মুহূর্তে পর্ব-৩৯

0
706

#মুহূর্তে
পর্ব-৩৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“আমার এখানে আসার সাহস কিভাবে হলো?” কবিতা তীর্থকে দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে। তীর্থ উত্তর দেয় না। চুপচাপ দরজা বন্ধ করে দিব কবিতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে উল্টো প্রশ্ন করে, “তুমি বাসায় কবে আসছো? সবকিছুর একটা সীমানা থাকে। তুমি আমার কল ধরছো না, নাম্বার ব্লক করে রেখেছ, কতবার গাড়ি পাঠিয়েছে তোমাকে না নেওয়ার জন্য? এই নাটকের শেষ করবে তুমি। এক সপ্তাহ হয়ে গেছে।”
কবিতার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তীর্থের এমন কথায়। কিন্তু সে শান্ত গলায় বলে, “এক সপ্তাহ হোক, একমাস হোক অথবা এক বছর আমি তোমাকে কাছে আর আসছি না।”
“তুমি আসবেনা? ঠিক আছে, তাহলে আমার বাচ্চাদের আমি নিয়ে যাব। তোমার ফিরে আসা লাগবে না।”
“তোমার বাচ্চাদের প্রতি এত ভালোবাসা কবে থেকে হয়ে গেল? তুমি এখন থাকতে পাড়ছো না তাদের ছাড়া? অথচ আগে তো ওদের সাথে একদিন খেলার মতো তোমার কাছে সময় হতো না। কাব্যের অসুস্থ হবার পূর্বে কবে তুমি ওদের সাথে সময় ব্যয় করেছে আমাকে একটু বলতো। আর তোমার সন্তানদের প্রতি তোমার মায়া লাগছে তাই না? তাহলে তুমি এসে নিষ্পাপ প্রাণ কে কিভাবে মারার চিন্তাও করতে পারো? একবার বুক কাঁপেনি তোমার?”

তীর্থ কবিতার কাছে তার দুই বাহু ধরে বলে, “কারণ আমি তোমার কথা ভেবেছি। বাচ্চাদের কথা ভেবেছি। আমাদের কথা ভেবেছি।”
“মিথ্যা কথা। তুমি কেবল নিজের কথা ভেবেছ। আমাদের কথা ভাবলে তুমি কখনো অন্য মেয়ের সাথে এমন সম্পর্ক রাখতে না।”
“ঠিকাছে, আমি স্বার্থপর। আমি খারাপ। আমি জঘন্য। তুমিতো ভালো। তাহলে ফিরে আসো না আমার জন্য না হোক, আমাদের বাচ্চাদের জন্য। তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করো। তোমার জেদের জন্য ওদের জীবন নষ্ট হতে পারে। ভবিষ্যতে যখন তারা নিজের বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে কী উওর দিবে তুমি? কি বলবে? যদি তুমি নিজের জেদের কারণে তাদেরকে নিজের বাবার কাছ থেকে দূর করেছ?”
তীর্থ কবিতার দুই গালে হাত রেখে কথাগুলো বলে। কবিতা তাকায় তীর্থে চোখের দিকে। সে চোখে চোখ রাখলেই আজও তার বুকে কম্পন উঠে। আগে সে কম্পন ছিলো ভালোবাসার। কিন্তু আজ তা বেদনার। তার চোখ নম্র হয় সে দৃষ্টির দর্শনে। সে তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “এই নাটক ধ্রুব শিখিয়ে পাঠিয়েছে তোমায় তাই না?”

