#মুহূর্তে
পর্ব-৫৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
কবিতা কেঁপে উঠে কথনের স্পর্শে। স্তব্ধ হয়ে যায়। সে চমকে উঠে তাকায় কথনের দিকে।
কথন কবিতার অবাক দৃষ্টিতে দেখে হেসে দেয়। তার চোখে চোখ রেখে বলে, “এখন না ধরলেই তো চুলার উপর যেয়ে পড়তে। এত অসাবধানতা নিয়ে কাজ করো কীভাবে?”
কবিতা চোখ নামিয়ে নেয়। পিছিয়ে যেয়ে বলে, “ধন্যবাদ।”
তারপর কথনের পাশ কাটিয়ে যেয়ে ড্রয়ের থেকে নুডলসের প্যাকেট নেয়। এই ঘটনার পর আর একবারও কথনের দিকে তাকানোর আর সাহস করে না সে।
কথনও কিছু বলে না। সে এক কোণায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে কবিতার দিকে। এই নিরবতা কেমন বেমানান লাগছিলো কবিতার কাছে তাই সে বলে, “আজ আমি চাকরি ছাড়বার কথা বড় ম্যাডামকে বলেছি। আগামী মাসে ছাড়বো। ভাবছি অনলাইনে ব্যাবসাতে ধ্যান দিব। কিছু করার ইচ্ছা থাকলে এতটুকু ঝুঁকি তো নিতে হবে।”
“আমি জানি তুমি সাফল্য অর্জন করবে। তুমি যখন একটু ভালো করে কামাই করতে শুরু করবে তখন তোমার স্বপ্ন পূরণ করো।”
কবিতা হাসে, “আমার আগে যে ফ্যাশন ডিজাইনার হবার ইচ্ছা ছিলো সে কথা বলছেন? কিন্তু এখন সে বয়স নেই।”
“শেখার কোনো বয়স হয় না কবিতা। ইচ্ছা থাকলেই সব হয়।”
কবিতা মৃদু হেসে কথনের দিকে তাকায়, “এখন আমার কি ইচ্ছা করছে জানেন? আমার পরিস্থিতিতে যে নারীরা পড়েছে অথবা ভবিষ্যতে পড়বে তাদের সাহায্য করার সুযোগ। তাদের যেন নিজেকে নিরুপায় মনে করে তার স্বামীর ঘরে পড়ে না থাকতে হয়। নিজে কাজ করে জীবনে এগোতে পারে। সবার ভাগ্য তো আর আমার মতো হয় না যে তারাও অনুর মতো কাওকে পাবে। অনেকে ফ্যামিলি প্রেশারে এসে অনেক অত্যাচার সহ্য করে। আমার থেকেও অনেক করুণ অবস্থা হয় তাদের কিন্তু কোনো সুযোগ না থাকায় সে নরক থেকে তারা বেরোতে পারে না।”
“আমি জানি তুমি একদিন তোমার সকল স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।”
কবিতা একটু অবাক হয়ে তাকায় কথনের দিকে। তার নিজের উপরও তো এত বিশ্বাস নেই। তাহলে কথনের এত বিশ্বাস কীভাবে? আকস্মিকভাবে তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। নিজ অজান্তেই। সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে, “আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনি অন্যসবার মতো আমার সাথে করুণা দেখান নি। সাহস দিয়েছেন। ধন্যবাদ।”
“শুধু ধন্যবাদ দিলে হবে? তোমার মনে হয় না এর পরিবর্তে তোমার কিছু দেওয়া উচিত?”
কী?”
“তোমার কি মনে হয় আমি কি চাইব?”
কবিতা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। অস্বস্তিবোধ করে। সে ফিরে নিজের কাজ করতে করতে বলে, “আপনি কি চাইবেন আমি কি করে বলবো? আমার তো বিশেষ কিছু দেওয়ার সামর্থ্যও নেই।”
“আমি যা চাইবো তা কেবল তুমি দিতে পারবে।”
মেজাজ খারাপ হয়ে যায় কবিতার। সে তার কাজ ছেড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কথনের দিকে। কড়া কিছু বলতে যাবে তখনই কথন বলে উঠে, “তুমি যে নুডলস রান্না করছো তা চাইবো। এখন তুমি যেহেতু রান্না করছো কেবল তুমিই দিতে পারবে।”
কবিতা হতদম্ব হয়ে তাকায় কথনের দিকে, “আপনি নুডুলসের কথা বলছিলেন?”
“হ্যাঁ। তুমি কি ভেবেছ?”
লজ্জা পেল কবিতা। তার মাথায় বাজে একটি ধারণা এসেছিলো। এত বাজে কিভাবে চিন্তা করলো সে? সে তো জানে কথন এমন ছেলে না। সে মাথা নামিয়ে বলল, “কিছু না।”
“তো তুমি কি ভাবলে? তোমার মাথায় কি বাজে কিছু এসেছিলো? ছিঃ ছিঃ কবিতা এসব ভাবো তুমি?”
