মাস্টারমশাই পর্ব ২১

0
200

মাস্টারমশাই
পর্ব ২১
_____________
মাহবুব যেমনটা ভেবেছিল বাড়ি ফিরতে ঠিক তার বিপরীতটা হলো। তানভীর স্যার মাহবুবকে ক্ষমা করে দিলেন। মানুষ মাত্রই ভুল করে, সে-ই ভুল যদি নিজে থেকে শুধরে নেয় তাহলে তা মন্দ নয়। ছেলের সাফল্যে তিনি ভীষণ রকমের খুশি। তিনি গর্ব করে নিজের ছেলের নাম বলতে পারেন। তবুও ছেলের ওপর ভীষণ রকমের মান-অভিমান জন্মায়। স্যারের একটু বেশি অভিমান হয়েছে। কারণ, মাহবুব চলে যাওয়ার পরে আমিনা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বিভিন্ন রকমের অসুখকে আসক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু এই মান-অভিমান বেশিদিন টিকলো না।কেবল প্রিয় মানুষদের ওপর মান-অভিমান করা যায়। তিনি তাই করেছেন। তিনি যদি দীর্ঘ সময় ধরে প্রিয় মানুষের উপর অভিমান করে থাকেন, তাহলে বিপরীত মানুষটি কি করে প্রিয় মানুষ হতে পারে? ছেলে ফিরে আসার অল্প সময়ের মধ্যে পুরনো সব কথা ভুলতে শুরু করেন। নিজের অতীত আর মনে করতে চান না। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়। সময় করে মসজিদে যান। সময় করে আমিনার স্মৃতি মনে করেন। ওই স্মৃতি কখনো আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে আবার কখনো বিষণ্ণতায় ভরিয়ে দেয়। সবকিছু অনুকূল চলতে থাকে। আবার সংসার ভরে ওঠে। শুধু সংসারের কান্ডারী নেই। একজন নারী ছাড়া সংসার অসম্পূর্ণ। আমিনার অভাব পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে। তখনই মাহবুবের বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠে। ইয়াসমিনের মতো মাহাবুব আর দুপুরের সম্পর্ক মেনে নেন তানভীর স্যার। দুপুরের পরিবারের সঙ্গে তানভীর স্যার কথা বলেন। তারাও রাজি হয়ে যান। ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দেন।

মাহবুবের বিয়ের পর আরও দুটো মাস কেটে যায়। তখনো বাড়ির মধ্যে একটা উৎসবের আমেজ রয়েছে। যে মানুষটা কখনো কোনো অনুষ্ঠান পছন্দ করতেন না,আজ ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁরও অনুষ্ঠান পছন্দ হয়ে উঠেছে। কিন্তু,আনন্দ উৎসব এই সব কিছুর মাধ্যমে কি জীবন কাটানো সম্ভব? জীবনের একটা স্রোত রয়েছে। সেই স্রোতে সবাইকে পা দিতে হবে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। একবার পড়ে গেলে উঠে দাঁড়ানো অনেক কঠিন। মাহবুবের অফিস থেকে বারবার ফোন আসতে থাকে। কানাডায় ফিরে যেতে বলে। এতদিনে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে। মাহবুব ছাড়া সেই কাজগুলো শেষ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মাহবুব এখন কি করবে? একদিকে নিজের বৃদ্ধ বাবা অন্যদিকে তার স্বপ্ন? এখন কোনটা বেছে নেবে সে? স্বপ্ন না বৃদ্ধ বাবা! দুটোই তার খুব প্রিয়। অনেক ভেবেচিন্তে মাহবুব একটা সিদ্ধান্তে আসে। বৃদ্ধ বাবা আর স্ত্রীকে নিয়ে কানাডায় চলে যাবে। এখানে বাড়ি রেখে লাভ নেই। সে বাড়ি বিক্রি করে দিতে উদ্যত হয়। আব্বুকে সমস্ত কথা বলে। তানভীর স্যার মন দিয়ে ছেলের কথা শুনলেন। কিন্তু রাজি হলেন না। শুধু বাড়ি নয় তিনি এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবেন না। এই গ্রামে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। এই গ্রামে সুখ দুঃখ তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। প্রতিটি গাছের পাতা তাঁর চেনে। এই গ্রামের মেঠো পথ ছেড়ে তিনি চকচকে রাস্তায় যেতে চান না। