#মুহূর্তে
পর্ব-৫৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
কথাটা শুনে মৃণা বড়সড় এক ঝটকা খায়। স্তব্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ ভয় তাকে এমনভাবে কাবু করেছে যেন তার প্রাণ গলায় আটকে এসেছে।
“কী হলো এখন এই চ্যাঁ চ্যাঁ করা মুখ বন্ধ হয়ে গেল কেন?” অনু বলল দৃঢ় কন্ঠে। আইদ তার বাহু ধরে বলল, “অনু এসব কথা সবার সামনে…”
অনু তার হাত এক ঝাড়নে সরিয়ে দেয়, “সবার সামনেই বলবো। এটা এখন আর তোদের ব্যাপার না যে তুই আমাকে চুপ থাকতে বলবি আর আমি চুপ থাকবো। ও আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলেছে। তোর কাছে নিজের সম্মান তুচ্ছ হতে পারে কিন্তু আমার কাছে অনেক মূল্যবান। এছাড়া তুই ছেলে তোকে এক দুইটা কথা বলে সবাই চুপ হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিকই আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলবে। তুই চাস তোর জন্য আমার চরিত্র সবার সামনে খারাপ হোক?”
আইদ কিছু বলল না। অনুকে আর থামাল না। অনু হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে মৃণার চোখে চোখ রেখে বলে, “তো কি বলছিলে আমি বেশরম? আর তোমার মধ্যে শরম উতলায় পড়ছে? তুমি সে না যে এক বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক তৈরির জন্য ব্যকুল হয়ে পড়েছিলে? তার দু’টো বাচ্চা আছে জেনেও।”
“দে..দেখো নিজের ভুল লুকানোর জন্য আমার নাম তুলবে না।” মৃণা আবার আইদের মায়ের দিকে তাকিয়ে বুল, “মা দেখেছেন এখন এরা নিজের ভুল লুকানোর জন্য আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলছে। কেবল আমার উপর না আপনার বংশের রক্তের উপরও।”
আইদ ধমক দিয়ে উঠলো, “মৃণা চুপ করো। তোমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের করবে না? আমি ভেবেছিলাম তুমি এ কয়মাসে একটু হলেও শুধরে গেছ। কিন্তু তা ভাবাটা আমারই ভুল ছিলো। কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না।”
বুঝে উঠার পূর্বেই আইদের মা তার গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। উঁচু স্বরে বললেন, “তোর লজ্জা লাগে না, এই মেয়ের জন্য নিজের স্ত্রীকে কলঙ্কিত করছিস তুই? যদি এই মেয়ের কথা একটুও সত্যতা থাকতো, তাহলে এসব আগে বলিস নি কেন তুই? এখন নিজের চুরি ধরার পর নাটক করছিস?”
আইদের মা’য়ের কথা শুনে মৃণার প্রাণ ফিরে আসে। সে তার হাত ধরে বলে, “মা আমি এইখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না। চলুন।”
মৃণা তাকে এবং নিজের মা’কে নিয়ে যাওয়ার সময় অনু বলে উঠে, “মিস্টার তীর্থের সংবাদ আপনারা সবাই নিশ্চয়ই শুনেছেন। সেখানে তীর্থের বাহুডোরে একটি মেয়ের ছবি ছিলো। মেয়ের চেহেরাটা ঘোলাটে থাকার কারণে নিশ্চয়ই তার চেহারা দেখতে পারেন নি। আমার কাছে সে ছবিটা আছে, আপনারা চাইলে আমি আপনাদের সবাইকে তা দেখাতে পারি।”
কথাটা শুনেই সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মৃণা। পিছনে ফিরে দ্রুত যেয়ে অনুর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিলো। তার ফোন চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। কিন্তু কোন ছবিই পেল না সে। অনু তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “তুমি কিছু না করলে এভাবে দৌড়ে এলে কেন? তবে আপাতত আমার ফোনে না থাকলেও তা নিতে এক মুহূর্তেও লাগবে না। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আইদের কাছেই তো ছবি আছে। ওই তো ছবি তুলেছিলো।”
অনু একটু বাঁকা ঝুঁকে আইদের মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “আর আন্টি আপনার বৌ’মায়ের প্রেগ্ন্যাসির কয় মাস জানেন? পাঁচমাসের বেশি হবে। আর আপনার ছেলের সাথে তার বিয়ের কয়মাস হয়েছে?”
