মুহূর্তে পর্ব-২৮

0
646

#মুহূর্তে
পর্ব-২৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তীর্থ দ্রুত অফিসে এলো তার কাজ শেষ করার জন্য। কাব্য অসুস্থ থাকায় সে ভেবেছিলো আজ অফিসে আসবে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ পড়ে গেল। সে কাজটা করতেই হবে। তাই কাব্যকে ছেড়ে তার আসতে হলো অফিসে। সে যত দ্রুত সম্ভব কাজটা সেরে নিলো। আজ বাসায় যাওয়ার তাড়া আছে। কেবিন থেকে বের হবার পূর্বেই ফোন বেজে উঠে তীর্থের। মৃণা কল করছে। মেয়েটা অসময় কল করার অভ্যাস আছে। অকারণেই। তাই তীর্থ কল ধরে না৷ কিন্তু অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে যাওয়া পথ পর্যন্ত সম্পূর্ণ রাস্তায় এক মুহূর্তের জন্যও তার ফোন বাজা বন্ধ হয় নি। গাড়িতে উঠে অবশেষে না পেরে তার কলটি ধরতেই হলো।

“কী হয়েছে মৃণা? এতবার কল কেন করছ?”
ওপাশ থেকে মৃণার কান্নাভেজা কন্ঠ ভেসে এলো, “তুমি আমার কল কেন ধরছিলে না তা বলো। আমি গতকাল রাত থেকে তোমাকে কল দিচ্ছি। তুমি জানো না আমার লাইফে কী চলছে? আমি যদি মরে টরে যাই তাও তো খবর পাবে না।”
“এসব কথা বলতে নেই। ওই কাব্য অনেক অসুস্থ তাই বাসায় ছিলাম। অফিসে একটু কাজের জন্য এসেছিলাম তাই ধরতে পারলাম। তুমি বলো কি হয়েছে?”
“তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসো মিরপুরে। দেখা করে বলছি।”
“এইমাত্র বললাম কাব্য অসুস্থ, ওকে হাস্পাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
“পরে নিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ দেরি হলে তো তুফান আসবে না। তুমি এখনই আমার সাথে দেখা করো, নাহয় আমি কি করব জানি না।”
“আমি কাল পুরশু দেখা করছি তোমার সাথে।” বলে কল কেটে দিলো তীর্থ। গাড়ি চালিয়ে রওনা দিলো নিজের বাসার দিকে। মাঝরাস্তায় আবার তার ফোন বেজে উঠে। তীর্থ আবারও বিরক্ত হয়ে কলটা ধরে মৃণার।
“কী সমস্যা মৃণা বলেছি তো আগামীকাল দেখা করব।”
“হোয়াটসঅ্যাপে ক’টা ছবি দিয়েছি। দেখ।”
তীর্থের কথা বাড়াতে মন চাইলো না। সে রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখল ছবিগুলো। সাথে সাথে নিজের চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। মৃণার হাতে ব্লেড নিয়ে কাটা চিহ্ন। কাটা স্থানে রক্ত ভেসে আছে। সাথে হাত কাটার একটি ভিডিও দিয়েছে সে। এসব দেখে তার শরীর কেমন শিউরে উঠে। সে ফোন কানের কাছে নিয়ে চিল্লিয়ে বলে, “তোমার মাথা খারাপ? এসব কী করেছ তুমি?”
“তুমি যদি না চাও আমি হাতের রগ কেটে ফেলি, তাহলে এখনই দেখা করো।”
“তুমি….” দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে তীর্থ, “ঠিকাছে কিন্তু আমার জলদি এসে পড়তে হবে।”
তীর্থ গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো মিরপুরের দিকে।

