মুহূর্তে পর্ব-৫০

0
684

#মুহূর্তে
পর্ব-৫০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কবিতা বড় ম্যাডাম থেকে অনুমতি নিয়ে গেল হাস্পাতালে। কবিডরে যেয়েই সে ধ্রুবকে পায়। সে কেবিনের বাহিরেই বসেছিলো। কবিতাকে দেখেই সে এগিয়ে এলো, “কবিতা ভালো হয়েছে তুমি এসে পড়েছ। তুমি তাহিরার কাছে যেয়ে ওর খেয়াল রাখো।”
ধ্রুবর কথা কবিতার কানে গেলেও সে উওর দিতে পারে না। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। তার চোখের নিচের কালি স্পষ্ট। মুখেও কেমন মলিন ভাব। দাঁড়ি বেড়ে গেছে তার। ধ্রুবকে এত বাজে অবস্থায় কখনো সে দেখে নি। সে সবসময়ই গুছানো মানুষ ছিলো। স্টাইলিশ ছিলো। সবসময়ই নিজের যত্ন করতো। শেষবার তার অগুছালো অবস্থা তার মা’য়ের মৃত্যুর সময় ছিলো। আর কখনোই ধ্রুবকে এত বাজে অবস্থায় সে দেখে নি।

ধ্রুব আবারও বলে, “কবিতা কোথায় হারিয়ে গেলে? প্লিজ তাহিরার কাছে যাও।”
“আপুর কী হয়েছে?”
“দুর্বলতার কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। এখনো অজ্ঞান। হোটেলের লবিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। তারপর ম্যানেজার তার ফোন থেকে আমায় কল দেয়। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানলাম ওর অসুখ ঘনিয়ে আসছে। ও নিজের চিকিৎসা না করানোর কারণে অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।”
“আপনি কি বলছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আপুর কোন অসুখ? আর আপু হোটেলে কি করছিলো?”
ধ্রব দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ওর লিউকেমিয়া।”
চমকে উঠে কবিতা, “মানে ব্লাড ক্যান্সার?”
মাথা নাড়ায় ধ্রুব। কবিতা স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত। কাঁপানো গলায় বলে, “আপনি মিথ্যা বলছেন তাই না? আপনি মিথ্যা বলছেন।” প্রায় চেঁচিয়ে উঠে কবিতা।
“আই উইশ আজও আমি মিথ্যা বলতে পারতাম।”
ধ্রুবর নম্র চোখ দেখে কথাটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় কবিতা। সে ধ্রুবর হাত ধরে বলে, “আপনি তাহলে আপুর কাছে না থেকে এখানে বসে কী করছেন? জলদি আসুন।”
কবিতা তার হাত ধরে এগোলেও ধ্রুব নড়ে না। কবিতা অবাক হয়ে ফিরে তাকায় তার দিকে। ধ্রুব বলে, “আমি ওকে দূর থেকে দেখছি। ওর কাছে যাওয়াটা আমার জন্য বারণ।”
“এসব কী বলছেন আপনি?”
“পাপের পরিণাম ভোগ করছি। তাহিরা আমার কাছ থেকে তার শেষ ইচ্ছায় চেয়েছে তাকে যেন এই জনমে নিজের মুখ না দেখাই। আমি ওকে দূর থেকে দেখছি। তুমি ওর কাছে যাও।”
কবিতা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ ধ্রুবর দিকে। ধ্রবর করণীয়র পর তার প্রতি মোটেও খাবার লাগা উচিত না কবিতার। কিন্তু আজবভাবে তার খারাপ লাগছে।
সে ধ্রুবর হাত ছেড়ে দ্রুত গেল তাহিরার কাছে।

