মাস্টারমশাই পর্ব ২৪

0
325

মাস্টারমশাই
পর্ব ২৪
_______________
‘আপনারা কারা? আপনাদের তো আমি ঠিক চিনতে পারলাম না।’ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কাবেরী কথাগুলো বলল। লোকগুলোকে দেখে সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। উপস্থিত লোক গুলো যেন মেয়েটার পরিস্থিতির কথা বুঝতে পারল। তাদের মধ্যে একজন স্বাভাবিক ভাবে বলল,’আপনি ভয় পাবেন না। আমরা খারাপ মানুষ নই। আপনার স্বামী আমাদের পাঠিয়েছেন। এই বাড়ি থেকে জিনিসপত্রগুলো শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’ কাবেরী জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে কি সব ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল। নিজের ভুলে নিজে লজ্জিত বোধ করলো। লোক গুলো কি ভেবেছে কে জানে! মাস্টারমশায়ের চিন্তায়, নিজের সংসারের কথা পুরোপুরি ভুলে গেছে। অনেকদিন হলো গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। দশ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার অনুরোধ রয়েছে। যিনি এই বাড়িটা কিনেছেন, তিনি এই পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বড় একটি বাড়ি বানাবেন।গ্রামের বাড়িতে অনেক দামী জিনিসপত্র রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে স্মৃতিমাখা অনেক আসবাবপত্র। সেগুলো গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তার গ্রামে আশা। প্রথমে সুমন গ্রামে আসতে চাইছিল। কিন্তু কাবেরী তাকে আসতে দেয়নি। এই বাড়ি বিক্রি করার পর তারা হয়তো, আর কখনো গ্রামে আসতে পারবে না। এখানে এসে তাদের লাভ কি? এখানে তাদের কিছু নেই। শেষবারের মতো নিজের গ্রামকে দেখার বাসনা জাগে কাবেরীর মনের মধ্যে। পুরনো স্মৃতি খুঁজতে গ্রামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। এক গাদা কাজ পড়ে রয়েছে, কিন্তু কোনো কাজকে পাত্তা দেয়নি সে। ছুটে এসেছে নিজের গ্রামে।পুরনো স্মৃতিকে খুঁজতে। কাবেরীকে বাসে তুলে দিয়ে সুমন বলে ছিল, পরের দিন সকালে তিনজন মানুষ ভ্যান গাড়ি নিয়ে গ্রামের আসবে। সমস্ত জিনিসপত্র সঠিকভাবে গাড়িতে তুলে দিতে। কাবেরী যদি চায় তাহলে সেই গাড়িতে শহরে ফিরে আসতে পারে। না হলে, কদিন গ্রামে থেকে তারপর না হয় শহরে ফিরে আসবে। এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে সে গ্রামে আসে। কিন্তু গ্রামে এসে সবকিছু ভুলে যায়।মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে তার বাড়ি বিক্রি করার ইচ্ছাটা মরে গেছে। কিন্তু বাড়ি বিক্রি না করেও উপায় নেই। মালিককে কথা দিয়ে দিয়েছে সে। এমনকি মালিকের থেকে টাকা নেওয়াও হয়ে গেছে। বাড়িটা বিক্রি করা কি ভীষন জরুরী? তাদের তো টাকাপয়সার অভাব নেই। এই বাড়ি বেছে কতই বা টাকা পাবে! বাড়িতো পুরনো। কাবেরীর কাছে এসব ভাবার সময়ের সময় নেই।সে লোকগুলোকে ভেতরে আসতে বলল। নিজে ফ্রেশ হয়ে সবার জন্য চা বানালো। চা খাওয়া শেষ হতে সবাই নিজেদের কাজে লেগে পড়লো।লোক গুলো বাড়ি থেকে একটা একটা জিনিস নিয়ে গিয়ে গাড়ির মধ্যে রাখলো। কাবেরী সেগুলোকে প্রখর দৃষ্টিতে দেখলো। কিছু কিছু জিনিস বারবার নাড়াচাড়া করায় কারণে, জিনিস গুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। কাবেরী তাদেরকে বলল, ভেঙ্গে যাওয়া জিনিস গুলো তোলার দরকার নেই। ফেলে দিতে। ভেঙ্গে যাওয়া জিনিস গুলো দেখে কাবেরীর বুক কেঁপে ওঠে। এই জিনিসগুলো একসময় কত প্রিয় ছিল। বুক ভরে আগলে রাখতো।