#মুহূর্তে
পর্ব-৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“আরে কত পার্ফেক্ট স্টোরি। নায়ক নায়িকার প্রথমে দেখা হয় তারপর খুনসুটি হয় তারপর ভালোবাসা হয়। একদম পার্ফেক্ট লাভ স্টোরি।”
“অসম্ভব।” কবিতা ও কথন দুইজনে একত্রে কথাটি বলে একে অপরের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাল। আবার বিরক্তিসহ চোখ ফিরিয়ে নিলো।
কথন তার দুলাভাইকে ঝাঁজালো গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি এইসব কী আজেবাজে বলছেন। এইসব পাগল ছাগলদের মুখ লেগে লাভ নেই। আপনি যার সাথে দেখা করাতে এনেছিলেন তার সাথে দেখা করি চলেন।”
কথন তার দুলাভাইয়ের হাত ধরে এগিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু তার দুলাভাই বললেন, “ওর সাথেই দেখা করাতে এনেছিলাম।”
কবিতা চোখ দুটো ছোট ছোট করে যাচাই করে লোকটাকে, “আপনি কী আমার চেনা?”
“আসলে তুমি আমাকে দেখ নি আমি দেখেছিলাম। সিদ্দিকের কাবিনে এসেছিলাম তখন।”
“সিদ্দিক কে?”
“যার বিয়েতে এসেছ সে।”
“ও” কবিতার হঠাৎ মনে পড়ে তার কবির ভাইয়ার কথা। কবির ভাইয়া যদি জানে সে এখানে এসে ঝামেলা করেছে তাহলে তাকে কালই নিয়ে যাবে। ভয়ে তার মুখের রঙ উড়ে যায়। সে জোরপূর্বক হেসে বিনয়ের সাথে কথনের দুলাভাইকে বলে, “সরি ভাইয়া আসলে আমি জানতাম না কবির ভাইয়া আপনার চেনা। প্লিজ উনাকে আজকের ব্যাপারে কিছু বলেন না। আমাকে সেই লেভেলের বাঁশ দিবে। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
কথন হাসে কবিতার হঠাৎ পরিবর্তন দেখে, “সিংহ এর বিড়াল হওয়ার গল্প চোখের সামনে দেখছি।”
“বিড়ালের মতো খামচি দিলে বুঝবেন।”
“দুলাভাই ওর ভাইকে কল দেন তো একটা। আমি কথা বলবো।”
“না, ওকদম উনাকে নাম্বার দিবেন না।”
কথনের দুলাভাই নির্বিকারে বলে দেয়, “তুমি আগেই ওর ভাইয়ের সাথে কথা বলেছ। ওই’যে আম্মুর তোমার জন্য একটা মেয়ে পছন্দ হয়েছিলো না মেয়ের বড় ভাই তোমার সাথে বিয়ে নিয়ে কথা বলল। মেয়েটা তো ও-ই।”
কথন ও কবিতা একে অপরের দিকে তাকাল অবিশ্বাস্য দৃষ্টি।
কথন আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করে, “দুলাভাই তুমি মজা করছ তাই না? এই বিনা মগজের মেয়ের সাথে তোমরা আমার বিয়ের কথা চিন্তাও করতে পারো না। আর ওর ক্লাসজিনেসের ধারণা তোমার নাই। সকাল থেক আমার মাথা নষ্ট করে রাখছে।”
কবিতা মুখ বানায় কথনের কথাগুলো শুনে। কিন্তু এইবার সে মেজাজ গরম না করে বলে, “আমি নিজের দুর্নাম শুনে এত খুশি আর কখনো হই নি।”
কথন আড়চোখে তাকায় কবিতার দিকে। তার কথার পাত্তা না দিয়ে দুলাভাইকে আবার বলে, “দুলাভাই আপনে না ভালো। আমি এই মেয়ের সাথে কিছুতেই বিয়ে করব না।”
