মুহূর্তে পর্ব-৪৯

0
778

#মুহূর্তে
পর্ব-৪৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“সব মাইয়াগো এগুলো সহ্য করতে হয়। বাচ্চাকাল থেকে এগুলো শিখা উচিত।”
তীর্থের মায়ের এমন কথায় হাসে কবিতা, “এটাই তো সমস্যা। মেয়েদের শুধু সহ্য করা শেখানো হয়। সাহস করে লড়াই করা নয়। আমাকেও তাই শেখানো হয়েছিল। তাইতো এত বছর আপনার মানসিক অত্যাচার সহ্য করেছি।”
এই কথায় চড়ে উঠে তীর্থের মা, “ওই মাইয়া তুই এসব কি বলোস? আমি তোর উপর অত্যাচার করছি?”
“কন্ঠ উঠিয়ে কথা বলবেন না। এটা আমার বাসা, আপনার ছেলের না। আর না আমি আপনার ছেলের বউ। আর আপনার তো সম্মান করার মতো কোন কারণ আমার কাছে নেই। আপনার বয়সের মর্যাদা রাখছি কেবল, নাহলে আপনি আমার সাথে এত বছর যা করেছেন তার পরিণাম অনেক খারাপ হতো। আর যদি একটা কথা বলেছেন তাহলে বলে দিচ্ছি, যৌতুক চাওয়ার জন্য তো আইনও শাস্তি দেয়। আপনি সম্ভবত তা জানেন না। তাইতো আমাদের প্রতিবেশী সবার সামনে বলতে থাকেন যে আমার বাসা থেকে আপনাকে কিছু দেয় নি। তারপর কতগুলো খোঁটা শোনান। অকথ্য ভাষায় কথা বলেন। আরে আমার তো মাথায় এ ব্যাপার আগে আসে নি। আপনার ছেলের সাথে আপনাকেও জেলে পাঠালে কেমন হয়? তারপর দুই মা ছেলে জেলে বসে পিকনিক করেন। এখন আর বেইজ্জতি করাতে চান, না এখানেই এই কথোপকথনের সমাপ্তি ঘটাব?”

তীর্থের মা উঠে দাঁড়ায়। নাক ফুলিয়ে কবিতাকে বলে, “তোমারে… তোমারে তো আমি পরে দেইখা নিব।”
“আমার কথা মতো না চললে ক’দিন পরে এমনিতেই পুলিশথানায় দেখা হবে।”
তীর্থের মা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না রাগে হনহনিয়ে চলে যায়।

তীর্থের মা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বাসায় ঢুকে বলে, “ওই মাইয়ার কথা ভুলে যা। আর ওর কথা ঘরে তুলবি না।”
বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই মা’য়ের মুখে এই কথা একটু থতমত খেয়ে যায় তীর্থ। সে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে?”
“কী হইসে? ওই মাইয়া আমারে হুমকি দেয় ওরে তালাক না দিলে আমগোরে জেলে ভরবো। তুই যে ওরে কাল মারসোস তার কেস কইরা।”
তালাকের কথা শুনে তীর্থের বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে।
কবিতা তাকে ছেড়ে যাবার পর তালাকের বিষয়টা স্বাভাবিক হবার কথা ছিলো। তবুও কথাটা বিশ্বাস হলো না তার। সে বলল, “তুমি মিথ্যা বলছো। কবিতা আমাকে তালাক দিতে পারে না। এটা অসম্ভব।”

“তোরে ছাইড়া গেছে এতদিন হইসে। ওই মাইয়া নাকি চাকরিও নিসে। মানে তোর কাছে ফিরা আসার ওর কোনো ইচ্ছা নাই। তাও এই কথা কস?” মা তীর্থের কাছে যেয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই চিন্তা করবি না। ওর চেয়ে সুন্দর মাইয়ারে তোর বউ কইরা আনমু।”
তীর্থ এক ঝাড়ন দিয়ে তার মা’য়ের হাত সরিয়ে দিলো। বলল, “তুমি ওখানে যেয়ে ওকে উল্টাপাল্টা কথা বলে এসেছ তাই না? যেন ও আমার কাছে না ফিরে।”
“আমি এমন কেন করমু?”
“কারণ তুমি সবসময় চাইতে যেন কবিতা আমার জীবন থেকে চলে যাক। এখন খুব খুশি তুমি তাই না? তোমার ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে। কবিতা আর আমার জীবনে থাকতে চায় না। আমাকে এভাবে দেখে তো তুমি আরও খুশি।”
তীর্থের মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। যে তীর্থ আজ পর্যন্ত তার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলে নি সে আজ তার সাথে এত বেয়াদবি করছে?
যেন এতটুকু তার জন্য অবাক করার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। এর থেকে বেশি অবাক কান্ড দেখলো সে। তীর্থের চোখের পানি দেখে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। তীর্থের বাবা যখন তাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন তখন তীর্থ বারো বছরের ছিলো। সেদিন শেষ কান্না করতে দেখেছিলেন তিনি তীর্থকে। এরপর আজ, এতবছর পর আজ তিনি তীর্থকে কান্না করতে দেখছেন। এক মুহূর্তের জন্য তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না।