একটা কিছু নোংরা হলে সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে দিত। মায়ের উপর চিল্লাচিল্লি করতো। ওইসব জিনিস গুলো আজ ফেলে দিতেও দ্বিধাবোধ করছে না। ভাঙ্গা জিনিস গুলো দেখে কাবেরীর মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে পড়লো।ছোটবেলায় মাস্টারমশাইকে তাদের ভীষণ প্রয়োজন হতো। তাই তারাও মাস্টারমশাইকে সম্মান করতো ভালোবাসতো। মাস্টারমশাইয়ের কিছু হলে চিন্তা হতো। কিন্তু আজকে মাস্টারমশাইকে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। কারণ, পুরনো জিনিসপত্রের মতো মাস্টারমশাইকে আর প্রয়োজন নেই। তিনি তাঁর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।তিনি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলেও কারোর কিছু যায় আসে না। পুরনো জিনিসপত্র আর পুরনো মানুষ দুটোই যেন এক।

বেলা গড়িয়ে যেতে রইল। এ বেলার মধ্যে জিনিসপত্র নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। কাজের তাড়া রয়েছে। লোক গুলো একসময় বাড়ির একদম ডান পাশের রুমে প্রবেশ করতে উদ্যত হয়। কাবেরী বাধা দেয়। সে-ই রুমে তাদের প্রবেশ করতে বারণ করে। ওটা শুভজিৎ এর রুম।ওই রুমে সে থাকতো। সে মারা যাওয়ার পর কাবেরী ওই রুমে প্রবেশ করতে সাহস পায়নি। কিছুদিন পর তারাও শহরে চলে যায়। নিজের মাও ওই রুমে প্রবেশ করতে সাহস পায়নি। রুমের মধ্যে প্রবেশ করলে শুভজিৎ এর বীভৎস মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। গা ঝিমঝিম করে ওঠে। একটা চাপা ভয় কাজ করে।নিলেশ বাবু মাঝে মাঝে প্রবেশ করতেন। আজ কাবেরীর ভয় করছে না। রুমের মধ্যে প্রবেশ করার প্রবণতা বাড়ছে। লোকগুলোকে কিছুক্ষণ পর ওই রুমে যেতে বলল। তাদেরকে এখন বাড়ির অন্যান্য জিনিস গুলো তুলতে বলল। তারা কাবেরীর কথা যথাযথ মানলো। দরজা ঠেলে কাবেরী রুমের মধ্যে প্রবেশ করল। রুমটা ততটা অপরিষ্কার নয়। বাবা নিশ্চয়ই বাড়ির অন্যান্য রুমের সঙ্গে এই রুমটাও পরিস্কার করে যেতো। তাই রুমটা এতটা ঝকঝক করছে। রুমের মধ্যে প্রবেশ করতেই একটা চাপা অতীত স্মৃতিতে জেগে উঠলো। বুকটা চিন চিন করে উঠছে। ঘরের মধ্যে কত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। কত মধুর সংলাপ আর কত হাসির খোরাক বয়ে গেছে।মায়ের কাছ থেকে মার খেয়ে কত কান্নার সাক্ষী আছে দেওয়াল গুলো। জড়িয়ে রয়েছে আনন্দের মুহূর্ত গুলোও। শুভজিৎ এর জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা এই রুমই একমাত্র সাক্ষী। কাবেরী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। ঘরের মধ্যে থেকে একটা চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এই ঘরের মধ্যে কত ভালবাস, কত অভিমান, কত রাগ, কত বিদ্রুপ, কত ছোট ছোট মুহূর্ত, আরও কত কি জড়িয়ে আছে। এখনো পর্যন্ত শুভজিৎ এর ব্যবহৃত পোশাক আশাক, বিছানা সব কিছু রয়েছে। শুধু মানুষটা নেই। হারিয়ে গেছে অনেক বছর আগে। কিন্তু কি করে হারালো তা জানতে পারল না কেউই।দেশের আইনের কাছে হেরে গেছে একটা প্রাণ। সবাই ভুলে গেছে। কাবেরীও ভুলে গেছিল। আজ এই বাড়িতে এসেছে বলে মনে পড়ল।