মেঘফুল পর্ব-২

0
6078

#মেঘফুল_২
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার।
_________________________________

কারণ আগন্তুক আর কেউ নয় তারই মা। রাবেয়া ছিটকে পরলেও তেমন কোনো আঘাত পান নি। কিন্তু মেয়ের মতিগতি বুঝতে পেরে তিনি অগ্নিশর্মা হলেন। কাছে এসে জান্নাতের গালে কষে একটা থাপ্পড় মারলেন। জান্নাত থাপ্পড় খাওয়ার জায়গায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেললো। রাবেয়া রুমের ভেতরে ঢুকে দরজা লক করে দিলেন। রাশভারী হয়ে পিছন ফিরলেন। জান্নাতের চোখে জল। কিন্তু মায়ের ওমন রূপ দেখে, সে ভীষণ ভয় পেলো। গুটিশুটি মেরে আগের জায়গাতেই ঠায় মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। রাবেয়া তার এক হস্ত টেনে বিছানায় বসালেন। দু’হাত দিয়ে মেয়ের কাঁধে ধরে,ঝাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন-” পালাতে চেয়েছিলি তাই না!”
জান্নাত ভয়ে চুপ করে রইলো। রাবেয়া রাগত্বস্বরে বললেন-” পালিয়ে গেলেই বুঝি সব ঠিক হয়ে যেত! একবারও আমাদের কথা ভাবলি না। আজ যদি তুই পালিয়ে যাইতি, তাহলে তোর বাপকে আমি কি জবাব দিতাম? জবাব তো পরের কথা! সমাজে মুখ দেখাতাম কি করে?
তারপর তিনিও কেঁদে ফেললেন। কান্নারত কন্ঠে মেয়েকে বলতে লাগলেন-” শোন,আমি তোর মা। তোর যে কতটা কষ্ট হচ্ছে,সেটা আমি বুঝি। তুই কেমন পাত্র চাস এ বিষয়ে তোর বাবাকে বলেছিলাম। কথাগুলো তো ভালো করে শুনলোই না তারউপর আমায় শাসিয়ে বললো-” চুপ! আরেকটা কথা বললে তোকেও এ বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো। এমন সোনার টুকরা ছেলেটা যে অকে বিয়ে করবে এটা ওর সৌভাগ্য। মা-মেয়ে দুইজন মিলে বিয়েটা ভাঙার ধান্দায় আছো তাই না?একটা কথা শুনে রাখ রাবেয়া,যদি তোর মেয়ে এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় কিংবা কোনো অঘটন ঘটায় তাহলে আমি তোর অবস্থা কাহিল করে ছাড়বো!”