তিনি আবার তীর্থকে সামলাতে গেলে তীর্থ তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তিনি জিজ্ঞেস করে, “এই রাতে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
উওর দেয় না তীর্থ। বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। তীর্থের মা যেয়ে তার রুমে বসেন। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে তার। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। সন্তানের কষ্ট কোনো মা’য়েরই সহ্য হয় না। আজ ঘর পরিষ্কারের সময় অনেক সিগারেট ও মদের বোতল পেয়েছেন তিনি। তার অবাক হওয়ার সীমা থাকে না। তার ছেলে এইসব কবে থেকে শুরু করল?

এর উপর তার নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছে। সেও একটি কারণ তার ছেলের এই অবস্থার। হয়তো অতীতে কবিতার সাথে এত বাজে ব্যবহার না করলে আজ তার ঘরে এই অশান্তি হতো না। হয়তো। এই কথায় আরেকটি চিন্তা এলো তার মাথায়। কবিতাকে সে এত অপছন্দ করে কেন? মেয়েটি তো কখনো তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি। তাকে কখনো কষ্ট দেয় নি। উল্টো তার যত্ন নিতো, তার সব কটু কথা সহ্য করতো, তার সব বাজে স্বভাবও। তাহলে কেন সে কবিতাকে আপন করতে পারলো না?
অনেক চিন্তা করেও উত্তর পেলেন না তিনি।
.
.
অনু আসার পরে সে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে কবিতার সাথে। কবিতা বাচ্চাদের খাইয়ে জলদি ঘুম পড়িয়ে দিয়েছে। তাই আরামে খেতে বসে দুই বান্ধবীর গল্প করছে। কবিতা তীর্থের মা’য়ের সাথে সব কথোপকথন শুনায় অনুকে। অনু তো এসব শুনে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বিস্মিত গলায় বলল, “ভাই তুই আসলে এভাবে কথা বলেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“আমার তো এখন তার চেহারা দেখতে ইচ্ছা করছে। ভাই তুই আমার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলি না কেন?”
“এইসব বাদ দে, তুই আগে আমাকে এটা বল আমার কোন জামাই কোন দেশে আছে?”
অনু খাবার খাচ্ছিলো, কবিতার কথা শুনে তার কাশি শুরু হয়। সে পানি পান করে কবিতার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসে, “তুই জেনে গেছিস?”
“তুই জানিস আমার মেজাজ তখন যে খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তুই মিথ্যা বলতে গেলি কেন? আমার কত লজ্জা পড়তে হয়েছে তুই জানিস?”
“সত্যি বললে সবাই তোকে নিয়ে কথা বলতো। গবেষণা করতো। এসব নিয়ে মানুষের কত ইন্টারেস্ট তুই জানিস না? তোর জন্যই বলেছি।”
“যা বলার বলুক। আমার কিছুই আসে যায় না। এতকিছুর পর আমার আজকাল কোনো অনুভূতিই হয় না। তুই এরপর কাওকে মিথ্যা কথা বলবি না। বুঝেছিস?”
মাথা নাড়ায় অনু।

রাতের খাবার শেষে অনু বসে বসে টিভি দেখছিলো। এমন সময় এক আননোওন নাম্বার থেকে কল আসে। বিরক্ত হয় অনু। তবুও কল ধরে।
“হ্যালো, কে?”
“অনু বলছো? অনু, আমি আবির।”
আবিরের নাম শুনতেই অনু চমকে যায়। বিছানায় দাঁড়িয়ে পড়ে। বিস্মিত কন্ঠে বলে, “আবির ভাইয়া আপনি আমায় কল দিয়েছেন?”
“হ্যাঁ, একটা কথা ছিলো। প্লিজ তুমি কবিতাকে জানিও না।”
অনু নিজেকে সামলে আবার ঠিকমত বসলো, “হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন।”
“কবিতার পরিবারে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
কথাটা থমকে যায় অনু। সে কি বলবে? কবিতা তো তাকে আবিরকে সত্যটা বলার জন্য মানা করেছে। এমন সময় কবিতা থেকে ডাক দিলো। ফোনের মধ্যে কবিতার কন্ঠ শুনে আবির হয়ে ওঠে, “কবিতা তোমার বাসায়? আমি জানতাম কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। অনু সত্যি করে বল কি চলছে?”
“না না, এটা তো আমার রুমমেটের কন্ঠ। কবিতা আমার পাশে থাকবে কেন? ওর নিজের ঘর সংসার আছে।”
এমন সময় কবিতা আবারো ডাক দেয় তাকে। অনুর তো এই মুহূর্তে কাঁদতে মন চাইছে। কোথায় ফেঁসে গেল সে? সে বিরক্তি নিয়ে কবিতাকে জবাব দেয়, “আরে ভাই আসছি একটু অপেক্ষা কর।”

