মুহূর্তে পর্ব-৪৫

0
621

#মুহূর্তে
পর্ব-৪৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তাড়াহুড়ো করে বাসা চেঞ্জ করেছে অনু এবং কবিতা। কাব্যের অসুস্থতার পরে হাস্পাতাল থেকে বাসায় যেতেই অনুর ভাবি তাদের অনেক ভালো মন্দ কথা শোনাতে থাকে। অনু এটাও জানতে পারে যে কাব্যের এত অসুস্থ্য থাকা সত্ত্বেও তার ভাবী বাচ্চাটাকে এভাবে ফেলে রেখে আরামে টিভি দেখছিল। কথাটা শুনতেই অনুর মেজাজ বিগড়ে যায়। সে ভেবেছিল আগামী মাসেই বাসা চেঞ্জ করবে। কিন্তু এসব কান্ড দেখে সে নতুন বাসাতে উঠার চিন্তা করেই নিলো। তার অফিসের যাওয়ার রাস্তায় একটি নতুন বিল্ডিং হচ্ছে। যদিও কাজ এখনো শেষ হয় নি কিন্তু নিচে এক পরিবার থাকার মতো ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালাও এই বিল্ডিংয়েই থাকে। কয়েকদিনে বিল্ডিংয়ে অন্যান্য পরিবারও এসে পড়বে। এক সাপ্তাহের মাঝে এই জায়গাটাই খুঁজে পেল সে। সকাল থেকেই তার ঘর পরিবর্তনের কাজে ব্যস্ত। অনু বিকেলে জোর করে আইদকেও নিয়ে এসেছে তাদের সাহায্য করতে। যদিও সে বলেছে তাদের সাহায্যের জন্যই আইদের এখানে আনা। তবে কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আইদকে আনার একমাত্র কারণ হলো মৃণা। অনু চায় না আইদ সারাটাক্ষন মৃণাকে সামনে দেখে কষ্ট পাক। প্রতিদিন সে অফিসের কাজে বাহিরে থাকলেও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তো কারণ ছাড়াই বের হতে পারে না।

ঘর গুছানো প্রায় শেষ। আসবাবপত্র তেমন বেশি নেই বলে সময় কম লাগলো। কাজ শেষে অনু বিছানায় বসে হাফ ছাড়লো, “উফফ কাজ করতে করতে হয়রান হয়ে গেলাম।”
আইদ সে রুমেই দাঁড়িয়ে ছিলো। অনুর কথা শুনে সে চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “কি কাজ করলে তুমি শুনি? সব কাজ আমি এবং কবিতা আপুই করলাম। তুমি বসে শুধু খাচ্ছিলে এবং বাচ্চাদের সাথে খেলছিলে।”

কবিতা কুহুকে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিলো। আইদের কথা শুনে সে মৃদু হাসে।
অনু মুখ ফুলিয়ে বলে, “তোদের দিয়ে কাজ করানো একটা কাজ না? আর তুই কবিতাকে আপু ডাকলে আমাকে আপু ডাকিস না কেন? আমি কবিতা থেকে সম্পূর্ণ আড়াই মাস বড়।”
“আপু ডাকার মতো কোনো কাজ করেছ? সারাক্ষণ কানের নিচে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকো। আমি তো তাও তুমি করে ডাকি, তুমি তো আমাকে তুই-তারাকি ছাড়া কথায় বলো না। আর কবিতা আপুকে দেখো কত শান্ত।”

এই কথা শোনার সাথে সাথে অনু তাড়াহুড়ো করে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো সামনে। চোখ দুটো এমনভাবে বের করে আইদের তাকাল যেন এমন আজব কথা আগে কখনো শুনিনি। গলায় জোর দিয়ে বলল, “এই মেয়ে আর শান্ত? আমি তোকে বলি, ছোটবেলা আমার মত শান্তশিষ্ট মেয়ে একটাও ছিলো না। এই মেয়েটাই আমাকে বদ বানিয়েছে। বদমাশি কাকে বলে, কত প্রকার, ও কি কি সব ওর থেকেই জানা যেত। বিয়ের পর ওই তীর্থের জন্যই না….” এতটুকু বলতে বলতে থেমে যায় অনু। শেষের বাক্য বলাটা বোকামি ছিলো তার। তীর্থের নাম শুনতেই পরিস্থিতিটা থমথমে হয়ে যায়। কবিতা এবং আইদ দুইজনের মাঝে অসস্তি ছড়িয়ে যায়। অনুর নিজের উপরই রাগ উঠছিলো। যে কোন দুঃখে বলতে গেল এই কথাটা?

