মাস্টারমশাই পর্ব ১৮

0
202

মাস্টারমশাই
পর্ব ১৮
_____________
‘আমাকে একবার কলকাতা নিয়ে যাবে? ছোটবেলা থেকে কত আশা ছিল, কলকাতায় যাব। হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে হাঁটবো। দেশ-বিদেশে কত মানুষের মুখে ওই ব্রিজের ঐতিহ্যের কথা শুনেছি।’ অস্পষ্ট গলায় আমিনা আবদার রাখলেন স্বামীর কাছে। তানভীর স্যার আমিনার মাথার কাছে বসে রয়েছেন। তিনি স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরলেন। তাঁর কপালে আলতো করে চুম্বন দিয়ে বললেন,’তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ। তারপর তোমাকে শহর থেকে একবার ঘুরিয়ে আনবো। এখন তো আর আমাদের কোনো পিছুটান নেই। আমরা অনায়াসে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পারি।’
আমিনার চোখ বিষণ্নতায় ভুগছে। একটার পর একটা ঘটনা তাঁকে দুর্বল করে দিয়েছে। মরণ রোগ তাঁকে ধরেছে। শরীর ভীষণ দুর্বল। ঠিক মতো চলাফেরা করতে পারেন না। বাথরুমে যেতে হলেও একজনের সাহায্য লাগে। তাঁর সাহায্যের কান্ডারী কেবল তার নিজের প্রাণ,নিজের অস্তিত্ব, নিজের স্বামী। মাহবুব যখন প্রথম কোলে এসেছিল তখন তাকে ঘিরে কত স্বপ্ন দেখে ছিলেন আমিনা। তাঁর সমস্ত স্বপ্ন তার ছেলে পূরণ করবে। হারিয়ে যাওয়া জীবনটাকে নতুন করে গুছিয়ে ছিল। ছেলেকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ভেবেছিলেন,আর দশটা ছেলের মতো তার ছেলে হবে না। সামান্য হলেও আলাদা হবে।মাহবুব প্রমাণও করেছে আর দশটা ছেলের মতো, সে নয়। সে সত্যিই আলাদা। ছেলের বয়স যতই বাড়তে থাকে ততই আমিনার বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক কমতে থাকে। ছেলেকে বড় করতে হবে তার স্বপ্ন পূরণের পথ প্রসারিত করতে হবে। এখন বাপের বাড়ি গেলে হবে না। নিজের আনন্দ ত্যাগ করতে হবে।একসময় ছেলে বড় হল আর বদলে গেল। মাকে ছেড়ে চলে যেতে কষ্ট হল না তার। শুধু বদলালো না সে-ই মানুষটি। যাকে প্রথমবার দেখে ঘৃণা হয়েছিল। মনে হয়েছিল তার ছোটবেলা ধ্বংসের কান্ডারী। যার বাড়িতে প্রথম কয়েকটা বছর চাকরের মতো থাকতে হয়েছিল।যার জন্য রাতে না চাইতেও যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো। সে-ই মানুষটি এখনো তাঁর খেয়াল রাখেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রয়েছেন। এমন ভালোবাসার মানুষ আর কোথায় পাবেন তিনি?