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। আমিনার স্মৃতি রয়েছে। এই স্মৃতি ছেড়ে তিনি কি করে চলে যাবেন। আমিনা কষ্ট পাবে। তাকে এখানে একা রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। নিজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই বাড়িতেই থাকবেন।
‘আব্বু,তুমি একজন শিক্ষক। একজন শিক্ষকের মুখে কি আত্মার কথা মানায়? এগুলো সব কুসংস্কার।’ তানভীর স্যার মৃদু হাসলেন। তিনি জানেন এগুলো সবই কুসংস্কার। কিন্তু স্মৃতি! স্মৃতি কুসংস্কার নয়। স্মৃতি ছাড়া মানুষের বড় হয়ে ওঠা অসম্ভব।স্মৃতি মানুষকে কখনো নতুন পথ দেখায় আবার কখনো মানুষকে এলোমেলো করে দেয়। এবাড়িতে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠেছে। আমিনার সুখের সংসার ছিল। এই সংসার ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জীবনের বিশেষ মুহূর্ত নয়, জীবনের প্রতিটা মুহূর্তই সুন্দর। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত এই বাড়ির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
মাহবুব বুঝতে পারে তার আব্বুকে রাজি করানো কখনোই সম্ভব নয়। মানুষটি অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছেন। তবে নিজের আইন থেকে সরে আসেননি। নিজের জেদ এখনো রয়েছে। মাহবুব আরও বুঝতে পারে, তাঁর আব্বু নিজের জেদ, নিজের আইন থেকে কখনো সরে আসবেন না। নিজের জেদ আর আইনের জন্য তিনি এতকিছু হারিয়েছেন। আর তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এগুলো পালন করে যাবেন। এর জন্য যদি মানুষটাকে আরও অনেক কিছু হারাতে হয়, তার জন্য তিনি প্রস্তত আছেন। তবে বৃদ্ধ বাবাকে একা ছেড়ে যেতে পছন্দ হলো না মাহবুবের।সে কথা দিয়েছিল বৃদ্ধ অবস্থায় বাবাকে সব সময় খুশি রাখবে।সে ঠিক করল, দুপুরকে বাড়িতে রেখে দিয়ে যাবে। দুপুর থাকলে বাবা তার সঙ্গে গল্প করতে পারবেন। নিজের একাকীত্ব দূর করতে পারবেন। দুপুরকে নিজের মেয়ে ভাবেন তানভীর স্যার। কখনো কোনো কিছুতে অসুবিধা হবে না। মাহবুব বলামাত্রই দুপুর রাজি হয়ে যায়। সে তার বাবার কাছে থাকতে রাজি হয়। মাহবুব বিদেশে চলে যাবে। মাঝেমধ্যে আসবে। সামনে থেকে দুপুর রাজি হয়ে গেলেও ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরতে শুরু করে। শুধু দুপুর বলা ভুল, মাহবুবেরও মন খারাপ হয়ে যায়। স্ত্রীকে রেখে বিদেশে যেতে মন চায় না। বুক আনচান করে ওঠে। ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে থাকা এত সহজ নয়। একে অন্যের হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিল সবসময় পাশে থাকবে। সুখ দুঃখ সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এতগুলো দিন তারা আলাদা ছিল। আজ বিয়ের পর আবার আলাদা থাকবে। দুপুর জানে, মাহবুব বিদেশে চলে গেলে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকবে। মাহবুব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। রাতে ফেরার পর ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে হবে না। রাতের পর রাত জেগে কাঁদতে হবে। চেনা অনুভূতি অচেনা হয়ে উঠবে। ভালোবাসার অভাবে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে সে। এখন রঙ্গিন বয়স। একে অপরের হাত ধরে ঘোরাঘুরি করবে। বাইরে নির্জন জায়গায় বেড়াতে যাবে। ছাদের উপর বসে গল্প করবে। এটাই তো ভালোবাসা। একে অপরকে ভালো করে চিনবে। সময় বিনিময় করবে। কিন্তু বিয়ের পরেও যদি থাকে দূরত্ব, তাহলে এ সব কি করে হবে? দূরত্ব তো খারাপ জিনিস। মায়া কমিয়ে দেয়। ভালোবাসায় মায়া না থাকলে, তা আবার কেমন ভালোবাসা? তবে পরিবারের কথা ভাবতে হবে। দুপুর কিছুতেই তার বুকের কষ্ট কাউকে বুঝতে দিল না। সবকিছু মেনে নিল। বৃদ্ধ বাবাকে তো এখানে একা রেখে যাওয়া যায় না।

সারারাত মাহবুব আর দুপুর একটাও কথা বলল না। নিজেরা অন্য দিকে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যায়। দুজনের বুকের কষ্ট দুজনের হৃদয়ে চাপিয়ে রাখলো। প্রকাশ করল না। সকালে উঠেও তারা ভালো মতো কথা বলল না। তাদের কার প্রতি এত রাগ! কার প্রতি এত অভিমান! তারা নিজেরাও জানে না। ফ্লাইটের টিকিট বুকিং করার সময় মাহবুব আবার একবার দুপুরকে জিজ্ঞেস করল, তার কোনো অভিযোগ নেই তো? দুপুর মাথা নাড়িয়ে না বলল। কিন্তু এবার আর নিজের চোখের জল লুকিয়ে রাখতে পারল না। মাহবুবের সামনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাহবুব দুপুরের মনের অবস্থা বুঝতে পারল। তাকে বুকের মধ্যে আগলে নিল। পিঠে হাত চাপড়ে বলে, শান্ত হও। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি প্রত্যেক দু-মাস অন্তর ফেরার চেষ্টা করব। একটু মানিয়ে নাও। দুপুর কোন কথা বলল না। মানিয়ে নেওয়া….. এই কথাটি বলা সহজ কিন্তু বাস্তবটা বড্ড কঠিন। সব সময় কেন মানিয়ে নেবে? ছোটবেলা থেকে এটা করো না ওটা করো না…. এটাকে মানিয়ে নিতে শেখো। তারপর যখন বড় হলো, এক বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে চলে আসলো। এটা কি কম মানিয়ে নেওয়া? আর এখন বলছে, তুমি এখানে থেকে ঘর-বাড়ি বৃদ্ধ বাবার দেখাশোনা করো। তোমাকে ছেড়ে স্বামী বিদেশে থাকবে। এটাও মানিয়ে নিতে হবে? জীবনে শুধু মানিয়ে নিয়ে চলল। কখনো তো নিজের মতো করে বাঁচতে পারল না। অন্যের সুখ-দুঃখ দেখতে গিয়ে কখন নিজের ভালোলাগা ভালোবাসা…. ।‌
দুপুর খুব সহজ সরল সাদাসিদে মেয়ে। সবকিছু মানিয়ে নিলো। চোখের জল মুছে ফেলল। তারপর স্বামীর পাশে গিয়ে বসলো। এমন সময় তাদের রুমে তানভীর স্যার প্রবেশ করলেন। শ্বশুর মশাইকে দেখে দুপুর একটু ঘাবড়ে যায়। তিনি কি সবকিছু বুঝতে পেরে গেছেন? এই মুহূর্তে তিনি হয়তো রাগ করবেন না। কিন্তু মানুষটার মন খারাপ হয়ে যাবে। মানুষটি মন খারাপ করুক, সে চায় না। মানুষটির সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছে। তানভীর স্যার সম্বন্ধে যতই জানে ততই শ্রদ্ধা বাড়তে থাকে। মানুষটা সম্পুর্ণ অন্যরকমের। অসম্ভব জ্ঞানী। তানভীর স্যার রুমে প্রবেশ করে গলা খাঁকরে বললেন,’মাহবুব,টিকিট কনফার্ম হয়ে গেছে?’