তাহিরার জ্ঞান ফিরতে সময় লাগে। কবিতা সেখানেই বসেছিলো। তার জ্ঞান ফেরার পর তাকে কিছুক্ষণ সময় দেয়। কিছু কথা বলে। তারপর জিজ্ঞেস করে, “আপু তুমি আমাকে সত্যটা বলোনি কেন? তোমার এত বড় অসুখ তাও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি? তুই চিকিৎসা করাও নি কেন? আর তুমি হোটেলে ছিলে কেন? ধ্রুব ভাইয়াকে তুমি দেখতে মানা করে দিয়েছ অর্থাৎ তুমি ঘর ছেড়ে হোটেলে ছিলে? একারণে তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছ? এত কিছু হয়ে গেছে আমাকে বলাটাও উচিত মনে করো নি?”
“আস্তে আস্তে, এত প্রশ্ন একসাথে করলে উত্তর দিব কিভাবে? তোর জীবনে এমনিতেই সমস্যার অভাব নেই , এর উচিত তোর চিন্তা করাতে চাচ্ছিলাম না। মনে আছে তুই সেদিন ধ্রুবর পরকীয়ার কথা আমায় বলেছিলি?”
কবিতা মাথা নাড়ায়। তাহিরা বলে,
“আমি তা কয়েকমাস আগে থেকে জানতাম। সেদিন মিথ্যা কথা বলেছি। অপেক্ষায় ছিলাম ধ্রুবকে মুক্তি দেবার জন্য। আর বেঁচে কি করব বল, আমার সব তো আগেই শেষ।”
“এসব কি বলছে আপু? এসব কথা মুখেও আনবে না।”
“ঠিকই বলছি। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। হয়তো কখনো প্রকাশ করিনি। যারা আমার কাছের ছিলো সবাই ছেড়ে চলে গিয়েছি। যে ধ্রুবকে আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি সে আমাকে কখনো ভালোবেসেছে কি’না সন্দেহ। ভালোবাসার মানুষটা অন্যকারো বাহুডোরে নিজ চোখে দেখাটা দম আটকে যাবার মতো। বিষয়টা কষ্টকর। আমার মা-বাবার মৃত্যুর সময়ের কষ্ট ঠিক কতটুকু ছিল আমার মনে নেই। কিন্তু সেদিনের মতো আমার কষ্ট আর কখনো হয় নি। জানিস আমি সবসময় মোনাজাতের দোয়া করতাম যেন আমার মনের কষ্টটা কমে যাক। আল্লাহ আমার দোয়া শুনেছে। আমি আমার মৃত্যুর সংবাদেই সে শান্তিটা পেলাম।”
কবিতা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সে কি বলে বুঝতে পারছে না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তাহিরা আবার জিজ্ঞেস করে, “ও বাহিরে তাই না?”
“হ্যাঁ ডাকবো?”
“না, চলে যেতে বল। তার জন্য হয়তো অন্য মেয়েরা অপেক্ষা করছে। অকারণে আমার জন্য ওর সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।”
“আপু উনার এত বাজে অবস্থা আমি কখনো দেখি নি। আমি তো তাকে প্রথমে চিনতেই পারি নি।”
তাহিরা চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকায় কবিতার দিকে। এই প্রথম তার গলা কেঁপে উঠে, “ওকে বলিস নিজের খেয়াল রাখতে। এভাবে নিজেকে নিয়ে অবহেলা যেন না করে। ওকে যেতে বল এখান থেকে। আমি ওকে দেখতে চাই না।” কথাটুকু বলার সময় তাহিরার চোখজোড়া নম্র হয়ে এলো। ভিজে গেল।

কবিতা কেবিন থেকে বের হয়ে দেখে ধ্রুব এখনো বাহিরের করিডরে বসা। সে যেয়ে দাঁড়ায় তার সামনে। বলে, “আপু আপনাকে যেতে বলেছে। আর বলেছে আপনি যেন নিজের খেয়াল রাখেন।”
“তুমি একটু বসো। কিছু কথা বলব।”
কবিতার ধ্রুবর সাথে বসতে রুচিতে বাঝলো। সে তার সাথে যা করেছে এরপর তার সাথে কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না কবিতার। তবুও সে বসলো। কেননা ধ্রুবর অবস্থা দেখে তার মায়া হচ্ছে। সে জানে, সে তাহিরার সাথে যত অন্যায় করুক না কেন এই পৃথিবীতে যদি ধ্রুব একমাত্র কাওকে ভালোবাসে তাহলে সে হলো তাহিরা। আচ্ছা, ভালোবাসলে কী ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিতে মন চায়? তার বিশ্বাস ভাঙাতেই এতই সহজ মনে হয়? একথাটুকু ভেবে ভালোবাসা শব্দটা নিয়েই সে দ্বিধায় পড়ে গেল। পরের মুহূর্তে ভাবলো, ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ আছে। তাহিরা এবং ধ্রুবর সম্পর্কটা সবচেয়ে ভিন্ন। তাদের একে অপরের সবচেয়ে বেশি কাছের। বন্ধু হিসেবে, পরিবার হিসেবে। ধ্রুব যদিও তাহিরাকে ভালো না বাসে তবুও তার অসুখের সংবাদে সবচেয়ে বেশি কষ্ট ধ্রুবরই হবে।

