মাস্টারমশাই পর্ব ১৫

0
184

মাস্টারমশাই
পর্ব ১৫
____________
শীতের আমেজ বেশ জোরালো। রোদের মধ্যে বসে খাওয়ার প্রবণতা গ্রামের প্রায় সকলের মধ্যে রয়েছে। তবে সকালে খাওয়ার মধ্যে যে অনুভূতি পাওয়া যায় দুপুরে সেই অনুভূতি থাকে না। প্রথম দিকে ভালো লাগলেও পরে বিরক্ত লাগে। তক্তপোশের (বসার চৌকি) উপর খেতে বসেছে তারা তিনজন। বাড়িতে প্রায় ছয়মাসের পর মাংস হলো। মাংসের প্রতি লোভ পরিবারে সকলেরই রয়েছে। কিন্তু দারিদ্রতা তাদের এই লোভকে চাপা দিয়েছে। ভগবান মানুষের মধ্যে হাজারো স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বপ্নের সাথে সাথে মানুষের পেটের খিদেও দিয়েছে।আর এই পেটের খিদে মানুষের হাজার হাজার স্বপ্ন শেষ করে দিচ্ছে। মাংস রান্না শুরু থেকেই কিশলয় দিদির পাসে ঘোরাঘুরি করছে। মাংসের কষা হতেই কিশলয়কে কড়াই থেকে একপিস তুলে দিয়েছে। এক পিস মাংস পেয়ে কত আনন্দ অনুভব করলো। আসলে গরিব মানুষ খুব অল্পতে খুশি হয়।কিন্তু সে-ই অল্পের সন্ধান পেতে তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আসলে মানবজীবন বড্ড অদ্ভুত! কোনো পরিবারের সুখের কারণ হচ্ছে তাদের পরিবারের দুপুরে মাংস হয়েছে। তাতেই সুখ। আবার কোনো পরিবারের সপ্তাহে তিন থেকে চারবার মাংস হচ্ছে এবং তাদের আরও অনেক কিছু রয়েছে। তবুও তারা সুখী নয়। সমাজে কোন মানুষের কেমন স্বপ্ন তা বোঝা বড্ড মুশকিল। কিছু মানুষের স্বপ্ন থাকে অনেকগুলো বড় বড় রেস্টুডেন্ট বানাবে। আবার কিছু মানুষের স্বপ্ন থাকে জীবনে একবার হলেও বড়ো রেস্টুরেন্টে উঠে খাবার খেয়ে আসবে। হয়তো, কবিরা এই ব্যাপারটিকে তাঁদের কাব্যের ভাষায় বর্ণনা করেছেন ধনী-দরিদ্র্যের বিভেদ বলে।

দোহারা গড়ন বিশিষ্ট শিউলি। প্রথমে বাবা আর ভাইকে খাবার পরিবেশন করল। তারা কিছুটা খাবার খাওয়ার পর, দ্বিতীয়বারের মতো ভাত নিল। তাদেরকে দ্বিতীয়বার ভাত দিয়ে নিজে খেতে বসলো।অনেকেই ভাবে পরিবারের যে মানুষটি খাবার পরিবেশন করে তার জন্য তরকারির পরিমাণটা বেশি থাকে। কিন্তু বাস্তবটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিউলির ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। বরাবরের মতো আজও ভাইয়ের সামান্য মুখের স্বাদ পূরণ করতে নিজের ভাগ কমিয়ে নিল। একবারের জন্যও কোণঠাসা বোধ করলো না। ভাইয়ের জন্য এইটুকু ত্যাগ কিছুই নয়। দিদি হয়ে ভাইয়ের জন্য এইটুকু করতে পারবে না, তাহলে সে কেমন দিদি? একজন পুরুষ ছাড়া হয়তো সংসার সম্পূর্ণ হতে পারে, কিন্তু একজন নারী ছাড়া সংসার কখনো সম্পূর্ণ হতে পারে না। আর এই পরিবারের একমাত্র নারী