মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব – ১৭

0
300

মেঘদিঘির পাড়ে – ১৭
মালিহা খান

৩৪.
আচ্ছন্ন বিকেল। সূর্যের তেজী আলোও মোলায়েম হয়ে আসে এসময়টায়। ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যা নামার ঘ্রান তীব্রতা পায়। একটাসময় হারিয়ে যায় বিকেল। সূর্যের কঠিনতা নমনীয়তায় ডুবতে ডুবতে শেষমেষ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। অথচ লালচে সুন্দরী আকাশটায় তখন গোটা একটা দিনের স্মৃতি। একটা দিন!
ইটরঙা সিঁড়ি ঘাটে বসে থাকা যুবতীর শুভ্র ওড়নার আচঁলে কতকগুলো সাদা নয়নতারা ঠাঁই পেয়েছে। নিজের দীর্ঘ বিঁনুনির ভাঁজে ভাঁজে সেই নয়নতারাদের গেঁথে দিতেই খুব মগ্ন হয়ে রয়েছে যুবতী। নিশব্দ পাড় ঘিরে রাখা সবুজ গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে একটু পর পর চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে বা কাঁকের দলের একটু পরপর ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া, নরম বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা।
তার ঠি ক পাশেই সামান্য দুরত্বে ধবধবে শার্ট গায়ের চোখা নজরের পুরুষটি একাগ্র নয়নে তাকেই দেখে চলেছে কখন থেকে। দৈবাৎ হাওয়া ওড়নায় আচঁল উড়িয়ে দিলো। নয়নতারারা গিয়ে ভেসে গেলো দিঘির জলে। মগ্ন যুবতী চকিতে ধ্যান ভাঙলো। অস্ফুটস্বরে ‘আ..আ…’ করতে করতে কোনরকম হাতের থাবায় দু’টো ফুল বাঁচাতে পারলো সে। শান্তনিরব নিশ্চুপ হয়ে ফুলদুটো গেঁথে নিলো বিঁনুনির শেষপ্রান্তে।
এরপর পাশে বসা পুরুষটির দিকে চেয়ে মিষ্টি কন্ঠে বললো,”

-“কেমন লাগছে?” কি রিনরিনে কন্ঠ। প্রিয়র চোখে একটু প্রশংসা শোনার অভিপ্রায়ে কাতর হচ্ছে গোপনে।

সায়নের তন্ময় মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হলোনা বিন্দুমাত্র। সে চেয়ে রইলো, যেভাবে সে চেয়ে ছিলো এতক্ষণ, অনেকক্ষণ। যেনো কতদিন দেখেনি। কতকাল, কতমূহুর্ত, কতদিবস।
তখন ঝুঁকে যাওয়ায় ইভার সামনের কাঁটা চুল কানের পিছ থেকে খুলে গেছে। সায়ন হাত বারিয়ে পালকের চেয়েও নরম স্পর্শে চুলগুলো জায়গামতো গুঁজে দিতে দিতে বললো,

-“বলতে পারবোনা, তুমি লজ্জা পাবে।”

ইভা বহুকষ্টে যতটুকু লজ্জা চেপে প্রশ্ন করেছিলো, বিধ্বংসী উওরে তাও আর দীর্ঘস্হায়ী হলোনা। চোখের পলক বারবার পড়লো। মসৃন গাল অদ্ভুত লাজুকতায় ভরে উঠলো। সায়ন চুল গুঁজেই হাত সরিয়ে নিলো। দিঘির জলে চাইলো। বর্ষা শেষ। শাপলাও নেই। সচ্ছ পানি।
আংটি পরানোর মাস পেরিয়েছে। ইভার পরিবার আদরের মেয়ের বিয়েটা তারা অতো সাদামাটা করে দিতে চান না। আরো প্রায় দু’সপ্তাহ পর নির্ধারণ হয়েছে বিয়ের তারিখ। সেই অপেক্ষাতেই কাটছিলো দিন। কাজের চাপে তারও অবসর হয়না গ্রামে আসার। তবু সে যে আসেনি এমন না! মেয়েটাকে যে কবে একবারে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। কবে?
সে একা মানুষ। মা, বাবাহীন জীবন। ছোট থেকে একাকীত্ব চিরসঙ্গী হলেও আজকাল কেবল সেই অভ্যস্ত জীবন থেকে অন্যভস্ত হতে ইচ্ছে করে।
সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হঠাৎই নিজের বা’হাতের তালু মেলে ধরে অদ্ভুত নরম স্বরে বলল,

-“তোমার হাতটা দাও..”

ইভা প্রশ্নচোখে তাকায়। সায়নের মেলে রাখা হাতের দিকে একবার দেখে আবার সায়নের মুখের দিকে তাকালো। হাতের উপর সময়মতো হাতটা না পেয়ে সহসাই ভ্রু কুঁচকালো সে। হাল্কা স্বরেই খানিক জোর দিয়ে বললো,”দাও?”

-“কেনো?”