কাল শহরে চলে গেলে আবার সবকিছুই অতীত হয়ে যাবে। কাবেরী আরও বেশি কাঁদতে শুরু করে -বাড়িটা আজ বিক্রি হয়ে যাবে ভেবে। কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা হবে। তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র গুলো বাইরে ফেলে দেওয়া হবে। কুকুরগুলো শুভজিৎ এর ব্যবহৃত জিনিসগুলোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, নয়তো দিনের পর দিন রোদ বৃষ্টি পেয়ে পচে যাবে। হয়তো, শুভজিৎ মরে গিয়েও এতদিন এই বাড়ির মধ্যে ছিল। কিন্তু কাল থেকে সে তার বাড়িটাও হারিয়ে ফেলবে। সে পথের ছেলে। পথে থাকবে। কিন্তু তার জীবন একটু অন্যরকম হতে পারতো, যদি তার বাবা মা থাকতো।
মেঝেতে বসে আছে কাবেরী। চোখ দুটো জলে ভরে গেছে। চোখ আর ব্যথা সহ্য করতে পারছে না। তারাও কেঁপে উঠছে। হঠাৎ লক্ষ্য পড়ে শুভজিৎ এর একটা হাফপ্যান্টের দিকে। হাফ প্যান্টের সাথে একটা দারুণ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পাশের বাড়ির এক ছেলের বিয়েতে তাদের বাড়ির সবার খাবার নেমন্তন্ন ছিল। রাতে দুজন মিলে খেতে যায়। কিন্তু পায়েল দেবী তাদেরকে নতুন পোশাক পরতে দেয়নি। তখন চেয়ার-টেবিলের তুলনায় মাটিতে বসে খাওয়ার প্রবণতা বেশি ছিল। জামা প্যান্ট নোংরা হয়ে যেতে পারে তাই তাদেরকে পুরনো পোশাক পরিয়ে দিয়েছিল। তারাও তখন পুরনো পোশাক পরতে দ্বিধাবোধ করেনি। সে-ই পোশাক পরে আনন্দে নাচতে নাচতে বিয়ে বাড়িতে যায়। কিন্তু খাবার খাওয়ার সময় কাবেরী একটা জিনিস লক্ষ্য করে, শুভজিৎ এর প্যান্টের চেইন খোলা। কাবেরী হাসিমুখে বলেছিল চেইন লাগাতে। শুভজিৎ কাবেরীকে হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, তার প্যান্টের চেইন নেই।তারপরে দুজন মিলে কত হেসেছিল। সবার চোখ তাদের দিকে ছিল। কাবেরী তার কানে কানে ফিসফিস করে বলেছিল, তোর সবকিছু দেখা যাচ্ছে। সে-ই মুহূর্তে শুভজিৎ কি অদ্ভুত আচরণ করেছিল। সেও কাবেরীর কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল, আমি বাচ্চা ছেলে। অসুবিধা নেই। আমিতো প্যান্ট খুলে পুকুরে সাঁতার কাটি। তখন আশেপাশে অনেকেই থাকে।তারপর দুজন মিলে অট্টহাসি দিয়েছিল। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো যে উপস্থিত মানুষদের মধ্যে কেউ পুরো ঘটনাটি না বুঝে হাসছিল। সেদিন কাবেরী আরও একটা জিনিস খেয়াল করেছিল, শুভজিৎ এর বয়সের তুলনায় তার ম্যাচিউরিটি অনেক কম।তার বয়স যথেষ্ট হয়েছে। তার সমবয়সী ছেলেরা কখনো এমনটা করত না। লজ্জিত বোধ করত। কিন্তু শুভজিৎ এর মধ্যে লজ্জার ছিটেফোঁটাও নেই। সে এখনো সেই ছোট্ট বাচ্চা। আবার সেই ছেলেটা কয়েকমাসের মধ্যে আত্মহত্যা করল। তা কী করে সম্ভব? হাফ পেন্টের চেইন কেটে গেছিল,মা জানতে পারলে ভীষণ বকবে।তাই কাবেরী প্যান্টে বোতাম লাগিয়ে দিয়েছিল। কাবেরীর সেটা ছিল প্রথম সেলাই করার অভিজ্ঞতা। কাবেরী উঠে গিয়ে প্যান্টটা টেনে আনলো।প্যান্ট টেনে আনতেই হঠাৎ করে কিছু একটা মেঝেতে পড়ার শব্দ কানে ভেসে আসলো। কাবেরী সেদিকে খেয়াল করলো। কিছু একটা কাচের জিনিস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কাবেরী বারবার সেই ভেঙ্গে যাওয়া জিনিস গুলো লক্ষ্য করলো। মনে পড়লো আরও এক অতীতের কথা। চোখ দিয়ে জল ভেসে আসলো। স্কুলের পড়ার সময় তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ছিল টিকলি। সে বাড়িতে লুকিয়ে একটা কাঁচের পুতুল কিনে ছিল।