মৃণাকে সর্বপ্রথম ফার্মেসিতে নিয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করাল তীর্থ। তারপর এক রেস্টুরেন্টে বসে বলল, “এইবার বলো। এত কী জরুরী তলব আছে তোমার?”
“এই শুক্রবার আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ের শাড়িও কেনা শেষ। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। তুমি আমাকে কবে বিয়ে করছ?”
তীর্থ ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু সে তার বিরক্তি প্রকাশ করল না। শান্ত গলায় বলল, “আমি বলেছি ভাববো। আমাকে সময় দেও একটু।”
“সময়-ই তো নেই। এই শুক্রবার মানে বুঝতে পারছ? মানে আর চারদিন বাকি। তীর্থ সত্যি করে বলো তো। তুমি আমাকে ভালোবাসো না? ভালোবাসলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”
প্রশ্নটা শুনে একটু হকচকিয়ে যায় তীর্থ। আজ পর্যন্ত সে মৃণাকে বলে নি সে তাকে ভালোবাসে। কিন্তু তাদের সম্পর্ক জড়ানোর পর মৃণার এই ধারণা করাটা স্বাভাবিক।
তীর্থ একটু কেশে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমি ওয়াশরুম থেকে একটু আসছি।” বলেই চলে গেল।

মৃণা মেজাজ গরম করে সেখানে বসে রইল। রাগে ফুলছিল সে। এমন সময় তীর্থের ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা তীর্থ টেবিলে রেখে গেছে। মৃণা ফোন হাতে নেয়। কবিতার নাম ফোনের স্কিনে দেখে ভীষণ বিরক্ত হয় সে। তার মেজাজ আরও গরম হয়। সে সাথে সাথে ফোনটা কেটে ফোন ফ্লাইট মোডে রেখে দেয়।

কিছুক্ষণ পর তীর্থ এসে মৃণাকে বলে, “মৃণা আমরা আগামী কাল কথা বলি? আজ আমার যেতে হবে।”
“আচ্ছা তোমার কাছে কি আমার কোন মূল্য নেই? এদিকে আমার জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর তোমার যেতে হবে?”
“কাব্য অসুস্থ।”
“কবিতা আছে তো ওর কাছে। আমার কাছে তো তুমি ছাড়া কেউ নেই।”
মৃণা তীর্থের হাত ধরে নিলো। আবদারের সুরে বলল, “প্লিজ তুমি এভাবে আমাকে একা ছেড়ে দিও না। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার আইদের সাথে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে সংসার করার কথা চিন্তাও করতে পারিনা।”
“তুমি চাও আমি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার মনে হয় তারা একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে তোর বিয়ে দিবে।”
“ওসব আমি সামলে নিব।”
“আর কবিতা এসব জানলে কী হবে তা বলো”

কবিতার নাম শুনতেই মৃণার বিরক্ত লাগল। সে মনে মনে ভাবল, “হ্যাঁ আমি কত চাই ও তোমার জীবনে থাকুক। একবার বিয়ে হতে দেও তারপর ওকে কীভাবে তোমার জীবন থেকে বের করব তা দেখ। তীর্থ এবং ওর সবকিছু কেবল আমার হবে।”
কিন্তু মুখে আর এ কথা সে বলল না। সে আরও শক্ত করে তীর্থের হাত ধরে বলল, “আমি সব সামলে নিব তীর্থ। আই প্রমিজ। প্রয়োজনে আমি সবাইকে ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসব। তুমি শুধু আমাকে আপন করে নেও।”
তীর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মৃণাকে সে কি বলবে, সে নিজে কি চায় তাই সে জানে না। কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না। তার মাথা কাজ করছে না। এই কোন সংকটে ফেঁসে গেল সে!
.
.
“আমাদের দেখা হবার রীতিটা ভঙ্গ করলে না তুমি।”
কন্ঠটা শুনে একটু চমকে যায় কবিতা। আচমকায় মুখ তুলে তাকায় তার সামনের লোকটার দিকে। লোকটা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে তার সামনে বসে আছে।

কথন!
কথন কবে এলো বাংলাদেশে? কবিতা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কথনের দিকে। কবিতার এমন চাহনি দেখে হেসে দেয় কথন। কবিতার মাথায় টোকা মেরে বলে, “ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছ কেন?”
কবিতা মৃদু হেসে বলে, “আপনাকে হঠাৎ এত বছর পর দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।”