আইদের মা এবং মৃণার মা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। তাদের চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার অবস্থা। অনু আবার বলল, “একদম ঠিক। চারমাস। আপনারা এতদিনেও এটা ধরতে পারেন নি? আপনার ছেলের সাথে বিয়ের সময়ও ও গর্ভবতী ছিলো। অর্থাৎ তাদের বিয়ে হয় নি।”
মৃণা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাঁপছিল সে। এমন সময় তার মা সামনে এসে কাঁপানো গলায় জিজ্ঞেস করে, “সত্যি বল…সত্যি বল এই মেয়ে কি ঠিক বলছে? কিছু বলছিস না কেন তুই? তুই… তুই কি সত্যি এসব করেছিস?” উওর না পেয়ে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় সে মৃণার গালে, “তোর লজ্জা লাগে নি এসব করার আগে? তোকে এইসব করার জন্য এত ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছি? তোর বাবা দিনরাত খেটে তোকে পড়াশোনা করিয়েছে, তোর সব ইচ্ছা পূরণ করেছে, তোকে এত সুন্দর একটা জীবন দিয়েছে। তাও তুই এসব করেছিস? লজ্জা লাগে নি তোর? একবার নিজের বাবার আমার কথা ভাবিস নাই? মুখ খুল নিলজ্জ মেয়ে কথা বল।”
বলতে বলতে সে মেঝেতে বসে পড়ে। অঝোরে কাঁদছে সে। নিজের কপালে মেরে বলে, ” আমি কষ্টে ছিলাম যে তোর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু এখন দেখি ভালোই হলো, সে তোর এই কুকীর্তির কথা জানলে এমনিতেই আর বাঁচতে পারতো না।”
আইদ এসে তাকে সামলায়, “আন্টি আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন। দয়া করে সামলান নিজেকে।”
অনু এবার নরম গলায় কথা বলল, “আন্টি আমি জানি এ কথা এখন বলা ঠিক নয়। তবুও আপনার জানা উচিত। মৃণার বাবার মৃত্যুর কারণ আপনার মেয়েই। ও নিজের প্রেগ্ন্যাসির কথা ফোনে…” সম্পূর্ণ কথা বলার আগেই আইদ তাকে থামিয়ে দেয়, “অনু, হয়েছে। আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। ”
অনুও এবার আইদের কথা মেনে নেয়। চুপ হয়ে যায় সে। বুঝতে পারে তার কথাটা তোলা ঠিক হয় নি। মৃণার মা উঠে তার হাত ধরে বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করে, “না তুমি বলো। কি বলতেছিলে বলো। ওর কথা শুনো না। বলো তুমি।”
অনু আড়চোখে তাকায় আইদের দিকে তারপর মাথা নামিয়ে বলে, “মৃণার প্রেগ্ন্যাসির খবর শুনেই ওর বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন।”
স্তব্ধ হয়ে যায় মৃণার মা। সে আর একটা শব্দও মুখে আনতে পারে না। সে নিচে পড়ে যেতে নিলেই আইদ তাকে ধরে নেয়। বলে, “আন্টি আপনার আর কিছু জানা লাগবে না। বাসায় চলেন।”
আইদ মৃণার মা’কে চলে গেল। পিছনে গেল আইদের মা’ও।
মৃণা সেখানে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে কি বলবে, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। এমন সময় একটি মেয়ে বলল, ” আমি এত নিলজ্জ মেয়ে জীবনেও দেখি নি। নিজে দোষ করে অন্যজনের উপর চাপাচ্ছিলো। সব কুকীর্তি সবার সামনে এসেছে, একদম ঠিক আছে।”
