মেঘকন্যা☁️ Part_04

মেঘকন্যা☁️
Part_04
Writer_NOVA

রাতে……

ঘুমের ঘোরে মনে হলো আমার ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিশ্বাস পরছে।সাথে অনেক শীত করছে।বেশ অস্বস্তি লাগছে।ফট করেই ঘুমটা ভেঙে গেল।তাকিয়ে দেখি রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার।লাইটের আলোতে আমি ঘুমাতে পারি না।তাই সবসময় রুমটাকে অন্ধকার করেই ঘুমাই।ডিম লাইটের আলোতেও ঘুম আসে না।একটু নড়াচড়া করে ডান কাত থেকে বাম কাত হতে নিলেই টের পেলাম, কেউ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে রেখেছে। তখনও মাথায় কিছু আসেনি।কেউ এভাবে কোল-বালিশের মতো জরিয়ে ধরে রাখলে ঘুমানো যায় নাকি।

আমি নড়াচড়া করা শুরু করলাম।তখন কেউ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো—-
বউ,বেশি নড়াচড়া করো না।আমাকে ঘুমাতে দেও।
আমিঃ আচ্ছা। (আনমনে)

আনমনে “আচ্ছা” বলার পর আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো।আমি তো একা ঘুমিয়ে ছিলাম।দরজা,জানালা সব বন্ধ। তাহলে আমার সাথে কে? ভয়ে হাত-পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেল।আমার দুটো হাতের ওপর দিয়ে সে এক হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরেছে।হাত দুটো ছুটানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু শুধু শুধু শক্তি ব্যয় ছাড়া আর কিছু হলো না।আমাকে নড়াচড়া করতে দেখে সে আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।তার হাত-পা গুলো হিম করা ঠান্ডা হয়ে আসছে।কোনমতে এক হাত অতিকষ্টে তার বাহু ডোর থেকে ছুটিয়ে আমি অন্ধকারে হাতড়ে নিজের মোবাইলটা খুঁজতে লাগলাম।

এবার সে বিরক্তির সুরে বললো—
বুঝতাছি না তোমার সমস্যা কি বউ? শান্তিতে কি একটু ঘুমাতেও দিবে না।দিনে তো তোমার চিন্তায় একটু ঘুমাতে পারি না।অন্ততপক্ষে রাতে একটু ঘুমাতে দেও।

আমি ততক্ষণে ভয়ে দরদর করে ঘামছি।হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে মোবাইল নিয়ে ফ্লাশ লাইট জ্বালাতেই আমি আৎকে উঠি। আমার সাথে কেউ নেই।

আমিঃ এটা কি হলো? আমি স্পষ্ট একজন পুরুষের কন্ঠ পেলাম।আমার মনে আছে কেউ আমায় শক্ত করে জরিয়ে ধরে ছিলো।এখন কোথায় গেলো।আমি কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম।মনে হয় এমনটাই হবে।দরজা,জানালা সব বন্ধ ভেতরে কেউ আসবে কি করে? আচ্ছা, কোন জ্বীন নয়তো? বাপ– রে🥶। আমি তো শুনেছিলাম রুম অন্ধকার করে ঘুমালে রাতে জ্বীন আসে।আল্লাহ বাঁচাও।গত ২ দিন ধরে কি হচ্ছে আমার সাথে। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায যলিমিন।লা ইলাহা ইল্লা আনতা —

ভয়ে ভয়ে রুমে লাইট জ্বালিয়ে দরজা,জানালা চেক করলাম।না,সব বন্ধ। পুরো রুমে কেউ নেই। লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম।কাঁথা দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুড়িয়ে তার ভেতরেও ঠকঠক করে কাঁপছি। আমি সিউর এখন আমার রুমে জ্বীন আছে।সারা রুমে হিম শীতল একটা বাতাস বইছে।