‘না, একটু সময় লাগবে।’
‘দুটো টিকিট কাটবি।’
দুটো টিকিটের কথা শুনে মাহবুব আর দুপুর কৌতুহলী হয়ে ওঠে। বাবা নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে বিদেশে ফিরে যাবেন। কৌতূহলবশত দুপুর তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল,’দুটো টিকিট কি হবে?’
‘এখনো বুঝতে পারছিস না?’
দুপুর মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল। মাহবুব কিছু বুঝতে পারল না। তানভীর স্যার জোরে জোরে হেসে উঠলেন। তারপর উচ্চ স্বরে বললেন,’আচ্ছা মাহবুব,তুই কখনো দেখেছিস তোর আম্মুকে ছেড়ে আমি কখনো কোথাও গেছি? সে নলকূপে জল আনতে গেলে, আমি তার পেছনে পেছনে যেতাম। গ্রামে অনেকে এই জিনিসটা খারাপ ভাবে নিত। বলতো, বুড়ো যত বৃদ্ধ হচ্ছে ততই চাঙ্গা হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি কখনো লোকের কথায় পাত্তা দেয়নি। লোকের কথায় কেন আমি আমার ভালোলাগাটাকে হারিয়ে ফেলবো। এতগুলো বছর একসঙ্গে থেকেছি বলে, একে অপরকে ভালো করে চিনতে পেরেছি।আর তোরা আমার ছেলে মেয়ে। তোরা কি করে ভাবলি, দুইজন আলাদা আলাদা থাকবি। তা হচ্ছে না। তোরা দুজন একই সঙ্গে কানাডায় ফিরবি।’
তানভীর স্যার থামলেন। দুপুর মাহবুব একে অপরের দিকে তাকালো। বাবার মুখে বাবার প্রেমের কথা শুনে তারা একটু লজ্জিত বোধ করলো। মুখ নিচু করে ফেলল। তানভীর স্যার একটা জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বললেন,’জানিস, একটা ছেলের জীবনে আল্লাহ দেওয়া সবচেয়ে দামি জিনিস কি? তার স্ত্রী। যখন একটা ছেলে জন্মায় তখন তার মা-বাবা তাকে আগলে ধরে বাঁচতে শেখায়। কিন্তু তারা নির্দিষ্ট সময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। তারপর তার ছেলে মেয়ে, তাদেরকে তো বিশ্বাস করা যায় না। সময়ের সাথে সাথে বদলে যায়। কিন্তু তার স্ত্রী, সে কখনো বদলায় না। সারাটা জীবন তার সঙ্গে থাকে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লড়াই করে। একটা সংসারে সবচেয়ে সুন্দর জিনিস একজন স্ত্রী। সুন্দর জিনিসকে বোঝার ক্ষমতা সবার থাকে না। তাই অনেক ছেলে তার স্ত্রীকে অবহেলা করে। কিন্তু যে বুঝতে পারে সে কখনও এমনটা করে না। বুক ভরে ভালোবেসে যায়। বাড়িতে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া হয়। দিনের পর দিন কথা হয় না। কিন্তু, একটা জিনিস লক্ষ্য করবি, স্ত্রী স্বামীর জন্য ঠিক রান্না করে রাখে। তার পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। এটাই তো ভালোবাসা।দশজন প্রেমিকাকে ভালোবেসে হয়তো আবার একজন প্রেমিকাকে ভালোবাসা যায়। কিন্তু নিজের স্ত্রীকে ভালবাসার পর অন্য কোনো স্ত্রী বা প্রেমিকাকে ভালোবাসা যায় না। যদি ভালোবেসে ফেলে, তাহলে প্রথম স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা ছিল না। ছিল কেবল দায়িত্ব ও কর্তব্য।’
বাবার কথা মন দিয়ে শুনল। তবুও বাবাকে একা রেখে তারা বিদেশে যেতে চাইলো না। মাহাবুব শান্ত গলায় বলল,’আব্বু, আমি আর দুপুর যদি বিদেশে ফিরে যাই, তাহলে তোমার অনেক কষ্ট হবে। তুমি এখানে একা থাকতে পারবে না।’