কথার কি ছিঁড়ি, ছ্যাহ্! রাগে-দুঃখে শরীরটা আমার জ্বলে যাচ্ছে। তাও জোরপূর্বক মনটাকে শান্ত করেছি। তোর বাপ একটা বাজখাঁই লোক। আমায় তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। আমি তো শুধু তোর চাহিদাটা বলেছিলাম যে, তুই কেমন পাত্র চাস? কিন্তু শুনলি তো কেমন কথা শুনালো আমাকে!” বলে তিনি আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললেন। জান্নাত তার মাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। সেও কেঁদে ফেললো। কান্নারত কন্ঠে বললো-” মাগো আমায় তুমি মাফ করে দাও মা! আমার জন্য তুমি গালি শুনলে। আমার বাবাটা এমন কেন! আজ আমি শ্যামল বর্ণের বলে বাবা আমাকে ওরকম একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন! কিন্তু আমিতো আমার নিজেকে গড়িনি মা। এটা তো সৃষ্টিকর্তার গড়া দান। আমার আমিটাকে নিয়ে আমিতো খুশিই ছিলাম। আজ আমরা তিনটা বোন বলে, বাবা আমাদের সাথে এরকম করছেন! তাই না মা?”
বাবাকে নিয়ে মেয়ের অভিমানী কথাগুলো শুনে মায়ের হৃদয়টা হু হু করে কেঁদে উঠলো। মাও কাঁদছে মেয়েও কাঁদছে। তাদের কান্নায় রুমটা ভারী হয়ে উঠলো। রাবেয়া কান্না থামিয়ে আঁচল দিয়ে চোখমুখ মুছলেন। জান্নাতের গালে দু-হাত রেখে আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখের জল মুছে দিলেন। কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন। তারপর শান্তভঙ্গিতে বললেন-” মারে তাকওয়া জিনিসটা হলো অন্তরের ব্যাপার। এটা যেকোনো শ্রেণির মানুষের মধ্যে থাকতে পারে। এমন নয় যে মাদ্রাসায় পড়লেই সেই ব্যাক্তি তাকওয়াবান হয়। কিংবা মাওলানা, হাফেজরা সবাই তাকওয়াবান। হাদিসে আছে নবীজী বলেছেন,” কিয়ামতের দিন তিন ধরনের মানুষদের আল্লাহ আগে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। তিন দলের লোকদের মধ্যে একদল হলো আলেম। ঐ কঠিন হাশরের দিন আল্লাহ তখন প্রথমেই আলেমকে জিজ্ঞেস করবেন,” আমি তোমাকে আমার দ্বীনের জ্ঞান দান করেছিলাম। তুমি এর কী ব্যবহার করেছো?”
আলেম তখন উত্তরে বলবে, ‘হে আমার রব! তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমি তোমার দেওয়া এই জ্ঞান অন্যকে শিক্ষা দিয়েছি।’
আল্লাহ প্রত্যুত্তরে বলবেন,‘তুমি মিথ্যা বলছো! তুমি বরং তোমার নিজের খ্যাতি ও অন্যরা যাতে তোমাকে অগ্রাধিকার দেয়, এই উদ্দেশ্যেই শিক্ষাদান করেছো। তুমি যা চেয়েছিলে, তা তুমি পেয়ে গেছো। সুতরাং, এখন এখানে তোমার প্রাপ্য কিছুই নেই।’ এই হাদিস পড়েই বোঝা যায় সকল আলেমরা তাকওয়াবান নয়। আমি এমনও বহু লোকদের দেখেছি যারা জেনারেল শিক্ষিত। অফিস,আদালত, কিংবা যেকোনো চাকুরীজীবি তাদের মধ্যে অনেকেই নবীজীকে মহব্বত করে। তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করে চলে। আজ যার সাথে তোর বিয়ে হচ্ছে ছেলেটাকে আমি দেখিনি। কিন্তু এই ছেলেটাও তো তাকওয়াবান হতে পারে! তাই কান্নাকাটি না করে ভাগ্যকে মেনে মা। আমাদের জীবনটাকে আমরা যতটা সহজ মনে করি,ততটা সহজ কিংবা ততটা কঠিনও নয়। আমরা তো অনেক স্বপ্নই দেখি। মনের ঘরে কত স্বপ্নের জাল বুঁনি। কিন্তু সব স্বপ্ন কি আর পূরণ হয়? কিংবা পূর্ণতা পায়? মৃত্যুর কথাই ধর। অনেক মানুষই এই কয়দিনের পৃথিবীতে এসে দুনিয়ার মোহে আকৃষ্ট হয়ে দুনিয়ার পেছনে দৌড়ায়। অনেকে তো এটা দোয়াও করে যে, আল্লাহ আমি পৃথিবীতে বাঁচতে চাই। মরতে চাই না। আমাকে পৃথিবীতে অমর করে দিন!” কিন্তু তাই বলে কি তাদের মৃত্যু হয় না? অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ তারাও গ্রহণ করে। কারণ জন্মিলে মরিতেই হইবে! এটাই চরম সত্য। অতএব আমাদের উচিৎ আখেরাতের কামাই করে এই মরণটাকে হাসিমুখে বরণ করা। এখন বলতে পারিস আখেরাতের কামাইয়ের জন্যই তো আমি তাকওয়াবান জীবনসঙ্গী চাইছি। হ্যাঁ এটা সত্য কিন্তু আগেই বলেছি আমাদের সব স্বপ্ন আল্লাহ পূরণ করেন না। কিছু কিছু স্বপ্ন অপূরণীয় থেকে যায়। তুই চাস তাকওয়াবান জীবনসঙ্গী। কিন্তু তোর বাবা এতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। হয়তো এটাই আল্লাহর তরফ থেকে তোর জন্য পরীক্ষা! এজন্যই বলছি ভাগ্যকে মেনে নিতে শিখ। একজন শায়েখ বলেছিলেন,” মরে গিয়ে মাটি হয়ে গেলাম। এটাই শেষ নয়,আমাদের ঈমানকে তাজা করে আমল করতে হবে। আর অল্প আমলেই কিন্তু আমরা নাজাত পেতে পারি ইনশাআল্লাহ।’ এজন্য আগে ঈমানটা তাজা কররে মা। ছেলেটা যদি তাকওয়াপূর্ণ হয় তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি গাফেল হয় তাহলে, তুই তাকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবি। আমি জানি এটা ভিত্তিহীন কথা। এই কথা বলা যতটা না সহজ, করা ততটা সহজ নয়। কিন্তু কি করবি এ ছাড়া যে তোর আর কোনো পথ নেই। তুই তোর সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাবি। বাকিটা আল্লাহ তোকে সাহায্য করবেন। আমি দোয়া করি বিয়ের পর যেন তুই সুখী হোস মা।” আর তোর বাবার আচরণে কষ্ট পাস না। লোকটা দিন দিন বড্ড খারাপ হয়ে যাচ্ছেন। তোর বাবার জন্য হেদায়েতের দোয়া করিস। আর হ্যাঁ,তুই শ্যামল বর্ণের মেয়ে বলে কখনো এ নিয়ে মন খারাপ করিস না। আল্লাহর সৃষ্টি সব মানুষই সুন্দর।” তারপর খানিকটা হেঁসে মেয়ের কপালে আবারও চুমু দিয়ে বললেন-” আমার মামনিটা শ্যামলা হতে পারে,কিন্তু ভীষণ মায়াবতী!”
মায়ের বলা প্রতিটা কথা জান্নাত মনযোগসহকারে শুনেছে। কথাগুলো শুনার পর নিমেষেই তার মনটা ভালো হয়ে গেলো। গভীর আবেশে মায়ের বুকে মাথা রাখলো। মায়ের শরীরের ঘ্রাণটা তার বড্ড ভালো লাগে। হয়তো আর আগের মতো এই বুকে মাথা রাখতে পারবে না। মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে নতুন একটি ঘরে। ভাবতেই ভীষণ কান্না পেলো তার। মাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো-” মা তুমি আমার সেরা মা। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। তোমার এই মেয়ের জন্য দোয়া করো মা। আমি যেন আমার ঝুড়িটা পরিপূর্ণ আমল দিয়ে ভরতে পারি। এবং তোমাদের জামাইটা যেন তাকওয়াবান হয়।” উত্তরে রাবেয়া মাথা নাড়িয়ে মুচকি হাসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এরমধ্যেই দীলু দরজায় কড়া নেড়ে বললো-” মা দরজাটা খোল। কাজী সাহেব আসছেন।”
রাবেয়া মেয়েকে ছেড়ে উঠলেন। জান্নাতের মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দীলু হুর মুর করে দ্রুত রুমে ঢুকে,জান্নাতের একপাশে গিয়ে বসলো। একসময় কাজী সাহেব আসলেন বিয়ে পরানো হলো। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলে,বর কনে কে এক করা হলো। আর তখনই জান্নাত এক পলক মেঘালয়ের দিকে তাকিয়েছিলো। এক পলক দেখেই তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে উঠলো। মাথার রগটা রাগে টন টন করছে। চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। তার বাবার প্রতি ভীষণ রাগ হলো। অভিমানে ঘোমটার আড়ালে কেঁদে ফেললো। পরক্ষণেই পাছে মায়ের বলা প্রতিটা কথা মনে পড়ে গেলো। আর তখনই…..

চলবে…….

ব্রিঃ দ্রঃ ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কোথাও কোনো ভুল হলে সেটা উল্লেখ করে দিবেন। আমি শুধরে নিবো ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here