কলিংবেল বাজল। অনু বলে, “আমি দেখছি।”
কবিতা থামায় তাকে। উঠে বলে,” কুহুকে খাওয়ানো শেষ। আমি এমনিতেই ওদিকে যাব। আমি দরজা খুলে দেখছি।”
কবিতা রান্নাঘরে প্লেট রেখে গিয়ে দরজা খুলে। দরজার বাহিরে কথনকে দেখে একটু চমকে যায় সে, “আপনি এখানে?”
“আসা মানা হলে আমি চলে যেতে পারি।”
“না না, আমি সেভাবে বলিনি। আপনার আজ এনগেজমেন্ট ছিলো। তাহলে আপনি তা ছেড়ে এখানে যে?”

কথন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “এখন কিসমত খারাপ না আমার কী করার বলো? বিয়ে ঠিক হলেই মেয়ে ছেড়ে চলে যায়। প্রথমে তুমি ছ্যাঁকা দিয়ে চলে গেলে, এরপর আজ এনগেজমেন্টের দিন মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেল।”
“বলেন কি?” চিন্তিত সুরে বলে কবিতা, “আপনি ঠিক আছেন তো?”

কথন বুকের বাশ পাশে হাত রেখে বলল, “ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে আছি। তাই সোজা হবার জন্য তোমাদের কাছে চলে এলাম।” কথন অনুমতি না নিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। আর সামনে বলতে থাকলো, “মেইনলি ঘরে সবাই সেন্টিমিন্টাল হয়ে আছে। সেখানে থাকলে সবাই অকারণে সান্ত্বনা দিয়ে দিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিতো। তাই তোমাদের সাথে গল্প করতে চলে আসলাম। বিশেষ করে কাব্যের সাথে খেলতে। প্রথমে গিয়েছিলাম অনুর বাসায়। সেখানে একটি মহিলা আমাকে দেখে যেমন করে মুখ বানালো যেন জীবনে মানুষ দেখে নি। তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে তোমরা বাসা চেঞ্জ করেছ আজই। হাস্পাতালে যেয়ে অনুর নাম্বার পেলাম, তারপর অনুর থেকে ঠিকানা নিলাম। চিন্তা করো তোমাকে খুঁজতে কত কষ্ট করতে হয়েছে আমার।”
কবিতা দরজা বন্ধ করে প্রথমের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সুরে আবারো জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি সত্যি ঠিক আছেন?”
“বেঠিক থাকার কি হলো? এমনিতেও জান্নাতের সাথে আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছা ছিলো না। মা’য়ের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের জন্য করতে হলো। এখন শান্তি আর শান্তি।”

কবিতা কিছুই বুঝতে পারছিলো না। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনার এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে গেছে আপনার কিছুই আসে যায় না?”
“আসে যায় তো। এ-কারণেই তো কেক নিয়ে এসেছি। সবাই মিলে কেক খেয়ে উৎযাপন করবো। তোমাদের নতুন বাসায় উঠার উপলক্ষে মিষ্টিমুখও হয়ে যাবে। আসো।”
কবিতা বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো কথনের রুমে যাওয়ার দিকে। তার পিছু গেল সে। রুমে যেয়ে দেখে অনু কথনকে আইদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। পরিচয় করানোর পর আইদ বলে, “আপনার কথা বলেছিলো অনু।”
“তোমার কথা আমাকে বলে নি। তোমরা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড না’কি?”
কথাটা শুনে হকচকিয়ে গেল আইদ। অনু স্বাভাবিক গলাতেই বলে, “ভাইয়া দশদিন হবে বন্ধুত্ব হয়েছে। উল্টাপাল্টা চিন্তা করেন না। আমাদের ফ্রেন্ডশিপও সেই লেভেলের ট্রাজিক ছিলো।”
“ট্রাজিক কীভাবে?”

