#মুহূর্তে
পর্ব-৩৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তীর্থকে এসব করতে ধ্রুব উৎসাহ দিয়েছে আপু। আমার সন্দেহ উনি…উনি নিজেও অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত। উনার অতীত দেখে আমার তাই মনে হয়, নাহয় উনি কেন তীর্থকে এসব করার জন্য প্রশ্রয় দিবে?”
তাহিরা থেমে যায় কবিতার কথা শুনে। নিথর হয়ে যায়।
তীর্থ এবং ধ্রুব ড্রইংরুমে বসে ছিলো। রুমের বাহির থেকে কবিতার কন্ঠ শুনতে পেয়ে দুজনের দৌড়ে এলো। কবিতার বলা শেষ কথাটি শুনতেই ধ্রুব ভয় পেয়ে যায়। তবু দেবে যায় না। সে কবিতার সামনে দৃঢ় গলায় বলে, “কবিতা না বুঝে কি বলছো তুমি? তোমার মাথা ঠিক আছে? মন চাইলেই আমাকে তুমি দোষারোপ করতে পারো না।”
“তীর্থ আমাকে নিজে বলেছে আপনি ওকে জোর করেছেন ওই মেয়ের সাথে সম্পর্ক করার জন্য।”
ধ্রুব অবুঝের মতো ব্যবহার করল, “আমি? কী বলছো তুমি? আমি এমন কেন করব? তীর্থ আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আর তুমি আমার বোনের মতো। আমি তোমাদের সাথে এমন করার কল্পনাও করতে পারি না।”
“আপনি তাহলে জানতেন না যে তীর্থ ওই মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কে আছে?”
“সত্যি বলতে আমি জানতাম। কিন্তু আমি সবই কয় মাস আগে জানলাম।”
“আপনি মিথ্যা বলছেন।”
“সত্যি। ওই মেয়ে তো তীর্থকে বিয়ের জন্য প্রেশারও দিচ্ছিলো। আমি ওকে অনেক বুঝানোর পর তীর্থ ওকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন শেষে এমন কান্ড হয়ে যাবে কে জানতো? তোমার বিশ্বাস না হলে আমি তাহিরার কসম খাচ্ছি। তুমি জানো এই পৃথিবীতে আমি কেবল ওকেই ভালোবাসি। ওর কসম অন্তত আমি মিথ্যা খাব না।”
এবার দ্বিধায় পড়ে গেল কবিতা। ভালোবাসার জন্য না হলেও, ধ্রুব অন্তত স্বার্থপরতার জন্য তাহিরার ভুল কসম কাটবে না। এই পৃথিবীতে আপন বলতে তার কেবল তাহিরা আছে। যদিও তীর্থের বিশ্বাসঘাতকতার পর কবিতার ভালোবাসার উপর কোনো প্রকার বিশ্বাস নেই। কিন্তু ধ্রুব এবং তাহিরার সম্পর্ক ভালোবাসা থেকেও বেশি। পরিবার বলতে তাদের একে অপরকে ছাড়া কেউ নেই।
কবিতা এবার নিজেই দ্বিধায় পড়ে যায়, “কিন্তু গতকাল যে তীর্থ নিজে…”
তীর্থও তার কথা কেটে বলল, “আমি গতকাল তোমাকে ধ্রুব সম্পর্কে কিছু বলি নি।”
কবিতা আর্তনাদ করে উঠে, “তুমি বলেছ।”
“আমার অস্বীকার করতে হলে আমি নিজের ভুল স্বীকার করতাম। আমি ধ্রুবর জন্য মিথ্যা বলব কেন?”