আবির ফোনের ওপাশ থেকে বলে, “আমি নিশ্চিত এটা কবিতার কণ্ঠ। সত্যি বলো অনু। কী হচ্ছে? আমি কবিতাকে না পেয়ে একদিন আগে ওর বাসার টি এন টিতে কল দিয়েছিলাম। একজন লোক ধরে বলল কবিতা কয়েক সাপ্তাহ ধরে সেখানে থাকে না। আমি একথা কবিতাকে জিজ্ঞেস করতে চায়নি কারণ ও কখনো আমাকে সত্যটা বলবে না। বলার হলে আগেই বলতো। দেখ অনু, এখন কেবল আমিই ওর অভিভাবক। ওর জীবনে কোন সমস্যার হলে আমার জানা দরকার।”

অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে আবির কে বলতে শুরু করল সকল ঘটনা। কথাগুলো সে এ-কারণে বলে না যে সে আবিরকে পছন্দ করে। বরং সে আগের থেকেই চাইতো কবিতা তার পরিবারের কারও সাথে দেখা করুক। তার আজকাল কবিতাকে নিয়ে ভারী চিন্তা হয়। মেয়েটা তার হৃদয়ের কষ্ট মেটায় না। কান্নাও করে না। স্বাভাবিক থাকে। এই স্বাভাবিক ভাবটাই তার মধ্যে ভয় জাগায়। সে চায় কারও সাথে নিজের কষ্ট শেয়ার করে তার মন হাল্কা হোক। সে বলেছিলো কবিতাকে, একটিবার তার পরিবারের সাথে যেয়ে যেন দেখা করে। সে যায় নি, উল্টো বলেছে, তীর্থ যেমন তার সাথে অপরাধ করেছে তেমনটা তারাও করেছে। সে যেয়ে তাদের মুখের থেকে এই কথা শুনতে পারবে না যে, তাদের কথা মানলে হয়তো আজ সে সুখে থাকতো।

কথাটা মিথ্যা নয়। অতীতে কবিতার পরিবার তার সাথে এমন কিছু করবে সে কল্পনাও করে নি। কবিতার রাগ তার কাছে জায়েজই মনে হয়।
.
.
বাহিরে তুফান ছুটেছে। তীব্র বৃষ্টি হচ্ছে। কবিতা সব কাজ সেরে ঘুমাতে যাবার আগে কয়েকবার ডাকলো অনুকে। মেয়েটা প্রতিদিন দেরিতে ঘুমিয়ে সকালে সময়ে উঠতে পারে না। কিন্তু সে অপেক্ষা করতে বলে আর আসলো না। কবিতা নিজে গেল ঘুমাতে। বিছানার কাছে যেয়ে তার দেখে ফোনের বাতি জ্বলছে। তীর্থ কল করেছো তাকে। ফোনের স্ক্রিনে তার নামটা দেখেই কবিতার দম আটকে আসলো। এত রাতে কী প্রয়োজন তার?

কবিতা কল ধরল না। কল শেষে ফোন হাতে নিয়ে দেখে অনেকগুলো মিসকল ও মেসেজ তীর্থের। সে এতটাও অবাক হয় না। সে আজ তীর্থের মা’কে যা বলেছে তার কারণে কল দিচ্ছে ধারণা হলো তার। আরেকবার কল আসায় তা শেষ হবার অপেক্ষা করে মেসেজ ওপেন করে পড়ে সে, “কবিতা বারান্দায় আসো একটু। আমি তোমার বাসার সামনে।”
কবিতা মেসেজটা পড়ে অবাক হয়। দ্রুত যেয়ে বারান্দার দরজা খুলে দেখতে পায় তীর্থ বাহিরে দাঁড়ানো। চারপাশের অন্ধকারে মাঝে একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে একটি গাড়ি দাঁড় করানো। সে গাড়িতেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে সে। তবুও দাঁড়িয়ে আছে।
কবিতার অবাক হওয়ার কারণ আছে। তীর্থ তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অথচ জোর করে বাসার ভিতরে ঢুকতে চায় নি এই ব্যাপারটা বিস্ময়কর।