-“দাওনা।”

অধৈর্য শোনায় সায়নের কন্ঠ। উপেক্ষা করবার মতন আবদার নয়। ইভা এদিক ওদিক তাকায়। যদিও এদিকে কেউ আসবেনা। এই ঝোপজঙ্গলের দিকে কেউ আসেনা। তারউপর সন্ধ্যা নামবে একটুপর। গ্রামের ভৌতিক বিশ্বাসগুলোর জন্য হলেও এদিকে কেও পা মাড়াবেনা। লাজুকগোছে সে হাত এগিয়ে দেয়।

-“কেউ দেখলে?”

নিজের পুরুষালি রুক্ষ হাতের মধ্যে পেলব হাতটা জড়িয়ে নিতে নিতে সায়ন বললো,

-“কে দেখবে? তোমার ভাই না বাড়িতে নেই? সে ছাড়া আর কেও সমস্যা করতে আসবেনা। নিশ্চিত থাকো।”

ইভার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে হাতের পিঠে মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের কপাল ঠেকালো সায়ন। কি উষ্ণতায় ভরা শীতল স্পর্শ। কন্ঠ দিয়ে শব্দ বেরোতে চায়না। তবু একটু স্বাভাবিক হবার জন্য কোনরকমে উচ্চারণ করলো,

-“আপনি সারাক্ষণ ভাইজানের সাথে লেগে থাকেন কেনো?”

সায়ন তাকায়না। ক্ষীণ, জড়ানো কন্ঠে উওর দেয়,
-“আমি না, তোমার ভাইজান লেগে থাকে।”

ইভা আর টু’শব্দটি করলো না। সূর্যের আলো বেশ ঢলে পড়লো। হলদে আভা ক্রমশ লালচে হয়ে উঠলো।মাথা ঝুঁকিয়ে হাতে কি আদরে কপাল ঠেকিয়ে রাখা সায়নের দিকে নরম চোখে চেয়ে রইলো ইভা। প্রচন্ড লজ্জায় হাত পা কাঁটা দিয়ে উঠলেও সে একবারের জন্যও হাত ছাড়তে বললোনা।
সেভাবে কতোসময় কাটলো জানেনা সায়ন। যখন সম্ভিৎ ফিরলো তখন বেশ অবাক হয়ে বললো,

-“তোমার দেখি পশম দাড়িয়ে গেছে। ভয় পাচ্ছো? আমি হাত ধরেছি বলে?”

ইভা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়। মিনমিন করে বলে,”না..নাহ্।”

সায়ন কি যেনো দেখে তার লাজুক মুখে। অত:পর খুব ধীরগতিতে হাতটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে যেতেই চমকে তাকায় ইভা। সায়ন এক ভ্রু উঁচিয়ে গাঢ় কন্ঠে বলে,

-“দিবো?”

ইভা আৎকে উঠে। প্রায় চিৎকার করে উঠে,”না..নাহ্।”

সায়ন সরবে হেসে ফেললো।

-“আস্তে! মজা করছিলাম। শান্ত হও।”

রসিকতা বুঝে ফেলতেই ভ্রু কুঁচকিয়ে দিঘির জলে দৃষ্টি আটকায় ইভা। বিশাল সূর্যটা বোধহয় দিঘিতেই ডুবে যাচ্ছে। একটু একটু করে প্রায়ান্ধকার হয়ে আসছে আশপাশ। ইভা জলে ডুবিয়ে রাখা পা নাড়িয়ে মোহাচ্ছন্ন বলে,

-“মেঘদিঘিকে দেখুন, ও এতে সুন্দর কেনো? আকাশ এতো সুন্দর কেনো?”

-“কিহ্? কি বললে?”

সায়নের তাড়াহুড়োর প্রশ্নে তাল কেটে যায় ইভার। ঘাড় বাঁকিয়ে শূন্য কন্ঠে বলে ,”কি বললাম?”

সায়ন আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে?
-“কি যেনো নাম বললে?”

-“মেঘদিঘি।”

-“মেঘদিঘি? এটার নাম? শুনিনি তো।”

ইভা ঈষৎ জড়োসড়ো হয়ে উওর দেয়,”আমি রেখেছি।”

-“তাই নাকি?”

-“হু।”

সায়ন কথা বাড়ায়না। সূর্য ডোবার আগমূহুর্তের অদ্ভুত সুন্দর আলোটা ছেঁয়ে আছে ইভার গায়ে। মুখের একপাশে। সায়ন মন ভরে দেখছিলো। ইভা হঠাৎ বলে,”বাড়ি ফিরতে হবে, আম্মা চিন্তা করবে।”কন্ঠে জড়তা। সায়নকে হাত ছেড়ে দেবার ইঙ্গিত। সায়ন হাত ছাড়েনা। ফিসফিসালো কন্ঠে বলে,

-“এই আলোর কি নাম জানো?”

ইভা একপলক তাকায় সায়নের দিকে। চোখে চোখ পড়ে যায়। সায়ন অন্যকন্ঠে বলে,

-“জানোনা?”

ভীষণ লজ্জায় জর্জরিত হয়ে ইভা বলে,
-“কনে দেখা আলো।”

ওপাশ থেকে উওর আসে,
-“তবে দেখতে দাও। তাড়া কিসের!”

~চলবে~
[রিচেক হয়নি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here