মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব – ১৯

0
307

মেঘদিঘির পাড়ে – ১৯
মালিহা খান

ইউসুফ হাসলো। স্মিত হাসি। বিভার মিনমিন করে করা প্রলয়ংকর প্রশ্নটা যে বেশ একটা ঝড় তুলে দিলো, বাহিরে তার লেশমাত্র প্রকাশ পেলো না। জবাবে প্রতীক্ষারত অঙ্গনাকে প্রতিক্ষায় রেখেই উঠে দাড়ালো সে। বিষন্নার মতোন চেয়ে থাকা চোখদুটোকে বেমালুম উপেক্ষা করার মতো ক্ষমতা নেই, তবু করতে হয়। করে যেতে হয়..হচ্ছে।
ধৈর্য্যর পারদমিটারটা যেনো কাঁচফেটে চৌঁচির হয়ে গেলো মূহুর্তেই। খপ করে ইউসুফের কবজির কাছে প্রচন্ড শক্ত করে টেনে ধরলো বিভা। শেষ শ্রাবণের ঘনকালো মেঘটার মতোন অভিমানিনী স্বরে বললো,

-“আপনি উওর দিবেন না?”
নিজের উপর নিয়ন্ত্রনহীন সে বরাবরই। রাগের বসে, ছেলেমানুষী করে কখন কি পাগলামি করে নিজেও জানেনা। আর এই পুরুষের উপর তো আজন্মের আক্রোশ।
অথচ তার দ্বারা কৃত সকল ঝড় যে এই মানুষটা মাথা পেতে সয়ে নেয় সেটাই কেবল চোখের আড়াল হয়ে যায় সবসময়। কেবল মানুষটার নির্লিপ্ততাই দেখে গেলো বোকা মেয়েটা। এই নির্লিপ্ততার পিছনে লুকিয়ে থাকা অগাধ প্রশ্রয় টা দেখতে পেলোনা। কখনোই..।

নখগুলো খুব সম্ভবত মাংস ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে। ইউসুফের ঠিক তেমনটাই মনে হলো। একটা একান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খানিকটা নরম গলায় সে বললো,

-“সারাক্ষণ এসব ঘুরে কেনো মাথায়?”

-“আপনার কি? আমার মাথা। আমি ঘুরাই। আপনার কি?” রাগে থিঁতিয়ে উঠলো বিভা। হাতের চাপ প্রবল হলো। তার ছেলেমানুষী উওরটায় আবারো হেসে ফেললো ইউসুফ। একবার হাতের দিকে তাকালো। চটচটে রন্জিত তরল পদার্থটা বেরিয়ে এসেছে। বললো,

-“নখে ব্যাথা পাবে বিভা। ভেঙে যাবে। ছেড়ে দাও।”

-“হোক, ভাঙুক, ছাড়বোনা।” ব্যস! হাতের দিকে ফিরেও তাকালোনা বিভা। চোখদুটো কি লাল হয়ে গেছে মেয়েটার। গলা দিয়ে নেমে যাওয়া শুকনো ঢোক গুলোও নজর এড়ায়না। কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা। চোখের টা নাহয় পারছে, মনেরটা?
ক্লান্ত ইউসুফ আবার বসে পড়লো হাঁটু গেড়ে। এর কাছে তার কন্ঠটাও উঠেনা। তুলোর মতোন নরম হয়ে যায়। এতো চায়। তবু একটু ধমকাতে পারেনা।

-“জেদ করেনা? ছেড়ে দাও?”কি অদ্ভুত নরম পুরুষালী স্বর।
বিভা গোল গোল করে তাকালো। ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকালো। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসতেই ঠোঁটের কোঁণ প্রসারিত করে হাসলো ইউসুফ। আস্তেধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।
বিভা বারদুয়েক পলক ফেললো। পুতুলের মতোন ঠেকলো ইউসুফের কাছে। বললো,

-“সবসময় এতো জেদ করো কেনো?”

-“আপনার সাথেই তো করি। আর কারো সাথে তো করিনা। এতেও আপনার সমস্যা?”