শিউলি। তার বয়স পঁচিশ পেরিয়ে গেছে। মা ছাড়া পরিবার সম্পূর্ণ অচল। মায়ের শূন্যতা সে পরিবারের কারোর মধ্যে আনতে দেয়নি। বাস্তব অভিজ্ঞতার সামনে সে বারবার রুখে দাঁড় হয়েছে। কোন জিনিস ভালো কোন জিনিস খারাপ সে অনেক ছোটবেলা থেকে জানতে পেরেছে। এই বয়সে সে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। হয়তো, কোনো এক বৃদ্ধ তা অর্জন করতে পারেননি। এর জন্যই তো সাহিত্যিকরা বলেছেন, শুধু বয়সে বড় হলে হয় না। বয়সের সাথে সাথে অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন আছে।
কিশলয়ের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। বালতিতে রাখা জল দিয়ে মুখ ধুতে গিয়ে ইচ্ছে করে জল নষ্ট করলো সে। শিউলির ভীষণ রাগ হয় ভাইয়ের উপর। রেগে বলল,’জল নষ্ট করছিস কেন? জল তো তোকে আনতে হয় না। জল আমি আনি। সারা দিনে তিনবার জল আনার কষ্ট তুই কি করে বুঝবি? একবার আমার সঙ্গে গেলে বুঝতিস।’ গড় গড় করে ভাইকে বকে গেল শিউলি। কিশলয় দিদির দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, তার জন্য একটু মাংস রাখতে। রাতে মুড়ির সঙ্গে মাখিয়ে খাবে। ভাইকে বকে অন্যের উপর রাগ প্রকাশ করলো। তার পুরো রাগ বাবাকে ঘিরে। ভাই এত জল নষ্ট করলো তাকে কিছু বলল না। অথচ এই কাজটা শিউলি করতো। তাহলে আর দেখতে হতো না। রাগে গনগন করছে সে। কমলাকান্ত বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন,’বাচ্চা ছেলে বোঝে নাকি? এত বকছিস কেন?’
‘ছেলেকে কিছু বললেই তোমার গায়ে ফোসকা পড়ে যায় আর মেয়ে…. সে তো বানের জলে ভেসে এসেছে। সে নাইনে পড়ে আর তোমার কাছে বাচ্চা লাগছে? আর আমি সেভেন এইটে পড়ার সময় থেকে কাজ করি। তখন তো কই তোমার আমাকে বাচ্চা লাগেনি। শুধু আমি মেয়ে বলে কি বড় হয়ে গেছিলাম?’
‘আহ্! সামান্য একটা ব্যাপারে কেউ এত রাগ করে?’
‘তোমার ছেলের সমস্ত কিছু তোমার কাছে স্বাভাবিক লাগে। যত অস্বাভাবিক শুধু তোমার মেয়ে।’
কমলাকান্ত বাবু আর কিছু বললেন না। তিনি আপন-মনে খেতে শুরু করলেন। মেয়ে একটু খিটখিটে জানেন। হঠাৎ করে রেগে যায়, আবার তা ক্ষণিকের মধ্যে গলে যায়। আর সমস্ত রাগ বাবার উপর প্রকাশ করে। তিনিও কোনোদিন মেয়ের সমস্যার কথা জানতে চাননি। মনের মধ্যে এক রাশ রাগ জমে আছে। শিউলি বাবার দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে কমলাকান্ত বাবুর খাওয়া শেষ হলো। তিনি খাওয়ার থালা ছেড়ে উঠলেন না। একই জায়গায় বসে থাকলেন। শিউলি ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিল না। সে উৎকট কন্ঠে বলল,’খাওয়া শেষ। বসে আছো কেন?’
