.
“নেফারতিতির সাথে আমার প্রথমবার কোথায় দেখা হয় জানো?”
মিউনার কপাল কুচকানোর ভাঁজ দৃশ্যমান হয়। নিজের প্রেমিক পুরুষ যদি তার সামনে কোনো অন্য কোনো সুন্দরী নারীর গল্প বলে তাহলে কোনো নারীই সেটাকে বরদস্ত করবে না এটাই স্বাভাবিক, সেটা হেলেন, ঐশ্বরিয়া কিংবা নেফারতিতিই হোক। কিন্তু মিউনাকে চুপ থাকতে হলো, কারণ ইতঃমধ্যে সে পণ করেছে বেঁচে থাকতে আর কখনোই সে রামিসের সাথে কথা বলবে না। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া জন্য নিজেকে বুঝাতে লাগলো নেফারতিতি শুধুই ইতিহাস, তার সঙ্গে রামিসের দেখা হওয়া সম্ভব না। রামিস তাকে খেপাতেই এইসব হাবিজাবি বলছে। রামিস মিউনাকে চুপচাপ থাকতে দেখে নড়েচড়ে বসলো, পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“তুমি শুনতে চাও না?”
মিউনা উত্তর দিলো না। মনে মনে ঠিক করে রাখলো বেশি জোরাজুরি করলে “তুমি কি নিজেকে আখেনাতেন মনে করো?” বলে মুখের উপর জবাব দিবে সে। রামেস জোর করলো না, বিরাট একটা হাই তুলতে তুলতে বললো,
“অন্য একদিন বলবো, ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। বাসায় যাই”
মিউনা ফুঁসে উঠলো এবার, ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
“তুমি না দুপুর সাড়ে এগারোটায় ঘুম থেকে উঠেছো?”
“দুপুর? সাড়ে এগারোটা দুপুর হলো কীভাবে? দুপুর কাকে বলে জানো? সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করলে তখন দুপুর হয়। আদিমকালের মতো সূর্যঘড়ি থাকলে এখন তুমি লাঠির ছায়াটাই খুঁজে পেতে না।”
মিউনা চোখ মুখ কুঁচকে বসে থাকলো। রামেস হাসি চাপিয়ে আবার খোঁচা দিলো,
“যা শীত পরেছে এরমধ্যে ভোরসকালে ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে বাহিরে আনানোর জন্যও তোমাকে চৌদ্দশিকের ভাত খাওয়ানো উচিত।”
মিউনা উঠে গিয়ে ধপ ধপ আওয়াজ করে দ্রুত হেঁটে চলে যায়। হেসে ফেলে রামিস, সে ভালোভাবেই জানে মিউনার এই রাগ মিশে যাবে আর ঘন্টাখানেক পরই।
.
মিউনা কপালে হাত রেখে বসে আছে, সামনের টেবিলে ছড়ানো ফাইল পত্র। একটা হিসাব কিছুই মিলছে না, যতই জটঘট পাকাচ্ছে ততই মাথা ব্যাথা তীব্র আকার ধারণ করছে। মিউনার এই সমস্যাটা আছে, একটু টেনশন করলেই মাথা ধরে। বিয়ের আগে আগে যখন এরকম মাথা ব্যাথা করতো, মিউনা কারোর সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারতো না, রেগে যেতো। রামিসকে সেই সময়টুকু ধৈর্য্য ধরতে হতো, ফলে সে মিউনাকে ঘাটাতো না। হিসাবের ঝামেলা ফেলে রেখে চেয়ার টেনে নিয়ে হেলান দিয়ে বসে, ব্যাথার দরুন হাত চলে আসে কপালে। মিউনা টুংটাং শব্দ শুনে কপাল থেকে হাত সরিয়ে পিছন ফিরে, রামিস দুকাপ চা ট্রেসহ টেবিলে রাখে,
“চা খাবে? ব্যাথা কমবে একটু।”
“দাও, ঐ হাতে কি তোমার?”