দুইজনে উঠে দাঁড়ায়। কথন তার ভেজা শার্টটার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি আর ভালো হলে না। তারপর বলো এইখানে কীভাবে? আর মেডামের এত মেজাজ খারাপ কেন?”
“আমার ছেলের খুব জ্বর। ওকে মাত্র এনে ভর্তি করলাম। চিন্তায় ছিলাম তাই মেজাজ খারাপ করে যা তা বলে ফেললাম। সরি।”
কথন চমকানোর ভান করে কবিতাকে জিজ্ঞেস করে, “জ্বর কী ওর না’কি তোমার? তুমি এত সহজে মানুষকে সরি বলতে কবে শিখলে?”
“সময় শিখিয়ে দিয়েছে।”
“তোমার বাচ্চা হয়ে গেছে কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার ছেলেকে দেখব।”
“আমার মেয়েও আছে। ওর ক্ষুধা লেগেছে, কিছু খাবার নিয়ে এসে যাই?”
“কেবিন নং কত?”
“৩০৪ সম্ভবত।”
কথন এক নার্সকে ডেকে ৩০৪ নং কেবিনে কিছু খাবার নিয়ে যেতে বলল। তারপর সে গেল কবিতার সাথে। লিফটের থেকে বের হয়েই কবিতা জিজ্ঞেস করে, “আপনি বাংলাদেশে কবে এলেন?”
“এই দুইমাস হবে। আসার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু মা’য়ের ইমোশনাল ব্লাকমেইলের সাথে কে জিতে? মা’য়েদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।”
“শেষ দেখার পর আর যোগাযোগ রাখলেন না আমার সাথে।”
কথাটা শুনেই কথনের ঠোঁটের হাসি মলিন হয়ে যায়। তার বুক চিরে বেরিয়ে আসে বেদনার নিশ্বাস, “বিদেশে যেয়ে কারও সাথেই যোগাযোগ ছিলো না। শুধু নিজের ক্যারিয়ার উপর ধ্যান দিয়েছি। ভাগ্য ভালো ধ্যান দিয়েছিলাম, নাহয় আজ তোমার সাথে এখানে দেখা হতো কীভাবে?”
“আপনি এখানে….”
“ইয়াপ আমি এখানের ডাক্তার। যদিও আমার শিফট আরও দুইঘন্টা পর। আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এলাম। ওর শিফট একটু পরই শেষ।”
“ওয়াও, ঢাকার সবচেয়ে বড় হাস্পাতালে ডাক্তার। আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণ করলেন।”
“আর তুমি?”
“আমি কী?”
“তুমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছ? কোথা থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্স করলে? আর এখন কী করছ?”
প্রশ্নটা শুনতেই কবিতার চোখে মুখে উদাসীনতার ছায়া পড়লো। ভাগ্যিস তাদের গন্তব্য এসে পড়েছিলো। তাই তার প্রশ্নটার উওর দিতে হলো না। সে জোরপূর্বক হেসে বলল, “কেবিন এসে পড়লো।”

কথন কেবিনে ঢুকে দেখে একটি বাচ্চা ছেলে বেডে শুয়ে আছে এবং অনুর কোলে আরেকটি বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। কথনকে দেখে অনু যেন আকাশ থেকে পড়ে। সে হা করে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, “কবিতা, আমার সামনে কী সত্যিই কথন দাঁড়িয়ে আছে না আমি স্বপ্ন দেখছি।”
“যদিও আমি এতই হ্যান্ডসাম যে সবাই স্বপ্নের রাজকুমার ভাবতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি আমাকে সত্যিই দেখছ।”
কথাটা বলে কথন হেসে কবিতার দিকে তাকালো। আগে যখনই সে এই কথা বলতো, তখনই কবিতা নাক ছিটকে এর বিপরীতে তাকে কথা শুনাতো। ঝগড়া হতো দুইজনের মাঝে। কিন্তু আজ কবিতা কিছুই বলল না। সে কেবল মৃদু হাসলো। কথনের বিষয়টা একটু অবাকই লাগে।

কাব্য জিজ্ঞেস করে, “মা এই আঙ্কেলটা কে?”
কবিতা কাব্যের কাছে যেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এখন একটু ভালো লাগছে?”
কাব্য মাথা নাড়া দিয়ে জানায়।
কাব্য ছোট হলেও তার বুদ্ধিমত্তা অনেক। কেবল পড়ালেখায় না। আসল জীবনেও। সে কাওকে সহজে কষ্ট দিতে চায় না। বিশেষ করে তার মা’কে। তাই মা যেন চিন্তা না করে এই কারণে সে মাঝেমধ্যে খারাপ লাগলেও চুপ থাকে। আজও তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু সে মা’কে তা বলতে চাইলো না।
কিন্তু কবিতা তো তার মা। ছেলে মুখে না বললেও তার কষ্ট বুঝে নিল কবিতা। সে কাব্যের কপালে চুমু খেয়ে বলল, “চিন্তা করে না বাবু, ডাক্তার আংকেল ঔষধ দিয়েছে। একটু পর আরও ভালো লাগবে।”
কাব্য হাসে কবিতার দিকে তাকিয়ে।