“এইটা তো আগে যখন এতগুলো মেয়েকে রিজেক্ট করসো তখন ভাবা উচিত ছিলো। এখন আম্মু আর তোমার কথা শুনবে না। আম্মুর ওকে অনেক পছন্দ হয়েছে। তোমার বোনদেরও। আমি এই নিয়ে কিছু বললে তোমার বোন যে ডেঞ্জারাস আমাকে কোরবানি করে দিবে। নিজে সামলাও তাদের। ওই’যে তোমার মা বোন আসছে।”
কবিতা দেখলো আবিরের সাথে একটি মহিলা তাদের দিকে আসছে। নিশ্চয়ই কথনের মা। তার সাথে কবিতার কথাও হয়েছে আগে। ভেবেছিলো কথনের মা ও বোন আসলে ভালোভাবে কথা বলবে না তাহলেই হয়তো বিয়েটা ক্যান্সেল হয়ে যাবে। কিন্তু এখন তাও সম্ভব না।
কবিতা এখন বুঝতে পারছে তাকে এতটা জোর করে কেন আনা হলো এইখানে। যদিও কবির ভাইয়া বলেছিলো ঢাকায় তার বিয়ের জন্য ছেলে দেখেছে তবুও এত জলদি সব করবে বলে সে স্বপ্নেও ভাবে নি কবিতা। আজ বাসায় যেয়ে আবির ভাইয়ার খবর করবে সে।
কথনের মা এসে কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছো মামনী? মাশাল্লাহ তুমি দেখি আগের থেকে সুন্দর হয়ে গেছ। তবে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। নিজের খেয়াল রাখছ না?”
কবিতার মন সেখানেই গলে যায়। আগেও একবার কবির ভাইয়ার সাথে তার বন্ধুর বিয়েতে দেখা হয়েছিলো এই ভদ্রমহিলার সাথে। তখনও অনেক মিষ্টিভাবে ও নরমসুরে কথা বলেছিলেন এই ভদ্রমহিলাটা। তাকে আদরও করেছিলেন। এমনকি সবার সাথেই অনেক বিনয়ের সাথে কথা বলছিলেন তিনি। কবিতা পরেরদিন দুষ্টুমি করে নিজের বান্ধবীকে বলেছিলো, ‘দোস্ত অনেক ভালো আন্টিটা। খোঁজ নিস তো তার কোনো ছেলে আছে না’কি? লাগলে ছেলেকে উঠায় নিয়ে এসে বিয়ে করে ফেলব। এত ভালো শাশুড়ী পাইলে একদম লটারি লেগে যাইব বুঝলি। যেহেতু মা এত ভালো সেহেতু ছেলেও অনেক ভালা হইব।’
কবিতা আড়চোখে তাকাল কথনের দিকে। বিড়বিড় করে বলল, “ভালো মাই ফুট! এত ভালো মা’য়ের এমন অভদ্র ছেলে হয় কীভাবে?”
কথনের মা জিজ্ঞেস করে, “কোথায় হারিয়ে গেলে মামনী?”
“না আন্টি কোথাও না। আমি ভালো আছি, আপনার কী খবর?”
উওর দেবার আগেই কথন তার মা’য়ের হাত ধরে তাকে একপাশে নিয়ে গেল। তারপর কিছু বলল বেশ বিরক্তির ভঙ্গিতে। কবিতা কথাগুলো না শুনলেও সে বুঝতে পারছে
আজ সকালের কথাগুলো আবারও তার মা’কে শুনাচ্ছে কথন।
কবিতা বিরক্তি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবির তাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “তুই আবার কী করেছিস রে?”
“বাসায় যেয়ে তোমার কাকের বাসার মতো চুলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পর বলব। ঠিকাছে?”
“তোর হঠাৎ কী হলো?”