“আমি তেমন কিছুই ভাবি নি।”
কথন শব্দ করে হেসে উঠে, “আমি মজা করছি। গম্ভীরভাবে নিও না।”
কবিতার ফোন বেজে উঠে। মেসেজ আসে তার। সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তীর্থের মেসেজ, “অবশেষে তোমার ইচ্ছা পূরণ করলাম। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছি। এখন থেকে তুমি মুক্ত।”
বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে কবিতার। সে কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় মেসেজটির দিকে। সে তো এটাই চাইতো তাই না? এই মুক্তির জন্যই তো তার এত সংঘর্ষ করা। তাহলে মনটা এত খারাপ লাগছে কেন? কেন হৃদয়টা শূন্যতায় ভরে গেছে। কেন চোখ দুটো ভিজে আসছে তার।
কথন প্রশ্ন করে, “কার মেসেজ এসেছে যে এতক্ষণ ভরে দেখছ?”
কবিতার ঘোর ভাঙ্গে কথনের কন্ঠে, “কেউ না। কোম্পানি থেকে মেসেজ এসেছে।”
কবিতা ফোন রেখে তার কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কথন তার মতো কথা বলছে। কবিতা টুকটাক উওর দিলেও তার মন সেখানে নেই। হঠাৎ তীব্র ব্যাথা উঠেছে তার বুকে। হৃদয়টার মাঝে বেদনা ছড়িয়ে গেছে।
.
.
রাত হয়েছে। মৃণা বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢোকার সাহস হচ্ছে না তার। ভয়ে তার জান বেরিয়ে যাওয়া অবস্থা। কিন্তু রাত হয়েছে, তার যাবার অন্য কোন জায়গা নেই। অনেক সংকোচ নিয়ে বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজায়। অনেকক্ষণ পর দরজাটা খুলে আইদের মা। কেমন ঘিনঘিন দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মৃণার কষ্ট হলো খুব। যে নারী সারাজীবন তাকে মমতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। আজ তার চোখে ঘৃণা ছাড়া কিছু নেই। আইদের মা রাগান্বিত স্বরে বলে, “এতকিছুর পরও এই দোয়ারে আসতে লজ্জা করে নি তোমার?”
মৃণা জানে এখন আর কোনো মিথ্যা বানিয়ে লাভ হবে না। তবুও সে চেষ্টা করে। কান্না করতে করতে বলে, “মা বিশ্বাস করেন ওসব মিথ্যা ছিলো। এটা সত্য যে আমার বিয়ের আগে একটা সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আজকাল তা কার না থাকে? কিন্তু আমার পেটের এই বাচ্চা আপনার বংশের রক্ত।”
“আইদ আমাদের তোমার প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট দেখিয়েছে মৃণা। আর কত মিথ্যা বলবে তুমি? আর কত নাটক করবে?”
মৃণার কন্ঠ শুনে গেস্ট রুম থেকে তার মা দৌড়ে বেরিয়ে এলো। তার পিছনে ছুটে এলো আইদও।
মৃণার মা তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে একের পর এক কয়েকটা থাপ্পড় মারে। তারপর বলে, “তোর লজ্জা লাগে নাই এখানে আসতে? লজ্জা লাগে নাই? আমাদের মুখে কালি মাইখা এখানে কীভাবে আসলি তুই? আরও বেইজ্জতি করাতে আসছিস তুই? আরে তুই জন্ম হওয়ার পরেই মরে গেলি না কেন? নিজের বাপরে খাইয়া লাইলি আর কারে মারতে চাস? আমাকে? নেয় মাইরা ফেল আমাকে। নিজের হাতে মাইরা ফেল। তোর মা হওয়ার থেকে তো মরা ভালো। সমাজে বের হওয়ার মতো অবস্থা রাখিস নাই। কলঙ্কিত করে দিলি আমাকে, তোর মরা বাপকেও।”
মৃণার মা তার হাত দিয়ে নিজের গলা চেপে ধরে।
মৃণা চমকে উঠে। সে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। সে কি করবে, না করবে কিছুই বুঝতে পারে না। কাঁপতে থাকে সে।
আইদ দ্রুত যেয়ে মৃণার মা’কে ছাড়ায়, “আন্টি প্লিজ এভাবে বলবেন না। আমরা আছি তো আপনার সাথে।”
মা আবারও মৃণাকে বলল, “দেখ দেখ এই হীরার মতো ছেলের সাথে তুই কি করছিস। একবার বুক কাঁপে নাই তোর? দুই বাচ্চার বাপের সাথে তুই…. ছিঃ! আমার তো মুখে আনার আগেই লজ্জায় ডুইবা যাইতে মন চাইতেছে। এক মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সংসার ভেঙে দিলি তুই? দুই বাচ্চা থেকে বাপ ছিনিয়ে নিলি? কেন করছিস তুই এমন? কেন করছিস? কীসের জন্য? ” মা আবার আইদের হাত ধরে কান্নাভেজা গলায় বলে, “আইদ বাবা তুমি আমাকে ওই মেয়ের কাছে নিয়ে যাও। আমি ওর পা ধরে ক্ষমা চাইব। যদি এতে এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ার পাপও একটু কমে।”
“আন্টি শান্ত হন। ডাক্তার আপনাকে এত টেনশন নিতে মানা করেছে। আপনার সমস্যা হবে।”
“আমি আর আর বেঁচে কী করব? আমি মইরা গেলেই ভালো। এই মেয়ের মা হওয়ার থেকে মরে যাওয়া ভালো।”
“এমন কথা মুখেও আনবেন না। আপনি কি আমার মা’য়ের মতো না? ছোটবেলা থেকে আমার মা বাবার মতো আপনি এবং আঙ্কেলও আমাকে আদর যত্ন করে বড় করেছেন।”
“আর এর পরিবর্তে এই কলঙ্কিনীকে তোমার ঘাড়ে তুলে দিসি। বাবা বিশ্বাস করো আমি যদি জানতাম যে এই মেয়ে এত জঘন্য চরিত্রের তাহলে আমরা কবে ওকে ত্যাজ্য করে দিতাম। বাবা বিশ্বাস করো। তুমি আমাকে বৃদ্ধ আশ্রমে দিয়ে আসো। আমার এখানে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে।”
আইদ মৃণার মা’কে শান্ত করতে জুটে যায়। আইদের মা’ও বলে, “রোমা আইদ ঠিক বলছে এখানে তোর কোনো দোষ নেই। সব দোষ এই মেয়ের। তুই আমাদের সাথেই থাকবি কিন্তু এই মেয়েকে আমি এঘরে কোনমতে জায়গা দেব না।”
মৃণা পায়ে পড়ে যায় আইদের মা’য়ের, “মা এমন করবেন না। আমি এই অবস্থায় কোথায় যাব বলেন?”
“যার বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরছো, তার কাছে যাও। আমার ছেলে অনেক ভালো দেখে ওকে ফুসলিয়ে ঘরে টিকতে পেরেছ। এখন আর না।”
“সে এই বাচ্চাকে জন্ম দিতে চায় না। মা দয়া করে আমাকে বের করবেন না। বাচ্চাটা জন্ম হওয়া পর্যন্ত আমাকে থাকতে দিন। আমি কোথায় যাব? কীভাবে বাঁচবো বলেন।”
মৃণার মা রাগে এসে তার বাহু ধরে তাকে টেনে তুলল। বলল, “বেশ্যাগিরি করে যেমন বাচ্চা পেটে ধরসোস তেমনি বেশ্যাগিরি জীবন কাটা। বের হো এখান থেকে।”
মৃণার মা ধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
মৃণা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। সে স্তব্ধ, নিস্তেজ। এই ঠিকানা হারাবার পর তার কেবল খেয়ালে আসে তীর্থের ঠিকানার। আর কোনো উপায় নেই তার কাছে।
.
.
তীর্থের মা দরজা খুলে দেখে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে আগে কখনও দেখেনি সে। মেয়েটির চুল এলোমেলো। গাল লালচে হয়ে আছে। আঙ্গুলের ছাপ বসা।
“আপনে কে? কী লাগবো?”
“তীর্থ আছে?”
“তীর্থের সাথে আপনার কি কাম? তাও এত রাতে?”
“দয়া করে উনাকে একটু ডেকে দিন।”
তীর্থের মা বিরক্তি নিয়ে গেল ভেতরে। একটু পর তার সাথে তীর্থও বের হয়ে আসে। সে মৃণাকে দেখে চোখজোড়া সরু করে নিলো। পকেটে হাত ভরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই সময় আমার বাসায় কেন?”
মৃণা মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলে, “আইদের পরিবারে সব জেনে গেছে। আমাকে আর রাখবে না তারা। আমার কাছে আর কোনো ঠিকানা নেই।”
“তো?”
বিস্মিত দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকায় মৃণা তীর্থের দিকে, “এটা তোমারও সন্তান তীর্থ। একটু তো মায়া রাখো।”
তীর্থের মা তো কথাটা শুনে চড়ে গেলেন। সে ছুটে এসে মৃণাকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, “তাইলে তুই ওই নিলজ্জ মাইয়া যে আমার ছেলেকে ফাঁসাইয়া ওর জীবন নষ্ট করছিস? এখন আমার পোলার জীবন নষ্ট কইরা কি করতে আইসোস এখানে?”
“আন্টি আমার গর্ভে আপনার ছেলের অংশ। আমি তার জন্য এসেছি।”
“ছিঃ ছিঃ তোর মতো মাইয়ার পেট থেকে আমার বংশের রক্ত লাগতো না। তোর লাইগা আমার পোলার সংসার, ব্যবসা, জীবন সব নষ্ট হইসে। আমার দুইটা নাতি নাতনি আছে। তারা আমগো সাথে না থাকলে প্রয়োজনে আমার পোলার অন্য জায়গায় বিয়া করামু। তাও তোরে এই বাসার আশেপাশে রাখুম না। বাইর হো আমার ঘর থেকে।”
মৃণা ছুটে এলো তীর্থের কাছে। তীর্থের এক হাত ধরে নিজের পেটে রেখে বলল, “তীর্থ এটা তোমার সন্তান। তোমার অংশ। তোমার কি ওকে নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই? বিন্দুমাত্র না?”
চলবে…
[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]
সকল পর্ব
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086