মুহূর্তে পর্ব-২৫

0
642

#মুহূর্তে
পর্ব-২৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মুহূর্তটা উদাসীন ছিল। কিন্তু কবিতার এত সুন্দর দিনে উদাসীন মুহূর্তটা ভালো লাগলো না। সে চায় না তাহিরার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনটায় সে কান্না করুক। তাই মশকরা করে বলল, “আপি তুমি চিন্তা করো না, আজ সারারাত তোমরা একে অপরের সাথেই কাটাবে। কিন্তু বিয়ের আগে এইসব, তাই ছোট ভাই বোনদের সামনে… ছিঃ ছিঃ ছিঃ।”
সকলে হেসে দিল কবিতার কথা ধরণ দেখে। তাহিরাও লজ্জা পেয়ে সাথে সাথে ধ্রুবকে ছেড়ে দিল। কবিতা সেখানেই থামলো না, আদেশ করে পলাশকে বলল, “এই’যে হাদারাম ভাইয়া আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন? বরকে টাকা না দিয়ে সেন্টারে ঢুকতে দিলেন কেন? বাইর করেন এখনই।”
“যো হুকুম আপু।”
পলাশ এসে ধ্রুবকে বাহির করতে নিলেই ধ্রুব বলে, “তুই না বরপক্ষ? তাহলে কন্যাপক্ষের কথা মানছিস কেন? এতক্ষণ ধরে অনুষ্ঠানের সকল আয়োজন আমরা করলাম এখন আমাদেরকে বের করে আমার থেকেই টাকা নিবে। শখ কত?”
পলাশ মাথা চুলকে কবিতাকে বলে, “আসলে আপু আমি তো বরপক্ষের তাই না?”
“কীসের বরপক্ষের? আপনি না আমার ভাই?”
ধ্রুব বলে, “ও তীর্থের ভাই আগে। তীর্থ কিছু তো বল।”
তীর্থ ফোনে ব্যস্ত ছিল। ধ্রুবর কথা শুনে সে একটু বিরক্ত হলো। তার আবার এইসব হাসি-ঠাট্টা মোটেও ভাল্লাগেনা। গেট ধরলে আরও আঁধাঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে এইসব বকবকানি শুনতে হবে তাই সে আদেশের সুরে বলল, “পলাশ ভেতরে চল।”
“জ্বি ভাই।”
পলাশ ভেতরে ঢুকতে নিলেই কবিতা আবারও বাঁধা দিলো, “জ্বি ভাই মানে কী? আমার কথা বেশি না তোমার তীর্থ ভাইয়ের।”
“তীর্থ ভাইয়ের।”
ফিক করে হেসে দিলো ধ্রুবর বন্ধুরা। অপমানে কবিতার মুখ থমথমে হয়ে যায়। তবুও সে হার মানার মানুষ তো না। সে একগাল হেসে বলে, “আর তোমার তীর্থ ভাই আমার কথা শুনবে।”
ধ্রুব আর তীর্থের বন্ধুরা এইবার শব্দ করে হেসে দিলো। একজন বলল, “তীর্থ ভাই কারও কথা শুনে না ভাবি। আগে প্রথম প্রথম প্রেমে পড়ছিলো তাই শুনতে হতো কিন্তু এখন তো আপনি তার বউ, তাই হারানোরও ডর নাই। শুনবে না একদম।”

কবিতা তাদের কিছু বলে না। তীর্থের কাছে এসে তার হাত প্রথমে মিষ্টি করে বলে, “তুমি আমার কথা শুনবে না?”
বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলে কবিতা। তাকে দেখলে এই মুহূর্তে যে কারও মনই গলে যাবে। কিন্তু তীর্থের পিছন থেকে তার বন্ধুরা বলে, “ভাই একদম গলবেন না। আমগো ইজ্জত মাটিতে মিশে যাইব।”
তীর্থ একপলক তাদের দুই তাকিয়ে আবার তাকায় কবিতার দিকে। যদিও কবিতার কিউটনেস দেখে এক মুহূর্তের জন্য তীর্থ গলে গেলেও সে নিজেকে শক্ত রেখে বলল, “একদম না। আমাদের একটা ব্রো-কোড আছে।”
“তোমাদের ব্রো-কোডের গুষ্টিকিলাই।” কবিতা বিরক্ত হয়ে বলল। তীর্থের বন্ধুদের দেখে তার আরও মেজাজ খারাপ হলো। তারা কবিতাকে নিয়ে হাসা-হাসি করছে আর তীর্থ তাদের সাইড নিচ্ছে? এইবার তো তার ইগোতে কথা আসলো। সে তীর্থের কানের কাছে ঝুঁকে বলল, “ঠিক দশমিনিট আগে তাহিরা আপুর এক কলিগ আমাকে সিঙ্গেল ভেবে সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তাহিরা আপু আসায় কিন্তু তাকে বলাও হয় নি আমি বিবাহিত। তুমি যদি এই মুহূর্তে কন্যাপক্ষে না আসো তাহলে আজ সারা ফাংশনে সে যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং ফ্লার্টিং করার চেষ্টা করে তাহলে আমি ভুলেও বলব না যে আমি তোমার ওয়াইফ। একদম করতে দিব। সাথে দুইমাস না আমাকে চুমু খেতে পড়বে আর না ছুঁতে দিব। এখন ভেবে দেখ কার পক্ষ নিবে তুমি?”