‘আরে বেটা, তুই তোর স্ত্রীকে নিয়ে বিদেশে যায়। আর আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকি। আমিনা আমার ঠিক দেখাশোনা করবে। রঘু তো আছে। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।’

সেদিন বাবা-ছেলে বৌমার মধ্যে অনেক কথাবার্তা হয়। তারপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়,মাহবুব আর দুপুর কানাডায় যাবে। আর তানভীর স্যার নিজের বাড়িতে থাকবেন। নির্দিষ্ট সময়ে মাহবুব আর দুপুর কানাডায় উড়ে যায়। নিজের ছেলে বৌমার সুখের কথা ভেবে নিজের সুখ বিসর্জন দিলেন। এই বয়সেও ত্যাগ স্বীকার করতে, তিনি দ্বিধা বোধ করলেন না। ছেলের সুখের কাছে তার সুখ নগণ্য। মাহবুব আর দুপুর চলে যাওয়ার কিছু মাস পর, ইয়াসমিনের কোল আলো করে সন্তান আসলো। বাপের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হতে শুরু করল। সন্তানের দেখাশোনা, সংসার, স্বামী, শশুর শাশুড়ি এগুলোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নিজের সংসার নিজে গোছাতে থাকে।নিজের বাবাকে খুব মনে পড়ে। অনেক কথা ভাবে। কিন্তু কিছু করার নাই। বাস্তবটা মেনে নিতে হবে।

দুপুর আর মাহবুব আর দেশে ফিরলো না। কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যদিও সময়মতো রোজ ফোন করে। কিন্তু ফোনে কি একাকীত্ব দূর করা যায়? ফোনের মাধ্যমে কি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে? একাকীত্ব মানুষটিকে ঘিরে ধরে। খুব অল্পদিনের মধ্যে খিটখিটে হয়ে ওঠে। মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা চলে আসে। অল্প বয়সে বার্ধক্য দেখা দেয়। মুখের মধ্যে যা আসে তাই বলে ফেলেন। সারাদিন বই আর খবরের কাগজ পড়ে সময় কাটিয়ে দেন। মাঝেমধ্যে টিভি দেখেন। কখনো বাগানে গিয়ে একা বসে থাকেন। কখনো আবার ধীরে ধীরে ছাদে উঠে যায়। একা বসে আমিনার কথা ভাবতে থাকেন। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। আমিনা থাকলে ভালো হতো। এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে ভালোবাসতো। অনেক কথা ছিল, সব কথা বলা হয়নি। কথাগুলো অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। হঠাৎ করে আমিনা চলে যাবেন সেটা-ই বা কে জানতেন! আরও কয়েকটা বছর এ ভাবে কেটে গেল। বাড়ির বাইরে তিনি আর বের হতে পারলেন না। বৃদ্ধ অবস্থায় নানা ধরনের চিন্তাধারা তাঁকে বন্দী করল ঘরের মধ্যে। তার ছাত্ররা তাঁকে পাগল বলে ডাকতে শুরু করল। তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করল। তিনি হাসির পাত্র হলেন। এ ভাবে ধীরে ধীরে তানভীর স্যার হয়ে উঠলেন মাস্টারমশাই।

১।
দীর্ঘ সময় ধরে রোদের মধ্যে বসে রয়েছে মাস্টারমশাই আর কাবেরী। মাস্টারমশাইয়ের বলা প্রতিটি কথাই কাবেরী খুব মন দিয়ে শুনেছে। মাস্টারমশাইয়ের অতীতের কথা জেনে গেছে সে। মাস্টারমশাইয়ের জন্য খুব কষ্ট হলো। মাস্টারমশাইকে বুঝতে শিখলো। চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। মাস্টারমশাই সম্ভবত আরও কিছু বলতে চাইছিলেন। তখনই কাবেরীর ফোন বেজে ওঠে। কাবেরীর হাজবেন্ড মানে সুমন ফোন করেছে।কাবেরী বারবার ফোন কেটে দিচ্ছে। মাস্টারমশাই ফোন রিসিভ করতে বলল। কাবেরী ফোন রিসিভ করল।
‘কতক্ষন থেকে ফোন করছি। ফোন ধরছো না কেন? গ্রামে গিয়ে আমাকে ভুলে গেছো?’