মাহবুব বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর একের পর এক ঘটনা…… তাঁকে ঘরে বন্দি করে দেয়। বাড়ি থেকে বের হন না। সবকিছুই তাঁর কাছে গুরুত্বহীন মনে হয়। নিজেকেও নিজের কাছে গুরুত্বহীন লাগে আজকাল।তাইতো বার্ধক্যের অনেক আগে তাঁকে বার্ধক্য পেয়ে বসেছে।একঘেয়েমি ভাবে বাড়িতে বসে থাকায় সব সময় চিন্তা করায় নানা ধরনের রোগ জাঁকিয়ে ধরেছে।কত মানুষ কত আত্বীয় স্বজন বোঝালো। কিন্তু আমিনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন হলো না। সারাদিন স্বামীর সঙ্গে গল্প করে কিংবা একা একা বসে সময় কাটিয়ে দেন। বেশিরভাগ সময়ই তাঁর চোখ থেকে জল পড়তে দেখা যায়। কেন কান্না করেন? তা জানা নেই কারোরই। তাঁর ধন সম্পদ কোনো কিছুর অভাব নেই তবুও মানুষটি অসুখি। কঠিন ব্যধিতে তিনি ভুগছেন। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, অভাগা যেদিকে তাকায় সেদিকেই জল শুকিয়ে যায়। আমিনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তানভীর স্যার পালঙ্ক থেকে উঠে বাইরে বের হচ্ছিলেন, তখনই আমিনা করুন গলায় স্বামীকে ডাকেন। তানভীর স্যার আবার আমিনার কাছে গেলেন। তাঁর চোখ দুটো মিটমিট করছে। চোখের কোনে জলের রেখা স্পষ্ট।
‘কিছু বলবে?’ শান্ত গলায় তানভীর স্যার আমিনা কে জিজ্ঞেস করলেন। আমিনা হঠাৎ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। স্যার কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁর সঙ্গে যে কেন এমন হচ্ছে জানেন না। জানলে নিশ্চয়ই তিনি তার সমাধান করতেন।আজ পর্যন্ত তিনি কত জটিল ইংরেজির ফর্মুলার সমাধান করেছেন, কিন্তু আজ জটিল সংসারের মায়ার সমাধান করতে পারছেন না। বড্ড মায়াবী এই সংসার।আমিনার এমন পরিস্থিতিতে তানভীর স্যার মন থেকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছেন। মানসিকভাবে তিনি আর কোনো কাজের জন্য প্রস্তুত নন। সমস্ত কাজে অনীহা চলে এসেছে। তাঁর জীবনে সবচাইতে প্রিয় মানুষটি আজ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তাহলে, তিনি কি করে ভালো থাকবেন? তানভীর স্যার একই প্রশ্ন দ্বিতীয় বার করলেন। আমিনা করুন গলায় উত্তর দিলেন,’কিচ্ছু বলার নেই। কিন্তু, আমাদের সঙ্গে এমনটা না হলেও তো পারতো,তাই না!’
‘দেখো আমিনা, আমরা সন্তানদের জন্ম দিয়েছি কিন্তু ভাগ্য নয়। তারা যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই করছে।কারোর মনের উপর অধিকার ফলানোর দুঃসাহস আমাদের নেই।’

এক মুহূর্তের জন্যও তিনি আর স্ত্রীর কাছে অপেক্ষা করলেন না। রান্নার ঘরে চলে আসলেন। বারবার ব্যাকুল হচ্ছেন তিনি। বসন্তের পর, গ্রীষ্মে হঠাৎ এক বিকেলে কালবৈশাখীর ঝড় তাদের সংসার তছনচ করে দিয়েছে। তানভীর স্যার রান্না করতে জানেন না। আমিনা কখনোই স্বামীকে রান্নার কাজে হাত লাগাতে দেননি। তাই তাঁর এমন করুণ পরিণতি। কোনো রকম ভাবে রান্না করতে হবে। রান্না না করলে খাবেন কি? নিজের রান্না নিজে খেতে পারেন না। অথচ আমিনা ওই রান্নার কত প্রশংসা করেন। অপেক্ষা না করে তানভীর স্যার রান্না বসালেন। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। আজকাল চোখটাও বড্ড বেহায়া হয়ে উঠেছে, কারণে অকারণে শুধুই জল ঝরে পড়ে। অন্যায় না করেও শাস্তি পেয়েছে। এত ভালোবাসা এত শাসনের পরও ছেলে মেয়ে চলে গেছে। আর কি বাকি আছে উনার জীবনে? হয়তো আরও অনেক কিছু দেখার আছে? মৃত্যুর ডেরায় পৌঁছাতে এখনো যে অনেক দেরি। আরও অনেক কিছু দেখে যেতে হবে।