“বই”
মিউনা চায়ে চুমুক দেয়। রামিসের রান্নার হাত ভালো, অন্তত মিউনার থেকে। পুরুষ মানুষের রান্নার হাত কোনো একটা দূর্বোধ্য কারনে ভালো হয় মিউনা জানতো আগে থেকেই। ছোটবেলায় মিউনা বাবার রান্না খাওয়ার জন্য বসে থাকতো সবসময়। বাহিরের খাবারকেও ছাড়িয়ে যেতো সেই রান্নার স্বাধ! মিউনা একতরফা হেসে নেয় মনে মনে, আবার কথা বলতে শুরু করে,
“কি বই? দেখি?”
রামিস শুনেও না শুনার ভান করে। মিউনা বিরক্ত হয়ে দ্বিতীয়বার একই কথা উচ্চারণ করে। রামিস খানিকটা ইতঃস্থত করে এবার। আমতা আমতা করে বলে,
“পরে দেখো, এখন তোমার মাথা ব্যাথা। পড়তে পারবে না”
“দাও”
মিউনার গম্ভীর স্বর শুনে আর কথা বাড়ায় না রামিস। বই হাতে নিতেই মিউনা কপাল কুঁচকে ফেলে,
“মিশরীয় মিথ?”
“এ জন্যই তোমাকে দেখাতে চাইনি”
“কে দিয়েছে?”
“কলিগ। মিউনা, ভুল বুঝো না। প্লিজ”
মিউনা বই রেখে চেয়ার থেকে উঠে যায়। বিছানায় জবুথুবু হয়ে চাদর প্যাঁচিয়ে শুয়ে পড়ে, রামিসের প্রতি রাগ উঠার কারনে মাথা ব্যাথা বাড়ছে বৈ কমছে না। রামিস পিছন পিছন গিয়ে মিউনার হাত স্পর্শ করে। হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে ফেলে সে। লাইট অফ করতে করতে রামিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
“আমাকে ভুল বুঝো না মিউনা, তুমি ভুল বুঝলে আমি এই পৃথিবীতে এতো কোটি কোটি মানুষের মাঝে একদম একা হয়ে যাবো!”
.
মিউনা আর রামিসের বাসাটা ছোট, ছিমছাম। দুটো বেডরুম, ডাইনিং, কিচেন, ব্যালকনি। একটা বেডরুম বন্ধ, অঘোষিত স্টোররুম বলা যায়। আর ব্যালকনি দিয়ে হাত বাড়ালেই যেন মেঘ ধরা যায়, শহুরে এলাকায় এমন বাসা সচারচর পাওয়া যায় না। বাসা পছন্দ করার দায়িত্ব ছিলো মিউনার, রামিস মেসে থেকে অভ্যস্ত, ফ্যামিলি বাসার কিছুই বুঝবেনা সে, এমন যুক্তি দেখিয়েই মিউনা বাসা পছন্দ করে। বাসা ঠিক হতেই ছোটখাটো একটা বুকশেলফের ব্যবস্থা করে ফেলে সে। দুজনই বই পড়ুয়া, সেই বাসায় একটা বুকশেলফ না থাকলে চলে!
বিয়ের এক মাস সবে মাত্র শেষ হয়েছে। রামিস ব্যস্ত হয়েছে, মিউনার আপাতত কাজ নেই যতক্ষন না ইন্টারভিউর ডাক পড়ে। কফি কাপ নিয়ে আয়েশ করে বসে চোখ যায় বুকশেলফের দিকে, ওদিকে তাকাতেই অস্বস্তিবোধ করে মিউনা। প্রথম তাকে সব উপন্যাস, মিউনার। রামিস উপন্যাস পড়ে না। আর দ্বিতীয় তাক ভর্তি মিশরীয় মিথ। এর একটাও তার কেনা না, সব রামিসের। প্রতিবার বইগুলোর দিকে চোখ পড়লেই মিউনার অস্বস্তি হয়। মনে হয় যেন স্বয়ং নেফারতিতি মৃত থেকে জীবিত হয়ে মিউনার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতেছে। মিউনা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, বইগুলো ওখানে রাখা যাবে না। এতে রামিস যতোই তার উপর রাগ করুক না কেনো।
রামিস অফিস থেকে এসে বুকশেলফের দ্বিতীয় তাক ফাঁকা দেখে মিউনাকে জিজ্ঞেস করে,
“বইগুলো কোথায়?”