‘আরে বাবা, একজনের বাড়িতে এসেছি। তিনি আমার ছোটবেলার মাস্টারমশাই। উনার সামনে ফোন ধরতে সাহস হয়নি।’
‘বাড়ি পৌঁছে একবার ফোন করে বলতে তো পারো, পৌঁছে গেছি। এদিকে আমি চিন্তায় মরছি।’
কাবেরী বাইরে বেরিয়ে আসলো।তারপর স্বামীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল। খুব ভোরে কাবেরী বাড়ি থেকে গ্রামের বাড়িতে এসেছে।কিন্তু পৌঁছে গিয়ে একবারও ফোন করেনি। সুমন কাবেরীকে একা ছাড়তে চায়নি কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য বাধ্য হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ নিজেদের নিয়ে কথা বলল। তারপর সুমন শান্ত গলায় বলল,’আজকে দুজন নবীন লেখক এসেছিল। তারা তাদের লেখা তোমার প্রকাশনীতে ছাপাতে চায়……।’
সুমনের কথা শেষ হওয়ার আগেই কাবেরী তাড়াতাড়ি করে বলল,’ভালো করে লেখা গুলো দেখে নেবে। না হলে আমি শহরে ফিরে যাই তারপর দেখা যাবে। এখনকার লেখক-লেখিকারা মনের মধ্যে যা আসে তাই লিখে ফেলে। না থাকে ঠিকমতো বাক্য গঠন, না থাকে শব্দচয়নের সৌন্দর্যতা। আর থাকে আহামরি কাহিনী।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি কবে এখানে ফিরবে?’
‘সকালেই তো আসলাম। আর এর মধ্যে ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করছো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। একটু ঘোরাঘুরি করো। তবে বেশিদিন থাকবে না। তোমার ফেরার অপেক্ষায় রইলাম।’
‘আমি পাঁচ দিনের মধ্যে ফিরে যাব। বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেলে চলে যাবো।’

আরও কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলার পর কাবেরী মাস্টারমশায়ের কাছে ফিরে আসলো।মাস্টারমশাই চেয়ার থেকে উঠে ভেতরে চলে গেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে যায়। কাবেরীকে নিজের বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ির অবস্থা কি হয়েছে, কেউ জানে না। দুপুরে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে খেয়েছে। রাতে নিশ্চয়ই অন্য কেউ খেতে দেবে না। নিজেকে রান্না করে খেতে হবে। গ্রামে ভাত তরকারি কিনতে পাওয়া যায় না। সে তাড়াতাড়ি মাস্টারমশায়ের কাছে গেল। মাস্টারমশাইকে বিদায় জানিয়ে বাড়ি ফিরতে উদ্যত হলো। কাবেরী বাড়ি ফিরে আসছিল, ঠিক তখনই মাস্টারমশাই পেছন থেকে ডাকলেন। তার হাতে একটা বই দিলেন। কাবেরী বই দেখে বুঝতে পারল, ওই বইটা দুপুরে টিভিতে দেখাচ্ছিল। কিশলয়ের লেখা ‘মাস্টারমশাই’ উপন্যাস। যে উপন্যাসের জন্য কিশলয় ‘সাহিত্য একাডেমী’ পুরস্কার পেতে চলেছে। মাস্টারমশাই কাবেরীর হাতে বই তুলে দিয়ে বললেন,’সময় পেলে এই উপন্যাসটি পড়িস। তোর ক্লাসমেটের লেখা বই। কিশলয় আমাকে দিয়েছিল বইটা পড়ার জন্য। আমি পড়েছি। বেশ সুন্দর গুছিয়ে লিখেছে ছেলেটা। অনেক বড় লেখক হয়েছে সে। আমার বেশ গর্ববোধ হয়। তুইও উপন্যাসটি পড়ে দেখ। আশা করি ভালোই লাগবে।’
কাবেরী মাস্টারমশাইকে কথা দিল সে অবশ্যই উপন্যাসটি পড়বে। উপন্যাসে কি রয়েছে সে অবশ্যই জানবে। উপন্যাসের মধ্যেও যেন কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।

পর্ব ২২ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here