“তুমি এখন মিথ্যা বলছো দেখেই আমার সন্দেহ নিশ্চিত হয়ে গেল। একটু আগেও আমার নিজের চিন্তার উপর সন্দেহ হচ্ছিল, এখন আর আমার সন্দেহ নেই।”
ধ্রুব রাগান্বিত স্বরে বলে, “কবিতা, তুমি তোমার মনগড়া কাহিনী নিয়ে কারো চরিত্রে প্রশ্ন তুলতে পারো না। তীর্থের এক্সট্রা মেরেটাল এফায়ার আছে বলে আমারও থাকতে হবে এটা কেমন কথা? প্লিজ নিজের কল্পনায় এসব বানিয়ে তুমি আমাদের সংসার ভাঙার চেষ্টা করো না। তোমার সংসার টিকে নি এর মানে এই না যে, তুমি নিজের বোনের সংসারে আগুণ লাগাবে।”
তাহিরা দাঁড়িয়ে ছিল রুমের এক কোণায়। কবিতা ছুটে যায় তার কাছে। তাহিরার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, “আপু বিশ্বাস করো, আমি মিথ্যা বলছি না।”
তাহিরা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলে, “হয়তো তোর কোনো ভুল হচ্ছে। ধ্রুব এমন কিছু করে নি যে মনে হবে সে আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে। ও নিজের সম্পূর্ণ অবসর সময় আমাকে দেয়, এসবের সময় কোথায় পাবে সে?”
“কিন্তু আপু যদি এমনটা হয় তাহলে তো কালকে এক কথা বলে আজ ফিরে গেল কেন? তোমার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার?”
“বিশ্বাসের কথা এখানে আসছে না সোনা। তুই আমার সাথে আয়, ঠান্ডা মাথায় কথা বলি।”
কবিতা সরে গেল তাহিরের কাছ থেকে। বলল, “প্রয়োজন নেই। আমি এতটুকুই বলতে এসেছিলাম। যাই এখন।”
“কোথায় যাবি তুই? তুই, কাব্য এবং কুহু আমার কাছে এসে থাকবি।”
“আমি এমন একটা মানুষের ঘরে থাকবো না যে আমার সংসার ভাঙার জন্য একটু হলেও দায়ী এবং যার জন্য আমার বোনকে ভবিষ্যতে কষ্ট পেতে হবে। আমার মতো বিশ্বাসঘাতকতা অনুভব করতে হবে।”
“কবিতা জেদ করিস না। ”
কবিতা বিরক্তি নিয়ে বলল, “আমি যাই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
কবিতা যাবার সময় তাহিরা তার হাত ধরে বলে, “আমি তোকে কিছু টাকা দিচ্ছি, তা অন্তত নিয়ে যা।”
“তোমার টাকার প্রয়োজন নেই। আমি নিজে সব মেনেজ করে নিব।” কবিতা তাহিরার হাত ছাড়িয়ে নেয়। তাহিরা বুঝতে পারছে কবিতার মেজাজ এ মুহূর্তে প্রচন্ড গরম। সে কোনোভাবে তাকে শান্ত করতে চাইছে। সে কবিতার গালে হাত রেখে বলল, “শুন সোনাপাখিটা, আপুর সাথে রাগ করিস না। আমি যা করছি বুঝেশুনে করছি।”
“তাহলে তোমার যা ঠিক মনে হয় তুমি করো, আমার যা ঠিক মনে হয় তা আমি করবো।”
কবিতা চলে যায়। তাহিরা তার পিছনে যেতে নিলে ধ্রুব তাকে থামিয়ে বলে, “ওকে যেতে দেও। আপাতত ওর মন মানসিকতা ঠিক নেই। একটু শান্ত হোক। আমি কয়দিনের মধ্যে তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাব।”
তাহিরা তীর্থের দিকে তাকিয়ে ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ওকে এখনই এই ঘরের থেকে যেতে বলো। আমি যেন ওকে আর আমার ঘরে না দেখি।”
“আচ্ছা জান তুমি রুমে যাও। আমি দেখছি।”
তাহিরা রুমে যাবার পর ধ্রুব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে তীর্থকে বলল, “তুই আজ নিজের সাথে সাথে আমাকেও ডুবিয়ে দিতি। যেখানে তুই দেখছিস যে কবিতা মেনে নিচ্ছিলো যে ওর ভাবনা ভুল তাহলে তুই কেন বলতে গেলি যে তুই গতকাল বলিসই নি।”
” শেষ মুহূর্তে এটাই প্লান হয়েছিলো।”
“কিন্তু পরিস্থিতি দেখে তো পালটে দিবি কথাটা। বলতি মিথ্যা বলেছিস। আচ্ছা যাই হোক, তাহিরা কবিতার কথা মেনে নেয় নি এটাই অনেক।”
“এখন তুই জলদি করে আমাকে আমার কবিতা ফিরিয়ে দিবি। যেমন করেই হোক। এই কথাই হয়েছিল আমাদের।”
“আমার মনে আছে।”
“আচ্ছা তুই তাহিরার মিথ্যা কসম খেলি কেন?”