কবিতা একগাল হেসে আবারও যেয়ে দাঁড়ায় তাহিরার পাশে। যেয়ে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে তীর্থের দিকে তাকায়।
তীর্থ একবার তাকায় তার বন্ধুদের দিকে। আবার কবিতার দিকে। পলাশ জিজ্ঞেস করে, “ভাই আমি কী করব?”
তীর্থ একটু কেশে যেয়ে দাঁড়ায় কবিতার কাছে। বলে, “কবিতা যা বলছে তা কর।”
“ভাই আপনি এভাবে আমাদের ধোঁকা দিতে পারেন না।” একে একে ধ্রুব ও তীর্থের সব বন্ধুরা চেঁচামেচি শুরু করে। কবিতা শুধু এতটুকু বলে, “দেখেন আপনাদের ভাই আপনাদের যত সাইডই নেক না কেন তার দুর্বলতা আমার হাতেই আছে। বিয়ের আগেও এবং এখনো। এখন সবাই লাইন মতো যান গেইটের কাছে। যেয়ে টাকা দেওয়ার প্রিপারেশন নেন। একমিনিটে না লাইন ধরে যান, নাহয় আপনাদের তীর্থে ভাইয়ের বলতে হবে।”
কেউ আর কিছু বলার সাহস পেল না। কবিতার কথা মতোই চলে গেল।

গেইট ধরার পর নিয়ম অনুযায়ীই বিয়ের কাজ শুরু করা হয়। তাহিরা এবং ধ্রুবকে বসানো হয় স্টেজে। বিয়েটা একটু অকপটে ছিলো। বয়স্ক বলতে সেখানে কেবল ছিলো কবিতার শাশুড়ী এবং তাহিরার দাদী। আর বাকিরা তাদের বন্ধু, কলিগ অথবা প্রতিবেশী। তাহিরা অথবা ধ্রুব কারও আত্নীয়দের মধ্যে কেউ-ই আসে নি। ধ্রুবর পরিবার তো আগের থেকেই তার সাথে সম্পর্ক ভেঙে ফেলেছিলো। তাহিরার বাবার সাথে সম্পর্কিত সকলে বিদেশে সেটেল্ড তাই তাদের আশা হয় নি। আর মা’য়ের সাথে সম্পর্কিত আত্নীয়রা তার সাথে সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক নয়। কবিতা যখন থেকে তীর্থকে বিয়ে করেছে তখন থেকেই তাদের মধ্যে কেউ তাহিরার সাথে কথাও বলে নি। তাদের ধারণা, কবিতার এই ভুলটি করার কারণ হলো তাহিরা। কেননা, কবিতা তাহিরার কাছে এসে থাকার পরই এমন কান্ড ঘটিয়েছে।