ইউসুফ হাঁফ ছাড়ে। উঠে যেতে যেতে বিরবির করে বলে,”সমস্যা নেই। কোনো সমস্যা নেই।”
আর মনে মনে বলে,
-“তোমার প্রদর্পণেই আমার সমর্পণ।”

৩৬.
গ্রামে শীত পড়ে গেছে। অক্টোবরের শুরু কেবল। তবু শেষরাতের দিকে মোটা কাঁথার নিচেও ঠান্ডায় শরীর জমে হিম হয়ে যায়।
বরফের মতোন পা দু’টো সুঁড়সুঁড় করে কাঁথার ভেতর গুঁটিয়ে নিলো তন্দ্রা। আধঘুম চোখদুটো কোনরকমে মেললো। সরফরাজ সোজা হয়ে ঘুমিয়ে আছে। একহাত কপালে উঠানো, আরেকহাতে সে ঘুমিয়েছে। একেতো রক্তজমানো ঠান্ডা। তারউপর কোথ্থেকে যেনো দমকা বাতাস এসে ঘর ছেঁয়ে গেলো। তন্দ্রা হুরহুর করে কেঁপে ওঠে। উওরের জানলাটা বোধহয় খোলা। নিশ্চিত উনি খুলেছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখার নূন্যতম শক্তিটাও পেলোনা সে। নড়েচড়ে সরফরাজে দিকে চেপে আসলো। একহাত উদোম বুকের উপর রাখলো। উষ্ণ বুকটাও কি ঠান্ডা হয়ে আছে!
অস্ফুট স্বর শোনা গেলো সাথেসাথেই,

-“তন্দ্রাবতী? নড়ছো কেনো?”

তন্দ্রা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই অভিযোগ ছুঁড়ে,
-“শীত করছে। আপনি আমাকে ধরে ঘুমান না কেনো?”

সরফরাজ চোখ মেলে। কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে তন্দ্রার গায়ের কাঁথাটা গলা পর্যন্ত টেনে দেয়। কিভাবে জড়িয়ে ধরবে সে মেয়েটাকে? পেটে চাপ লাগবেনা? বুঝতে চায়না।
তার কাছে লেপ্টে থেকেও তন্দ্রার দাঁত কাঁপছে। কিড়কিড় শব্দ হচ্ছে। সরফরাজ বুক থেকে তন্দ্রার হাতটা সরিয়ে দেয়। মাথার নিচ থেকে নিজের হাতের বদলে বালিশ টেনে দিয়ে উঠে বসে। তন্দ্রা শিশুসুলভ কন্ঠে বুলি ছাড়ে,

-“কই যান?”

-“জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি। শীত কম লাগবে।”

জানলা বন্ধ করে দিয়ে আলমারি খোলে সরফরাজ। দেখেশুনে আরেকটা কাঁথা বের করে। বেশ ভারি দেখে।আসার আগে ধীরগতিতে চলতে থাকা ফ্যানটাও বন্ধ করে দেয়। ঘরটা নীরব হয়ে যায়। নিশ্বাসের শব্দও প্রতিধ্বনির মতো শোনায়।
তন্দ্রার গায়ের পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে হাতের কাঁথাটা দু’ পাল্লা করে ছোট্ট শরীরটার উপর দিয়ে দেয় সে। তারউপর আবার পাতলা কাঁথাটা দিয়ে কপালে হাত রেখে বলে,

-“এখনো শীত করছে তনু?”

-“উহু। শুতে আসেন।”

সরফরাজ নির্ভার শ্বাস ছাড়ে। কাঁথাটা আরেকটু টেনেটুনে তন্দ্রার পেছনে যেয়ে শুতেই তন্দ্রা যারপরনাই অবাক হয়ে বলে,”পেছনে যেয়ে শুচ্ছেন কেনো? এপাশে আসেন।”
সরফরাজ কাঁথার নিচে ঢুকে যায়। তন্দ্রাকে কাছে টেনে পিঠটা চওড়া বুকের সাথে ঠেকিয়ে নিতে নিতে বলে,”এইযে তোমাকে ধরে শুচ্ছি। আর কথা না। ঘুমিয়ে পড়ো।”

তন্দ্রা হাসল। সুখের হাসি। ওপাশ থেকে জড়িয়ে এপাশে আসা শক্তপোক্ত হাতটার উপর হাত রেখে চোখ বুজে বললো,
-“কাল লেপটা নামাতে হবে বুঝলেন?”

সেকেন্ড পাঁচেকও কাটলোনা বোধহয়। গ্রীবার উপর অপ্রস্তুত আদরটায় তীব্র শীতের চেয়েও শিরশির করে কেঁপে উঠলো তন্দ্রা। কোনরকমে বললো,”কি করেন! ঘুমানতো।”

পেছনের থেকে সরফরাজের মৃদুহাস্য কন্ঠ শোনা গেলো,
-“আমি থাকতে তোমার লেপের কি দরকার তনু?”

-“ছিহ্!”

-“ভয় পেলে তো আব্বা আম্মার সামনে জাপটে ধরতেও লজ্জা পাওনা। আর এখন এক কাঁথার নিচে ছিহ্ ছিহ্ করছো। হায় তন্দ্রাবতী!”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here