তীর্থ তাকে দেখে এগিয়ে আসে কিছুটা। আবারও ফোন করে তাকে। কবিতা এবার ফোন ধরে। জিজ্ঞেস করে, “তুমি আবার কোন নাটক শুরু করেছ? আমার বাসার সামনে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছ তুমি?”
“কবিতা মা কি তোমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে? এ-কারণে তুমি আমার কাছ থেকে ডিভোর্স চাচ্ছো?”
“আমি গতকালও তোমার কার কথা বলেছি। ওহ সরি, তুমি তো নেশায় ডুবে ছিলে মনে থাকবে কি করে?”
“আমি তোমায় কষ্ট দিয়েছি তাই না? আই এম সরি কবিতা, আই এম সো সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে।”
“উফফ ভুল হয়ে গেছে, ভুল হয়ে গেছে। কতবার এই এক কথা বলে ক্ষমা চাইবে তুমি? ভুল একবার হয়, দুইবার হয়। হাজারবার না। আর আমি আগে থেকেই তালাকের কথা চিন্তা করছি। আমার এই সম্পর্কে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে।”
“জান প্লিজ আমার কথা শুনো, তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিও না। তালাক কোনো ছোট বিষয় না। তুমি আমাকে ভালোবাসো কবিতা। একথা তুমি অস্বীকার করতে পারবে?”
এই প্রশ্ন অনেক সময় ধরে চুপ থাকে কবিতা। ফোনের দুইপাশে নিরবতা। একসময় সে কাঁপানো গলায় উওর দেয়, “না, আমি অস্বীকার করতে পারবো না।”
“তাহলে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের দুইজনকে কষ্ট দিচ্ছো। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত লাগে, কিন্তু তার অনুতাপ সারা জীবনের থাকে।”

“যেমন তুমি এক মুহূর্তে অন্য মেয়ের কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার বিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে দিলে। না তুমি আমাদের সম্পর্কের মর্যাদা রেখেছ, আর না ভালোবাসার। জানো আমি কেন তোমার কাছ থেকে তালাক চাই? কারণ তোমাকে আমি যতবার দেখি ততবারই আমার মাথায় প্রথম ভাবনা আসে তুমি অন্য একটি নারীকে স্পর্শ করছো, তাকে ভালোবাসছো, তাকে….” দম আটকে এলো কবিতার। সে সম্পূর্ণ কথাটুকু শেষ করতে পারলো না। কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস ফেলে সে আবার বলে, “তোমাকে ভালোবেসে অথবা ঘৃণা করে, তোমার থেকে দূরে থেকে আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু তোমার কাছে থেকে আমি বাঁচতে পারবো না। বারবার ভেঙে পড়বো তোমার বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে করে। আমি তখন আর নিজেকে সামলাতে পারবো না। আমার মনে হয় কি জানো? তোমার কাছে থাকলে আমি নিজেকে শেষ করে ফেলতে পারি।”
শেষের কতটুকু দিতে বুকের ভিতর তুফান আনার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সে উন্মাদের মতো বলল, “এভাবে বলো না কবিতা। প্লিজ এভাবে বলো না। আমি সব ঠিক করে দিব।তোমার ভালোবাসা, বিশ্বাস সব ফিরিয়ে আনব।”
“একটি মানুষ ধোঁকা দিলে তাকে আবার ভালোবাসা যায়, তবে বিশ্বাস করা যায় না। আর বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসার মূল্য নেই। আর গতকালের পর থেকে তো আমি তোমার সাথে থাকলে সারাক্ষণ আতঙ্কিত থাকবো, তুমি কখন আমার সাথে জোর করো অথবা মদ খেয়ে মারধর করো আমায়।”
এখানেই চুপ হয়ে যায় তীর্থ। সে কিছু বলতে পারে না।

বারান্দা থেকে ছিটকে আসা বৃষ্টির পানি কবিতার চোখের অশ্রুজলের সাথে মিশে যাচ্ছিল। সে নিজেকে সামলে চোখ, মুখ মুছে। তারপর কঠিন গলায় বলে, “তোমার মা নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে তুমি তালাক না দিলে আমি কি করতে পারি। দেখ তীর্থ, আমি তোমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বলবো না যে আমাকে ভালোবাসলে তুমি ডিভোর্স দিয়ে দেও। না, কারণ আমার মুক্তি আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইবো না। আমি যা বলছি তোমার তা করতে হবে, নাহলে… ”
“নাহলে আমাকে জেলে পাঠাবে তাইতো? আমি রাজি। তোমার জন্য আমি সব করতে রাজি। সব কষ্ট সইতে রাজি।”
“তাই? এক পরিণাম জানো? তোমার স্বপ্ন, তোমার সাফল্য, তোমার ব্যবসা সব মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে। তুমি আমার জন্য এইসব বিসর্জন দিতে রাজি?”
কথাটা শুনে থতমত খেয়ে যায় তীর্থ। এভাবে সে চিন্তা করে নি। আসলেই তার জেলে যাবার খবর এলে তো তার সব শেষ হয়ে যাবে।