কবিতা একসময় ধ্রুবকে নিজের ভাই বলে সম্বোধন করেছিলো। আসলে ভাইও মেনেছিলো। তাই তার প্রতি আলাদা জায়গা আছে তার মনে। ধ্রুব তার সাথে যত খারাপ করুক না কেন, সে ভাই শব্দটার মর্যাদা টুকু সে রাখবে।

ধ্রুব চোখ মেঝেতে স্থির রেখে বলে, “আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ করেছি কবিতা। নিজের স্বার্থের জন্য তোমাদের সকলের জীবন নষ্ট করেছি। তোমার সংসার ভাঙার দায়ী আমি। তোমার ভাই বলার মর্যাদাটুকুও আমি রাখি নি।”
কবিতা চুপ রইলো। কিছু বলল না।
ধ্রুব আবার বলে, “তীর্থ আমার সাথে থাকতো। আমি যে মেয়েদের সাথে ঘুরাঘুরি করি তা যেন সে তাহিরাকে না জানায় এই কারণে আমিই মৃণার সাথে ওকে জোর করে সম্পর্কে করানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি কখনো ভাবেনি ও কখনো এত গম্ভীর সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারে। আমি তোমার অপরাধী কবিতা। তুমি যে শাস্তি দিবে, আমি মেনে নিব।”
কবিতা এবারও কিছু বলে না। ধ্রুব বেঞ্চ থেকে সোজা হাঁটু গেড়ে বসে পা ধরে নেয় কবিতার। কবিতা চমকে উঠে, “কি করছেন আপনি?”
“আমি জানি তোমার কাছে আমি যত ক্ষমা চাইবো ততই কম হবে। আমি অনেক খারাপ করেছি তোমার সাথে। আমি না কখনো ভাবি নি যে তাহিরাকে আমার কখনো হারাতে হবে। তাই ওকে গ্রান্টেড নিয়েছি। বলে না খুব সহজে কিছু পেয়ে গেলে কদর থাকে না। আমার অবস্থাও তাই। এত সুন্দর একটি জীবন পেলাম, ভালোবাসার মানুষ পেলাম, সব পেয়েছি কিন্তু কিছুর কদর করি নি। তোমার মতো বোন পেয়েছিলাম, তার মর্যাদাও রাখি নি। তীর্থের বন্ধুত্বের লাভ উঠিয়েছি। আমি জঘন্য একটি মানুষ। হয়তো আমি সম্পর্কের মর্যাদা রাখতে পারি না বলেই আল্লাহ আমার জীবনে কাওকে রাখে নি। তাহিরা আমার মা’কে মৃত্যুর পূর্বে করা ওয়াদাটা সবসময় পালন করেছে। আমি করতে পারি নি। আমার মা মৃত্যুর কাগারে গিয়ে আমার হাত ধরে বলেছিলো, ‘তোর বাবা যেভাবে সারাজীবন আমাকে আগলে রেখেছে, সম্মান দিয়েছে, বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে, ভালোবেসেছে সেখাবে তুই তাহিরাকে রাখবি।’ আমি এই কথাটা কখনো তাহিরাকে বলিনি। উল্টো তার মা’কে করা ওর ওয়াদাই মনে করিয়ে গিয়েছি। ধিক্কার আমার উপর। আমি কখনো বাবার মতো হতে পারি নি। আফসোস। যদি হতাম, তাহলে হয়তো তাহিরার জীবনের শেষ মুহূর্তে আমার ওর পাশে থাকতাম। আমার এভাবে লুকাতে হতো না।”

ধ্রুব তার চোখ মুখে কবিতার হাত ধরে নেয়। অনুরোধ করে, “কবিতা আমি তো ওর কাছে থাকতে পারবো না। প্লিজ তুমি ওর খেয়াল রেখো। ওকে চিকিৎসা করার জন্য মানাও। ওকে বলো আমি জীবনেও ওর সামনে আসবো না। ওর জীবন থেকে দূরে থাকবো। কেবল ওকে নিজের জীবন আবার নতুনভাবে শুরু করতে বলো। এমন কাওকে খুঁজে নতুন করে সংসার করতে বল যে কখনো ওকে কষ্ট দিবে না। ওর বিশ্বাস ভাঙবে না। আমি ওর জীবন থেকে অনেক দূরে যাব, কিন্তু ওকে খুশি থাকতে বলো।”
কেন যেন কবিতার চোখও নম্র হয়ে এলো। সে চেয়েও চোখের জল আটকাতে পারলো না। সে এবারও কিছু বলল না।