অনুকে কিছু বলতে দেয় না কবিতা। ব্যাপারটা মহলটাকে আরও বিদঘুটে করে তুলবে। সে বলে, “এসব কথা পরে হোক। আগে বলুন কে কে চা খাবেন?”
সকলেই হ্যাঁ বলল। কবিতা রান্নাঘরে গেল চা বসাতে। সাথে নুডলস রান্না করার জন্য পানিও বসালো। কিছুক্ষণের মধ্যে কথনও সেখানে এসে হাজির, “একগ্লাস পানি হবে?”
কবিতা তাকে পানি দেয়। কথন রান্নাঘরের তাকে বসে পানি পান করে। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে, “তুমি হঠাৎ তখন কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলে কেন?”

কবিতা তার দিকে তাকাল না। নিজের কাজ করতে করতে বলল, “বিষয়টা কমপ্লিকেটেড। তীর্থ যে মেয়ের সাথে পরক্রিয়া করেছিল, সে মেয়ের সাথে এই আইদের বিয়ে হয়েছিলো। তখন মৃণা প্রেগন্যান্ট ছিলো বলে বিয়েটা খারিজ মানা হয়। কিন্তু বিয়ে খারিজ হলেই তো আর কষ্ট খারিজ হয়ে যায় না। তাহিরা আপুর কথানুযায়ী আইদ স্বভাবতই শান্ত ছেলে এবং খুবই ভালো। এমন লোকেরা সহজে নিজের কষ্ট প্রকাশ করে না। তাই আমিই বলেছিলাম অনুকে ওর খেয়াল রাখতে। যেহেতু ওরা একই অফিসে কাজ করে। ও আইদের সাথে বন্ধুত্ব করে ভালোই করলো।”
“তোমার এতে অস্বস্তি লাগে না? মানে আইদকে দেখলে।”
“আমার আজকাল জীবনের প্রতি মুহূর্তই অস্বস্তিকর লাগতে। এর মানে আমি নিজের জীবন তো শেষ করে দিতে পারি না। তাই না?”
কথাটা বলে কবিতা কথনের দিকে তাকিয়ে ছোট মিষ্টি এক হাসি দিলো।

কথাটা শুনে কথনের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। যতটা না কথা তাকে প্রভাবিত করে, এর থেকে বেশি এই ভেবে সে কষ্ট পায় যে সে কোনো ভাবেই কবিতার কষ্ট দূর করতে পারবে না। আজ কবিতার হাসিটাও তার হৃদয়ে সুঁইয়ের গাঁথার মতো ব্যাথা দিচ্ছে। তবে সে নিজের এই হতাশা প্রকাশ করল না৷ কবিতার কষ্ট সে না দূর করতে পারলেও কিছু মুহূর্তের জন্য তার ঠোঁটের কোণে হাসি তো আনতে পারবে।

কথন বলল, “তোমার আমাদের প্রথম দেখা মনে আছে? তোমার জন্য আমি শিল্পা ম্যামের কাছ থেকে প্রথমবার বকা খেয়েছিলাম। ”
কবিতা আপত্তিকর মনোভাব পোষণ করল, “একদম না। সব দোষ আপনার ছিলো।”
“দেখো কবিতা মিথ্যা বলবে না। তুমি লিটিলারি বিনা মগজের মেয়ে ছিলে সে সময়।”
“মুখ খুলাবেন না একদম। পাগলের মতো সকল কাজ আপনার ছিলো। আর আপনি আমাকে একবার আসলে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন আমি কখনো ভুলবো না।”
কথনের সেদিনের মনে করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়া অবস্থা, “আমারও মনে আছে। ও বন্ধু ছিলো আমার। তোমার বকা শুনে পালিয়ে গিয়েছিলো আর আমার সাথে যোগাযোগ করে নি।”