কবিতা এরপর কথনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, “এটা কথন আংকেল। তুমি আংকেলের সাথে গল্প করো, মা আসছি একটু। ঠিকাছে?”
কবিতা আবার কথনের দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি। আপনি বসুন।”
কবিতার বেরিয়ে যাবার পর কথন কাব্যের পাশে এসে বসে। কাব্য এবং কুহু দুইজনই অনেকটা দেখতে কবিতার মতো। মুখে মায়া ভরা। কথন কাব্যকে দেখে অনেক খুশি হয় কিন্তু তার বুকের যন্ত্রণাটাও বাড়ে। বুকের ভেতরটা জোরে মুচড়ে উঠে। কবিতার দুটো প্রতিচ্ছবি দেখে সে যতটা খুশি ততটাই তার দুঃখ হলো এই ভেবে যে ভাগ্যে হলে আজ কাব্য এবং কুহুর মতো বাচ্চা আজ তার ও কবিতার হতো। তার বুকে জমে থাকা কষ্টটা সে মুখে প্রকাশ করে না। কাব্যের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “হাই চ্যাম্প। তুমি দেখি অনেক স্ট্রং। হাতে নিডেল লাগানো তাও কাঁদছ না, আমি আগে তোমার মতো স্ট্রং বয় তো দেখি নি।”
কথাটা শুনে একগাল হাসে কাব্য। তার চোখদুটো ঝলমলে হয়ে উঠে, “সত্যি?”
“একদম সত্যি।”
কথন কিছুক্ষণ কাব্য এবং অনুর সাথে গল্প করে। এরই মাঝে কবিতা আসে নার্স এবং প্রণয়ের সাথে। প্রণয়কে দেখেই কথন বলে, “আমার মনেই হচ্ছিলো ওর চিকিৎসা তুই করছিস।”
“তুই এখানে!” প্রণয় অবাক কন্ঠে বলে।
“তোকে কবিতার কথা বলেছিলাম, মনে আছে? ওই কবিতা।”
প্রণয় তাকায় কবিতার দিকে। হেসে কথনকে আলাদা কেবিনের বাহিরে নিয়ে যেয়ে বলে, “তুই ঠিক আছিস?”
“বেঠিক থাকব কেন?”
“না ওর সাথে এতবছর পর আবার দেখা হলো তাই।”
“আরে আমি পুরনো কথাগুলো পিছনে ছেড়ে এসেছি। ওসব বলে লাভ নেই। দেখ মেয়ে টা আজও সেই তাড়াহুড়োয় কাজ করে। আজও জলদি হাঁটতে যেয়ে পানি ফালিয়ে দিলো আমার উপর। আমি শার্ট চেঞ্জ করে আসছি, তুই ভালো করে কাব্যকে দেখবি। ও কবিতার ছেলে, ওর যেন কোনো কষ্ট না হয়।”
প্রণয় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তা কথনের যাওয়ার দিকে। সে জানে ঠোঁটের কোণে যত বড়ই হাসি এঁকে রাখুক না কেন তার বুকে পীড়ন হচ্ছে। সে পীড়া সে কিছুতেই মুখে ভেসে উঠতে দিবে না। সবটা লুকিয়ে রাখবে নিজের মনের সিন্দুকে।

কথন নিজের কেবিনে যেয়ে টেবিলের ড্রয়ের থেকে তার শার্ট বের করে। শার্টের বোতামগুলো খুলে পরিবর্তন করতে যাবে এমন সময় তার চোখের সামনে ভেসে উঠে কবিতার মুখ। কাঁপানো নিশ্বাস ফেলে সে। তার মনে হচ্ছে তার চোখে জল এসে জমেছে। যেকোনো মুহূর্তে সে জল গাল বেয়ে পড়বে। সে টেবিলে হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ।
এতবছর পর কেন আবার সামনে আসতে হলো কবিতার?
কেন তার পুরনো ক্ষতগুলো আবার তাজা করতে হলো?
ভাগ্য তাদের এক করতে নারাজ, তাহলে কেন তাদের আবার দেখা করাল?
কষ্ট দিতে? সে কী এতই খারাপ যে বারবার তাকে এই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে? কবিতাকে এখন পাওয়াটা তার পক্ষে অসম্ভব। সে অন্যকারো বউ, কারও মা। তার কথাটা ভাবাটাও তো অনুচিত। তাহলে ভাগ্য কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে যে তার এই ভুল কাজটি করতে হয়।