সেদিন অনেক চেষ্টা করেছিলেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। কিন্তু পারেননি। সমস্ত প্রমান তাদের হাতে ছিল। আসলে, তিনি সেদিন ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছিলেন। ইচ্ছে করে যেন সব দোষ মাথায় চাপিয়ে নিয়েছিলেন। যাদের জন্য তিনি করতে চাইছিলেন তারাই তাঁকে দোষী বানিয়েছে। তাহলে, তিনি কার জন্য লড়াই করবেন? লড়াই করা বৃথা। তানভীর স্যার জানেন না তারা জিতে গিয়ে খুশি হয়েছিল কি না!কিন্তু তিনি অন্তর থেকে জানেন, তিনি হেরে গিয়েও জিতে গিয়েছিলেন। নিজের চাকরি হারিয়ে ফেলেন। অনেকের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠেন।অনেকের মন থেকে শ্রদ্ধা ভক্তি উঠে যায়। তিনি এমন একটা জঘন্য কাজ কি করে করলেন? একটুও বিবেকে বাঁধলো না? তিনি সবসময় অন্যের দোষ ধরে অন্যকে কথা শোনাতে ছাড়তেন না। গ্রামবাসীরাও সুযোগ পেয়ে যায়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে থাকে। যেখানে সেখানে কানাঘুষো হতে থাকে তানভীর স্যারকে নিয়ে। উনার একটা দোষকে গ্রামবাসীরা একশোটা দোষের সমান দেখেছিল। উনার জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাকে টেনে এনে, ওই সব ঘটনার মধ্যে দোষ খুঁজতে থাকে। এবং তারা সফলও হয়। যদিও তিনি এগুলোর একটাতেও পাত্তা দেননি। মা আর মেয়ে অনেক সময় বাড়িতে বলতো, উনার নামে মানুষ কত কি খারাপ কথা বলেন। তিনি ভেতর থেকে খুব কষ্ট পেতেন। বুক চিন চিন করে উঠতো। অন্যায় না করেও অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। তবুও হাসিমুখে উত্তর দিতেন, কিছু মানুষের কাজ পরচর্চা করা। তাদের জীবনে কোনো লক্ষ্য থাকে না। সারা জীবন মানুষের পরচর্চা করে যাবে। তাদেরকে নিয়ে বেশি ভাবা উচিত নয়। তারপর দিন যতই কাটতে থাকে কানাঘুষো ততই বন্ধ হতে থাকে। একসময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
আরও একটা বছর কেটে যায়। ইয়াসমিন সদ্য অনার্স কমপ্লিট করেছে। তখন সে রাকিবের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। রাকিবের বয়স যথেষ্ট হয়েছে। বাড়ি থেকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেয়। রাকিব সবকিছু ইয়াসমিনকে বলে। ইয়াসমিন বড্ড বিপদে পড়ে। আব্বু যে ধরনের মানুষ তাতে মনে হয় না তাদের সম্পর্ক মেনে নেবেন। তাছাড়া ইয়াসমিনের বয়স তেমন একটা হয়নি। তবে কি সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে? সম্ভব নয়। বাবা মা অনেক স্বপ্ন নিয়ে তাদেরকে বড়ো করেছে। তাদেরকে ঠকাতে পারবে না সে। দাদা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তার চলে যাওয়া শোক এখনো কাটিয়ে তুলতে পারেনি আম্মু। এমনটা করলে বাবা-মায়ের মান সম্মান থাকবে না। প্রয়োজন হলে প্রেম বিসর্জন দিবে, কিন্তু পালিয়ে যাবে না। একরাত্রিতে ইয়াসমিন সবকিছু আব্বুকে বলে। আব্বুকে বলেই কান্না করে ফেলে সে। ভয়ে কাঁপতে থাকে। আব্বু নিশ্চয়ই বকবেন। প্রয়োজন হলে গায়ে হাত তুলবেন। কিন্তু ইয়াসমিন আব্বুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক অন্য মানুষকে দেখতে পেল। আব্বু একবারের জন্যও ছেলের কথা জানতে চাইলেন না।