তাহিরার আপন বলতে সেখানে কেবল ছিলো কবিতা এবং তার দাদী। যেহেতু দাদীর বয়স অনেক হয়েছে তা সে উঠে হাঁটা চলাও করতে পারে না, সেহেতু কবিতাই সব দায়িত্ব নিলো। যদিও তার এইসবের প্রতি বেশি জ্ঞান নেই তবুও সে যতটুকু পারে করছে।
কবিতা খেয়াল করে আজ সারা অনুষ্ঠানে তীর্থ তার পিছু পিছু ঘুরছে। অবশেষে সে তীর্থকে জিজ্ঞেস করেই নিলো, “তোমার সকল বন্ধুরা ওখানে গল্প করছো, আর তুমি আমাকে আমার পিছু নিচ্ছ কেন?”
তীর্থ মুখ গোমড়া করে কাঠকাঠ গলায় বলল, “ওই ছেলেটা কোথায় যে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল?”
কবিতা কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো। তারপর মুখ টিপে হাসতে থাকে।
তীর্থ বিরক্ত হয়ে বলে, “এখানে হাসার কী আছে?”
“তুমি এই কারণে আজ সারাটাক্ষণ পিছু পিছু ঘুরছিলে? এখন তো ভাবছি ছেলেটাকে পার্সেল করে আমার সাথে নিয়ে যাব। তোমার প্রথম প্রেমিকাকে ছেড়ে আমার প্রতি একটু ধ্যান তো দিবে তুমি। উফফ জেলাস হলে কত কিউট লাগে তোমাকে।” কবিতা গাল টেনে বলল।
তীর্থ কবিতার হাত ধরে বলল, “করছটা কী? এখানে আমার সব কর্মীরা আছে। এভাবে আমাকে গাল টিপতে দেখলে কী ভাববে সবাই? পরে আর ভয় পাবে না।”
“তোমাকে কতবার বললাম ভয় না পাইয়েও কাজ করানো যায়। আর এই কী ভাববে? ভাববে যে তোমার প্রিয় ওয়াইফ তোমাকে আদর করছে।”
তীর্থ বিরক্তি হাত সরায় কবিতার। আবদারের সুরে বলে, “এত সাজার কী প্রয়োজন ছিলো? তোমাকে সুন্দর লাগছে তো। যেয়ে এই সাজগোজ মুছে আসো যাও। ঐ ছেলেকে তো খুঁজে পেলাম না কিন্তু ওকে খুঁজে চক্করে দেখি কতজন তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।”
“তাহলে বুঝ তুমি কতটা লাকি? এতজনের মাঝে আমি তোমাকে বাছাই করেছি। এরপর আমাকে ছাড়া তোমার প্রথম প্রেমিকাকে সময় দেওয়ার সময় এবং আমার সাথে ঝগড়া করার এইটা মাথায় রেখ।”
কবিতা ভেংচি কেটে একরাশ ভাব নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তীর্থও তার পিছনে যায় তাকে মানানোর জন্য, যেন সে এত সাজগোজ মুছে নেই।

নীল রঙের মসলিন শাড়ি পরে আছে মৃণা। শাড়িটি রুপার কাছ থেকে ধার নেওয়া। এত দামি শাড়ি সে আগে পড়েনি। রুপা যে একবার বলাতেই তাকে শাড়িটি পরতে দিবে তা সে ভাবেও নি। সে হলে তো কখনই দিত না। পরেই তার মনে পড়, রুপার কাছে এমন শাড়ির অভাব নেই। রুপার বাবার অবস্থা যেমন ভালো, তেমনি তার বয়ফ্রেন্ডের অবস্থাও ভালো। এর উপর নিজেও তার বাবার জন্য কাজ করে ভালোই টাকা রোজগার করে। রুমার ভাগ্য দেখে মাঝেমধ্যে হিংসা লাগে তার, এত সুন্দর ভাগ্য তার কেন হলো না?
.
.
.
মৃণা সেন্টারের গেইট দিয়ে ঢুকতেই চমকে যায়। চারপাশটা অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো। রাতের অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে চারপাশ। তার মনে হল এক বিশাল রাজমহলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। চারদিকে বাতি এবং ফুল দিয়ে সাজানো। পার্কিং-এ গাড়ির মেলা লাগানো। এর মাঝে একটি পুরনো বাইক থেকে নামতে ভীষণ লজ্জা লাগে মৃণার। সে বাইক থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে আইদ থেকে দূরে সরে যায়। তারপর দোয়ার দিয়ে প্রবেশ করার সময় বলে, “আপনাকে বলেছিলাম একটা গাড়ি ভাড়া করে আনতে। এইখানে সবাইকে দেখছেন? সবাই কত সুন্দর গাড়িতে এসেছে?”