তীর্থ চমকালো। কবিতা আবারও বলল, “সে তোমায় এটাও বলেছে যে আমার দুর্বলতা আমার সন্তানরা। তাই তুমি এখন আমার সন্তানদের কথা তুলছ তাই না?” কবিতা একটু পিছিয়ে যায়। তার শরীর কাঁপছিলো। অবশ অবশ লাগছিলো তার। সে পিছনের টেবিল ধরে দাঁড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নরমসুরে বলল, “তুমি জানো আমি যে তীর্থকে ভালোবেসেছিলাম সে কেমন ছিলো? তার চোখে তাকালে মনে হতো আমার থেকে সুন্দর নারী সে এই জীবনে আর দেখে নি, আমাকে ছাড়া অন্যকোনো নারীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর ইচ্ছাও হয় না তার, আমার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা অপলক তাকিয়ে থাকলেও তার দৃষ্টি ক্লান্ত হবে না। তুমি জানো…তুমি জানো আমি যখন জানতে পেরেছি তুমি অন্য মেয়ের সাথে….” দম আটকে আসতে চাইলো কবিতার। সে তবুও সামনে বলল, “আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিছুতেই না। আমি বারবার ভাবছিলাম যে মানুষ ছোটবেলা থেকে তার বাবাকে ঘৃণা করে এসেছে কারণ তার বাবা পরকীয়া করেছে। তার মা’কে ধোঁকা দিয়েছে। তাদের একা ফেলে ফেলে চলে গিয়েছে। সে মানুষ এমনটা করতে পারে? এটা আদৌও সম্ভব? তার কাছে সম্পর্কের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি হওয়া উচিত।”

কবিতা তীর্থকে বিস্মিত হতে দেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কী হলো? এই কথা তোমার মাথায় আসে নি? তুমি একবারও ভাবো নি একসময় যেভাবে তোমার বাবা তার সংসার নিজ হাতে শেষ করেছিলো আজ ঠিক তেমনি তুমিও আমাদের সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছ। একবার ভাবো কাব্য এবং কুহু যখন জানবে তাদের বাবা কি করেছে তাহলে তোমাকেও তারা সেভাবে ঘৃণা করবে যেভাবে তুমি তোমার বাবাকে….” সামনে বলতে পারলো না কবিতা। তীর্থ এসে কবিতার মুখ চেপে ধরলো। তার চোখে ভয়। সে ভয়ার্ত গলায় বলল, “প্লিজ কবিতা। এমন করো না। তুমি ওদের এসব জানাতে পারো না।”
“কেন? তোমার মতে তো তোমার ছোট এক ভুল হয়েছে। ভুল জানাতে কীসের ভয়? ভুল তো মাফ করা যায় তাই না? আজ না হোক, দশ বছর পর হলেও তো তারা জানবে। তখন কী করবে তুমি?”
“কবিতা প্লিজ ক্ষমা করো আমায়। আমি ভুল করে ফেলেছি। আই প্রমিজ আর করবো না। আরেকটা সুযোগ দেও।”
“তাহিরা আপুও তো ধ্রুবকে সুযোগ দিয়েছিলো। সে কী করেছে সে সুযোগের?”
“ধ্রুব আর আমি কি এক না’কি?” উচ্চস্বরে বলে তীর্থ। কিন্তু কবিতা এবারও শান্ত গলায় উওর দিলো, “আমি তোমার জায়গায় হলে তুমি আমায় ক্ষমা করতে? সেদিন কথনের সাথে আমায় দেখে তোমার মেজাজ আকাশ চড়ে গিয়েছিলো। আমি যদি অন্য পুরুষের সাথে শুয়ে আসতাম তাহলে তুমি আমায় মেনে নিতে?”

কথাটুকু তীর্থের মাথা খারাপ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। তবুও সে নিজেকে শান্ত রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করল। সে জানে এই মুহূর্তে মাথা নষ্ট করলে কবিতাকে ফিরে পেতে আরও কষ্ট হবে তার। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “হুম, ভু…ভুল হলে আরেকটা সুযোগ দিতাম।”

“তাহলে এক কাজ করি চলো। তুমি যতদিন ঐ মেয়ের সাথে নাম কি যেন? ওহ মৃণা। ওই মৃণার সাথে যতটুকু অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটিয়ে এসেছ আমিও অন্য পুরুষের সাথে ঠিক ততটুকু কাটিয়ে আসি। তোমার যেমন শান্তির প্রয়োজন ছিলো, আমারও তেমন শান্তির প্রয়োজন। তখন তোমার আর আমার হিসাব বরাবর…..” কথা শেষ না হতেই তীর্থ হাত তুললো কবিতার উপর। গালে এত জোরে চড় মারলো যে তার ফর্সা গালে আঙুলের দাগ বসে গেছে। তীর্থ কবিতার বাহু শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “খবরদার আরেকটা শব্দ মুখ থেকে বের করবা না। এই মুহূর্তেই আমি মেরে ফেলবো তোমাকে। তোমার সাহস কীভাবে হয় অন্য পুরুষের কথা ভাবো তুমি? তুমি আমার স্ত্রী। সে মর্যাদায় থাকো।”

