মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব – ২৪

0
348

মেঘদিঘির পাড়ে – ২৪
মালিহা খান

দোকানী ছেলেটার সাথে টুকটাক কথা বলছে ইউসুফ। বিভা নির্বাক শ্রোতার ভূমিকায়। সে চুপচাপ মাটির দিকে চেয়ে চা খাচ্ছে। চোখজোড়া চিন্তিত, ভ্রান্তিতে ভরপুর। তার কিছুতেই ভালো লাগছেনা। অধৈর্য, ছটফটে লাগছে। মন স্হির করতে পারছেনা। কি হচ্ছে এসব? কেনো হচ্ছে? কেনো প্রত্যাশিত পুরুষের নিবিড় সঙ্গ তাকে স্বস্তি দিতে পারছেনা?
বিভা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুখ তুলে বললো,”দোকান বন্ধ হবে কখন?”

দোকানী ছেলেটা একবার ইউসুফের দিকে তাকালো। তারপর একফালি হেসে উওর দিলো,”এইতো এহনই বন্ধ হইয়া যাইবো ভাবি। আপনাগো হইলেই বাত্তি নিভাইয়া দিমু। আবার খুলুম ভোরের দিকে। মাইনষে মসজিদে যায় তো। ওইকালে আবার ভালো কাস্টমার পাওন যায়।”

বিভা মাথা দোলালো। গলার স্বর নামিয়ে ইউসুফকে বললো,

-“যাবেন না? রাত হয়েছে।”

ইউসুফ উওর দিলোনা। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে ইশারায় দোকানী ছেলেটাকে কাছে ডাকলো। সে আসলে নির্ধারিত মূল্যর খানিক বেশি এগিয়ে দিতেই বেচারা স্বলজ্জ হাসলো। নিতে চাইলোনা। ইউসুফ নম্রকন্ঠে বললো,
-“তোমার রাখতেই হবে। এই দু’কাপ চা আমার জন্য খুব বিশেষ।”

বিভার কানদুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। সে কোনোভাবেই হজম করতে পারছেনা। ইউসুফ কেনো এমন ব্যবহার করছে? কেনো তার নির্লিপ্ততায় আজ রাজ্যসম ভঙ্গুর ধরলো? বিভা উওর খুঁজে পেলোনা। প্রশ্ন করতে মন টানলোনা।
ইউসুফ আস্তে করে হাত ধরতেই সম্ভিৎ ফিরলো। একপলক চোখে চোখ পড়লো। চোখ নামিয়ে ধীরগতিতে সেই আদেশে পা মেলালো বিভা।

ইউসুফের হাতটা অসম্ভব ঠান্ডা। নরম চাঁদের মোহনিয়া আলোয় তার সুন্দর মুখখানার দিকেই বুঁদ হয়ে চেয়েছিলো বিভা। তার চোখে অদ্ভুত অপারগতা। বেহায়া চোখ কিছুতেই নামছেনা। আচমকা সে হোঁচট খেলো। মুখ থুবড়ে পড়ে যাবার আগেই হাত টেনে সামলিয়ে দিলো ইউসুফ। ফিচেল গলায় বললো,”রাস্তা দেখে হাঁটো বিভা। অন্যকিছু পড়েও দেখা যাবে।”

ঝুমঝুমে মেয়েলি মনে হয়তো তীব্র ঠান্ডাও ততোটা কাবু করতে পারেনি যতটা কাবু করলো এই অতিসামান্য ছোট্ট বাক্যযুগল। বিভা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। মিনমিন করে বললো,

-“আমি রাস্তা দেখেই হাঁটছি। অন্যকিছু না।”

-“তাই নাকি? ভালোতো!”তার কন্ঠে স্পষ্ট বিদ্রুপ।

বিভা উশখুশ করলো কিছুক্ষণ। তারপর না পেরে ডেকে উঠলো,

-“শোনেন?”

অসহ্য অধৈর্য কন্ঠটা রাস্তার নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। প্রতিধ্বনির মতোন বেজে উঠলো। ইউসুফ নরম গলায় উওর দিলো,”বলো?”

-“আপনি ঠিক আছেন তো?”

ইউসুফ হাসলো, উওর দিলো,”তোমার কি মনে হয়?”