কথার তালে কবিতা অমনোযোগী হয়ে গরম পাতিলে ধরতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে নিলো। সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিলো সে। ফুঁ দিতে থাকলো।

কথন কবিতার এমন কান্ড দেখে আঁতকে উঠে। লাফ দিয়ে তাক থেকে নেমে কবিতার কাছে যায়। তার হাতটা ধরে বলে, “মাথা নষ্ট না’কি? খালি হাতে কেউ গরম পাতিল ধরে?”
কথন সাথে সাথে ট্যাপ কল ছেড়ে ঠান্ডা পানির নিচে তার হাত রাখে। আবারও বকা দেয় কবিতাকে, “কাজ করার সময় দেখে করতে পারো না? ইশশ কতখানি পুড়ে গেছে।”
কবিতা হাত সরানোর চেষ্টা করে বলল, “অসুবিধা নেই। আমি ঠিক আছি।”
কথন আরও রেগে যায়। ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে। আবারও কবিতার হাত পানির নিচে রেখে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি বলতো বেশি ব্যথা করছে না তো?” বলে আবারো তাকায় কবিতার দিকে। চোখে চোখ মিলে। হয় কিছু মুহূর্তের নয়ন বন্ধন। তীব্র গতিতে বাহির থেকে হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিয়ে যায় কবিতা কৃষ্ণ কেশ।

কথন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে কবিতার দিকে। এত বছর কবিতা দেখতে অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি তো তার মুখের মায়া। সে হাত বাড়িয়ে কবিতার চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজতে নিলেই কবিতা পিছিয়ে যায়। খানিকটা অস্বস্তি তার মুখে ভেসে উঠেছে। সম্ভবত তার ছোঁয়াটা কবিতার পছন্দ হয় নি।

কথন নিজেকেই সংযত করে নেয়। সে কবিতাকে বলে, “তোমার রান্না করার প্রয়োজন নেই, আমি করছি।”
“আপনি?” অনেকটা অবাক হয়ে বলে কবিতা।
“কেন আমি করতে পারি না? তোমার থেকে মজা করে রান্না করে দেখাব। যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”
“না না, প্রয়োজন নেই।”
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি মনে মনে ভাবছ আমি রান্না করলে কেউ খেতেই পারবে না। এখন তো আমিই রান্না করে দেখাব।”
কথন কবিতা একপাশে দাঁড় করিয়ে বলল, “এখানে দাঁড়াও এবং আমাকে মাস্টারশেফের মতো খাবার রান্না করতে দেখ।”
কথন নিজে রান্না করছিলো। খানিক সময় পর অনুও এসে তাকে সাহায্য করে। কবিতা চলে যায় বেডরুমে কুহুর খেয়াল রাখতে।

হঠাৎ করেই অনু জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া আপনি কী কবিতাকে এখনো পছন্দ করেন?”
কথন সবজি কাটছিলো। অনুর কথা শুনে খানিকটা হকচকিয়ে যায় সে। অনু আবারও বলে, “আমি আট বছর আগে থেকেই জানি যে আপনি কবিতাকে পছন্দ করেন। আপনার ওর প্রতি সকল যত্ন দেখেই তা স্পষ্ট বুঝা যায়। কবিতা এমন মেয়ে না যে কোনো ছেল তাকে পছন্দ করবে কিন্তু সে বুঝবে না। কিন্তু আপনার বেলাতেই ও কি করে যে বুঝেতে নি তা আমার মাথায় ঢুকে না।”
“ওর দোষ নেই। আমি এমন একজন মানুষ যে মনের কথা বলতে সংকোচবোধ করে না। তবে কবিতার ক্ষেত্রে বিপরীত হলো। আমি ওকে কিছুতেই নিজের মনের কথা জানতে দিতে চাই নি। এর কারণটা আমি জানি না। কিন্তু খুব সংকোচবোধ হতো। অবশ্য না বলে ভালোই করলাম, তখন কবিতা তীর্থের সাথে সম্পর্ক ছিলো।”
“আর এই কথা কে বলল আপনাকে? বিয়ের একমাস আগে দুইজনে সম্পর্কে জড়িয়েছে। আমার যতটুকু মনে হয় কবিতা সে সময়েই তীর্থকে গভীরভাবে ভালোবাসা শুরু করেছিলো। প্রথম যখন তীর্থ তার ভালোবাসা প্রকাশ করে তখন কবিতা নিজেও কনফিউজড ছিলো। কারণ ও নিজের অনুভূতি নিজেই জানতো না। কিন্তু তার প্রতি তীর্থের ভালোবাসা…সরি মিথ্যে ভালোবাসা দেখে সে মুগ্ধ হয়েছিলো। আপনি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করলে সম্ভবত ওর ভালোবাসার মানুষ হতে পারতেন।”

অনুর কথা শুনে খুবই হতাশ হয় কথন। এই কারণে যে সে কবিতাকে পেতে পারতো, বরং এই কারণে যে অতীতে সে তার অনুভূতি প্রকাশ করলে হয়তো আজ কবিতাকে এত কষ্টের সম্মুখীন হতে হতো না।

অনু আরও বলে, “কী আজব কান্ড তাই না? সেসময় তীর্থ চুপচাপ ব্যক্তি ছিলো যে কখনো নিজের অনুভূতির প্রকাশ করতো না, কিন্তু সে কবিতার কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে একটুখানিও দ্বিধা বোধ করলো না। অন্যদিকে আপনি, সব সময় নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন অথচ কবিতার বেলায় আপনার অনুভূতিগুলো অপ্রকাশিতই থেকে গেল। আচ্ছা একটি প্রশ্নের উওর দিবেন? আপনি কবিতাকে ভালোবাসেন বলেই কি আজও অন্যকাওকে বিয়ে করেন নি?”
কথনের বুক চিরে হতাশার নিশ্বাস বের হয়। সে তার কাজে ধ্যান দেয়। মৃদু হেসে উওর দেয়, “সম্ভবত।”

অনু খানিকটা দ্বিধাবোধ করে আবারও জিজ্ঞেস করে, “কবিতা ডিভোর্সের জন্য আমার সাথে পরামর্শ করছিলো দু’দিন আগে। উকিলের সাথে কথা বলতে বলেছে আপনি কি….” অনুর কথার শেষ হবার পূর্বেই কথন তার কথা ধরে নেয়। বলে, “না, আপাতত আমার ওকে পাওয়ার মতো কোনো ইচ্ছা নেই। আমি কেবল ওর সাথে থাকতে চাই। একটা বন্ধু হিসেবে। আমি চাই না আমার অনুভূতি প্রকাশ করে এই খারাপ সময় পাশে থাকার সুযোগ দাও আমি হারিয়ে ফেলি। এছাড়া এখন ওর নিজেকে চেনার সময়, নিজেকে গড়ে তোলার সময়। আমি এই সময় ওকে কোনো বাঁধনে আবদ্ধ করতে পারি না। আর আমি জানি ও তা দিবেও না। ও অনেক বড় ঠোকর খেয়েছে। এরপর ও কাউকে সহজে ভালোবাসতে পারবে না। আমি এক বন্ধু হয়ে ওর পাশে থেকেও ওকে ভালোবাসতে পারি, ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারি। কিন্তু ওর এই লড়াইয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারি না।”
কথনের উওরে ভীষণ সন্তুষ্ট দেখায় অনুকে।

অনু এবং কথন চা, নুডুলস রান্না করে ভিতরে নিয়ে যায়। সকলে খাবার পর কথন নিজেই নিজের প্রশংসা করে, “আহ কি রান্না করলাম আমি। একদম মাস্টারশেফ লেভেলের।”
অনু বলে, “ভাইয়া আমি আপনার হেল্প করেছি কিন্তু।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ বোন। আমি হেড শেফ আর তুই সু-শেফ। আমার মনে হয় আমাদের এই ডাক্তারি এবং অফিসের কাজ ছেড়ে বড় কোনো রেস্টুরেন্টে শেফ হিসেবে কাজ করা উচিত।”
“মনের কথা বলছেন ভাইয়া।”

