আজ শুক্রবার জান্নাতের বিয়ে। শরতের ভাদ্র মাস চলছে। নীল আকাশ জুড়ে পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের অক্লান্ত ছুটাছুটি। নব বধূর ন্যায় যেন সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত। খুব সুন্দর শরৎ বন্দনা।
বর্ষার ঋতুতে আকাশের মেঘফুল ঝরে। কিন্তু এটা শরতের ঋতু। আকাশ জুড়ে মেঘেদের হেলাফেলা হলে ও নব বধূর সাজে সজ্জিত বধূটির আঁখিদ্বয় দিয়ে, নোনাজল নামক মুক্ত দানার অজস্র মেঘফুল ঝরছে।
কেন সে তার মূল্যবান মেঘফুল ঝরাচ্ছে? সে এক করুণ কাহিনী!
জান্নাত তার বাবা-মায়ের বড় মেয়ে। অথচ তার বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান করা হয়নি। বাড়ি ভর্তি মেহমান হয়নি। জান্নাতের ভেতরটা অজানা ভয়ে বারবার কেঁপে উঠছে। অনুষ্ঠান নাই বা করা হোক, কিন্তু কি দেখে? তার বাবা ঐ শহরের ছেলের সঙ্গে তাকে বিয়ে দিচ্ছেন? মাত্র চারদিনের আলোচনায়! সে তো সবমসময় চাইতো তার বরটা যেন তাকওয়াবান হয়। কারণ সে নিজেই একটা পাপী। এখানকার পরিবেশে সে সঠিকভাবে কোনো আমল বা দ্বীন মেনে চলতে পারে না। তাই আরেকটা পাপী লোককে বিয়ে করে সে তার লাইফ নষ্ট করতে চায় না। এজন্য সে সবসময় চাইতো তার জীবনসঙ্গী তাকওয়াবান হোক। যার হাত ধরে সে মৃত্যুর পর জান্নাতে যেতে পারবে। কিন্তু তার বাবা তার সাদা-কালো স্বপ্নে,এক বালতি জল ঢেলে সব আশা ভেঙে চুরমার করে দিলেন। বাবা যেমনতেমন,শহরের ছেলেটা কেমন? দ্বীনদার নাকি দুনিয়াদারী? সে তো কিছুই জানে না। এমনকি একনজর ছেলেটাকে দেখেওনি! শুধু জানে ছেলেটা সরকারি চাকুরীজীবি।ছেলের নিজস্ব বড় একটা ফ্ল্যাট আছে। ব্যাস, তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার বাবা পাগল। কিন্তু সে তো এরকম কাউকে চায় না! তাও তার বাবা তাকে এরকমই কারো সাথে বিয়ে দিচ্ছেন। বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। তাই সে ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সে জেনারেল লাইনে পড়লেও মোটামুটি ধার্মিক একটা মেয়ে। মোটামুটি বলার কারণ, সে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, ফরজ রোজা রাখে, কুরআন তিলাওয়াত করে। পর্দা না করলেও কলেজ কিংবা বাড়িতে বেগানা পুরুষদের থেকে নিজেকে দূরে রাখে। মিথ্যা-গিবত ইত্যাদি পাপ গুলো থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ও নিতান্তই চুপচাপ ও ঠান্ডা মেজাজের একটি মেয়ে। এবার অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ওরা তিনবোন এক ভাই। ভাইটা অবশ্য তার মায়ের পেটের ভাই নয়। ছেলেটাকে তার বাবা নবজাতককালে রাস্তার পাশের একটা ঝোপে, তোয়ালে পেছানো কান্নারত অবস্থায় পেয়েছিলেন। তারপর থানায় একটা সাধারণ ডায়রী করেছিলেন। কিন্তু বাচ্চাটাকে কেউ নিতে আসেনি। পুত্রহীন বাবার হৃদয়ে তখন বাচ্চা ছেলেটার জন্য গভীর মমতা হয়েছিলো। তাই তিনি বাচ্চাটাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন জিসান। তাকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখলেন। এখন তার বয়স পাঁচ বছর। জিসান তার পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যের চোখের মণি। বোনরা তাকে অনেক ভালোবাসে। মা-বাবা নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করেন। যাইহোক জান্নাতের বাবার নাম জমির মিয়া। তিনি পেশায় একজন বেসরকারি কর্মকর্তা। মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন। রাবেয়া যখন প্রথম কন্যাসন্তান তথা জান্নাতের জন্ম দিলেন তখন জমির ভীষণ খুশী ছিলেন। তারপর দ্বিতীয় কন্যা দিলুর জন্ম হলো। এসময় এ খবর শুনে জমিরের চাচী,লায়লা বেগম দিলুকে দেখে তার ঘরে ফেরার সময় জমিরকে সামনে পেলেন। মুখ গুমরা করে বললেন-” ও জমির তোর বউ মনে অয় তোর সাশুড়ির বেলা পাইছে। বেয়াইনেরও তো পর্তমে খালি ফুরি অইছে, এরপর না তোর সালা অইলো। যাকগে বাপু পারলে আরেকখান বিয়া করিস। ফুরিগো কি আর বুইড়া বৈসে তোরে পালতে পারবো!”