অনু পিছনে তাকিয়ে উঁচু স্বরেই বলল, “আপনাদের মধ্যে কে যেন আমার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলছিলেন? তাদের চাঁদমুখটা একটু দেখি তো। সে কি কখনো আমাকে আইদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করতে দেখেছেন? বন্ধুত্ব ও প্রেমিকের মধ্যে একটি সীমানা আছে এবং সে সীমানায় আমি থাকতে জানি। আর আপনারাও নিজের চিন্তাধারাকে উন্নত করতে শিখুন। আধুনিক শুধু মুখে হলেই হয় না।”
অনু রাগে সেখান থেকে বেরোতে নিয়ে আবার ফিরে এলো। মৃণাকে বলল, “আর তুমি বাদাম খাও। সম্ভবত আমাকে মনে নেই তোমার। ক’মাস আগেও বলেছিলাম যে আমি কবিতার বান্ধবী। তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য সেদিন তামাশা করি নি। তার সম্মানের খাতিরে। কিন্তু কি ভেবেছিলে আমি আইদের মতো সবার কথা চিন্তা করব? একদম না। রাস্তায় হাঁটতে যেয়ে সাপ কামড় দিলে তা কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে কিন্তু নিজে সাপের সামনে যেয়ে নাচতে থাকলে যদি ভাবো যে সে সাপ তোমাকে কাপড় দিবে না তাহলে তো তা বোকামি। টাটা।”
অনু ভেংচি কেটে সেখান থেকে চলে গেল। মৃণা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ। আজ তার সব শেষ। সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন কি মুখ নিয়ে যাবে সে আইদের বাসায়? তার যে আর কোনো ঠিকানা নেই।
.
.
রাতে কবিতা বাসায় এসে দেখে কথন এসেছে। আবিরের সাথে গল্প করছে সে। সে আজ কথনকে এমনিতেই কল দিতো। তাহিরার চিকিৎসার জন্য কথা বলতে। যেখানে এখন সে তাহিরার চিকিৎসা করাচ্ছে সেখানে কোনো প্রকার উন্নতি দেখতে পারছে না সে। কথন যেহেতু ডাক্তার, ভালো উপদেশ দিতে পারবে সে। সে কথনের সাথে কথা বলতে যাব তখনি দরজায় কলিংবেল বাজে।
কবিতা দরজা খুলে অনুকে দেখে বলল, “আরে তুই এত জলদি এসে পরলি? পার্টি শেষ?”
“কথা বলিস না এই বিষয়ে। মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।”
“কী হলো?”
অনু উত্তর দেয় না। সোজা ভেতরে চলে যায়। কবিতাও যায় তার পিছনে, “আরে হয়েছে কি তা তো বল।”
“ওই মৃণার বাচ্চা, শাঁকচুন্নি, ডাইনি, রাক্ষসীটা পার্টিতে এসে বলে আমার না’কি আইদের সাথে কি চলছে। আমার ক্যারেক্টরে সমস্যা আছে। সাহস কি ওই মেয়ের? আজ একবারে ধুঁয়ে দিসি। শালী বেশরম মাইয়া।”
“বলিস কি? কি হলো তারপর?”
“মাথা ঠান্ডা হলে কাহিনী বলবো নে। এখন ভাল্লাগছে না।”
“আচ্ছা তুই কুল ডাউন হো। আমি তোর পছন্দের কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি।”
অনুর উঁচু স্বরে আবির এবং কথনও রুমের সামনে এসে পরেছিলো। কবিতাকে রান্নাঘরে যেতে দেখে কথনও তার পিছনে গেল। আবির গেল অনুর কাছে। তার পাশে বসে বলল, “মেজাজ কি বেশি খারাপ?”
অনু বিড়বিড় করে বলে, “একটু ভালো তো হয়েছিলো। পরে মনে পড়লো জনাব তো আজ নিজের এক্সের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। জনাবের মুখে যে হাসি মনে হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধ জয় করে এসেছে। যেন আকাশে উড়ছে সে।”
“কি বলছো? শুনতে পারছি না।”
“কিছু না। আপনি বলুন, শুনলাম আপনিও আজ কারও সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। মিটিং ভালো গেল?”
“এক পুরনো ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
অনু আড়চোখে তাকায় আবিরের দিকে। আবারো বিড়বিড় করে বলে, “ফ্রেন্ড না গার্লফ্রেন্ড বলেন।”
“তুমি কি বলছো শুনতে পাচ্ছি না।”
“কিছু না।”
“কাব্যকে নিয়ে গিয়েছিলাম বুঝলে? ফ্রেন্ডের বাচ্চার সাথে এত ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। আসতেই চাইছিলো না।”
অনু এবার খুশিতে লাফিয়ে উঠে। উড়ু উড়ু গলায় বলে, “তার বাচ্চা আছে?”
“হ্যাঁ, কেন কি হলো?”
অনু নিজের খুশি নিয়ন্ত্রণ করে বলে, “না না কিছু না। তো বলেন কি বলছিলেন।”
আবির হাসে, “তোমার মুড দেখছি ভালো হয়ে গেছে। সেখান থেকে কথনের সাথে একটা বাসা দেখতে গিয়েছিলাম। পছন্দও হয়েছে। ক’দিনেই সেখানে উঠবো। বাসা কাছেই। আমার সাথে কালকে দেখতে যাবে?”
অনু চোখ দুটো বড় বড় তাকায় আবিরের দিকে। সে মুহূর্তেই সকল রাগ গলে যায় তার। গাল লালচে হয়ে যায়। সে চোখ নামিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। আবির আবারও বলে, “কবিতাকে বলেছিলাম তাহিরাকে নিয়ে আমার সাথে শিফট করতে। তখন ও আমাকে জানায় তুমি ওর জন্য কতকিছু করেছ। হয়তো অন্যকেউ হলে করতো না। কবিতা আসলেই ভাগ্যবান, সে তোমার মতো বান্ধবী পেয়েছে।”
“এভাবে বলবেন না। আমার যা করা উচিত ছিলো তাই করেছি।”
“বাই দ্যা ওয়ে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োর কারণে তোমাকে বলা হয় নি। তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। নীল রঙ তোমার উপর বেশ মানায়।”
অনুর লজ্জা আরও বাড়ে। লজ্জায় যেন মিইয়ে যায় সে। সে সিদ্ধান্ত নিলো আজ থেকে নীল রঙ তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। আগামীকালও সে নীল রঙের ড্রেস পরেই আবিরের সাথে যাবে।
.
.
কবিতা অনুর প্রিয় নুডলস রান্না করছিলো। চুলায় পানি বসিয়ে সবজি কাটছে সে। কথন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তা দেখতে থাকে। কবিতা সবজির কাটা শেষে নুডুলস এর প্যাকেট আনতে যেয়ে ফিরতেই কথনকে দেখে ঘাবড়ে পিছিয়ে যেতে নেয়। সে পরে যেতে নিলেই কথন তার কোমর জড়িয়ে ধরে।
কবিতা কেঁপে উঠে কথনের স্পর্শে। স্তব্ধ হয়ে যায়। সে চমকে উঠে তাকায় কথনের দিকে।
চলবে…
*ভেক্সিন দেবার কারণে আজ শরীর একটু ভালো লাগছে না। তাই ছোট করে দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল আরেক পর্ব দেবার চেষ্টা করব।*
[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]
সকল পর্ব
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086