আইদ হতদম্ব হয়ে একবার তাদের দিকে তাকায়,আবার তাকায় নুডুলসের দিকে, “এটা কেবল ম্যাগি নুডুলস। ম্যাগি নুডিলস রান্না করে শেফ হওয়া যায় না।”
অনু কাঁটা চামচ আইদের মুখের সামনে ধরে বলে, “দেখ বেশি কথা বলিস না। এই রান্নার সাথে আমাদের ইমোশন জড়িত। খেয়ে এখনই বলবি যে শেফমার্কা রান্না হয়েছে।”
“শেফমার্কা আবার কী?”
কবিতা হাসতে হাসতে উওর দেয়, “অর্থাৎ শেফ রান্না করেছে এমন।”

আইদ কিছু বলতে নেয় এর পূর্বেই তার ফোন বেজে ওঠে। সে ফোন পকেট থেকে মৃণার কল দেখেই তার চোখেমুখে উদাসীনতা ছড়িয়ে যায়। এই হাসি ঠাট্টার মহলটা বিদঘুটে লেগে উঠে তার। অনু তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় হারিয়ে গেলি তুই? কে কল করছে?”
কবিতা মৃণার নাম নিয়ে কারও খুশি নষ্ট করতে চায় নি। তাই বলল, “একটা এলাকার বন্ধু কল দিয়েছে। আমি কথা বলে আসি।”

আইদ উঠে বারান্দায় গেল। কল ধরে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, “কল দিচ্ছো কেন?”
“কোথায় তুমি? এখনো বাসায় আসছো না কেন?”
“আর তোমাকে আমার উওর দিতে হবে কেন?”
ফোনের ওপাশ থেকে মৃণা কঠিন গলায় বলে, “আমি জিজ্ঞেস করছি তাই উওর দিতে হবে।”
“কে তুমি শুনি?”
“আমি তোমার….” সামনে বলতে পারে না মৃণা। থেমে যায় সেখানেই।
“তুমি আমার কেউ না। দেখো মৃণা তোমাকে আমার বাসায় কেবল এইজন্য থাকতে দিয়েছি কারণ আংকেলের মৃত্যুর পর আন্টির অবস্থা খারাপ। তোমার কুকর্ম আমি তাকে এই মুহূর্তে শোনাতে চাই না। তুমি ক’দিনের মেহমান মাত্র সে ঘরে। তাই নিজের সীমানা থেকে কথা বলো। আর তা না পারলে নিজের আশিকের কাছে যেয়ে হক জমাও। ওহ সরি, আমিও কি বলছি সেদিন তো সে তোমায় ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বাহির করে দিয়েছিলো।”
ওপাশ থেকে মৃণার কোনো উওরই শুনতেই পারছিলো না আইদ। এমন সময় অনু দরজার কাছে এসে বলল, “কি’রে আর কতক্ষণ লাগবে তোর? চা ঠান্ডা হয়ে গেল।”
“তুমি যাও, আমি আসছি।”

এবার মৃণার কন্ঠও শোনা গেল, “তোমার সাথে কোনো মেয়ে আছে?” তার কন্ঠ ক্ষোভে ভরা।
“নন অফ ইউর বিজনেস।”
“উওর দেও আইদ।”
“তোমাকে জবাব দেবার প্রয়োজন আমি বোধ করি না। আর একবার কল দিলে তোমার জন্য অনেক খারাপ হবে।”
কল কেটে দেবার পূর্বে মৃণা আবার বলল, “তোমার সাথে যে মেয়ে আছে সে আমাকে নিয়ে তোমার কান ভরছে তাই না? তুমি কখনো এমন ছিলে না আইদ। তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছ?”
মৃণার কোনো কথা শোনার রুচি তার হলো না। এ-কারণে কল কেটে দিলো সে।

চলবে…

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here