“আছে তো, খুজে দেখো”
“নেই”
“কোন বই”
“মিশরীয় মিথের বইগুলো, একটাও নেই। তুমি কিছু করেছো?”
“আমি সতীনের সংসার করবো না রামিস।”
রামিস অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। বইগুলো তবে মিউনার সতীন সমতুল্য! মিউনার অদ্ভুত কান্ডে হাসি আর বইগুলোর জন্য আফসোস, দুটো মিলে এক মিশ্র অনুভুতির সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে আর কখনোই বই কিনে না রামিস। মিউনা অবশ্য কিনে, রামিস বাধা দেয় না। টিভি সিরিয়ালে দেখার থেকে বই পড়া ভালো, এমনিতেই যে পরিমান সন্দেহ করে রামিসকে, ওসব সিরিয়াল দেখা শুরু করলে এজন্মে আর মিউনার সাথে সংসার করা হবে না তার!
.
খটখট শব্দ শুনে ঘুম ভাঙ্গে মিউনার। রামিস বাসায় ফিরেছে, প্রায় রাত ১২টা। ইদানিং দেরী করে ফিরছে রামিস। মিউনার অস্বস্তি হয়, বিছানা থেকে উঠে রামিসের পাশে দাঁড়ায়,
“কই ছিলেন?”
“অফিসে”
“এতো রাত পর্যন্ত!”
“কাজ ছিলো”
মিউনা রামিসের একদম মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। রামিস পানির গ্লাস টেবিলে রাখে শব্দ করে, বিরক্ত হয়ে বলে,
“আর কিছু বলবে?”
“সত্যি করো বলো তো, কিছু লুকাচ্ছো আমার কাছ থেকে?”
“কি লুকাবো?”
“এতো রাত করে ফিরো কেনো ইদানিং?”
“সন্দেহ করছো?”
“করতে চাচ্ছিনা, তাই জিজ্ঞেস করছি। সত্যি করে বলো কি লুকাচ্ছো?”
রামিস আবার বিরক্ত হয়। পরনের কাপড় না বদলেই শুয়ে পড়ে চিৎ হয়ে। মিউনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, রামিসকে বুঝতে পারে না সে আগের মতো!
.
প্রায় সব মেয়েদেরই বিয়ে নিয়ে বেশ বড়সড় একটা প্ল্যান থাকে। মিউনা আর রামিসের বিয়ে সে অনুযায়ী হলেও মিউনার বিয়ের ছবি গুলো উল্টেপাল্টে দেখা হয়নি আর। ছবি দেখতে গিয়ে মিউনা টের পায় সব ছবি পেনড্রাইভে।রামিস তখনো বাহিরের ব্যস্ত, রামিসের ব্যস্ততা বরাবরই মিউনার মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলে। মিউনা নিজেই রামিসের ল্যাপটপে পেনড্রাইভের ছবিগুলো বের করতে শুরু করে, ছবি বের করতে গিয়েই বেশ বড় একটা চমক খায় সে। ল্যাপটপ ভর্তি নেফারতিতির ছবি, জীবনী, আর্টিকেল। কোনোটা ভাস্কর্যের, কোনোটা চিত্রকরের কিংবা কম্পিউটারে আঁকা ছবি। এসব ছবি দেখার পর মিউনার দম বন্ধ করা কান্না পায়। কান্না জোর করে আঁটকে রাখে মিউনা, কাঁদলে আবার মাথা ব্যাথা করবে। রামিস দ্রুত হেঁটে এসে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। মিউনার দিকে না তাকিয়েই হন হন করে হেঁটে চলে যায়। ব্যালকনির বাহিরের দিকে মুখ করে গ্রিলে ভর দিয়ে দাড়ায় রামিস। মিউনা পিছন পিছন গিয়ে আঁটকে রাখা কান্না ছেড়ে দিয়ে বলতে শুরু করে,
“তোমার জীবনে যেহেতু অন্য নারীর অস্তিত্ব মিশে থাকবেই তবে আমাকে ধোঁকা দিলে কেনো? তাও এমন কেউ যার সাথে তোমার কোনো সম্পর্কই নেই, যে কিনা মৃত, একটা ইতিহাসে অংশ খালি!”
“নেফারতিতিকে তুমি কতটুকু জানো মিউনা?”