কথন তার পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে বসে চেয়ারে। ওয়ালেটে কবিতার ছবি দেখে সে ছবিতে আঙুল বুলিয়ে বলে, “তোমাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে কবিতা কিন্তু খুশিও হচ্ছে তোমার এখন একটা সুখী পরিবার আছে। আমি তোমাকে পেতে পারি নি কিন্তু তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে তুমি পেয়েছ। এত মিষ্টি দেখতে সন্তানের মা তুমি। আর কী চাই আমার? তোমাকে দেখে কষ্ট হলেও এতটুকুতে আমি সন্তুষ্ট যে তুমি সুখী।”
কথনের চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়ে সে ছবিতে।
.
.
প্রণয় কাব্যের চেকাপ করছিলো। এমন সময় অনু কবিতার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, “দোস্ত শুন আমি বুঝে গেছি এই হাস্পাতাল এত বড় কীভাবে হলো।”
“ভালো চিকিৎসা দিয়ে।”
“আরে ধ্যুর না। কথন এবং ডক্টর প্রণয়ের মতো হট হট ডাক্তার রাখলে তো মাইয়ারা অসুস্থ না অসুস্থতার বাহানা দিয়ে আইবো। আইলেই তাদের টাকা।”
কবিতা চোখ ঘুরিয়ে বিরক্তি নিয়ে তাকায় অনুর দিকে।
অনু তো ভীষণ সিরিয়াস। সে চোখদুটো বড় বড় করে বলে, “মজা করতেছি না। একদম সত্যি।”
কবিতা বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

প্রণয় কবিতাকে কেবিনের বাহিরে নিয়ে বলে, “জ্বরের ঔষধ দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমি কিছু পরীক্ষা করতে চাই।”
“হ্যাঁ, ডাক্তার অবশ্যই করুন।”
“আপনি বললেন ওর প্রায়ই এমন জ্বর আসে। তাই আমার ওর আগের মেডিক্যাল হিস্ট্রিও লাগবে।”
“আমি এখনই বাসায় যেয়ে আগের রিপোর্ট আনছি।”

“আমিও সাথে আসছি তোমার।” কবিতা দেখতে পায় কথন এগিয়ে আসছে তার দিকে। কথন এসেই বলল, “আমি নিয়ে যায় তোমায়। আমি গাড়ি এনেছি তাই তোমার সুবিধাও হবে।”
কবিতা রাজি হলো। রাত হয়ে এসেছে। তার একা যাওয়াটা ঠিক হবে না। আর সে জানে, এই মুহূর্তে কথনের উপর সে ভরসা করতে পারে। এতবছর পর হলেও সে কথনের উপর ভরসা রাখতে পারে।
.
.
মৃণাকে বুঝাতে বুঝাতে তীর্থের রাত হয়ে এলো। যেমন তেমন করে সে মৃণাকে বুঝিয়ে বাসায় পাঠায়। মেয়েটা বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। আগে পরে কিছু ভাবছে না। এর মধ্যে তীর্থ পড়ে আরেক দ্বিধায়। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। মাথায় কিছুই ঢুকছে না তার। সে ভেবেছিল ধ্রুব আসলে এ বিষয়ে তার সাথে কথা বলবে কিন্তু মৃণা তো এর সময়-ই দিচ্ছে না। সে বলেছে আজ রাতেই তাকে শেষ সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। এত জলদি এত বড় সিদ্ধান্ত কীভাবে নেয় সে? এর উপর এত জটিল সিদ্ধান্ত। কোন ফাঁদে নিজেকে ফাঁসিয়ে দিলো সে? এখন নিজের উপরই জেদ উঠছে।