একটা বড় কাঁচের মধ্যে ছোট ছোট দুটো পুতুল ছিল। টিকলি ওটাকে বাড়িতে রাখতে সাহস পায়নি। সে কাবেরীরকে দিয়েছিল রাখতে। মায়ের রুমে রাখলে মা জানতে পেরে যাবে।তাই কাবেরী শুভজিৎ এর রুমে রেখে ছিল। কথা ছিল ওটা একদিন টিকলিকে ঠিক ফেরত দেবে। কিন্তু সে তো আর স্কুলে যায়নি। নিশ্চয়, টিকলি পুতুলের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল। টিকলি এখন কোথায়? সেটাও জানে না। হয়তো অনেক অভিমান করে আছে,তার পুতুল ফেরত দেয়নি বলে। কত প্রিয় ছিল তার এই পুতুলটা। অথচ তার প্রিয় পুতুলটা তাকে ফেরত দেওয়া হয়নি। এই অন্যায়ের কি ক্ষমা হতে পারে?শহরে যাওয়ার পর কাবেরী অনেকবার টিকলির খোঁজ করে। অনলাইনে অনেক খোঁজেছে, কিন্তু তার দেখা পায়নি।বাবা গ্রামে আসলে টিকলির খোঁজ নিয়ে যেতে বলতো। কিন্তু নিলেশ বাবু প্রতিবারই মেয়েকে হতাশার খবর দিয়েছেন। আজকে তার পুতুলও ভেঙে গেল। স্কুলের শেষ দিনের রেজাল্ট আসলেই একটা অদৃশ্য ইরেজা। যা কয়েকটা নাম্বারের বিনিময়ে মুছে দেয় জীবনের অনেক কিছু অধ্যায়। উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা যে বাড়িটা একসময় অনায়াসে প্রবেশ করা যেতো। দু’বছর পরই ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে গেলে অনুমতির দরকার হয়। টিকলি মেয়েটা একটু অন্যরকম ছিল। তাকে সবাই তার দিদার নাম ধরে ডাকত। এমনকি কাবেরীও তাকে তার দিদার নামে ডাকত। আর টিকলি ভীষণ রাগ করতো। তার রাগটাই সবাই পছন্দ করতো। তাকে রাগিয়ে সবাই যেন আনন্দ পেত। টিফিন হওয়ার সাথে সাথে,সে কাবেরীর টিফিন কেড়ে খেয়ে নিত। পাশাপাশি পাঁচিলের উপর বসে সারা জীবন যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।আজ হয়তো পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায়,কিন্তু চিনতে পারে না। কারণ,কাবেরী আর টিকলির বিচ্ছেদ স্কুলজীবন শেষ হওয়ার অনেক আগে ঘটেছিল। তখন তাদের মুখের আকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। টিফিন কেড়ে খেয়ে নেওয়া মেয়েটা এখন হয়তো অন্যের টিফিন তৈরি করে দিতে ব্যস্ত। রাতে বাড়িতে লুচি হলে বাসি লুচি গুলো পরের দিন স্কুলে নিয়ে যেতো। স্যারের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সেগুলো খাওয়ার আনন্দটা আজ বিবর্ণ। বাসি লুচির স্বাদ আজ পাংশু হয়ে উঠেছে। বান্ধবীর ভিড়ে বান্ধবীরা হারিয়ে যায়। শুধু অক্ষত থেকে যায় বান্ধবীর ভালোবাসা আর গোটা কয়েক স্মৃতি।
আজ আর নীলডাউন,মুরগি সাজা,কান ধরে উঠবস, এগুলো করতে হয় না।রোল নাম্বারগুলো এখনো মনে আছে।প্রতিদিন বসার জায়গা গুলো আজ অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে। এগুলো একটাও ভুলে যেতে পারেনি কাবেরী। এগুলোকে বড্ড মিস করে সে। একদিন নীল ডাউন করতে হলে কান্না করে ফেলতো।আর এখন সে-ই নীলডাউনকে মিস করে। এগুলো তার জীবনে স্মৃতি হয়ে থেকে গেছে। কিন্তু কিশলয় এগুলো সব কিছু ভুলে গেল। সত্যি কি সব কিছু ভুলে গেছে কিশলয়? হয়তো না! হয়তো, সে স্মৃতিগুলোকে ভাষার আকারে জীবন্ত করতে চাইছিল। স্মৃতিগুলোকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু সে কখনো ভাবেনি, এই স্মৃতিগুলোকে জীবন্ত করতে গিয়ে একজন মানুষকে মৃত বানিয়ে দেবে। একজন মানুষের এত বড় একটা সর্বনাশ হয়ে যাবে!