কমলাকান্ত বাবুর কোমল চোখ ব্যাঘ্র হয়ে উঠলো। তিনি আমতা-আমতা করছেন। ইচ্ছে করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর সুশ্রাব্য কণ্ঠে বললেন,’আসলে, তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল….।’
বাবার কথা তাচ্ছিল্য করে হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,’টাকা চাই তো?’ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললেন কমলাকান্ত বাবু।মেয়ের কাছে তিনি কতটা অপমানিত হলেন, তিনি নিজেও জানেন না। তিনি কখনো মেয়েকে এক টাকাও দেন না। তাহলে কেন মেয়ের কাছ থেকে টাকা চাইছেন? সে কোথা থেকে টাকা পাবে?আজকাল মেয়েটাও তাঁর কথা শোনে না। মুখের উপর যা আসে তাই বলে যায়। কোনো কিছুকে ভয় করে না। কিন্তু টাকা তো কমলাকান্ত বাবুর চাই। লজ্জা পেলেও কিছু করার নেই। তিনি নিরুপায়। হালকা মাথা তুলে বললেন,’হাজার টাকা মত লাগবে। এক সপ্তাহের মতো…. তারপর তোর টাকা ফেরত দিয়ে দেব। ধার হিসেবে দে।’
‘যখনই তোমার টাকা দরকার হয় তখনই তুমি এমন কথা বলো। এর আগে এমনভাবে ভুলিয়ে অনেক টাকা নিয়েছো, কিন্তু কখনো ফেরত দিয়েছো? তুমি কি করে আমার কাছ থেকে টাকা চাও,বল তো? আমাকে কখনো টাকা দিয়েছো বুঝি? বাড়িতে পাঁচটা গরু আছে। তাদের জন্য কখনও এক আঁটি ঘাস এনে দিয়েছো? দাও নি। উল্টে বলেছো, তাদেরকে রেখে লাভ কি? আমি বাড়ির কাজের পাশাপাশি তাদের দেখাশোনা করি।দোকানে দুধ বিক্রি করি। কিন্তু কি অদ্ভুত! দুধ বিক্রির টাকাও আমাকে দাও না। তুমি নিয়ে নাও। ওইখান থেকে কিছু টাকা সরিয়ে রাখি। কিন্তু তুমি তাও আমাকে রাখতে দাও নি। যখন তোমার দরকার হয় নিয়ে যাও। জানো বাবা, একটা মেয়ে যখন বড় হয় তখন তার কত কিছুর প্রয়োজন হয়। তুমি কখনো জানার চেষ্টা করেছো? তোমার যে একটা মেয়ে আছে, তুমি কখনো স্বীকার করতে চাও নি।’
এক নিঃশ্বাসে শিউলি কথাগুলো বলে গেল।রাগে গনগন করছে। চোখ দুটো জলে ভর্তি। দুফোঁটা জল ভাতের থালায় পড়লো। সে খেতে পারছে না।পায়ের দুটো হাঁটু উঁচু করে বসে থাকল। কমলাকান্ত বাবু মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে খুঁজে পেলেন না। কিন্তু ছেলের জন্য বই আনতে হবে। তার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। ক্লাস নাইনে সরকার থেকে দুটোর বেশি বই দেয় না। সবগুলো বই এনে দিতে হবে। যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। কদিনের মধ্যে টাকা সংগ্রহ করা উনার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার বই কিনে দিতে না পারলে ছেলে অনেক পিছিয়ে পড়বে। তিনি নিরুপায়। এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে গেলেন। তাঁর সৌম্য-শান্ত মুখমন্ডল বিবর্ণতায় ভরে গেলো। তিনি একটু থেমে বললেন,’এবারে আর এমনটা হবে না। তোর টাকা ফেরত দিয়ে দেব। শেষবারের মতো টাকাটা দে। ওই তো পাশের বাড়ির মেয়ের জন্য একটা সম্বন্ধ দেখেছি। তার বিয়ে দিতে পারলে, এক হাজার টাকা দেবে। ওই টাকা তোকে দিয়ে দেব। একটু বোঝার চেষ্টা কর। তোর ভাইর বই……..’
‘সবকিছুই তো তোমার ছেলে। আমি কেউ না বলো! তোমার ছেলের স্বপ্ন পূরণ হবে। আর আমি তার জন্য কেন এত ত্যাগ স্বীকার করব বল তো? আমারও জীবন আছে। আমারও বাঁচতে ইচ্ছে করে। কেন তোমাদের জন্যে আমি আমার জীবনটাই নষ্ট করব? আমার বয়স পঁচিশ হয়ে গেছে তা তোমার খেয়াল আছে? আমার চেয়ে কত ছোট মেয়ে নিজেদের সন্তান সন্ততি নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। আমিও একটা মেয়ে। আমারও তো ইচ্ছে করে। আমি জানি বাবা, তুমি কখনো আমার বিয়ে দেবে না।সারাটা জীবন আমাকে এই ভাবে কাটিয়ে দিতে হবে।’
শিউলি কিছুক্ষন থামল। কমলাকান্ত বাবু কিছু বললেন না। শিউলি আবার বলতে শুরু করল,’বাবা,তুমিতো ঘটকালি করো। গ্রামের কত ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়েছো তুমি। কই কখনো তো আমার জন্য কোনো পাত্রপক্ষ আনোনি। তার উত্তর কি তোমার কাছে আছে? আমি গ্রামে এখন বেরোতে পারি না। আমার বিয়ে হয়নি বলে কত মানুষ কত কথা শোনায়। তার খবর কি তোমার কাছে আছে? থাকলেও সেই কথাগুলো কখনো তুমি কানে দাও না……।’
‘বোঝার চেষ্টা কর, মা। একটা মেয়ের বিয়ে দিতে অনেক খরচ। পণ ছাড়া কেউ মেয়েকে ঘরের বউ বানাতে চায় না। আমি কোথায় টাকা পাবো?’