মিউনা থমকে গেলো মুহূর্তেই। কান্নার কারনে গলার স্বর জড়িয়ে গেলো তার। রামিস নিজেই বলতে শুরু করে,
“নেফারতিতিকে আমি প্রথমবার দেখি স্বপ্নে। হ্যাঁ, প্রথমবার ওটা স্বপ্নই ছিলো। মাথায় বেশ লম্বাটে একটা মুকুট, যার সামনের দিকে সাপের অবয়ব। বিস্তীর্ণ মরুভুমি আর পিছনে জ্বলজ্বলে সূর্য। জ্বলজ্বলে সূর্যের উল্টো পিঠে দাঁড়িয়েও তার সৌন্দর্য একটুকুও কমেনি, মনে হচ্ছিলো যেন একজন দেবী দাড়িয়ে আছেন। এরপর থেকে প্রতি বছরই একবার করে আমি তাকে দেখেছি। একুশে জুন অর্থাৎ, বছরের সবচেয়ে বড় দিন। ঐদিনই দেখি, স্বপ্ন নয় বাস্তবে। জানো মিউনা? ইতিহাস আমাদের সবকিছু বলতে পারে না। ইতিহাস মতে নেফারতিতি ছিলেন মিশরীয় সভ্যতার দ্বিতীয় নারী ফারাও। যিনি সভ্যতার উন্নতি করেছেন, ধর্ম সংস্কার করেছেন। আখেনাতেনের সঙ্গে একাধিক ঈশ্বরে বিশ্বাস থেকে সরে আতেন অর্থাৎ সূর্যদেবের উপাসনার প্রবর্তন করেছিলেন। ইতিহাসে তাকে প্রচন্ড ক্ষমতাশালী ও সুখী হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু জানো, প্রকৃতপক্ষে সে নিজেকে শূন্য মনে করতো। একজন নারী কখন নিজেকে শূন্য মনে করে জানো?”
মিউনা বুঝতে পারলো না কি উত্তর দিবে। মিউনার কান্না পেলো না আর। চোখ দুটো বড় বড় করে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। উত্তর না পেয়ে আবার রামিসই বলা শুরু করলো,
“অসম্ভব রূপবতী হওয়া শর্তেও ফারাও আখেনাতেনের একমাত্র স্ত্রী ছিলো না সে, ছিলো না কোনো পুত্রসন্তানের মাও। পুত্রসন্তান ছাড়াও প্রধান স্ত্রীর উপাধি লাভ করলেও সে বংশ রক্ষা পারেনি। সে নারী ফারাও হতে পারলেও তার মৃত্যুর পর আর তার রক্ত বহাল থাকেনি। নেফারতিতির প্ররোচনায় আখেনাতেন ধর্ম সংস্কার করেছে এমন গুজব রটলেও নেফারতিতিকে আখেনাতেন কখনোই এতোটুকু স্থান তার হৃদয়ে দেয়নি। ”
রামিস ঢোক গিলে একবার, ব্যালকনির ওদিকের অন্ধকার যেন ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে। যেই ব্যালকনি দিয়ে দিনের বেলা মেঘ ধরা যায়, সেই ব্যালকনিই রাতের বেলা বিষন্নতার চূড়ান্ত রূপ নেয়। গাছের পাতার সাথে পাতা বাড়ি খেয়ে খসখসে শব্দ হয়। নাইটগার্ডের হুইসেলের শব্দ শুনা যায়। রামিস শূন্যতা অনুভব করে, নিজের জন্য নাকি নেফারতিতির জন্য বুঝে উঠতে পারে না। মিউনা পিছনে থেকে রামিসের কাঁধে হাত রাখে, কন্ঠ খানিকটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কীভাবে সম্ভব? নেফারতিতির সঙ্গে তোমার আসলেই দেখা হতো?”
রামিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছন ফিরলো। পকেট থেকে খু্ঁজে বের করলো কিছু একটা। হাতের মুঠো খোলা হলে মিউনা দেখলো, রামিসের হাতে একটা পুরোনো আমলের তামার মুদ্রা,যার এক পিঠে সূর্য, অন্য পিঠে নেফারতিতি।
মুদ্রা-দোষ
~কুয়াশা
২০/০১/২৩ইং
(রিপোস্ট)