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়, কিন্তু সমস্ত জিনিসপত্র গোছানো শেষ হয় না। নিজের জন্য এবং আগন্তুক লোকেদের জন্য রান্না করে কাবেরী। আগন্তুক মানুষগুলো খাবার খিয়ে ক্লান্ত শরীর রোদে এলিয়ে দিয়েছে। তারা বিশ্রাম করছে। এর ফাঁকে কাবেরী কিশলয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তার সঙ্গে অনেক কথা বাকি আছে। অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হবে। এইভাবে সে কাউকে অপমান করতে পারে না। কিশলয়ের বাড়ির রাস্তা অচেনা নয় কাবেরীর কাছে। তবুও এত দিনের পর রাস্তা চিনতে একটু অসুবিধা হলো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছে যায় কিশলয়ের বাড়িতে। চারিদিকে খাঁ খাঁ করছে। ফাঁকা জায়গায় তার বাড়ি। আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই। নির্জন আর বেশ মনোরম জায়গায় তার বাড়ি।কাবেরী সোজা কিশলয়ের বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। কিশলয় বারান্দায় পড়ার টেবিলের কাছে সারা শরীরে চাদর ঢেকে বসে আছে। জানালা দিয়ে বাইরের নারকেল গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। কিশলয় যেন পুরোপুরি ধ্যানে মগ্ন।নারকেল গাছের ডগায় একটা কাক বসে ‘কা’ ‘কা’ শব্দ করছে।দুটো কাঠবেড়ালি একবার নারকেল গাছের উপরে আর একবার নিচের দিকে খুব স্পিডে দৌড়াচ্ছে।।বাড়িতে প্রবেশ করে কাবেরী বুঝতে পারল বাড়িটা বেশ শীতল। অসময়ে কাবেরীকে দেখে একটু হতভম্ব হল কিশলয়। কাবেরীর দিকে তাকিয়ে বলল,’কি রে! ভর দুপুরে আমার বাড়িতে……।’
কাবেরী কোনো কথা না বলে পাশে থাকা চেয়ার টেনে এনে তার পাশে বসলো। কিশলয় মৃদু হাসলো। তার বাড়িতে এসেই তাকেই পাত্তা দিচ্ছে না। কি অদ্ভুত মেয়ে! যদিও কিশলয় ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক নিল। তার ছোটবেলার বন্ধু। এক বন্ধুর বাড়িতে অন্য বন্ধু কি করবে তার জন্য কি অনুমতির প্রয়োজন? সম্ভবত নয়। কাবেরী চেয়ারে বসে অগ্নিদৃষ্টিতে কিশলয়ের দিকে তাকালো। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’তুই বাড়িতে একা থাকিস?’
‘না, বাবা থাকেন। তিনি অসুস্থ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। সব সময় বিছানায় শুয়ে থাকেন।’
‘তাহলে, রান্না-বান্না আর বাড়ির সমস্ত কাজ কে করে?’