মেয়ের পছন্দ মানে তাঁরও পছন্দ। তিনি বিয়েতে রাজি হলেন। সেদিন ইয়াসমিন জীবনে সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি আব্বু রাজি হবে সেটা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। শাসনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আব্বুর ভালোবাসা বুঝতে পারে ইয়াসমিন। তার আব্বু দুনিয়ার সবচাইতে ভালো আব্বু। আব্বু হয়তো এতদিন জন্মদিনের উপহার দেয়নি, কিন্তু আজ যে জিনিসটা দিলেন,তার একুশ বছর ধরে জন্মদিনে গুছিয়ে থাকা উপহারের চাইতে অনেক গুণ বেশি। ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী করে পাওয়ার মতো ভাগ্য কি সবার হয়? আনন্দে চোখে জল চলে আসে।খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু আমিনা বিয়েতে বাধা দেয়। ছেলে কি কাজ করে? তাঁর আচরণ কেমন? তার পরিবার কেমন? সবকিছু জানা উচিত।কিন্তু তানভীর স্যার যেটুকু জানার প্রয়োজন সেটুকুই জানলেন। অতিরিক্ত কিছু জানলেন না। তিনি মনে করেন, জীবনে কোনো মানুষ কখনো পারফেক্ট হয় না। রাকিবের জীবনে অবশ্যই কিছু খারাপ দিক আছে। তার সম্বন্ধে বেশি কিছু জানতে গেলে তার খারাপ দিক গুলো বেরিয়ে আসবে। তার খারাপ দিকগুলো নিয়ে চিন্তায় পড়বে। সব সময় মনের মধ্যে একটা ভয় থাকবে। তখন কি হবে? মেয়ের বিয়ে দেবেন না? মেয়ের বিয়ের জন্য অন্য কোনো ছেলেকে ঠিক করবেন?তারপর অন্য কারোর হাতে মেয়েকে তুলে দেবেন। কিন্তু মেয়ে‌ কি আদৌ সুখী হবে? হবে না। ইয়াসমিনের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছে। তাই মেয়ের পছন্দকে পূর্ণ মর্যাদা সমর্থন করলেন। বেশ জমজমাট করে রাকিব আর ইয়াসমিনের বিয়ে হল। ঘর খালি করে ইয়াসমিন শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। মা ও মেয়ে দুজন মিলে হাউমাউ করে কাঁদলেন। লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেললেন তানভীর স্যার। কাউকে বুঝতে দিলেন না। তিনি তো মেয়ের বাবা। বাবা হয়ে ভেঙ্গে পড়তে পারেন না। শক্ত হতে হবে।
প্রথমের দিকে সকাল দুপুর সন্ধ্যা তিন বেলা ফোন করতো ইয়াসমিন। সপ্তাহে একবার হলেও বাবা মার সঙ্গে দেখা করতে আসতো।তারপর আস্তে আস্তে কমে যায়। শ্বশুরবাড়ি থেকে নানা ধরনের দাবি করে, টেলিফোনের বিল প্রচুর আসছে।সারাদিন ফোনে কথা বলতে থাকলে বাড়ির কাজ গুলো কে করবে? এভাবে টাকা নষ্ট করলে চলবে না। এছাড়া প্রত্যেক সপ্তাহে বাপের বাড়ি যাওয়া কোন মানে হয় না। নতুন সংসার হয়েছে। বুঝে নিতে শেখো। এখন আর ঘোরার বয়স নয়। নিজের সংসার নিজে হাতে সামলাও।
ধীরে ধীরে ইয়াসমিনও সংসারের কঠিন মায়ায় ডুবে পড়ে। আস্তে আস্তে করে বাপের বাড়ি পরের বাড়ি হতে শুরু করে। এখন সপ্তাহে এক বারের মতো ফোন করে খোঁজ নেয়। মাস তিনেকের মধ্যে মাঝেমধ্যে আসে। ইয়াসমিন চলে যাওয়া পর আমিনা আর তানভীর স্যার একলা হয়ে যান। আমিনা আরও অসুস্থ হয়ে ওঠেন। একাকিত্বে ভুগতে শুরু করেন। আমিনা বার বার তানভীর স্যারকে বলেন, ছেলের একটা খোঁজ নিতে। সে কেমন আছে? কি করছে? সবকিছু জানতে।মা ভীষণ অসুস্থ, এই কথা জানলে সে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। কিন্তু তানভীর স্যার এর একটাও করেননি। তিনি ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেননি। নিজে থেকে গেছে, নিজে থেকে আসবে। তাকে খোঁজার কোনো মানে হয় না। স্ত্রীর এই দাবি তানভীর স্যার রাখতে পারলেন না। এতকিছুর পরও তিনি নিজের আইনে অটল থাকলেন।
দু’ঘণ্টার রান্না চার ঘণ্টায় শেষ করলেন। রান্না শেষ হওয়ার পর টেবিলের ওপর সব সাজিয়ে রাখলেন। তারপর স্ত্রীর জন্য খাবার বেড়ে রুমের মধ্যে নিয়ে গেলেন। বেশ কয়েকদিন ধরে আমিনার অসুস্থতা বেড়ে গেছে। একেবারেই উঠতে বসতে পারেন না। সব সময় বিছানায় শুয়ে থাকেন।