ধ্রুব গেল না। সারারাত সেখানেই বসে থাকলো। তবে কবিতা তাহিরাকে বলে দিয়েছে ধ্রুব চলে গেছে। এই অনুরোধটাও ধ্রুবরই। পরেরদিন ডিসচার্জ করা হয় তাহিরাকে। কবিতা তাহিরাকে জোর করে নিজের বাসায় নিয়ে যায়। ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগও করে তার চিকিৎসার জন্য।

দেখতে দেখতে দুইমাস কেটে যায়। কবিতার জীবনে এই সময়কালেও অনেককিছু হয়। তীর্থের সাথে তার ডিভোর্সের কথা চলছে। তীর্থের উপর আসলেই পুলিশ কেস করেছিলো সে। তাকে ভয় দেখানোর জন্য। বিশেষ কিছু পরিণাম আসে নি। কবিতার ধারণা টাকা খাইয়ে সে ছুটে গেছে। তারপর সে পরকীয়া এবং নারী নির্যাতনের ভিত্তিতে তালাকের জন্য আবেদনও করেছে। তা এখনো হয় নি। তাও কেবল তীর্থের কারণে। এর উপর তার এলাকায় তার নামে বিভিন্ন কথা উঠে। কথাগুলো তার তালাককে নিয়েই। তার চরিত্র নিয়েও গবেষণা করা হয়। এমনকি তার জন্য অনুর চরিত্রেও প্রশ্ন তুলে। এর একটাই কারণ, তার তালাক। এলাকার সবাই জানে সে ডিভোর্সি। এতেই সকলে দুশ্চরিত্রার ট্যাগ দিয়ে দিয়েছে তাকে। কেউ তার স্বামী থেকে আলাদা হবার থাকার কারণ জানে না, জানতেও চায় না। কিন্তু যেহেতু ডিভোর্স হচ্ছে, স্বাভাবিক তারই দোষ। কথা এখানেই থেমে গেলেও ভালো ছিলো। কিন্তু এমনটা হয় না। এলাকার কিছু ছেলেপেলেও তার সাথে খারাপ ব্যবহারে পিছ’পা হয় না। একদিন তো এক লোক ঘরে ঢুকে কবিতার সাথে খারাপ কিছু করারও চেষ্টা করে। কিন্তু কবিতা নিজেকে বাঁচায়, সাথে লোকটাকে মেরে শিক্ষাও দেয়। সেদিন তার মধ্যে এত শক্তি কিভাবে এসেছিলো সে জানে না। তবে এতটুকু জানে জীবনের এত বড় এক পরীক্ষা পেড়িয়ে আসার পর সে আর দুর্বল নয়।

এই ক’মাস কেবল খারাপ গেছে এমনটাও নয়। ভালোও কয়টা জিনিস হয়েছে তার সাথে। তার কাজ ভালো চলছে। যদিও এখনো সে সব ঠিক মতো গুছাতে পারে না। সে তার বোন, বান্ধবী ও ছেলে মেয়ের সাথে ভালোই আছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার সে তার স্বপ্নের দিকে এগোচ্ছে। নিজের অজান্তেই।
অনুর কলিগ মোহনার জন্য সে যে শাড়ি বানিয়েছিলো তা মোহনা ফেসবুক গ্রুপে আপলোড দেয়। শাড়ির ডিজাইন দেখে অনেকেই কাজ পছন্দ করে। অর্ডার দিতে চায়। এমনকি অফিসের লোকেরাও। অবশ্য কবিতা প্রথমে মানা করে দিলেও পরে খেয়াল করে তার এসব মন্দ লাগছে না। উল্টো শাড়ি নিয়ে কাজ করার সময় তার ভালো লাগে। সকল চিন্তা, অশান্তি ভুলে বসে সে। তার খেয়াল থাকে কেবল শাড়ির ডিজাইনের ভেতর। এমনিতেও বিকেল চারটার অফিস শেষে, ঘরের কাজ এবং বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর পরও তার কাছে সময় থাকে। আজকাল তাদের তাহিরাই পড়াশোনা করায়। তাই টুকিটাকি অর্ডার নেয় সে।