বাহু এত শক্ত করে ধরায় ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে কবিতা। সে কাঁপানো গলায় বলল, “তুমি করতে না। তুমি কখনোই আমাকে মাফ করতে না। আমাকে মেরে ফেলতে তুমি। তাহলে তুমি কীভাবে বলো যেন আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেই? কীভাবে? তুমি বারবার আমাকে কষ্ট দিয়েছ, আর আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। তোমার মনে হচ্ছে এটা তোমার প্রথম ভুল। না, এটা তোমার প্রথম ভুল না। তুমি এবং তোমার মা গত ছ’বছর ধরে আমার উপর মানসিক অত্যাচার করেছ। আর আজ তো শারীরিক আঘাত করতেও পিছ’পা হলে না তুমি।”

তীর্থ ছেড়ে দেয় কবিতার বাহু। সে নিজের উপরই অবাক হয়। সে কবিতার উপর হাত তুলেছে? মাথা ঠিক ছিলো না তার। সে কি করছিলো তাও বুঝতে পাড়ছিলো না। তার দৃষ্টি যায় কবিতার গালের দিকে। তার ফর্সা গাল লালচে হয়ে গেল। যেন রক্ত জমে গেছে। তা দেখে বুক কেঁপে উঠলো তীর্থের। সে কাঁপা-কাঁপা হাতে কবিতার গাল ছুঁয়ে দেখল। তারপর তাকাল কবিতার দিকে। তার চোখের জল দেখে আগের মতোই অস্থির হয়ে পড়ে তীর্থ। কবিতার গালে আলতো করে হাত রেখে তার কপালে কপাল ঠেকায় তীর্থ। চোখ বন্ধ করে বলে, “কবিতা আমি জানি তোমার এই রাগের পিছনে আজও আমার জন্য ভালোবাসা আছে। আর আমি যে তোমার উপর হাত তুলেছি এর পিছনেও আমার ভালোবাসা আছে। আমি তোমার মুখে এসব কথা কীভাবে সহ্য করি বলো? তোমাকে ছাড়া আমার জীবন শূন্য হয়ে গেছে। আমি এলোমেলো হয়ে গেছি তোমাকে ছাড়া। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি নি। আমার কিছুতেই শান্তি লাগছে না। আমাদের ভালোবাসার দোহাই দিলাম, ফিরে আসো আমার কাছে।”

কবিতা তীর্থের বুকের হাত রেখে আলতো হাতেই তাকে দূরে সরায়, “তোমার মনে আছে আমি বিয়ের আগে একবার বলেছিলাম। তোমার সব আঘাত আমি সহ্য করতে পারবো তোমার ভালোবাসার খাতিরে, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা না। যেখানে তুমি আমার বিশ্বাস ভাঙতে এক মুহূর্তও লাগালে না সেখানে ভালোবাসা কীসের? আর তোমার এখন আমাকে কেন প্রয়োজন? অন্য মেয়ের বাহুতে তোমার শান্তি ছিলো। তার কাছে যাও। তুমি আমায় ভালোবাসলে অন্যমেয়ের কাছে শান্তি খুঁজতে যেতে না। ভালোবাসলে, সে শান্তির জন্য আমার প্রয়োজন হতো তোমার। তীর্থ দয়া করে তুমি যাও এইখান থেকে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না প্লিজ। তোমাকে আমি যত দেখছি ততই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
“কবিতা…” তীর্থ আবারও কবিতাকে ছুঁতে নিলেই কবিতা তার দুই কানে হাত ধরে হাহাকার করে উঠে, “প্লিজ যাও। যাও এখান থেকে। আমার জীবন থেকে চলে যাও।”