মৃণার কথার ধরণটা রুক্ষ ছিলো। অন্যকোনো পুরুষ হলে কড়া জবাব দিয়ে দিতো মৃণাকে কিন্তু আইদ এমন না। সে সবসময়ের মতো ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল, “অন্যদের দেখিয়ে কী হবে বলো? নিজেদের সামর্থ্য থেকে বড় দেখাতে নেই।”
মৃণার আইদের কথার উওর দিতে মন চাইলো না। আইদের কথাগুলো শুনলে মৃণার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অজ্ঞ মনে হয় তাকে।

সে বিশাল সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় মৃণার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। এমন ধরনের বিয়ে তার করার ইচ্ছা অথবা এর থেকেও বড়। তার মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠে মহলটা দেখে। আইদ আলতো করে হাত ধরে তার, “আসো তোমাকে তাহিরা আপুর সাথে দেখা করাই। উনারই আজ বিয়ে। তুমি তার সাথে দেখা করে অনেক খুশি হবে, খুবই ভালো সে।”
মৃণার কারও সাথে দেখা করার জন্য মোটেও আগ্রহী ছিলো না। এই বিশাল হলরুমের সাজগোজের মাঝেই তার মন ধরে আছে।
কিন্তু একটু সামনে এগিয়ে ধ্রুবকে বধূর পাশে দেখতে পেয়েই সে চমকে যায়। আজ ধ্রুবরও বিয়ে হওয়ার কথা। অর্থাৎ তাহিরার সাথে ধ্রুবর বিয়ে?
এর আরেক অর্থ হলো এইখানে তীর্থও আছে। মনটা আকুপাকু করে উঠে মৃণার। তার অবাধ্য নজর তীর্থের খোঁজে ব্যস্ত। কিন্তু তীর্থের দেখা পেয়ে সে বেশি খুশি হলো না, বরং তার মনটাই উদাসীন হয়ে গেল। তীর্থ কবিতার সাথে। সাথে বললেও ভুল হবে, তার পিছু পিছু ঘুরছে সে।

আইদ মৃণাকে নিয়ে স্টেজে উঠে তাহিরা এবং ধ্রবর সাথে নিজের হবু বউ বলে পরিচয় করাতেই ধ্রুব বলে উঠে, “আরে মৃণা যে! আমি তো জানতামই না তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কখনো বলোই নি।”
খানিকটা লজ্জা পায় মৃণা। সে ভালো করে বুঝতে পারছে যে ধ্রুব তাকে খোঁটা মেরে কথাটা বলছে। তীর্থ বিবাহিত জেনে সে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল সে ঘটনাকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলেছে ধ্রুব।
আইদ জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া আপনারা একে অপরকে চিনেন?”
“একদম। ও তো প্রায় প্রতিদিনই আমাদের অফিসে আসে।”
আইদ অবাক হয়ে তাকাল মৃণার দিকে। সে এই ব্যাপারে কিছু জানেনা। তবে অন্য মানুষদের সামনে কিছু বলে না তাকে। মৃণা তার হবু স্ত্রী, তার সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আইদের।
ধ্রুব নিজ থেকেই কথাটা পরিষ্কার করে, “মানে প্রথমে ভার্সিটির এসাইনমেন্টের জন্য আমাদের ব্যবসা সম্পর্কে জানতে এসেছিলো। এখন কাজ সম্পর্কে ধারণা নেবার জন্য আসে। ভালোই কাজ করছে, আমি তো ভাবছি অফিসে কিছু সময়ের জন্য একটা কাজ দিয়েই দেখি। কী বলো মৃণা?”
মৃণা মুখে উত্তর দিলো না, শুধু জোরপূর্বক হাসলো।

স্টেজ থেকে নামার পর আইদ তাকে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি বললে না যে তুমি এসাইনমেন্টের জন্য কারও অফিসে যাচ্ছ?”
“আমার কী সবকিছুর জন্য আপনার পারমিশন নেওয়া লাগবে এখন? আমার মা বাবাও তো আমাকে এত প্রশ্ন করে না। আপনি বললে আমি আমার নিশ্বাসও আপনার অনুমতি নিয়ে নিব।”
“আমি তো সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করছিলাম।”
“আচ্ছা শুনুন, আমার তৃষ্ণা পেয়েছে।”
“তুমি দাঁড়াও আমি এখনই তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসছি।