“এইখানে যে আমাকে জোর করে বিয়ের জন্য দেখা করাতে নিয়ে এসেছ তা জেনে গেছি আর আমি বাসায় যেয়ে তোমার গার্লফ্রেন্ডকে এইটা জানাব যে তুমি কত ভিতু। বড় ভাইয়ের সাথে টু শব্দও করতে পারো না। আর বড় ভাইয়াকে বলবো তোমার গার্লফ্রেন্ডের কথা।”
“পাগল হয়ে গেছিস না’কি?”
“দেখ ভাইয়া আমাদের কি ডিল ছিলো যে তুমি আমাকে ভাইয়ার অত্যাচার থেকে বাঁচাবে আর আমি তোমাকে। তুমি তোমার পক্ষ থেকে ডিল ভাঙছ। আমি তো এত ভালো না যে চুপচাপ বসে থাকব। এছাড়া আমি শান্তি পাব না।”
“তুই… তুই এমন কিছু করতে পারবি না।”
“চ্যালেঞ্জ করছ? তুমি জানো না ভাইয়া আমাকে চ্যালেঞ্জ করা ডেঞ্জারাস।”
“এইজন্যই তোকে বিয়ের কথা এখন জানাই নি। তোকে এই বিয়ের কথা আবার কোন ছাগলে জানাল?”
কবিতা আঙুল দিয়ে ইশারা দিলো কথনের দুলাভাইয়ের দিকে। আবির তার দিকে তাকিয়ে নড়ে চড়ে দাঁড়াল। আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন ভাই? আপনাকে আজ অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে।”
কথনের দুলাভাই মুখ বানিয়ে বলল, “আমি আপনার কথা শুনেছি। আর ওদের ঝগড়া দেখে ভুলে বলে ফেলেছি।”
জোরপূর্বক হাসে আবির। কথাটা মুখ থেকে বের করেও আফসোস হচ্ছে তার।
কথনের মা ফিরে এসে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে কবিতার সাথে। অনেক আদর করে তাকে। কথনের দুই বোনের সাথেও কথা হয় কবিতার। কথনের বড় বোনটা একটু শক্ত কিন্তু ভালো। আর ছোট বোন একদম কথনের মা’য়ের মতো মিষ্টি। কবিতা ভাবছে এই কথন নামক ছেলেটাই এমন কীভাবে হলো?
ভাবতে ভাবতেই কথনের দিকে চোখ যায় তার। এমন মুহূর্তে কথনও তার দিকে তাকাল। দুইজনের চোখেমুখে বিরক্তি। বিরক্তি নিয়েই দুইজনে চোখ ফিরিয়ে নিলো। সে রাতে সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান তারা দুইজন বিরক্তি নিয়েই কাটাল।
.
.
তাহিরা রান্না করছিলো। কলিংবেলের শব্দ শুনে সে চুলা বন্ধ করে যেয়ে দরজা খুলে। ধ্রুবকে দেখে বলে, “দাদী বাসায় নেই।”
“তো?” ধ্রুব নির্বিকারে ঢুকে যায় বাসার মধ্যে। তাহির অশান্ত হয়ে দ্রুত দরজা লাগিয়ে ধ্রুবর পিছনে যেয়ে বলে, “তোকে কতবার মানা করলাম এভাবে হঠাৎ করে তুই বাসায় ঢুকে যেতে পারিস না। মানুষ দেখলে কি বলবে?”
“তাদের মুখ, তারা যা বলার বলুক আমার কী?”