জমির বিয়ে করার কয়েকমাস পরই তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন। বাবা তাঁর জন্মের আগেই মরেছেন। তাই চাচী লায়লা বেগমকে তিনি মায়ের মতো ভালোবাসেন। চাচীও নিজ ছেলের মতো স্নেহ করেন বিধায় উপরোক্ত কথাটি চাচীর মুখে শুনে, তিনি গভীর চিন্তায় পরে গেলেন। যদিও দ্বিতীয় বিয়ে করেননি কিন্তু হুট করেই সেই হাসিখুশি মানুষটা তখন কেমন যেন রুক্ষভাষী হয়ে গেলেন। শেষে নীলুর জন্ম হলো। এ যেন কাটা গায়ে নুনের ছিটা! তিনি এবারে প্রচন্ড বদমেজাজি-খাপছাড়া হয়ে গেলেন। অথচ এই ছেলে দেন কে,মেয়েই দেন কে? মূর্খ মানুষগুলোর মাথায় থাকে না। ছেলে-মেয়ে সবই তো আল্লাহর দান। তাও মেয়ে হলে জন্মদাত্রীকে কেন দোষ দেওয়া হয়,আজব!
তিনি তার স্ত্রী রাবেয়ার সাথে তখন ভালো আচরণ করতেন না। কোনো কাজে রাবেয়ার সামান্য ক্রুটি হলেও ছাড় দিয়ে কথা বলতেন না। ইচ্ছামতো বকাঝকা করতেন। এরপর যখন জিসানকে কুড়িয়ে পেলেন, তখন তাঁর আনন্দের আর সীমা রইলো না। তিনি আগের মতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু ইদানীং মেয়েগুলোকে নিয়ে তাঁর বড্ড দুঃশচিন্তা হয়। কারণ বড় মেয়ের বয়স বিশ বছর। তারউপর গায়ের রং শ্যামলা।”মেয়েরা কুঁড়িতে হয় বুড়ি’,বলে একটা কথা আছে। তাঁর মেয়ে তো বিশ বছরে পা রেখে ফেলছে। এখনও তেমন কোনো ভালো পাত্রের সন্ধান তিনি পাচ্ছেন না। এদিকে মেঝো মেয়ে দিলুর বয়স আঠারোর কৌঠায়। নীলুও সতেরো বছরে পা দিলো। এই ছোট দুটিকে নিয়ে তাঁর এত মাথা ব্যাথা নেই। কারণ ওরা যথেষ্ট সুন্দরী। ওদের জন্য অনেক ভালো ভালো পাত্রপক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু বাঁধ সাধলো বড় মেয়েকে নিয়ে। তাকে বিয়ে না দেওয়ায় ছোটদের নিয়ে তিনি ভাবতে পারছেন না। আর বড় মেয়েকে রেখে ছোটগুলোকে যে বিয়ে দিবেন তার আর সাহসেও কুলোচ্ছে না। এতে যদি লোকে মন্দ বলে!
—
চারদিন আগে একটা ঘটক এসেছিলো জান্নাতের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। পাত্রের ডিটেইলস জেনে জমির মিয়ার খুব মনে ধরলো। সাথে সাথেই তিনি ঘটককে তার মতামত জানান। ঘটক পাত্রের বাবাকে জমির মিয়ার হ্যাঁ সূচক মন্তব্য জানালেন। পাত্রের বাবা বললেন-” আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে পাত্রীর বাবাকে বলেন আমি আগামীকালই আমার স্ত্রীকে নিয়ে উনার মেয়েকে দেখতে আসবো। আমার ছেলে আসবে না। তবে আমার আর তার মায়ের পছন্দই, তার পছন্দ!”
তারপর মেয়ে দেখা হলো। পাত্রের বাবা আলম আহমেদ আর রিনা বেগম জান্নাতকে দেখেই পছন্দ করে ফেললেন। আলম মিয়া সাথে সাথেই আলহামদুলিল্লাহ বলে জমিরকে তাঁর বাসায় যাওয়ার আহ্বান করলেন। জমির পরদিন তাদের বাসায় গেলেন। তাদের বড় ফ্ল্যাট,দামী দামী আসবাবপত্র দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। এরপর আলম আহমেদের সাথে কোশল বিনিময় হলো। আলম দুঃখীত হয়ে বললেন-” ভাই সাহেব আমি দুঃখীত আমার ছেলেটা বাসায় নেই। তাই সরাসরি দেখতে পারলেন না। আজকে স্কুলে যেতে মানা করেছিলাম। কিন্তু পরে তার হেড স্যার ফোন করে বললেন, আজ তাকে স্কুলে যেতেই হবে!”