🌨️🌨️🌨️

মেঘার কান্ড দেখে সোফায় মুখ গোমরা করে দুই হাত গালে দিয়ে বসে আছে মেঘপুত্র। কোথায় ভেবেছিলো বেচারা আজ সারারাত বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে।সেই ভাবনায় এক বালতি পানি ফেলে মেঘা নিজেও ঘুমাবেনা আর ওকেও ঘুমাতে দিবে না।অন্ধকার ছাড়া সেও ঘুমাতে পারে না।আর তার গুণধর বউ লাইট জ্বালিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।

মেঘপুত্রঃ আল্লাহ, আমি এখন কোথায় যাবো? ভাগ্যিস ঠিক সময়ে অদৃশ্য হয়ে সোফায় চলে এসেছি। নয়তো আমার জ্বীনের ভয় পাওয়া বউ আমাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যেতো।ধূর,আজও আমাকে সোফায় ঘুমাতে হবে।বিয়ের পর নাকি বউ ছাড়া ঘুমাবো🥺।বলেন তো এটা কি সহ্য হয়।মাথার মধ্যে যত্তসব ফালতু চিন্তা নিয়ে ঘুরে এই মেয়েটা।কে বলবে? সে যে মেঘপুত্রের বউ মেঘকন্যা।আজ আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কি আর করবো এখন? জেগে জেগে বউ পাহারা দেই।

সারারাত ভয়ে আর ঘুম আসেনি।এই মনে হয় কেউ আমাকে ধরতে আসছে,নয়তো কাঁথা ধরে টান দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কথায় আছে বনের বাঘে খায় না তো মনের বাঘে খায়। আমার ঠিক সেম দশা হয়েছে। ফজরের নামাজ পড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। অনেক দিন পর আজ সূর্যদয় দেখবো।তারপর ইশরাকের(নফল)নামাজ পরে আম্মিকে রান্নায় সাহায্য করবো।সূর্য উঠতে এখনো ঢেঢ় সময় বাকি।মসজিদে এখনো জামাআত শুরু হয়নি।হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।

আমিঃ রাতে কি আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম নাকি সত্যি ছিলো সেটা। আমাকে বারবার বউ বলছিলো। তাহলে কি যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল সে— ধূর কি ভাবছি।সে আসবে কোথা থেকে? সে তো আমার মুখও দেখিনি।আমার তো মনে হচ্ছে না আমি ভুল কিছু দেখেছি। কেউ শক্ত করে আমায় ধরে ছিলো।তার হাত-পা গা হিম করা ঠান্ডা ছিলো।এগুলো স্বপ্ন বা মনের ভুল কিছু তেই হতে পারে না। নিশ্চয়ই কোন জ্বীনের কাজ।আমাকে ভয় দেখানোর জন্য। আমাকে এর পেছনের রহস্য খুঁজে বের করতে হবে।এক্ষেত্রে আমাকে একজনি সাহায্য করতে পারে। আর সে হলো আয়িশ।এই আয়িশ ব্যাটার দুই দিন ধরে কোন খোঁজ নেই কেন?অসুস্থ হয়ে পরলো নাকি।নাহ্ বিকালে একবার ওর বাসায় যেতেই হয়।

হঠাৎ মনে হলো পেছন থেকে কেউ জাপটে ধরে তার মুখ আমার চুলে গুঁজে দিলো। তার গরম নিশ্বাস আমার কানে বারি খাচ্ছে। লো ভয়েজে কানের কাছে তার ঠোঁট এনে বললো।

—- ছোট মাথাটাকে এত প্রেসার কেন দেও বলতো।কি দরকার আছে এতো ভাবার? যা হচ্ছে তা হতে দেও।সবসময় মনে রেখো আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে।কি জানি বলছিলে তুমি? ওহ মনে পরেছে।তোমার সাথে এরকম অদ্ভুত কাজগুলো তোমার সাথে জ্বীনে করছে।তাও ভয় দেখানোর জন্য। কোন জ্বীনের এতবড় সাহস আছে নাকি আমার বউকে ভয় দেখাবে।

ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে আসছে।আবারো সেই হিম শীতল স্পর্শ। এবার সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম।ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই।

— আল্লাহ হাফেজ বউ।নিজের খেয়াল রেখো।আর এত ভয় পেয়ো না।আমার বউকে এতো ভয় পেলে চলবে না।নামাজে দেরী হয়ে যাচ্ছে।

আবারো কানের সামনে নিচুস্বরে কেউ কথাটা বললো।বাতাসে তার কথাগুলো বারি খাচ্ছে। বুকের ভেতর কেউ মনে হচ্ছে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।কি মিষ্টি কন্ঠ!! কোন ছেলের ভয়েজ যে এত মধুর হতে পারে তা আমার কোন ধারণা ছিলো না। সারা শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে। দৌড়ে রুমে গিয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলাম।বুকে হাত দিয়ে জোর শ্বাস ছারতে লাগলাম।

মেঘপুত্রঃ পাগলী একটা।এতো ভিতু কেন মেয়েটা? শক্তি ফিরে পেলেও মানুষের মতো চালচলন কিছুই বদলানি।রাতে তো আমার ঘুম হারাম করেছে।আল্লাহ জানে কত রাত এরকম লাইটের আলোতে ঘুটঘুট করে তাকিয়ে থাকতে হবে। এই রে মসজিদে নামাজ শুরু হয়ে গেছে। আমি এখন ভাগি।

মেঘপুত্র মুচকি হাসতে হাসতে বাতাসের বেগে মসজিদে চলে গেল।আর মেঘকন্যা ভয়ে কিচেনে মায়ের কাছে ছুটলো।

🌨️🌨️🌨️

সাওদা বিনতে মেঘা,দেখতে সত্যি অপূর্ব সুন্দরী। কারো নজর একবার তার ওপর পরলে তার অন্য কোন দিকে নজর পরবে না।তার গায়ের রংটা শুভ্র মেঘের মতো। দুধের মধ্যে কয়েক ফোঁটা নীল মেশালে যে রংটা হবে সেটাই তার গায়ের রং। এতটা সাদা যে হাতে থাকা নীল রগ-গুলোও স্পষ্ট দেখা যায়।

তবে তার গায়ের রংটা একেক সময় একেক বর্ণ ধারণ করে। চাঁদের ওপর নির্ভর করে রং পাল্টায়।পূর্ণিমা,আমাবস্যার মাঝেও কয়েক বার ভিন্ন ভিন্ন রং হয়।চোখ দুটো টানা টানা,নাকটাও চোখা। হাটু অব্দি হালকা লাল ঘন চুল।হাত-পায়ের নখ ও চোখ দুটো হালকা আকাশি কালার।বয়স বেশি নয়।মাত্র ২২ বছর।অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো মেঘা মানুষের ভিড়ে গেলেই তার গায়ের রং, চোখ, চুল যাবতীয় অঙ্গ-পতঙ্গ সাধারণ মানুষের মতো হয়ে যায়।প্রথম প্রথম তার বাবা-মা ও সে অবাক হলেও এখন বিষয়টা স্বাভাবিক ধরে নিয়েছে।

বাবা মোহাম্মদ আবিদ ইসলাম পেশায় সরকারি চাকুরিজীবী। অনেক বড় পদে আছেন তিনি।মা জাওদা ইসলাম গৃহিণী। আবিদ ইসলাম ও জাওদা ইসলাম ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন।বিয়ের চার বছরেও তাদের কোন সন্তান হয়নি।ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারেন আবিদ ইসলাম কখনো বাবা হতে পারবেন না।এই খবরটা শুনে জাওদা ইসলাম তার স্বামীকে ছেড়ে চলে যায়নি।সব বাঁধন থেকে তাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন আবিদ ইসলাম। কিন্তু সে তার স্বামীকে ফেলে কোথাও যায়নি।তারা নিজেদের জন্য একটা বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়েছিলো।তার আগেই তারা মেঘাকে নিজেদের বাসার দরজার সামনে পান।