“দেখ তোকে নিয়ে কথা হলেও তোর কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু আমি মেয়ে, আমার নামে বদনাম উঠবে।”
ধ্রুব সোফায় বসে ছিলো আর তাহিরা দাঁড়িয়ে ছিলো তার ঠিক সামনে। ধ্রুব তাহিরার হাত ধরে একটানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আর দুষ্টুমি করে বলল, “চল এক কাজ করি, বিয়ে করে ফেলি। তারপর বাসায় এলে, তোর কোলে মাথা রাখলে অথবা তোকে জড়িয়ে ধরলেও কেউ কিছু বলতে পারবে না।”
তাহিরা এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠে ধ্রুবর কথা শুনে। পরের মুহূর্তে সে বুঝতে পারলো ধ্রুব রসিকতা করছে। তাই সে ধাক্কা দিয়ে ধ্রুবকে কাছ থেকে সরিয়ে দেয়, “ফাজলামো না ধ্রুব। এইসব ফাজলামো করার বিষয় না।”
“আমি সিরিয়াস। তোর বোন গতকাল বলল তুই না’কি সর্বগুণেগুণান্বিত। তোকে যে বিয়ে করবে তার ভাগ্য খুলে যাবে তাহলে আমি অন্যকাওকে চান্স কেন দিব?” বলেই শব্দ করে হাসে ধ্রুব। তাহিরা বরাবরই বিরক্ত ধ্রুবর ব্যবহারে। সে খোঁটা মেরে বলল, “আমার সাথে বিয়ে করলে তোর ওই হাজারো প্রেমিকার কী হবে?”
“ওরাও থাকবে।”
“আমি এমন একটি মানুষকে বিয়ে করব যে কেবল আমাকে ভালোবাসবে। আর যার মনে শুধু আমিই থাকব কিন্তু তোর মনে এত মেয়ে ভরে আছে আমার জন্য কোনো জায়গাও খালি হবে না।”
তাহিরা রাগে কটমট করতে করতেই রান্নাঘরের দিকে রওনা দেয়। তারপর আটার ডিব্বা বের করে রুটি বানানোর জন্য। হঠাৎ তার পিছনে কারও আসার আভাস পায়। নিশ্চয়ই ধ্রুব হবে। কিন্তু তার ধ্রুবর সাথে কথা বলার জন্য মোটেও রুচি হলো না।
ধ্রুব এসে তাহিরার পিছনে দাঁড়ায়। পিছন আলতো করে জড়িয়ে ধরে তাহিরাকে। তার হাত দুটো তাহিরার পেটে আবদ্ধ করে এবং তাহিরার পিঠ ঠেকায় নিজের বুকেতে। তাহিরার কাঁধে মাথা রেখে নরম গলায় বলে, “তুই এত ছোট এত রাগ করিস কেন বল তো।”
তাহিরা কেঁপে উঠে ধ্রুবর স্পর্শে। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। আজকে ধ্রুব প্রথম তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরলো। বাহিরে থেকে যতটা স্থির ভেতর থেকে ততটাই অশান্ত হয়ে আছে তাহিরা। ধ্রুবর নিশ্বাসের উষ্ণতা তার কাঁধে ছুঁতেই কেঁপে উঠে সে। কাঁপানো গলায় সে বলল, “দূরে সরে কথা বল।”
“কেন?”
“আমি বলেছিলাম না দূরে থাকতে। তুই দিনদিন আমার কথা অমান্য করতে মজা পাস তাই না? তোকে আমি আমার হাত ধরতে মানা করেছি আর তুই আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছিস? আমার স্বামী ছাড়া অন্যকোনো পুরুষের অধিকার নেই আমাকে এভাবে ছোঁয়ার। ছাড় আমাকে।”
“কিন্তু তোকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না যে। নড়াচড়া না করে একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। তোর চুলের ঘ্রাণটা অনেক সুন্দর। তোর ঘ্রাণও। কেমন মিষ্টি সুবাস।”
ধ্রুব আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাহিরাকে। তাহিরার চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে পারে। ধ্রুবর নাকের, ঠোঁটের ছোঁয়া এসে লাগছে তাহিরার গলায়। তার স্পর্শে কুঁকড়ে উঠে সে। তার ভেতরটা মুচড়ে উঠে। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। এক অজানা অনুভূতি এসে তাকে কাবু করে। অশান্ত হয়ে উঠে সে।
চলবে….
[বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন। ধন্যবাদ।]
সকল পর্ব-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=381227816949915&id=100051880996086