তীর্থ বাসায় এসে দেখে বাসায় তালা দেওয়া। কবিতা এ অসময়ে কোথায় গেল? ফোন বের করে সে দেখতে পায় তাই ফোন ফ্লাইট মোডে করা। ফ্লাইট মোডে কীভাবে গেল সে বুঝতে পারে না। ফোন ঠিক করার পর দেখে দেখে কবিতার আঠারোটা মেসেজ। সকল মেসেজেই লেখা, ‘কাব্যের অবস্থা ভালো নয়, তুমি কোথায়?”
” জলদি আসো।”
“তুমি কল ধরছো না কেন?”
“তোমার কোন কাজ তোমার ছেলের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই উওরটা তুমি এসে দিবে আমাকে।”

মেসেজগুলো দেখে এক মুহূর্তের জন্য তীর্থের হৃদস্পন্দন থেমে গেল। তার মনের ভেতর কু ডাকছে। কাব্য ঠিক আছে তো? এখন কোথায় তারা?
সে সাথে সাথে কবিতাকে কল দিলো কবিতা কল কেটে দেয়। এরপর যতবারই কল দিলো সে ধরলোই না। আতঙ্কে তার জান বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। সে তার বাসার সামনেই কবিতাকে কল করার সাথে সাথে পায়চারি করছে।

তার বাসার সামনে একটি গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে নামে কবিতা। কবিতাকে দেখে তীর্থ তার দিকে ছুটে যেতে নিলেও থেমে যায়। গাড়ির থেকে অন্য একটি মানুষও বের হবে। কথন? সে কবিতার সাথে কী করছে?

কবিতা কথনকে কিছু বলে ছুটে এলো বাসার দিকে। বাসার সামনে এসে তীর্থকে দেখে থমকে যায় সে। রাগে তার শরীর জ্বলে উঠে। মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। যেয়ে দরজা তালা খুলতে নিলেই তীর্থ তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “এই কথন এখানে কেন? এত রাতে সে তোমার সাথে কি করছে? আর তুমি আমার কল ধরছ না কেন?”
কবিতা কোন উত্তরই দিলো না তীর্থের প্রশ্নের। সে দরজা খুলে চলে গেল। ভিতরে যেয়ে সোজা বেডরুমে যেয়ে আলমারিতে কাব্যের আগের ফাইল খুঁজতে থাকে।

তীর্থও যায় তার পিছনে। কথনকে কবিতার সাথে দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। সে কবিতার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তোমাকে।”
কবিতা তীর্থের হাত ধরে নিজের হাত থেকে সরিয়ে দেয়।তারপর বলে, “আর আমি আপনার প্রশ্নের উওর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না।”
কবিতা নিজের কাজে আবারও জুড়ে গেল।
কিন্তু উওরটা তীর্থের ইগোতে লাগে। সে জেদের চোটে বলে, “প্রয়োজন মনে করছ না? এত রাতে পর পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়ানোর মেয়েদের কী বলে জানো?”

কবিতা স্তব্ধ যায়। সে কিছু রিপোর্ট খুঁজছিলো। তীর্থের কথা শুনে সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পাড়লো না। তীর্থ তার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলছে? তাদের মাঝে যতই দূরত্ব আসুক না কেন, সে কখনো ভাবতেও পারে না তীর্থ তার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলতে পারে।

তীর্থ আবারও বলল, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি কবিতা। এতরাতে তুমি কি করছিলে ওই ছেলের সাথে?”
কবিতা পিছনে ফিরেই গালে চড় মারে তীর্থের। আর্তনাদ করে উঠে, “তোর সাহস কী করে হয় আমার চরিত্রে প্রশ্ন করার?”
তীর্থ এমন কিছুর জন্য অপ্রস্তুত ছিলো। কবিতা কখনো তার উপর হাত তুলতে পারে সে কল্পনাও করে নি। তার এই মুহূর্তে প্রচুর রাগ হবার কথা কিন্তু কবিতার এমন অগ্নিমূর্তি দেখে সে কিছুই বলতে পারলো না। সাথে সে এটাও বুঝতে পারছে তার কথার ধরণটা ভুল ছিলো। সে রাগের বশে কী বলে ফেলল এটা?