সেদিন ছিলো উজ্জ্বল পূর্ণিমা।চারিদিকে দিনের মতো ফর্সা চাঁদের আলো। আজও বিছানার দুই দিকে দুজন ঘুরে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে ।হঠাৎ জাওদা ইসলাম একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পান।প্রথমে ভুল ভেবে পাত্তা দেন না।কিন্তু কিছু সময় পর আবার কান্নার আওয়াজ পান।

জাওদাঃ কি গো ঘুমিয়ে গেছো?

আবিদঃ কি হয়েছে?

জাওদাঃ তুমি কি কোন বাচ্চার কান্নার শব্দ পাচ্ছো?

আবিদঃ এত রাতে বাচ্চা আসবে কি করে? আশে পাশে কোন বাড়িও নেই। এমনটাও নয় যে আমাদের বাড়িতে কোন ভাড়াটে থাকে।তুমি ভুল শুনেছো।ঘুমিয়ে পরো তো দেখি।

জাওদাঃ আমি ভুল শুনিনি।কিছু সময় ধরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।

আবিদঃ অনেক সময় এমন হয়।দুষ্ট জ্বীনেরা ভয় দেখানোর জন্য বাচ্চা সেজে কান্না করে। তুমি সেদিকে কান না দিয়ে ঘুমাও।রাত অনেক হয়েছে।

জাওদাঃ চলো না দেখে আসি।

আবিদঃ তুমি কি পাগল হলে জাওদা।রাত পৌনে ১ টা বাজে।এই সময় বাইরে যাবো??

জাওদাঃ প্লিজ এমন করো না। একবার দেখে আসি।আমার মন বলছে নিশ্চয়ই কোন বাচ্চা কাঁদছে।

আবিদঃ বাচ্চা নিয়ে সারাদিন চিন্তা করতে করতে তোমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে জাওদা।

জাওদাঃ তুমি কথা বাড়িয়ো না।একবার দেখেই চলে আসবো।চলো প্লিজ।

আবিদঃ তোমার বাচ্চাদের মতো জেদ করা এখনো গেলো না জাওদা।ঠিক আছে চলো।

দুজন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। বাইরে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতেই শুভ্র মেঘের মতো দেখতে একটা ফুটফুটে বাচ্চা দেখতে পেলো।জাওদা ও আবিদ ইসলামকে দেখেই বাচ্চাটা খিলখিল করে হেসে উঠলো। বাচ্চাটার সারা শরীর থেকে সাদা আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। সেই আলোর আভা সোজা আকাশে উঠে গেছে। চাঁদের পাশে কয়েক টুকরো শুভ্র মেঘের ওপর আলোটা ঠেকেছে।

জাওদা ইসলাম খুশি হয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না।তারপর থেকে বাচ্চাটা তাদের কাছে থাকে।আবিদ ইসলাম বাচ্চাটাকে তার নিজের বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে চাইলে জাওদা ইসলাম তা করতে দেয়নি।সে বলেছে,আল্লাহ তাদের জন্য বাচ্চাটাকে উপহার পাঠিয়েছে।কেউ যাতে সন্দেহ না করে তার জন্য সেখানকার বাসা বিক্রি করে ঢাকার গুলশানে এসে নিজেদের বাড়ি করে।

সারাদিন তেমন কোন অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হইনি মেঘা।তাই রাত ও সকালের কথা পুরো ভুলেই গিয়েছে।বিকালে তৈরি হয়ে আয়িশের বাসায় গেলো সে।কিন্তু গিয়ে যা দেখলো তাতে হাসতে হাসতে ওর পেট ব্যাথা হয়ে গেলো।

(চলবে)

রিচেইক দেওয়া হয়নি।তাই ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here