কবিতা আজ অফিস থেকে একটু দেরি করে আসে। যেহেতু আজকাল তাহিরা কাব্যকে স্কুল থেকে আনে তাই তার চিন্তা হয় না। কবিতা বাসায় আসতেই দরজায় তাহিরা তাকে ধমক দেয়, “তোকে ফোন দিচ্ছিলাম। ফোন বন্ধ রাখতে হলে ব্যবহার করিস কেন?”
“ফোনে চার্জ ছিলো না। কী হয়েছে?”
“কাব্য সে স্কুল থেকে বের হয়ে কান্না করেই যাচ্ছে।”
“বলো কি?”
কবিতা তাহিরার কোলে কুহুকে দিয়ে ছুটে গেল কাব্যের কাছে। বেডরুমে যেয়ে দেখে আসলেই কাব্য কাঁদছে। কাব্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে, “কী হয়েছে বাবা তুমি কাঁদছো কেন?”
কান্না বাড়লো কাব্যের। সে ঠোঁট উল্টে বলল, ” আম্মু আজ না টিচার বলেছে আমাকে স্কুল থেকে বের করে দিবে। আম্মু প্রমিজ আমি কিছু করি নি। আম্মু আমাকে বের করে দিলে আমার ফ্রেন্ডসদের কী হবে?”
কবিতা কথাটা বুঝতে পারলো না। হঠাৎ তাকে বের করে দেবার কথা বলা হলো কেন? সে কাব্যের চোখ মুছে বলে, “কাঁদে না সোনা, আম্মু কাল যেয়ে টিচারের সাথে কথা বলবো। ওকে?”
মাথা নাড়ায় কাব্য। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার মা’কে।

সকালে কবিতা স্কুলে যেয়ে প্রথম পিরিয়ডেই দেখা করলো কাব্যের ক্লাসটিচারের সাথে।
“ম্যাম আমি জানতে পারি আপনি কীজন্য কাব্যকে স্কুল থেকে বের করে দেবার কথা বলেছেন? ও কি কোনো দুষ্টুমি করেছে অথবা পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে?”
“না। ওর তো পড়ালেখা ভালোই। আর খুব শান্ত ছেলে।”
“তাহলে সমস্যা কোথায়? আপনি ওকে বের করার কথা কেন বললেন?”
“দেখুন ম্যাম আপনার এবং আপনার হাসবেন্ডের ডিভোর্স হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আপনি আমাদের এত এক্সপেন্সিভ স্কুলের খরচাপাতি চালাতে পারবেন না। আপনি দুইমাসের বেতনও দিতে পারে নি। বেতন ছাড়াও আরও খরচ আছে। যা আপনার পক্ষে এফোর্ড করা সম্ভব না। আর আমি এখন ওকে এক্সপেল করার কথা বলছি না। সামনের মাসে ওদের ফাইনাল পরীক্ষা। এরপর নতুন ক্লাসে আপনি ওকে নরমাল কোথাও ভর্তি করতে পারেন। এতে আপনারও সমস্যা হবে না। আমি আপনার কথাও ভাবছি।”
কবিতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল টিচারের দিকে, “আর আপনাকে একথা কে জানাল যে আমি কাব্যের বাবার থেকে আলাদা হয়েছি।”
“মিঃ তীর্থই জানিয়েছে।”
“ওহ, আর আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন যে আমি আমার ছেলেকে বড় করার যোগ্য নই। কারণ আমি একজন নারী। একজন মহিলা চাকরিজীবি হিসেবে আপনার চিন্তাভাবনা অনেক উন্নত।”
কথাটা শোনার পর মনে হলো কাব্যের টিচার লজ্জা পায়। সে কিছু বলতে নিবে এরপূর্বেই কবিতা বলল, “ম্যাম আমি বুঝতে পারছি না আপনারা কি ছাত্র-ছাত্রীদের এখানে শিক্ষা দিতে বিদ্যালয় খুলেছে না ব্যবসা করতে? এছাড়া আপনি ওদের স্কুলের প্রিন্সিপাল কি জানে যে আপনি এভাবে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে ব্যবহার করেন? আপনার প্রয়োজন হলে আমার সাথে যোগাযোগ করতেন, আমার ছেলেকে এভাবে বলার আগে আপনি এতটুকু বিবেকে আসে নি যে ও বাচ্চামানুষ? ও কতটা কষ্ট পেতে পারে আপনার কথায়? থাক আপনার সাথে আমার কথা বলা লাগবে না, আমি প্রিন্সিপালের সাথেই যেয়ে এই ব্যাপারে কথা বলছি।”
সে উঠে যেতে নিলেই কাব্যের টিচার তাকে থামায়, “ওয়েট। প্লিজ এমন করবেন না।”
“কেন করবো না? আপনার ব্যবহার তার জানা উচিত না? আর কেবল সে কেন আপনাদের এত উন্নত স্কুলের বাচ্চাদের সাথে কেমন ব্যবহার করে তা সকল অভিভাবকদের জানা উচিত।”
“দেখুন প্লিজ এমন করবেন না। আমার চাকরি সমস্যায় পড়ে যাবে।”
“ঠিকাছে। কিন্তু এরপর থেকে এমন কিছু শুনলে আমি চুপ থাকবো না। আর আপনি সঠিক তথ্য রাখুন। আমি এই মাসে বকেয়াসহ বেতন পরিশোধ করে দিয়েছি। আপনি বাচ্চাদের পড়ায় ধ্যান দেন, তাদের ফ্যামিলি মেটারে না।”
এতটুকু বলে সে রাগে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। এত কিছু শোনানোর পরেও তার রাগ কমে না। রাগে কটমট করছিল সে। তীর্থের সাহস কি করে হলো তার ছেলেকে এসবের মাঝে আনার? এতকিছুর পরেও সে তীর্থের বড় কোন ক্ষতি করতে চাই নি। কিন্তু এখন তীর্থ তার ছেলেকে এসবের মাঝে এনে অনেক বড় ভুল করেছে। নিজের জন্য তাকে একবার হলেও ছাড় দিতে পারে, তার সন্তানদের জন্য নয়। তার এই কাজের অনুতাপ তাকে করতেই হবে।

দুইদিন পর,
তীর্থ অফিসে বসে ছিলো। নিজের ব্যবসার হিসাব দেখছে সে। ব্যবসার লাভ অনেকাংশ কমে গেছে। এই নিয়ে সে ভারী চিন্তায় আছে। নতুন কোন ডিজাইন না আসায় তেমনটা কেউ শপেও আসে না। কবিতার উপদেশ দ্বারা তাদের আগের সকল ড্রেসের ডিজাইন নিয়ে কাজ হতো। তার ডিজাইনগুলোর ধরণই ভিন্ন ছিলো। গ্রামীন এবং আধুনিক মিলিয়ে। এই কারণেই তাদের পণ্যের এত চাহিদা ছিলো বাজারে। কিন্তু এখনের করা ডিজাইনগুলো বাজারে অহরহ পাওয়া যায়, তাই তেমন চাহিদা নেই। এই নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পরেছে সে। তার অনুপস্থিতে যে ক্ষতি হয়েছে তাও এখনো পোষাতে পারে নি। সামনে কি করবে?

অনুমতি না নিয়েই রাহাত জলদি করে ঢুকে পড়ে তার কক্ষে। এমনিতেই চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছিল তার। রাহাতের এই কান্ডে তার সকল চিন্তা রাগ হয়ে বর্ষণ হলো রাহাতের উপর, “হোয়াট দ্যা হেল! এভাবে রুমে ঢুকে পড়ার মানে কী? নিজের চাকরি কি তোমার প্রিয় না যে আদব-কায়দা সব ভুলে গেছ? ”
রাহাত আতঙ্কিত স্বরে বলে, “স্যার এখন এসবের সময় নেই। আপনি জলদি নিউজ দেখুন কি হচ্ছে।”
রাহাত তার ফোনটা দিলো তীর্থের কাছে। আর বলল, “স্যার জলদি কিছু করতে হবে, নাহলে এই একটি খবরে আমাদের ব্যবসা বিরাট বড় ঝুঁকিতে পরতে পারে।”

চলবে…

লেখকের কথাঃ আমি কোনো ভুল তথ্য দিয়ে থাকলে ক্ষমা চাইলাম। আমি আইনগত বিষয় সম্পর্কে বিশেষ একটা জানি না। খোঁজ করে যতটুকু পেয়েছি, তাই দিয়েছি। ভুল হলে ক্ষমা করবেন। এছাড়া আজ হঠাৎ গল্পটা টেনে নিয়ে আসতে হয়েছে নাহয় এতটুকুই অনেক পর্ব হতো, যা পড়তেও ভালো লাগতো না।

[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]

সকল পর্ব
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here