তীর্থ এক ঢোক গিলে কবিতার বাহুতে হাত রেখে বলে, “কবিতা আমার কথা শুনো, আমি ভুলে….”
তীর্থকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয় কবিতা, “খবরদার আমার কাছে আসবি না। আমি কথনের সাথে কি করছি শুনতে চাস? তোর জন্য যে তোর বাচ্চার জান থেকে কাজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই আমি কথনের সাথে। আমার ছেলেটা আজ এত অসুস্থ ছিলো আর তুই তোর কাজ থেকে সময় পাচ্ছিলি না? কী কাজ ছিলো তোর এমন? তোর কী মনে হয় আমার ছেলের কিছু হলে আমি তোকে ছেড়ে দিতাম? আমার বাচ্চাদের কিছু হলে আমি প্রথমে তোদের মারতাম, তারপর নিজে মরে যেতাম। তোর বুক কাঁপে নি নিজের ছেলেকে….ছেলেকে এই অবস্থায় ছেড়ে…. ” কবিতার কথা বলতে দম বন্ধ হয়ে আসে। নিশ্বাস আটকে আসে। মাথা ঘুরিয়ে উঠে। সে পড়ে যেতে নিলেই আলমারি ধরে সামলে দাঁড়ায়।

তীর্থ ছুটে এসে তাকে ধরতে নিলেই সে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। তবুও তীর্থ তাকে ছাড়ে না কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে যেয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে আসে। কবিতাকে একটু পানি খাইয়ে তাকে বুকে ভরে নেয়। অস্থির হয়ে বলে, “সরি জান। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি তোমাকে ওর সাথে সহ্য করতে পারি না। রাগের মাথায় কি বলে ফেললাম সরি, সরি, সরি।”
কবিতা তীর্থের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। কান্নাভেজা গলায় বলে, “আমাকে কী ভেবে রেখেছ তুমি? আমি নিজের সারাটা জীবন তোমার পিছনে নষ্ট করে দিলাম আর তুমি আজ আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলছ? তুমি যে মাঝেমধ্যে এত রাত করে বাসায় ফিরে আছিস আমি কখনো তোমাকে সন্দেহ করেছি। কারণ আমি জানি আমাদের মাঝে যতই দূরত্ব হয়ে যাক না কেন তুমি আমাকে আগের মতোই ভালোবাসো। কখনো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।”
তীর্থ কবিতার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কবিতার শেষ কথাটা শুনতেই সে চোখ সরিয়ে নিলো। ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে তার। এক অজানা ভয় তার চারপাশের হাওয়ায় মিশে গেল। সাথে অপরাধবোধ তাকে আঁকড়ে ধরে। কবিতা তাকে এতটা বিশ্বাস করে?
যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কবিতা কখনো তার সাথে মৃণার সম্পর্ক জেনে যায় তখন?

কবিতার অবাধ্য চোখদুটো অনবরত পানি ঝরাচ্ছিল। তার বুকের ভেতর এতটা যন্ত্রণা আর কখনো হয় নি। তীর্থ কীভাবে পারে তার চরিত্রে প্রশ্ন তুলতে? যে লোকটার কারণে সে তার সব ছেড়ে দিয়েছে আজ সে লোকটা তার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলছে?
সে দৃঢ় কন্ঠে বলল, “তোমার যদি আমার উপর বিশ্বাস না থাকে তাহলে আমাকে ছেড়ে দিও। আমি কিছু বলব না। কিন্তু আমার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তোলার সাহস করবে না। আমি জানি, আমার আল্লাহ জানে আমার চরিত্র কেমন। আমার যদি তোমাকে নিজের চরিত্রের প্রমাণ দিতে হয় তাহলে এমন সম্পর্কে রেখে লাভ কী?”

কেঁপে উঠে তীর্থের বুকের ভেতর। কবিতা তাকে ছেড়ে দেবার কথা বলছে? অসম্ভব। তাদের মাঝে যত সমস্যা থাকুক, অশান্তি থাকুক না কেন, কবিতা তার সব। কবিতাকে ছাড়া সে তার জীবন কল্পনাও করতে পারে না।

কবিতা উঠে যেতে নিলেই তীর্থ তার হাত ধরে নেয়। বলে, “আমার ভুল হয়ে গেছে কবিতা।”
কবিতা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়, “খবরদার আমাকে স্পর্শ করার সাহসও তুমি করবে না। আমি এই মুহূর্তে তোমার চেহেরাও দেখতে চাই না।”

চলবে…

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here