর করে রাজি করিয়েছে গাজরাটা বানানোর জন্য। আজ সকালে ফুলিকে দিয়ে সব ফুল পেড়ে রিয়ানের বিছানায় ঢেলে দিয়ে বলল, একা হাতে বউয়ের জন্য গাজরাটা বানিয়ে নাও। আমাদের মেলা কাজ। বানানো শেষ হলে আমাদের দিয়ে এসো। তোমার বউকে পরিয়ে দেবো। বলেই সবাই বেরিয়ে গেল। সবাই ভেবেছিল রিয়ান হয়ত বানানো শেষ করতে পারবে না বা বানাতে বিরক্তবোধ করবে। কিন্তু নামাযে যাওয়ার আগে নিক্বণের হাতে গাজরার থলেটা ধরিয়ে দিতে ভাই বোন সব অবাক। তারপর সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।
চলবে…