বাবার কথা শুনে হাসতে লাগল শিউলি। হাসতে থাকলেও চোখ দুটো জ্বলজ্বল করল। কমলাকান্তবাবু আর কিছু বললেন না। তিনি উঠে চলে গেলেন। এক জায়গায় ঠাওর হয়ে বসে রইল শিউলি। শুকনো ভাতের উপর মাছি এসে বসেছে। খাওয়ার ইচ্ছে নেই। সে ভাবলো, বাবাকে এতগুলো কথা শোনানো কি উচিত হল? তিনিও তার জায়গায় সঠিক। তিনিও এত টাকা কোথায় পাবেন? বাবা নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছেন। বাবাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু তার আর কিছু ভালো লাগে না। এইভাবে একঘেয়েমি জীবন তাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সে-ও চায় আর চারটে মেয়ের মতো তার জীবন যাপন করতে। কিন্তু সম্ভব নয়। পরিস্থিতি আর ভাগ্যের কাছে অসহায়। সে চায় তার ভাইয়ের সব স্বপ্ন পূরণ হোক। ছোটবেলা থেকে তাকে মানুষ করেছে। তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি তো কি হয়েছে? ভাইয়ের স্বপ্ন তো পূরণ হবে।

রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি। পাশাপাশি দুই ভাইবোন শুয়ে আছে। দুজনের চোখে ঘুম কিছুতেই আসছে না। দুজনেরই ঘুম না আসার কারণ সম্পূর্ণ আলাদা। একজন সবকিছু নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। সবকিছুকে পেছনে ফেলে সে বড় হবে। এটাই তার স্বপ্ন।আর একজন স্বপ্ন দেখছে, নিজে কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করে অন্যের স্বপ্ন পূরণ করবে। দুজন অনেক কাছাকাছি থাকলেও দুজনের চিন্তা ধারা অনেক দূরে। দুজনের ভাবনার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। শিউলি বিকেলে বাবাকে এক হাজার টাকা দেয়, ভাইয়ের বই কেনার জন্য। বাবা একবারের জন্যও না বলেননি।তিনি টাকা পেয়ে একটা প্রফুল্ল হাসি হেসে ছিলেন। তারপর সোজা বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। বই এনে ছেলেকে দেন।নতুন বই পেয়ে ছেলে যতটা না খুশি হয়েছিল তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল বাবা আর দিদি। শিউলি ভাইয়ের মাথায় হাত বোলিয়ে দেয়। তাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে। মাএ চোখটা বন্ধ করেছিল কিশলয়। তারপর কিছু একটা মনে পড়ে যায় তার। সে ছুটে বইয়ের কাছে যায়। শিউলি কিছু বুঝতে পারল না। লাইট অন করে দিল। বইয়ের মধ্যে কিছু একটা দেখে বারবার গুনগুন শব্দ করলো। অনেকক্ষণ পর আবার দিদির কাছে ফিরে আসলো। লাইট অফ করে তার পাশে ঘুমিয়ে পড়লো।
‘কি রে, এত রাতে বই খুললি কেন?’মৃদু কণ্ঠে শিউলি কিশলয়কে জিজ্ঞেস করল।
‘একটা সূত্র মনে করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছিলো না। তাই বই খুলে দেখে নিলাম।’
‘সকালে দেখতে পারতিস। এখন দেখার কোন মানে হয়?’