‘আমি নিজেই সবকিছু করি।’
কাবেরী এবার শান্ত হলো। কাবেরী খুব ভালো করে জানে, কিশলয়ের পারিবারে আর্থিক অবস্থার কথা। সে কোথা থেকে উঠে এসেছে; সেটা কারোর কাছে অজানা নয়। যে ছেলে ছোটবেলা থেকে এত যন্ত্রনা কষ্ট সহ্য করেছে, সে বড় হয়ে অন্য কাউকে অপমান করতে পারে! এটা কি করে সম্ভব? আবার এটা অসম্ভব না হওয়ার কোনো কারণ নেই। শুধুমাত্র সাদা চামড়া আর শিক্ষিত হলে ভদ্র মানুষ হওয়া যায় না। কাবেরী শান্ত গলায় বলল,’তোকে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো, তুই সবকটা সঠিক উত্তর দিবি।’
কিশলয় সোজা হয়ে বসলো। এবার চাদর থেকে পুরোপুরি মাথাটি বের করল। মৃদু একটা হাসি দিয়ে কাবেরীকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বলল।
‘কাল রাতে তোর লেখা ‘মাস্টারমশাই’ উপন্যাসটি আমি পড়ে শেষ করলাম। কিন্তু উপন্যাসটি পড়ে আমি সম্পূর্ণ হতাশা হয়েছি। জানি না এই উপন্যাস কি করে ‘সাহিত্য একাডেমীর’ জন্য নির্বাচিত হয়েছে। যদিও যোগ্যব্যক্তি সব সময় সঠিক সম্মান পায় না। কিছু স্বার্থপর মানুষের কাছে তারা হেরে যায়।’ কাবেরী থামল। কিশলয় তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার বাড়িতে এসে তাকে অপমান করছে। এটা কি মেনে নেওয়া যায়? তবুও কিশলয় কিছু বলল না। কাবেরী আবার বলল,’ তুই মাস্টারমশাইয়ের সম্মন্ধে বই লিখেছিস, মাস্টারমশাইয়ের কোনো অনুমতি ছাড়াই। তিনি চাইলে তোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তোর বই নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। তোর জেল হতে পারে। আবার তুই বইয়ের মাধ্যমে ওই মানুষটাকে অপমান করেছিস। একবারও তোর বিবেকে বাঁধলো না?’
কিশলয় তখনও চুপ থাকল। দুজন একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিশলয় চাদরটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিল। তারপর সে অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো বলল,’আমি কি কোথাও তানভীর স্যারের নাম ব্যবহার করেছি?’
‘সূচনা কথা’য় তানভীর স্যারের নাম উল্লেখ রয়েছে। স্পষ্ট ভাষায় ব্যাকেট মধ্যে শেখ তানভীর আলম লেখা রয়েছে।’
‘তানভীর আলম এই নামটা কি শুধু একজনের হতে পারে? আর একজন মানুষের নামও তানভীর আলম হতে পারে। তাছাড়া এটা একটা উপন্যাস, আত্মজীবনী নয়। সাধারণত আত্মজীবনীতে চরিত্রগুলি সম্পূর্ণ সত্য হয় আর উপন্যাসের চরিত্রগুলি কল্পনা হয়। বইয়ের প্রথমেই বলা হয়েছে এটা একটি উপন্যাস। স্বাভাবিকভাবে মাস্টারমশাই চরিত্রটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আশা করি তুই ‘কোনি’ উপন্যাস পড়েছিস? সেখানেও বলা হয়েছিল কোনি একটা দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। তার বেঁচে ওঠার লড়াই নিয়ে এই উপন্যাস। প্রথমে লেখা ছিল কোনি উপন্যাসটি বাস্তব কাহিনী…।”
কিশলয়ের কথা আটকে কাবেরী তাড়াতাড়ি বলল,’আমি ‘কোনি’ উপন্যাস পড়েছি। আমি জানি না, বাস্তবে কোনি বলে কোনো মেয়ে আছে কিনা! হয়তো, কোনি মেয়েটা লেখকের কল্পনা। কিন্তু মাস্টারমশাই! মাস্টারমশাই তো কল্পনা নয়। তিনি বাস্তব জীবনে রয়েছেন। তাকে অপমান করার অধিকার তোর নেই।’
‘আমি কাউকে অপমান করিনি। আমি কোন একটা গল্পে কোন এক চরিত্রকে নিজের মতো করে গড়ে তুললাম। আর ওই চরিত্র কোনো মানুষের সঙ্গে মিলে গেল। তাহলে সে আমার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবো। তা কখনো হতে পারে না।তাহলে কোনো লেখক বাইরে থাকতে পারবে না। সবাই জেলের মধ্যে থাকবে। কারণ,তাদের গড়ে তোলা চরিত্র এই পৃথিবীতে কোনো না কোনো মানুষের সঙ্গে মিলবে। হয়তো, গল্পের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল থাকে না। কিন্তু প্রতিটি গল্প কোনো না কোনো মানুষকে কেন্দ্র করে রচিত হয়। বাস্তব জীবন গল্পের মতো হয় না, কিন্তু গল্প…….।”