আইদ যেতেই মৃণা আবারও খুঁজে বের করে তীর্থ ও কবিতাকে। সে যেয়ে ইচ্ছা করেই ধাক্কা খেল তীর্থের সাথে। সে পড়ে যেতে নিলেই তীর্থ তাকে ধরে নেয়। মৃণাকে এই অনুষ্ঠানে দেখে অবাক হয়ে যায় সে। এইখানে কী করছে মৃণা? ভয়ে বুক কেঁপে উঠে তীর্থের। কবিতা ঠিক তার পাশে দাঁড়ানো। যদিও মৃণা তাকে ওয়াদা করেছে যে সে কখনো কাউকে কিছু বলবে না, কিন্তু সে কী বিশ্বাস রাখতে পারে মৃণার উপর? তাকে চিনে একমাস বটে।

কবিতা তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি ঠিক আছ?”
কবিতার কন্ঠ শুনতেই তীর্থ মৃণাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে নিজে এক’পা পিছিয়ে যায়।
মৃণা এক পলক তীর্থের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ উওর দেয়। কবিতা বলে, “ওয়েট, তোমাকে আমি কোথাও দেখেছি। তুমি সেদিন তীর্থের ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলে তাই না?”
মাথা নাড়িয়ে আবারও হ্যাঁ জানায় মৃণা। সে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নেয় কবিতা শাড়ির উপর। সে ভেবেছিল কবিতা যেহেতু তীর্থের বউ, সেহেতু দামী শাড়ি পরে আসবে। অথচ সে সাধারণ একটি শাড়ি পরে এলো। এমনই এক শাড়ি আইদ তার জন্য এনেছিলো। কিন্তু কমদামী বলে তা পরে নি মৃণা। এত বড় অনুষ্ঠানে এমন শাড়ি কে পরে আসে?

কবিতা নমনীয়ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করে, “কখন এলে?”
তখনই তীর্থ তার হাত ধরে নেয়, “কাজি আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। তাহিরা এবং ধ্রুবকে একবার দেখে আসা উচিত।”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।” কবিতা মৃণার দিকে তাকিয়ে তার হাত ধরে মিষ্টি করে বলে, “কিছু লাগলে জানিও।”
তীর্থ কবিতাকে স্টেজে নিয়ে যায়। তাকে তাহিরার সাথে ব্যস্ত করে দিয়ে ধ্রুবকে নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলতে যায় সে।
“তোকে আমি এখনো গতবারের জন্য ক্ষমা করি নাই আর তুই আবার তোর কাহিনী শুরু করছিস?”
“আরে ভাই কী করলাম আমি?” হতবাক হয়ে বলে ধ্রুব।
“কী করেছিস? মৃণাকে তুই ডাকোস নাই?”
“না তো। তাহিরার এক কলিগ ওর বাগদত্তা। তার সাথেই এসেছে। আমি ডাকতে যাব কোন দুঃখে? তোর থেকে আবার মাইর খাবার জন্য? এত তেল নাই আমার বাবা।”
“বাগদত্তা!” চমকে উঠে তীর্থ।
“হ্যাঁ আমিও জানতাম না ওর এনগেজমেন্ট হয়েছে। আজই জানলাম। এখন তো তোর এতটা গিলটি ফিল করার কথা না। তুই যা করেছিস জ্ঞানহীনভাবে করেছিস। কবিতার সাথে অন্যায় করলেও সজ্ঞানে তো করিস নি। মেয়েটা তো জেনে-বুঝে ওর ফিয়োন্সেকে চিট করলো।”
“আমার এতে কিছু আসে যায় না। ওর এনগেজমেন্ট হয়েছে কিংবা হয় নাই, এতে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু একটা জিনিস বুঝে নে, ও যদি ভুলেও কবিতাকে কিছু বলে তোর এই বিয়ে আমি হতে দিব না। মাথায় রাখিস।”
“আরে ভাই আমি কী ডাকছি ওকে?”
“তুই ডাকছিস, না ডাকিস নি আই ডোন্ট ইভেন কেয়ার। এটা তোর দায়িত্ব, তুই ওকে কবিতার থেকে দূরে রাখবি। আমি আসছি।”
“আরে ভাই আমার বিয়ে আজ। আজ আমি দারোয়ানগিরি করব না’কি?”
“প্রয়োজনে তাই করবি।”