“মিথ্যা কসম কোথায় খেলাম? আমি তো তোকে মানা করেছিলাম বিয়ের জন্য এবং তুই এই কারণে ওকে ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলি। আমি এই বাক্যের সাথেই কসম কেটেছি, আগের কোনো বাক্যের সাথে নয়।”
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে তীর্থ, “তুই অনেক বেশি চতুর।”
“প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। এখন তুই এইখান থেকে যা। আমি তাহিরাকে দেখে আসছি।”
তীর্থ যাবার পর ধ্রুব যায় তাহিরার কাছে। তাহিরা বসেছিল বিছানার এক কোণে। ধ্রুব যেয়ে তাহিরার পিছনে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই কবিতার কথা ভাবিস না। ও না বুঝে-শুনে সব বলছিলো।”
“ভাবা যায় যে তীর্থ একসময় কবিতা ছাড়া কিছু বুঝতো না, কেবল তার জন্য হাসতো, কাঁদতো, তাকে কেবল মনের সব কথা বলতো, সে তীর্থ আজ এমন হয়ে যাবে। আমি কল্পনাও করতে পাড়ছি না। মানুষ এত পরিবর্তন হয়ে যায় সময়ের সাথে?”
ধ্রুব মুখ গুঁজে তাহিরার ঘাড়ে। বলে, “এসব নিয়ে বেশি চিন্তা করিস না, অসুস্থ হয়ে পড়বি।”
“আবার দেখ কিছু মানুষ হাজার বললেও পরিবর্তন হয় না।”
“উফফো এসব বাদ দে না। কবিতা এবং তীর্থকে নিয়ে পড়ে চিন্তা করা যাবে। আমি তো আছি তোর সাথে।”
তাহিরা মৃদু হাসে, “তুই আমার এমন করলে তো আমি নিশ্চিত মরে যেতাম।”
কথাটা শুনে চমকে উঠে ধ্রুব। তার সম্পূর্ণ দেহ কেঁপে উঠে তার। সে তাহিরাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রাগে তার মাথা ঠিক নেই। সে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে সেখানে, “তোকে না আমি বলেছি এসব কথা মুখেও আনবি না? এই মরা-টরার কথা আমার সামনে বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। খবরদার এসব বলবি না। তোর যদি কিছু একটা হয় আমি সে মুহূর্তেই নিজেকে শেষ করে দিব।”
তাহিরা হাসে। উঠে যেয়ে দাঁড়ায় ধ্রুবর সামনে। তার পা’য়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে ধ্রুব কপালে চুমু দেয় একটা। চুমু খেয়ে ধ্রুবর দিকে তাকায় সে। ধ্রুবর বিস্ময়ের চাহনি দেখে ফিক করে হেসে দেয়। গাল টিপে বলে, “পাগল একটা, এত জলদি রাগ উঠে গেলে কীভাবে চলবি জীবনে?”
ধ্রুব মুখ ফুলিয়ে তাহিরাকে বুকে ভরে নেয়। এবং বলে, “তুই আছিস তো আমাকে শান্ত করার জন্য।”
তাহিরা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ধ্রুবর শার্ট। চোখ বন্ধ করে বলে, “আজ কেন যেন মিদুলের মা’য়ের কথা মনে পড়ে গেল কবিতার কথা শুনে। কিন্তু আমি জানি, কবিতার সাহস আছে। ওর সাহস অনেক বেশি। ও যতই ভেঙে পড়ুক তবুও নিজেকে সামলে নেবার সাহস আছে ওর।”
ধ্রুব এই কথার প্রতি উত্তরে কিছু বলল না।
তাহিরা আবারও বলে, “ধ্রুব শুন, আজ থেকে প্রতিদিন আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবি ঠিকাছে? আমার না খুব শান্তি লাগছে তোর বুকেতে।”
“যো হুকুম মহারাণী। আপনার আদেশ আমি অমান্য করতে পারি?”