‘এসো বলছি। একদিন রেস্টুরেন্টে খেলে কিছু হবে না। বিল নিয়ে ভয় করতে হবে না। আমি আছি তো…’দুপুরের মুখে এমন কথা শুনে লজ্জিত বোধ করলো মাহবুব। অল্প সময়ের মধ্যে আঁধার নেমে আসবে। মাহবুব দ্রুত হেঁটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছিল। বাড়িতে ফিরে তাকে রান্না করতে হবে। ঘর-দুয়ার ঝাড় দিতে হবে। জামা-কাপড় পরিষ্কার করতে হবে। এরপর রয়েছে অফিসে একগাদা কাজ। সব মিলিয়ে পাগল পাগল অবস্থা মাহবুবের।
বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পর প্রায় দুই সপ্তাহের মতো বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়ে ছিল। কিন্তু তারা আর কতদিন দেখবে? মাহবুব বড় হয়েছে। নিজের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে। কোনো ইনকাম না করে বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে লজ্জা করছিল। এ-দিক ও-দিক ঘুরে চাকরির সন্ধান করে। কিন্তু ঘুষ ছাড়া সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো কোম্পানিই চাকরি দিতে রাজি হয়নি। শেষে মাহবুব একটা কাপড়ের দোকানে থাকতে শুরু করে। অল্প বেতন কিন্তু কাজ অনেক। তবুও মাহবুব রাজি হয়ে যায়। অনেক চেনা পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। চেনা-পরিচিত মানুষেরা তার বর্তমান পরিস্থিতি দেখে হাসতে থাকে। অপমান লাঞ্ছনা মাহবুব মেনে নিয়েছিল। তবে বাবার প্রতি রাগ দিনের পর দিন বাড়তে থাকে।বাবার জন্য বর্তমানে তার এই অবস্থা। কিন্তু সে হাল ছেড়ে দেয়নি। নিজের রাগ অহংকার বজায় রেখে আব্বুর কাছে ফিরেও যায়নি। কাপড় দোকানে কাজ করতে করতে সে একটা কোম্পানির সিকিউরিটির চাকরি পায়। ওইখান থেকে টাকা একটু বেশি রোজগার হতে শুরু করে। নিজের মতো করে গোছাতে থাকে নিজেকে। প্রায় প্রতি দিন একটা একটা করে ফর্ম তুলে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিতে থাকে। কিন্তু কোথাও কোন কিছু করে উঠতে পারছিল না।সিকিউরিটির দ্বায়িত্বে সময় দুপুরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ওই কোম্পানিতে দুপুর কাজ করতো। রোজ তার সঙ্গে দেখা হতো। প্রথমে একে অপরকে তাকিয়ে থাকতো কোনো কথা বলতো না। তারপর হ্যালো,হাই, তারপর বন্ধুত্ব। তারপর থেকে শুরু ভালোলাগা আর ভালোবাসা।দেখতে দেখতে মাহবুব একটা কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়। কোনো ঘুষ দিতে হয়নি। নিজের যোগ্যতায় নিজে চাকরি খুঁজে নেয়। অনেক খুশি হয় তবে মাইনে খুব কম। বাড়িভাড়া, নিজের পোশাক- আশাক, বাজার ইত্যাদি এগুলো করতে করতে মাইনের অর্ধেকের বেশি খরচ হয়ে যায়। বিলাসবহুল ভাবে থাকা ছেড়ে দিয়েছে সে। তারপর একদিন মনে পড়ে দুপুরের কথা।আগে যেখানে কাজ করত সেখানে নিশ্চয়ই দুপুর এখনো কাজ করে। দুপুরের অফিস টাইম জানা ছিল। তিন দিনের মতো অপেক্ষা করার পর দুপুরের সঙ্গে দেখা হয়। তারপর নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সব কথা বলে দুপুরকে। দুপুর খুব তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যায়। সে প্রথম থেকেই মাহবুবকে পছন্দ করত। কিন্তু বলার সাহস হয়ে ওঠেনি।