কবিতা তাচ্ছিল্য হাসে, “উত্তর নেই তোমার কাছে। কারণ আমার থেকেও তোমার কাছে তোমার ব্যবসা বেশি। এক মুহূর্তও তুমি তাই চিন্তা করছো।”
“এ-এমন কিছু না।”
“আমাকে মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই। তুমি ক’দিনের মাঝে ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে কেবল সাইন করে দিও। আর না করলে আইনগতভাবে আমার তালাকের দাবি জানানোর আরও উপায় আছে।”
ফোন কেটে দিলো কবিতা। তীর্থ উন্মাদের মতো কল দিতে থাকে কবিতাকে। সে এভাবে কবিতাকে হারাতে পারে না। সে পা বাড়ায় তার বাসায় যাবার জন্য। থেমে যায়। গতকালের পর তার সাহস হয় না। যদি আবারও সে যদি নিজের নিয়ন্ত্রণে না থাকতে পেরে কবিতাকে ব্যাথা দেয়?

কবিতা দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। তার চোখ দিয়ে ঝরলো কিছু বিন্দু দুঃখের জল। নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়ে সে। চোখ বন্ধ করে ফোনটা বুকে জড়িয়ে ধরে। তার বুকের কম্পন বাড়ে। হৃদয়ের জ্বলা বাড়ে।

রাতের নীরবতার মাঝে ভিন্নরমকের বিশেষত্ব আছে। রাতের নিরবতা তোমার আবেগ বাড়ায় ও সারাদিনের হাসিখুশি থাকার মিথ্যা নাটকটা বৃথা করে দেয় মুহূর্তেই।
.
.
দুইদিন কেটে যায়। কবিতা রীতিমতো অফিসে কাজ করছিলো। হঠাৎ তার ফোনে কল আসে। ধ্রুবর কল। সে খানিকটা অবাক হয়। এতদিন সে তাহিরাকে কল করে পায় নি। ভেবেছিলো এই শুক্রবারে তার বাসায় যাবে অনুকে নিয়ে।

কবিতা ধ্রুবর ফোন কেটে আবার তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে ধ্রুবর সাথে কথা বলে নিজের মেজাজ গরম করতে চায় না। আবারও ফোন আসে। বড় ম্যাডাম কাজ করছিলেন। দ্বিতীয়বার ফোনের শব্দ শোনে সে বলে, ” কলটা ধরো। অনেকসময় ইমাজেন্সি থাকে।”
ধ্রুবর তার সাথে জরুরী কী কথা থাকবে? সে-ই তীর্থকে নিয়েই সে বলবে। তবুও বড় ম্যাডামের কথায় সে কল ধরলো। রুমের এক কোণে যেয়ে বলল, “কী চাই বলেন।”
“কবিতা তুমি একটু হাস্পাতালে আসো, জলদি।”
কবিতা বিরক্তি নিয়ে বলে, “কোন দুঃখে? আপনি আর তীর্থ মিলে আবার কোনো নাটক পরিকল্পনা করেছেন? আপনাদের নাটক প্রদর্শন করার এত ইচ্ছা থাকলে থিয়েটারে যে করুন। আমার সময় নষ্ট করবে না।”
কবিতা কান থেকে ফোন কাটতে নিলেই ধ্রুব অশান্ত সুরে বলে, “তাহিরার জন্য ডাকছি। প্লিজ তুমি আসো। আমার…আমার খুব ভয় করছে।”
“তাহিরা আপু!” চমকে উঠে কবিতা, “তাহিরা আপুর কী হয়েছে?”
“একজনের কল এসেছিল, ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। আমার ওর সামনে যেয়ে ওর খেয়ালও রাখতে পারবো না। প্লিজ কবিতা তুমি আসো।”
ধ্রুবর কান্নাভেজা কন্ঠে কবিতা তার কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। সে বলে, “আমি এক্ষুনি আসছি। আপনি আমাকে হাস্পাতালের নাম ও ঠিকানা মেসেজ করুন।”

চলবে…

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here