.
.
অনু কাব্য এবং কুহুর সাথে খেলছিলো। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। এটাতো অনুর ফোনের রিংটোন নয়। সে উঠে দেখে কবিতার ফোন তার বিছানার উপর রাখা। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠে একটি বিদেশী নাম্বার। সে ফোন ধরে, “হ্যালো কে?”
কিছুক্ষণ নিরবতা থাকে ওপাশে। তারপর ভারী কন্ঠ ভেসে আসে, “অনু বলছো কী?”
কন্ঠটা শুনে দম বন্ধ হয়ে আসলো না। সে কিছু সময়ের জন্য স্থির হয়ে যায়।
উত্তর না পেয়ে ওপাশ থেকে আবারও প্রশ্ন আসে, “অনু না? অন্যকেউ? আপনি একটু কবিতাকে ফোনটা দিতে পারবেন?”
অনু বারান্দায় চলে যায়। সে কয়েকটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলার পর আমতা আমতা করে বলে, “আবির ভাইয়া আমি অনু। কবিতা আসলে ভুলে ফোন আমার কাছে রেখে গেছে।”
“ওহ অনু, কত বছর পর কথা হচ্ছে, কি খবর তোমার?”
“ভালো।”
“মাঝে মাঝে ফেসবুকে তোমার ছবি দেখি। দিনদিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছ। রহস্য কী?”
আবিরের মুখে তার প্রশংসা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল অনু। সে যখন কিশোরকালে ছিলো, তখন থেকে একটু একটু পছন্দ করত সে আবিরকে। কখনো বলা হয়নি। একসময় অন্য সম্পর্কে আবির জড়িয়ে যাওয়ায় অনু নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে আবিরের সাথে। তারপরে বিদেশে চলে যায়। দেখা হয় না, কথা হয় না। আগে যে তাদের বিশেষ কত হত এমনটাও নয়। তবু আজও আবিরের সাথে কথা বলতে গেলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে অনু। প্রথম পছন্দের রেশটা মনে হয় এককাল পরেও থেকেই যায়।
অনু লজ্জায় মাখা মাখা হয়ে বলল, “এমন কিছু না ভাইয়া। আপনারই হয়তো মনে হচ্ছে।”
আবির হাসে, “কবিতা ছবি দিয়েছিলো একদিন। ছবিগুলো দেখার সময় আমার একটা বন্ধু তোমায় দেখে। দেখেই ক্রাশ খেল বড়সড়। তাই সম্ভবত আমি আমার একা মনে হচ্ছে না। আচ্ছা কবিতার কী খবর বলোতো। ওকে পাওয়াই যায় না সহজে।”
অনু একটু চিন্তায় পড়ে গেল। আবিরকে কি বলবে সে? সত্যিটা বলবে, না কবিতার সব বলার অপেক্ষা করবে? কবিতার ব্যাপারে তার এভাবে বলাটা হয়তো উচিত হবে না। এই সিদ্ধান্ত কবিতার নেওয়া উচিত। তাই সে বলল, “সম্ভবত সংসারের কাজে ব্যস্ত ছিলো।”
“ওহ আচ্ছা। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কী সিঙ্গেল আছো?”
চমকে উঠে অনু, “আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে, তাহলে আপনি আমার প্রশ্ন করছেন কেন?”