রেস্টুরেন্টে এক প্লেট খাবারের দাম অনেক। তাই দুপুরকে বারণ করছিল সে। এখন সে কঠোর পরিশ্রম করে।মাঝেমধ্যে সময় পেলে দুপুরের সঙ্গে একটু আধটু বাইরে বের হয়। দুপুর শুনল না। সে টেনে টেনে মাহবুবকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। দুজনের জন্য খাবার অর্ডার করলো। মাহবুব কোনো কথা বলল না। বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বসে আছে। দুপুর মাহবুবের সমবয়সী। গৌর বর্ণ শরীর। স্বাস্থ্যের সঙ্গে দেহের উচ্চতার কোনো মিল নেই। ভীষন লম্বা আর রোগা। তবে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন।বাবা-মার একটিমাত্র মেয়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। মাহবুবের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে নিয়েছে ইতিমধ্যে। মাহবুবের আব্বুর কথা শুনে দুপুর আশাহত হয়নি। বরং তানভীর স্যারের প্রতি তার শ্রদ্ধা বেড়েছে। মানুষটিকে দেখার ইচ্ছে হয়। দুপুর মাহবুবের কাছে অনেকবার দাবি রাখে, তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। তাঁর আব্বু যা করেছে তার ভালোর জন্য। কিন্তু মাহবুব শুনেনি। দুপুর বেশি জোরও করেনি। সে বিশ্বাস করে, মাহবুব একদিন ঠিক বুঝতে পারবে।
‘তুমি কি এইভাবে বসে থাকবে? কোন কথা বলবে না!’ দুপুরের কথা শুনে মাহবুব মুখ তুললো। মাহবুব ভালোভাবে দুপুরকে দেখলো। সে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। প্রায় দুই বছর হলো বাড়ি ছেড়েছে। আম্মু আব্বু কেমন আছে সে জানে না। বোনের পড়াশোনা শেষ নাকি সে এখনো পড়াশোনা করছে তাও জানা নেই। তাই সে একটু ভেঙ্গে পড়েছে। পরিবার ছাড়া তার কিছু ভালো লাগছে না। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। যেখানে তার কথার দাম নেই, সেখান থেকে লাভ কি? বরং এখানে স্বাধীনভাবে আছে। বাড়িটা তো একটা জেলখানা,আর আব্বু পুলিশ অফিসার। উনার সমস্ত আইন মেনে চলতে হবে। কোনো কথা অমান্য করলে উনি এত বড় একটা ছেলেকে মারতে দ্বিধা বোধ করবেন না। মাহবুব হালকা স্বরে বলল,’আমার কিছু ভালো লাগছে না, দুপুর।’
‘কেন? কি হয়েছে?’
‘এত পরিশ্রম আমি কখনো করিনি। আমি পারবো না এই সমস্ত কাজ করতে। আমার কিছু ভালো লাগছে না। সবকিছুতে বিরক্ত বোধ করছি।’
‘মাহাবুব, পরিশ্রম ছাড়া কিছু হয় না। পরিশ্রম ছাড়া জগতে কেউ কিছু করতে পারে না।’
‘তুমি জানো না দুপুর! আমাদের অনেক সম্পত্তি রয়েছে। অনেক ক্ষেতের জমি রয়েছে। আব্বুর টাকার অভাব নেই। আমার আব্বু চাইলে আমি যে কোম্পানিতে কাজ করছি, ওই কোম্পানি অনায়াসে কিনে নিতে পারবেন। কিন্তু দেখো আমি সেই কোম্পানিতে ছোট্ট একটা পদে নিযুক্ত আছি। আমার আব্বু থেকেও না থাকার মতো। তিনি কখনো চাইলেন না তার ছেলে অনেক বড় জায়গায় যাক। দুটো বছর বাড়ি থেকে চলে এসেছি। একবারের জন্যও কেউ খোঁজ নেয় নি। তাদের কাছে তাদের ছেলে মূল্যহীন। এত টাকা থেকেও যদি সঠিক সময়ে ওই টাকা খরচ করা গেল না, তাহলে ওই টাকা থেকে লাভ কি?’
দুপুর বসে বসে মাহবুবের সমস্ত কথা শুনল। মাহবুবের কথা শুনে ভীষণ আশ্চর্য হয়। সে মাহাবুবের মন ভালো করার চেষ্টা করল। শান্ত মাথায় বলল,’তুমি নিজেই বললে সঠিক সময়ে সঠিক টাকা খরচ করা উচিত। তোমার আব্বু তাই করছেন। তোমাকে টাকা না দিয়ে ভালই করেছেন। তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো। তোমার আব্বু কোনো ভুল করেননি।’
‘তারমানে তুমিও আমার আব্বুকে সমর্থন করছো?’
‘তেমনটা নয়। ওই মানুষটাকে আমি কখনো দেখিনি। মানুষটাকে চিনিও না। তবে এটুকুই বলতে পারি, তিনি কোনো ভুল করেননি। সময় থাকতে বাড়ি ফিরে যাও, না হলে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলবে।পরে হতাশা ছাড়া….।’

পর্ব ১৯ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here