-“নেই। আপনি ঠিক নেই নিশ্চিত।”

-“আছি। আমি ঠিক আছি।”

বিভা থমকালো। শক্ত হাতের বাঁধন কি আরো একটু শক্ত হয়ে উঠলো? যত শক্ত হলে তাতে আর ভাঙন ধরানো যায়না?

৪৭.
তন্দ্রার ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে বসে আছে। চাতক পাখির মতো আধো অন্ধকার ঘরটায় চোখ বুলাচ্ছে। সরফরাজ গভীর ঘুম। তন্দ্রা উঠে বসেছে সে টের পায়নি। পেলে এতক্ষণে তন্দ্রাকে ঘুমিয়ে পড়তে হতো। যেভাবেই হোক তাকে ঘুম পাড়ানো হতো। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাতভর পায়চারি করা হতো।
তন্দ্রা হাই তুললো। ঘাড় ফিরিয়ে সরফরাজের কাছে ঝুঁকে গেলো। মুখটায় দুশ্চিন্তায় ছাপ ফুটে উঠেছে। ইভার বিয়ে নিয়ে হাজারখানেক ভাবনায় ডুবে থাকে। প্রকাশ করেনা, কিন্তু সে বুঝতে পারে। এই এখানে যাচ্ছে, ওখানে যাচ্ছে। কোনোকিছুতে একটু ক্রুটি রাখা চলবেনা তার।
তন্দ্রা পেলব হাত দিয়ে আলতো করে সরফরাজের চুল নেড়ে দিলো। সরফরাজ একটু নড়েচড়ে আয়েশ করে ঘুমালো। খুব ক্লান্ত বোঝা যাচ্ছে। তন্দ্রা তাকে আর বিরক্ত করলোনা। আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়লো। গুঁটি গুঁটি পায়ে দরজার ছিঁটকিনি নামালো। তারপর বেরিয়ে পড়লো। বারান্দার মৃদু আলো জ্বালানো। কিছুক্ষণ একা একা দাড়িয়ে থেকে ইভার ঘরের কাছে যেয়ে দাড়ালো তন্দ্রা। দরজাটা একটু ফাঁক করলো। ইভা, বাহাদুরকে ঘুমে বিভোর দেখে মুচকি হাসলো। দরজা ভিড়িয়ে দিলো আবার। একটু সামনে এগোতেই বিভার ঘর পড়লো।
বিভা দরজা আটকে ঘুমায়, তবু কি ভেবে যেনো আলতো ধাক্কা দিলো তন্দ্রা। তাকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলে গেলো। চাঁদের আলো আসা খালি বিছানাটার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো তন্দ্রা। ওরা এখনো ফিরেনি?

৪৮.
খোলা চুলগুলো বাঁধা দরকার। খুব যন্ত্রনা করছে। আস্তে করে ইউসুফের হাত ছাড়িয়ে দু’হাতে আলগোছে চুলগুলো মুঠো বন্দি করলো বিভা। কাঁচের চুড়ি রিনঝিন করে বেজে উঠলো। সাথে সাথেই ইউসুফ ঘাড় ফিরিয়ে প্রায় ধমকে উঠে বললো,

-“চুল বাঁধছো কেনো?”

বিভা হতচকিত হলো। দু’সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বোকার মতো হাত নামিয়ে ফেললো। বিরবির করে বললো,”না, বাঁধছিনা।”

তারপর আবার সব চুপচাপ।
একলা চাঁদের আলো, কনকনে ঠান্ডা আর ঘন্টা তিনেক ধরে গলায় আটকে থাকা অস্বস্তি উপেক্ষা করে
খুব ধীরগলায় ইউসুফ ডেকে উঠলো,”বিভা?

-“হু?”অন্যমনস্ক উওর।

-“আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি বিভা। ঠিক ততটাই ভালোবাসি যতটা ভালোবাসলে আর ভালোবাসা যায়না।”

বিভা একবার চমকে তাকালো। ইউসুফ সামনের দিকে তাকিয়ে আছে বিধায় দৃষ্টি বিনিময় হবার সুযোগ হলোনা। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোনো প্রত্যুওরও পাওয়া গেলোনা। তবে একটু সময় যেতে না যেতেই একটা ভীষণ সুখী মেয়েলি কন্ঠ হু হু করে ফুঁপিয়ে উঠলো। তপ্ত জল গড়িয়ে পড়লো তার হিমশীতল ঠান্ডা গাল বেয়ে।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here