ওপাশ থেকে ইতস্তত কন্ঠ শোনা গেল, “আমার বন্ধুর জন্য জিজ্ঞেস করছিলাম।”
অনুর এখন নিজের উপরই রাগ উঠলো। নিজেকেই কি লজ্জায় ফেলে দিলো সে। অনু বলে, “না, আমি সিঙ্গেল। কিন্তু আপাতত কেবল কাজে মনোযোগ দিতে চাচ্ছি।”
“ফেয়ার এনাফ। তাহলে রাখি। নিজের খেয়াল রেখো।”
ফোন রাখার পর গভীর নিশ্বাস ফেলে অনু। সে আবিরের সামনে গেলে ঠিক মতো কথাই বলতে পারে না। আর তার বন্ধুর সাথে সম্পর্কে যাবে? একজনের সাথে কথা বলে তার বন্ধুর জন্য অনুভূতি রাখা, বিষয়টা ভাবতেই অস্বস্তিকর লাগতে শুরু করে অনুর।
.
.
কবিতা দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। সে আর তীর্থের মুখোমুখি হতে চায় না আজ। কিন্তু রাস্তায় কোনো রিকশা পেল না সে। ব্যাপারটা ভীষণ বিরক্তজনক। এ কারণে হেঁটে যেতে হলো তার।
মাঝরাস্তায় দু’টি ছেলে তার পিছু নিলো। বখাটে মনে হচ্ছিল তাদের। কবিতা যেমন তেমন করে তাদের পিছু ছাড়ানোর জন্য দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।
কথন ঘুরে বেড়াচ্ছিল তার গাড়ি নিয়ে। গাড়ি চালানোর সময় হঠাৎ করে সে দেখতে পায় কবিতাকে। মেয়েটা এই সময় এমন নিরব জায়গায় একা কি করছে? সাথে সাথে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় সে। কবিতা সামনে দাঁড় করে।
হঠাৎ একটি গাড়ি এসে থামে কবিতা সামনে। মুহূর্ত খানিকের জন্য কবিতা ভয় লাফিয়ে উঠে। কথন জানালা খুলে বলে, “তুমি রাতে এখানে কী করছো? জায়গাটা তো ভালো না শুনলাম।”
কথনকে দেখে কবিতা প্রাণ ফিরলো।
“ওই’যে আসলে…ওই…” কবিতা কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলো না। কথন তার দ্বিধা বুঝতে পাড়লো। তার ব্যাক্তিগত জীবনের সম্মান রেখে তার কথা থামায় সে। বলে, “আচ্ছা তুমি গাড়িতে উঠে বসো আমি তোমাকে বাসায় দিয়ে আসছি।”
কবিতা একবার ভাবল মানা করে দিবে। কিন্তু পরক্ষণে তার মনে পড়ল, তার পিছনে পড়া দুইটি বখাটে ছেলের কথা। সে কথনের গাড়িতে উঠে বসলো।
কথন গাড়ি স্টার্ট করেই জিজ্ঞেস করে, “তুমি কী ক্লান্ত?”
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন যে?”
“তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে।”
“ওহ।”
“আরো মনে হচ্ছে তুমি চিন্তিত। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছ চিন্তায়।”
“এতটা বুঝাও ভালো না।”
“কুহু এবং কাব্য কেমন আছে?”
“ভালো।”
“আর তীর্থ?”
এ জায়গাতেই চুপ হয়ে গেল কবিতা। সে বুঝলো না এই কথার কি উত্তর দিবে। সে এভাবেই কাউকে নিজের দুঃখ প্রকাশ করে সান্ত্বনা নিতে চায় না। বিশেষ করে এই মুহূর্তে কারও সহানুভূতি চায় না তার। সে নিজ থেকে নিজেকে সামলাতে চায়। তাই সে কথা ঘুরিয়ে বলে, “আগে বলুন তো আপনি এখানে কী করছেন?”
“জানি না।”
“জানেন না? আপনি এখনো আগের মতো আজব কর্মকাণ্ড করে বেড়ান?”
কথাটা শুনে শব্দ করে হেসে উঠে কথন। সে জিজ্ঞেস করে, “তোমার এখনো মনে আছে?”