জমির সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললেন-” সমস্যা নেই ভাই। ছবিতে তো দেখেছিই। আমার আর দেখা লাগবে না।
হবু বেয়াইয়ের অমন সুন্দর উত্তর পেয়ে আলম খুব খুশি হলেন। তারপর নাশতার পর্ব শেষ করে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেললেন।
জমির মিয়া খুব খুশি হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন। আর মনে মনে আওড়ালেন” তা সরাসরি না দেখলাম ছবিতে তো দেখেছিই। এরকম সোনার টুকরা ছেলে কি আর পাইমু!”
—
কনের সাজে বিছানার উপর বসে জান্নাত কাঁদছিলো। চোখের জল বাঁধ মানছে না। দীলু চোখ পাকিয়ে বললো-” আপা আমি এত কষ্ট করে তোকে সাজাইলাম। আর এখন তুই কান্না করে কি সব সাজ নষ্ট করে দিবি!”
জান্নাত কান্নার বেগ কমিয়ে দিলো। দীলু তার গালে একটা চুমু দিয়ে বললো-” এইতো আমার সোনা আপা। শুন আপা এত কান্নাকাটি করিস না পরে মাথা ধরবে। তোর তো আরও মাইগ্রেনেরও সমস্যা আছে। এতটুকু বলে শেষ করতে না করতেই নীলু দৌড়ে রুমে ঢুকলো। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো-” মেঝআপা বর আসছে! গেট তো বাঁধা হয়নি চল দরজা আটকিয়ে টাকা আদায় করি?”
দীলু-” আহা,তাই বলে কি পাগলা কুকুরের তাড়া খাওয়ার মতো দৌড়ে আসবি! তুই যা আমি আসছি।”
নীলু ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। ও আবার ছুটে গেলো। বর গাড়ি থেকে নামতেই দরজা আটকিয়ে দিলো। আর দীলু খানিকটা হেঁসে জান্নাতকে বললো-” আপা এবার তো থাম,তোর বর এসে গেছে। যাই আমি গিয়ে বরং দুলাভাইকে দেখে আসি, হিহি!”
দীলু দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিলো। নীলুর সাথে জিসান আর তার বান্ধবী মিনু তিনজন মিলে বরের থেকে পাঁচ হাজার টাকা চাইলো। বর পক্ষ থেকে বরের দুই বন্ধু, ছোট চাচা, বাবা আর মামা এসেছে। নীলু দরজার ফাঁকে মুখ নিয়ে বললো-” কি হলো টাকা দিবেন নাকি দরজা একেবারে বন্ধ করে দিবো?”
বরের বন্ধু আমান টাকা পরিমাণ কমানোর জন্য নীলুর সাথে অনেক তর্ক-বিতর্ক করলো। শেষে তার পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকাই বের করে ফিসফিস কন্ঠে বরকে বললো-” মেঘালয় তোর শালি যা দজ্জাল, ভাবাগোভাবা না জানি তোর বউ কেমন হবে…!
মেঘালয় গম্ভীর হয়ে চোখ লাল করে আমানের দিকে তাকালো। আমান ফিক করে হেঁসে ফেললো। অতঃপর নীলুর হাতে টাকা দিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকলো।
এদিকে জান্নাতের মনে অন্যকিছু চলছে। সে ঠিক করেছে এ বিয়ে করবে না। আজ দুদিন ধরে শুধু সুযোগ খুঁজছে কিভাবে বাড়ি থেকে পালানো যায়। যেহেতু ঘরভর্তি মেহমান নেই। তাছাড়া রুমের আশেপাশেও কেউ নেই। তাই ও সময় নষ্ট না করে বিছানা থেকে ঝটপট নেমে পরলো। দৌড়ে দরজা দিয়ে বের হতে যাবে,এমন সময় সামনে থাকা আগন্তুকের সাথে একটা বড়সড় ধাক্কা খেলো। আগন্তুক আর জান্নাত দু’জনেই দুদিকে ছিটকে পরলো। ধাক্কাটা জান্নাতের নাকে লেগেছে। নাকে প্রচন্ড ব্যাথা পাওয়া সত্যেও আগন্তুককে দেখে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হলো। কারণ……
চলবে……….
#মেঘফুল_১
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার।
_________
ব্রিঃ দ্রঃ ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এবারের গল্পটি আমার আগের লেখা একটা গল্পকে এডিট করে লিখছি।কেমন হলো কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন।