#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১৭
প্রচণ্ড রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে অবনীর। কিন্তু রাগের সঠিক কারণ তার কাছে স্পষ্ট না। এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলেই উঠে দাঁড়ালো। ফাস্ট এইড বক্সটা রোজের হাতে ধরিয়ে দিতেই সে চলে গেলো। জুনায়েদ ভীষণ বিস্মিত কণ্ঠে বলল
–কি বললে?
অবনী বিরক্ত হল। ভীষণ বিরক্ত নিয়ে ঘুরে তাকিয়ে বলল
–কি বললাম?
–এখনই কি যেন বললে? আবার বল।
অবনী হতাশ শ্বাস ছেড়ে আবার ঝাঁঝালো গলায় বলতে শুরু করলো
–আপনি যদি তখন ওভাবে হাসি মুখে বাসায় না ঢুকতেন তাহলে আমি আপনার দিকে এতো আগ্রহ নিয়ে দেখতাম না। আর গ্লাসটাও পড়ে ভেঙ্গে যেতো না। এতো কিছুই হতো না। তাই বলছি সব দোষ আপনার ঐ হাসির। আপনি এতো সুন্দর…।
থেমে গেলো অবনী। জুনায়েদের অবাক করা অদ্ভুত হাসি দেখেই তার মস্তিস্ক খুলে গেলো। কি বলছে সেটা বুঝতে পেরেই থেমে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। জুনায়েদের অদ্ভুত ভাবে তাকানোয় অসস্তি টা আরও বেড়ে গেলো। চোখ নামিয়ে নিলো। জুনায়েদ মুচকি হেসে বলল
–তাহলে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে হাসতে দেখো। তাও আবার মুগ্ধ হয়ে। স্ট্রেঞ্জ! প্রেমে পড়েছ নাকি?
অবনী উত্তর দিলো না। ঘুরে চলে গেলো নিজের ঘরে। জুনায়েদ পেছন থেকে বলল
–শাড়িটা চেঞ্জ করে ফেল মিসেস জুনায়েদ ইশতিয়াক।
অবনী চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঘন ঘন পলক ফেলে নিজেকে স্থির করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে হাজার খানেক গালি দিলো। বোকামির জন্য এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়লো। কি দরকার ছিল এমন ভাবে রেগে যাওয়ার। এই রাগের কারনেই সে জীবনে কত রকম বিপদে পড়েছে। সেসব মনে রাখলেও তো একটা কাজ হতো। সেই ঘটনার পর থেকে অবনী নিজেকে ভীষণ ব্যস্ত রেখেছে। জুনায়েদের সামনে তেমন আসছে না। ইচ্ছা করে তো নয়ই। ভুল বশত পড়ে গেলে চোখ নামিয়ে নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে যাচ্ছে। অবনীর এমন বেহাল দশা দেখে জুনায়েদ ভীষণ মজা পাচ্ছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলছে। অবনী বিষয়টা খুব সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জুনায়েদ ঘরে বসে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। অবনী কফি নিয়ে ঘরে আসলো। রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে এখন। কফি দিয়েই সে চলে যাবে নিচে। অবনী কফিটা রেখে এক পাশে পড়ে থাকা এলোমেলো জিনিসপত্র নিজের জায়গায় গুছিয়ে রাখছে। জুনায়েদ শার্ট চেঞ্জ করতে বোতাম খুলছে এক হাতে। বেশ অসুবিধা হচ্ছে তার। কিন্তু অবনী একবারও তার দিকে তাকাচ্ছে না। জুনায়েদ বিরক্ত হল অবনীর উপরে। কিন্তু কিছুই বলল না। নিজেই আরেক হাত লাগিয়ে খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যাথা পেতেই চাপা আর্তনাদ করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। অবনী ঘুরে তাকাল। দৌড়ে কাছে এসে বলল
–কি হয়েছে?
জুনায়েদ আহত কণ্ঠে বলল
–শার্টের বোতাম খুলতে গিয়ে লেগেছে।
অবনী বিরক্ত হয়ে বলল
–নিজে নিজে কেন করতে গেলেন? আমাকে বলতে পারতেন। দেখি।
জুনায়েদের একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। এক এক করে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। জুনায়েদের গভীর দৃষ্টি তখন অবনীর শান্ত চেহারায় বিচরন করতেই ব্যস্ত। শেষের দিকে দুটো বোতাম বাকি থাকতেই সেলিনা অবনীর নাম ধরে ডাকল। গলা তুলে বলল
–আসছি ছোট মা।
অবনী শেষ বোতামটা খুলে দিতেই জুনায়েদ আলতো করে কোমরে হাত রাখল। শীতল হাতের স্পর্শে অবনী কেঁপে উঠলো। শুকনো ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে ফেললো। জুনায়েদ ভীষণ আবেগি কণ্ঠে বলল
–কি যেন বলছিলে তখন? আমার থেকে কোন কিছুই ইম্পরট্যান্ট নয়।
অবনী জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। জুনায়েদ তার নীরব প্রশ্রয়ে হাতের স্পর্শ আরও গভীর করে বলল
–আর এখন?
অবনী চোখ খুলে ফেললো। নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–ভুলে গেছি।
জুনায়েদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচে চলে গেলো। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে। এখন জুনায়েদের সামনে যাওয়া তার জন্য ভয়ংকর ব্যাপার। সবাই রাতের খাবারের জন্য নিচে নেমেছে। অবনী বেশ চুপচাপ। জুবায়ের রহমান ওর দিকে তাকিয়ে বলল
–অবনী মামণি। তোমার কি হয়েছে? মন খারাপ নাকি শরীর খারাপ?
অবনী কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। বলল
–আমার কিছু হয়নি ছোট বাবা। এমনিতেই।
কথা শেষ করে পাশে বসে থাকা জুনায়েদের দিকে চোখ পড়তেই তার অদ্ভুত চাহুনি দেখে আবারো দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ভেতরটা কেমন করে উঠলো তার। কোন কথা না বলে খাওয়া শেষ করে ফেললো। সব কাজ শেষ করে ঘরে গিয়ে দেখে জুনায়েদ বিছানায় শুয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। অবনীর চোখ পড়তেই সে অসস্তিতে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত প্রমান করার চেষ্টা করলো। জুনায়েদ কোন কথা বলল না। অবনীকেই দেখছে সে। অবনীর কাজ কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে হাত ধরে ফেললো। অবনী চমকে তাকাল। জুনায়েদ ভীষণ শান্ত কণ্ঠে বলল
–শুয়ে পড়।
অবনী চোখের পলক ফেলে তাকাল। জুনায়েদ বলল
–বোঝনি কি বলেছি?
অবনী মাথা নাড়ল। সে বুঝেছে। জুনায়েদ হাত ছেড়ে দিলো। খুব একটা সময় নিলো না অবনী। দ্রুত কাজ শেষ করে শুয়ে পড়লো।
————-
সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারলো জুবায়ের রহমান চলে যাচ্ছেন। জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় আজই ফিরতে হচ্ছে। আরও দুইদিন থাকার কথা থাকলেও সেলিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনিও যাবেন। সামনে মাসে আবারো একটা ছুটি আছে। তাই এখন আর তেমন কেউ জেদ করলো না তাদের। তবে অবনীর কিছুটা মন খারাপ হয়েছে। বাচ্চা দুটোর সাথে তার বেশ ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। সময়টা কিভাবে কেটে গেলো বুঝতেই পারলো না। ওরা চলে গেলে যে যার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর অবনীকে একা থাকতে হয় সারাদিন। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ওঠে সে। কিছু বলেও তো লাভ নেই। সকালের নাস্তা করেই তারা চলে গেলো। জুনায়েদও বের হয়ে গেলো তাদের সাথে। যাওয়ার সময় বলে যায়নি কখন আসবে। জায়েদ রহমান নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। অবনীও নিজের ঘরে এসে বসে আছে চুপচাপ। বাইরের আবহাওয়া আজ খুব সুন্দর। চারিদিকে ঝলমলে রোদ উঠেছে। একদম বাংলাদেশের মতো ওয়েদার। অবনী আনমনে আকাশের দিকে তাকাতেই তার ফোন বেজে উঠলো। বাংলাদেশ থেকে ফোন দেখেই রিসিভ করে ফেললো। অবনী কয়েকবার হ্যালো বললেও ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ এলো না। বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দেয়ার আগ মুহূর্তে ভারী নিশ্বাসের শব্দ কানে এলো। অবনী স্থির হয়ে বোঝার চেষ্টা করতেই ওপাশ থেকে তৈয়বা নাজনিন কিছুটা কাঁপা গলায় বললেন
–কেমন আছিস মা?
অবনী অবাক হয়ে গেলো। কথা বলতেও ভুলে গেলো সে। কয়েক সেকেন্ড পরই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল
–ভালো আছি মামনি। তুমি কেমন আছো? আর এতো রাতে ঘুমাওনি তুমি?
তৈয়বা অপ্রস্তুত হেসে বলল
–আমি তো এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাইনা। তোর কি খবর বল। শরীর কেমন আছে?
অবনী একটু থামল। বলল
–তুমি ঠিক আছো মামনি? শরীর ঠিক আছে? তোমার কথা কেমন যেন শোনাচ্ছে?
তৈয়বা অস্থির হয়ে বললেন
–না না আমি ঠিক আছি। আচ্ছা শোন। তুই বাংলাদেশে কবে আসছিস?
অবনী থমকাল। বলল
–মানে?
–তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। আর তোর বাপিও খুব মিস করছে তোকে। বাপিকে তো তুই চিনিস। মুখ ফুটে কখনো কিছুই বলবে না। কিন্তু মনে মনে খুব মিস করে। তুই এসে সারপ্রাইজ দিয়ে দে। খুব খুশী হবে।
অবনী খুশী হল। উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–বাপি আমাকে মিস করে? রাগ করবে না তো? আমি আসবো মামনি। আমি আজই জুনায়েদের সাথে কথা বলবো।
তৈয়বা এবার বলল
–সামনে সপ্তাহে আয় মা।
অবনী আরও কিছুক্ষন কথা বলে রেখে দিলো। সে আজ খুব খুশী। মুখ থেকে হাসি যেন সরছেই না। নিচে গেলো অবনী। সে যখন খুব খুশী হয় তখন রান্না করে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। নিজের মন মতো রান্না করলো। সবাইকে খাওয়াল। বিকেলের দিকে জুনায়েদ বাসায় ফিরে এলো। এসেই তার চোখে পড়লো অবনীর হাসি। পুরো দিন জুনায়েদ খেয়াল করলো অবনী বেশ খুশী। রাতের খাবার শেষে অবনী দুই কাপ কফি নিয়ে এলো ঘরে। জুনায়েদ জানালা খুলে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে পাতলা একটা টি শার্ট। বেশ এলোমেলো হাওয়া বইছে। অবনী পেছনে দাঁড়িয়ে বলল
–ঠাণ্ডা লাগছে না?
জুনায়েদ ঘুরে তাকাল। দুই হাতে দুটো কফির কাপের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলল
–লাগছে না।
অবনী একটা কাপ জুনায়েদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। জুনায়েদ সেটা নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল
–আজ এতো খুশীর কারণ কি ম্যাডাম?
অবনী বেশ অবাক হয়ে তাকাল। ঠোঁটের হাসিটা আরও প্রশস্ত হল। তার মানে জুনায়েদ তাকে খেয়াল করে। সে বুঝতে পারে অবনীর মনের অবস্থা। হেসে বলল
–মামনি ফোন করেছিলো।
জুনায়েদ একটু থেমে গেলো। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–কি বলল?
–বাংলাদেশে যেতে বলল। কয়দিন থেকে আবার ঘুরে আসতে বলল।
আনমনেই জুনায়েদের ভেতর থেকে একটা হতাশ শ্বাস বেরিয়ে এলো। ছোট্ট করে বলল ‘ওহ’। কফিতে চুমুক দিয়ে বলল
–কবে যাচ্ছ?
অবনী মুচকি হেসে জুনায়েদের পাশের দেয়ালটাতে পিঠ ঠেকাল। জুনায়েদ সামনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। অন্ধকার ঘরে বাইরে থেকে হালকা আলো আসছে। জুনায়েদের চূলগুলো বাতাসে হেলেদুলে আবার কপালে এসে পড়ছে। অবনী কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল
–ভাবছি সামনে সপ্তাহে যাবো।
জুনায়েদ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে। আমাকে বলে দিও। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো।
জুনায়েদের কণ্ঠ শুনে অবনী তাকাল। বলল
–আপনার মন খারাপ কেন জুনায়েদ সাহেব? কি হয়েছে? হাত ব্যাথা করছে?
জুনায়েদ ফিরে তাকাল অবনীর দিকে। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমি কি ছোট বাচ্চা যে হাত ব্যাথা করলে মন খারাপ করে কাদব?
অবনী শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসির রেশ কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত থাকলো। জুনায়েদ স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। আনমনেই বলে উঠলো
–তোমার এই ভবন ভুলানো হাসিটা আমার জন্যই বরাদ্দ থাক। সারাজীবন আমি এই হাসি মন ভরে দেখতে চাই।
অবনী থেমে গেলো। অদ্ভুত ভাবে তাকাল। কিন্তু জুনায়েদের চাহুনির সামনে তার সেই দৃষ্টি ফ্যাকাশে পড়ে গেলো। দৃষ্টি নত করে নিতেই জুনায়েদ এগিয়ে এলো। আনমনেই অবনীর গালে আলতো করে হাত রাখল। অবনী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পরেই হাত সরিয়ে ফেলে বলল
–তুমি চাইলে নিজের ঘরে শুয়ে পড়তে পারো। এখন আর কোন বাধা নেই।
অবনী চোখ খুলে তাকাল। জুনায়েদ আবারো জানালার বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। জুনায়েদের কথার কোন উত্তর না দিয়েই বিছা্নায় শুয়ে পড়লো। জুনায়েদ এক পলক সেদিকে তাকাল। মুচকি হাসল। মেয়েটা যে তার উপরে ধিরে ধিরে দুর্বল হতে শুরু করেছে সেটা ভেবেই সস্তি পেলো। কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়েই কাপটা রেখে গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো। কঠিন হয়ে গেলো মুখভঙ্গি। মাথায় একটাই বিষয় ঘুরছে। অবনীকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কোন প্ল্যান নয়তো?
চলবে……