“হুম, আছে। আপনি নিজে আজব গুজবকাহিনী করে আমাকে পাগলখানায় পাঠানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।”
“দিনগুলো কত সুন্দর ছিলো তাই না?”
কবিতা আড়চোখে তাকায় কথনের দিকে। এই বুক চিরে বেরিয়ে আসে বেদনার নিশ্বাস। সে সুন্দর দিনগুলোর মাঝেই তীর্থের প্রেমে সে পড়েছিল। সে ডুবেছিলো তার ভালোবাসার সমুদ্রে।সে কি জানতো এত সুন্দর মুহূর্তগুলো আজ তার কাছে এতটা বিষাক্ত লাগবে।
কথন হঠাৎ কবিতাকে জিজ্ঞেস করে ,”আচ্ছা কবিতা নিষিদ্ধ প্রেম করা কী অনুচিত?”
কবিতা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় কথনের দিকে। বলল, “ঠিক বুঝলাম না।”
“তোমার মনে আছে তোমাকে আমি বলেছিলাম আমি যাকে ভালবাসতাম তার বিয়ে হয়ে গেছে। এখনও তাকে ভালোবাসা কী অনুচিত?”
কবিতা ভাবে কিছুসময়। তার তীর্থ ও মৃণার বিষয়ও মাথায় এলো। কথনের ভালোবাসাও কী এমন?
কবিতা জিজ্ঞেস করে, “সে মেয়েটার সাথে কথা হয়?”
“খুব একটা না। খুবই কম। আসলে ও যেহেতু অন্য এক সম্পর্কে জড়িত তাই আমি নিজের সীমানার মাঝেই থাকতে চাই। ভাগ্যক্রমে দেখা হয়েছে কয়েকবার, সে উপলক্ষেই কথা হয়েছে।”
“সে এখনো জানে না আপনি তাকে ভালোবাসেন?”
“উঁহু, আমি চাই না ও জানুক।”
কবিতা নিজের উওর নিজেই পেয়ে গেল। উওর হলো, না।
কথনের ভালোবাসা তীর্থ এবং মৃণার মতো না। তার ভালোবাসা পবিত্র। এমন পবিত্র ভালোবাসাকে তাদের সম্পর্ক সাথে তুলনা করাটাও ভালোবাসার অপমান করা হবে।
কবিতা কথনের দিকে তাকায় না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় তার হাতের দিকে। হাতের আঙুল দিয়ে খেয়াল করছে সে, “না, কাওকে ভালোবাসা অনুচিত হতে পারে না। কিন্তু সে ভালোবাসায় আপনি ভুল কর্ম করেন তা ভালোবাসাকে অনুচিত বানিয়ে দেয়। ভালোবাসাটা আমাদের উপর নির্ভর করে না কিন্তু ভালোবাসাটা আপনি ঠিক কেমন চান তা আপনার উপর নির্ভর করে। আমার আগে মনে হতো ভালোবাসা শব্দটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে-কেউ ভালোবাসতে পারে না। কিন্তু এখন মনে হয়, শব্দটি খুবই সস্তা। আজকাল মানুষ সুন্দর শব্দটার সস্তা বানিয়ে দিয়েছে। নোংরামিকেও আজকাল ভালোবাসার নাম দেওয়া হয়। কিন্তু ভালোবাসায় যদি আপনার কাজগুলো অশোভন না হয় তাহলে সে ভালোবাসা পবিত্র। এমন ভালোবাসা পাওয়া এবং করা দুটোই ভাগ্যের ব্যাপার।”
কবিতা এবার তাকায় কথনের দিকে। মলিন হাসে, “এমন নিষিদ্ধ ভালোবাসাগুলো সুন্দর হয়। না কোনো চাওয়া, না কাছে আসা। কেবল দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়া। এই ভালোবাসা এমন অপেক্ষা, যার অন্ত নেই।”
কবিতার দিকে একপলক তাকাল কথন। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললো। হলো নয়নবন্ধন। সে চোখে এক মুহূর্তের জন্য ডুবেও তুফান উঠলো কথনের বুকের মাঝারে।
চলবে…
[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]
সকল পর্ব
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086