‘তুই কিছু জানিস না। তানভীর স্যার বলেন, ভালো স্টুডেন্ট হতে গেলে অনেক কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। যখন কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করছি কিন্তু মনে পড়ছে না, তখনই বই খুলে দেখতে হবে। তা যদি খাওয়ার সময় হয় তাও করতে হবে।’
শিউলি মৃদু হাসলো। ভাইয়ের পিঠে হাত বোলিয়ে বলল,’আমি মূর্খ সূর্খ মানুষ। কিছু জানি না। তানভীর স্যার অনেক কিছু জানেন। উনি অনেক জ্ঞানী মানুষ। তবে আমি দিদি হিসেবে তোকে একটা উপদেশ দেবো। এটা যদি মেনে চলিস তাহলে সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সম্মান পাবি। এই পৃথিবীতে অনেক মানুষই সাফল্য অর্জন করে, কিন্তু সম্মান পায় না। সম্মান একটা আলাদা জিনিস। তাকে অর্জন করা এত সহজ নয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সম্মান হলো নিজেকে নিজে সম্মান করা। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ নিজেই নিজেকে সম্মান করতে পারে না। অনেকেই,হয়তো, তোকে সম্মান করবে। কিন্তু দিনশেষে মনে হবে তুই ওই সম্মানের যোগ্য নয়। তার মানে হচ্ছে তুই নিজেকে নিজে সম্মান করতে পারছিস না।এককথায় তুই সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিস কিন্তু সম্মান নয়। সম্মান আর সাফল্য দুটো আলাদা জিনিস।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। এবারে উপদেশ শোনা?’ কিশলয় এক গাল হেসে দিদিকে বলল। শিউলি ভাইয়ের কান মুলে দিয়ে বলল,’যখন তুই সাফল্যের উঁচু জায়গায় পৌঁছে যাবি। তখন যারা জিজ্ঞেস করবে তুই এখানে এলি কি করে? তাদের হাসিমুখে একবার বলে দিস ‘দারিদ্রতা’। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটি শব্দ হলো দারিদ্রতা। দারিদ্রতা যেমন মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তেমনি আবার দারিদ্রতা মানুষের বেঁচে ওঠার মূল মন্ত্র হয়। জীবনে তুই যত বড় জায়গায় যাস না কেন, সব সময় মনে রাখবি তোকে কিন্তু মাটিতে পা দিয়ে হাঁটতে হবে। এটা যদি কখনো ভুলে যাস, তাহলে তুই সফলতা অর্জন করবি কিন্তু সম্মান নয়।’
দিদির কথা বারবার মনের মধ্যে আওড়াতে থাকলো কিশলয়। এই কথার মধ্যে যেন কিছু একটা লুকিয়ে রয়েছে। দিদির কথা যেন একটা সুপ্ত বীজ।এই বীজকে জল, মাটি, আলো দিয়ে গাছে রূপান্তর করার দায়িত্ব কেবল তার। আরও বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। কিশলয় লক্ষ করল দিদির চোখ বুজে আসছে। সে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল,’একটা কথা বলি!’
সবেমাত্র ঘুম ধরেছিল শিউলির। আচমকা ভাই ডেকে তোলায় সে বিরক্ত হয়ে ওঠে। একটু বিরক্ত প্রকাশ করে বলল,’বল!’
‘জানিস, ওই যে নলকূপের কাছে একজনের বাড়ি রয়েছে।ওদের বাড়ির লোকটা বলছিল, তোর দিদিকে বিয়ে দিবি না?বুড়ি হয়ে গেল তো! আমি কিছু বলতে পারিনি। সে আরও বললো,আমার মেয়ে কত ছোট, তার বাচ্চা হয়ে গেল। আর তোর দিদি…..। কি করে একা ঘুমায় রাতে? বলবি কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকতে।তাতে অন্তত একটু সুখ পাবে।’
শিউলির মুখের ভাবনা হারিয়ে গেল। সে ভাইকে এসব কথায় কান দিতে বারণ করল। এগুলো স্বাভাবিক কথা। ভাইয়ের মাথায় হাত বোলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। কিন্তু নিজে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেল। সহজে চোখে ঘুম আসলো না। চোখ থেকে জল বেয়ে পড়লো। রাতের অন্ধকারে চোখের জল কেউ দেখতে পেল না। লোকটির মুখ খুব ভালোভাবে মনে পড়ছে শিউলির। লোকটি প্রাপ্তবয়স্ক। শিউলি তার মেয়ের বয়সী। সেই মানুষ তার সম্বন্ধে কি সব কথা বলেছে। তারা যদি সামনে এমন কথা বলতে পারে, তাহলে ভেতরে ভেতরে কত কি না বলে। তার কথাগুলো একটা অবিবাহিত মেয়েকে কতটা আঘাত দিতে পারে,তা এই মুহূর্তে কেবল শিউলি অনুভব করতে পারছে।

পর্ব ১৬ আসছে
বিঃদ্রঃ এই ঘটনা গুলো কিন্তু ২০০২-০৩ সালের ঘটনা। তখনকার গ্রাম্য জীবন আর এখনকার গ্রাম্য জীবনের পার্থক্য অনেক। এখনকার তুলনায় আগেকার মেয়েরা অনেক অবহেলার শিকার হতো। আশা করি বুঝবেন। অযথা বিভ্রান্ত হবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here