তীর্থ সেখান থেকে সোজা যায় ছাদে। ছাদে যেয়ে সিগারেট ধরায়। আজকাল আবার তাকে সিগারেটের নেশায় ধরেছে। ব্যাপারটা কবিতা জানলে সর্বনাশ। তার সিগারেট মোটেও পছন্দ না। সহ্য হয় না তার সিগারেটের ধোঁয়া। কিন্তু তীর্থের আপাতত এর প্রয়োজন। হাজারো চিন্তা তীর্থের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আগে কবিতার ভালোবাসা তার সকল চিন্তা দূর করে দিতো কিন্তু আজকাল কবিতার জন্য সময় হয় না। তাই সিগারেটকেই নিজের সাথী বানাতে হলো তীর্থের।

ছাদে দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠে তীর্থ। সাথে সাথে তীর্থ তার হাতে সিগারেট জ্বালিয়ে দিল। ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরে সে। কেবল কবিতা না হলেই হল। পিছনে ফিরে দেখে মৃণা দাঁড়ানো। তার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস এলো। মৃণা এগিয়ে এলো তীর্থের কাছে, “আপনার ওয়াইফকে ভেবে সিগারেট ফালিয়ে দিলেন? এত ভয় পান নিজের বউকে?”
তীর্থ বিরক্তি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আজকাল মৃণার উপর প্রচন্ড রকমের বিরক্তি কাজ করে তার। মেয়েটা প্রতিদিন তাকে দেখতে আসে। বিষয়টা আসলেই অস্বস্তিকর।

মৃণা পাশে এসে দাঁড়ায় তীর্থের। আবারও জিজ্ঞেস করে, “আপনি নিজের ওয়াইফ কে খুব ভালোবাসেন তাই না?”
“নিসন্দেহে।”
এক ঢোক গিলে মৃণা। কেমন উদাসীন গলায় বলে, “আপনি এর একভাগও আমায় ভালোবাসতে পারেন না?”
তীর্থ চোখ ঘুরিয়ে থাকায় মৃণার দিকে, ” ফিয়ন্সে থাকা সত্ত্বেও তোমার মুখে এইসব কথা মানায়?”
চমকে উঠে মৃণা। আইদের কথা তীর্থ জানলে কি হবে তা সে ভাবে নি। এমন বোকামি কিভাবে করলো সে? সাথে সাথেই সে বাহানে বানায়। জোরপূর্বক হেসে বলে, “এই বিয়েতে আমি রাজি না। আমার মা বাবা জোর করে করাতে চাইছে। আইদকে আমি কখনো চেয়েও ভালোবাসতে পারি নি। সে সবার সামনে এত ভালো সাজে অথচ একা আমাকে কত কটু কথা বলে আপনি ভাবতেও পারেন না।”

তীর্থ খেয়াল করে চোখ ভরে এসেছে মৃণার। কথাটা শুনেও তার মন খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটার সাথে এত খারাপ হচ্ছে, এর উপর সে নিজেও তার সাথে কোনোদিন সুন্দরভাবে কথা বলে নি। ভেবেও মন খারাপ হয়ে গেল তার। সে একটু কেশে বলল, “তুমি চাইলে আমি ধ্রুবকে দিয়ে তোমার মা বাবার সাথে কথা বলাতে পারি।”
“না না আমার মা বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে। এমনিতেও তাদের কষ্ট দেবারও কোনো ইচ্ছা আমার নেই।” তারপর জোর করে একগাল হেসে বলল, “আমি তো আপনাকে ভালোবেসেছিলাম কিন্তু কখনো আপনাকে পাওয়ার ভাগ্য আমার হবে না তাই কার সাথে বিয়ে করছি এতে কি আসে যায়? আপনার কাছে হয়তো আমাকে বেশ বিরক্তিকর লাগতে পারে কিন্তু আমি কি করব? আমি চেয়েও আপনার প্রতি আমার অনুভূতিকে দাবাতে পারছি না। আমি জানি এইটা ভুল, তবুও এই ভুলটাও কেন যেন তৃপ্তি দিচ্ছে।”
তীর্থ কি বলবে সে বুঝতে পারে না।
মৃণা গভীর নিশ্বাস ফেলে, “আচ্ছা আমি যাই তাহলে। আইদ যদি আমাকে না পায় তাহলে ভীষণ সমস্যা করবে।”
বলেই চলে গেল মৃণা। তীর্থ তার যাওয়ার প্রান্তে তাকিয়ে রইলো। তার মনে হলো, মেয়েটার সাথে এত রুক্ষ ভাবে কথা না বললেও সে পারতো। এরপর দেখা হলে অবশ্যই ক্ষমা চেয়ে নিবে সে।

চলবে….

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব-

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here