কবিতা সে অবস্থাতেই মেঝেতে বসে পড়ে। কানে হাত রেখে, চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। তীর্থ একটু এগিয়ে ছুঁতে যায় কবিতাকে। কিন্তু কেন যেন স্পর্শ করতে পারে না। সেখানেই স্থির হয়ে সে দাঁড়িয়ে রয় কিন্তু মুহূর্ত। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা উঠে তার। তারপর চলে যায়।

কবিতা বসে রয় সেখানে। সএ আর নিজেকে সামলাতে পাড়ছে না কেন? আজই কেন তার নরম পড়তে হলো তীর্থের সামনে। সে যত অতীত থেকে দূরে যেতে যায়, তার অতীত ঘুরেফিরে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
কেন?
.
.
অফিস থেকে বের হতেই আজ আইদ কল দিলো মৃণাকে। মৃণা বারবার তার থেকে সময় চাইছে। আজ একসাপ্তাহ। দুইদিন বলে একসাপ্তাহ পাড় করলো সে। আর সময় কীভাবে দেয় সে?
মৃণা কল ধরতেই আইদ জিজ্ঞেস করে, “আর কত সময় লাগবে তোমার?”
ফোনের ওপাশ থেকে কিছু সময় নীরবতা পালন হলো। তারপর মৃণা আমতা-আমতা করে বলল, “আরও দুইদিন সময় দেও। আমি মা বাবাকে সব বল দিব।”
“দুইদিন দুইদিন করে আটদিন হলো। আর কত? ”
“তুমি কি ভাবছো বলাটা এত সহজ? আমি আমার মা বাবাকে কীভাবে বলি যে আমি বিয়ের আগের থেকে প্রেগন্যান্ট। আর যার বাচ্চার মা হতে চলছি সে আমাক আপন করে নিতে রাজি না।”
“যে মেয়ের এসব করতে লজ্জা লাগে নি তার বলতে লজ্জা লাগছে?” তাচ্ছিল্য হাসে আইদ। আবার বলে৷ “তুমি না বললে আমি আগামীকাল আসছি। আমি তাদের সব সত্য বলব। সাথে তোমার নষ্টামির প্রমাণও দেখাব।”
“আইদ আমার কথা তো শুনো…” আইদ ফোন কেটে দিলো। মৃণার কথা শোনার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। আজ এমনিতেও অফিসে অনেক কাহিনী হয়েছে। তার চাকরি হাতছাড়া করতে করতে বাঁচল সে। তার সন্দেহ এই সকল কাজ তীর্থের। সম্ভবত তীর্থ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার চাকরিটা থেকে তাকে বের করতে চাচ্ছে। ভাগ্যিস তা হলো না।

আইদ তার বন্ধুদের সাথে একটু ঘুরতে গেল। শান্তির জন্য। মৃণার কারণে আজকাল সবকিছুই অসহ্য লাগে তার। এর মধ্যেই কয়বার ফোন বাজলো। সে দেখে মৃণা কল করছে। মৃণার কল দেখে ফোন সাইলেন্ট করে রাখে সে। রাতে একটু দেরি করেই আইদ বাসায় ফেরে। দরজায় তালা লাগানো। বাসায় কাওকে না পেয়ে ফোন বের করে দেখে তার মা’য়ের সাথে মৃণা এবং ওর মা’য়েরও কতগুলো মিসকল। একটু ঘাবড়ে যায় আইদ। সে সাথে সাথে কল ব্যাক করে তার মা’কে।

“তুই…তুই কোথায় ছিলি? কতক্ষণ ধরে তোকে কল করছি আমি?” রাগান্বিত স্বরে বলে আইদের মা।
আইদের ভয় বাড়ে, “মা সব ঠিক আছে তো? আর তোমরা কোথায়?”
“আমরা হাস্পাতালে। মৃণার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে। জলদি আয় তুই।”

চলবে…

★ইনশাআল্লাহ আগামীকাল আরেকটা পর্ব দিব।★

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here