কিশলয় খকখক করে কাশতে শুরু করল।তার কাশি ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। সে যেন প্রাপ্তবয়স্ক পেরিয়ে বার্ধক্যের দিকে পা বাড়াচ্ছে। কাবেরী আর কথা বাড়াতে পারল না। কিশলয়ের যুক্তি কাছে সে হেরে গেছে। কিশলয়ের যুক্তি যথাযথ। কাবেরী অনেক বই পড়েছে। অনেক গল্পের চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পেরেছে। তা বলে কি সে ওই গল্পের লেখকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। তা তো সম্ভব নয়। তাহলে কিশলয়ের বেলা, এটা অন্যায় কেন? কিশলয় কোনো অন্যায় করেনি। সে নিজের মতো করে উপন্যাস লিখেছে। ওই উপন্যাসটিকে এত হার্ডলি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তবুও যেন একটা চাপা ভয়ার্ত মুহূর্ত থেকে যাচ্ছে। বারবার কাবেরীর মনে হচ্ছে, মাস্টারমশাই চরিত্রটি কিশলয়ের কল্পনার নয়; ওটা তানভীর স্যারের থেকে ইন্সপায়ার। কাবেরী আবার বলল,’তুই নিজের বুকে হাত রেখে বলতে পারবি, মাস্টারমশাই চরিত্রটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক?’
কিশলয় এবার থতমত খেয়ে গেল। নিজেকে প্রশ্ন করল। সত্যি কি মাস্টারমশাই চরিত্রটা কাল্পনিক? না একটা জ্বলন্ত চরিত্র! কিশলয়কে কিছু বলতে না দেখে,কাবেরী আবার বলল,’সমাজে সমস্ত মানুষের মতো তোরও কি মনে হয়, তানভীর স্যার ওই দিন কাগজগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল? প্যান্ডেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।’
‘আমি পুরোপুরি নিশ্চিত তিনি এই কাজ করেছিলেন। কারণ, তিনি কখনও কোনো অনুষ্ঠান পছন্দ করতেন না। আর সেদিন রাতে তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছাড়া এই কাজ অন্য কেউ কখনো করতে পারে না। আমরা প্রত্যেকদিন পড়া করে নিয়ে যেতাম, কিন্তু একদিন পড়া না করলে; তানভীর স্যারের হাত থেকে রেহাই পেতাম না। উপযুক্ত শাস্তি পেতে হত। তাহলে তানভীর স্যারের বেলা ব্যতিক্রম কেন? কিছু কিছু ভুলের কখনো ক্ষমা হয় না।’
দুজনেই চুপচাপ হয়ে গেল। একে অপরের দিকে বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। কাবেরী ভেতরের জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে কিশলয়ের বুক স্টোর। বেশ অনেক বই জমিয়েছে কিশলয়। যথেষ্ট শিক্ষিত কিশলয়। তার কাছে কিছুই নয় কাবেরী। তবে কাবেরী একটা কথা চিন্তা করছে, সে যখন রাতের বেলা মাঝ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, তখন অনেকবার উপরের দিকে তাকিয়েছে। উপরে তারা গুলো মিটমিট করে। মিটমিট করা তারা গুলো দেখতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু ওই তারাগুলোর পেছনে একজনের ভূমিকা অসীম। তা হলো আকাশ। আকাশ আছে বলে তারা গুলো মিটমিট করতে পারছে। তানভীর স্যারের অনেক স্টুডেন্ট আজ দেশে বিদেশে বড় বড় পদে রয়েছে। অনেকে বড় জায়গায় গেছে। তারা পৃথিবীর বুকে যেখানে সেখানে তারার মতো মিটমিট করছে। উজ্জ্বল হয়ে আছে। আর আকাশের মতো তাদেরকেও তৈরি করেছে মাস্টারমশাই। মাস্টারমশাইয়ের জন্য আজ তারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মিটমিট করতে পারছে। তারা কি কখনো মাস্টারমশাইয়ের এই ঋণ শোধ করতে পারবে? ঋণশোধ তো অনেক দূরের কথা। তারা আজ সে-ই মাস্টারমশাইকে অপমান করছে। বড় হয়ে ভুলে গেছে তারা কোথা থেকে বড় হয়েছে। পৃথিবীতে এই অন্যায়ের কি কোনো শাস্তি নেই?

পর্ব ২৫ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here