(১)
— ” আমি প্রেগন্যান্ট, বৃত্ত! ”
মেঘার বলা কথাটা বৃত্তের কানে বোম বিস্ফোরণের মত শোনালো। বইয়ে পড়েছিল সে, উত্তেজনার সময় চোখের মণির আকৃতি দশগুন বেড়ে যায়। আজ তার চোখের আকৃতিও খানিক এমন হয়ে গেছে। বৃত্ত সামনে থাকা মজাদার খাবারের লোভকে ত্যাজ্য করে মেঘার দিকে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
— ” তার মানে আমি সঠিক ছিলাম। সেদিন আমরা ইন্টিমেট হয়েছি? ”
মেঘা মাথা নিচু করে ফেললো। আজ তার নিজের প্রতি ঘৃনা অনুভব হচ্ছে। কিন্তু এমন’টাতো হওয়ার কথা না। মেঘা অত্যন্ত উচ্ছল এক মেয়ে। ‘ jab we met ‘ মুভির কারিনা কাপুরের বলা সেই ডাইলগের মত, ‘ মে আপনি ফেভরেট হু।’ কিন্তু মেঘার জীবনটাই এমন অগোছালো হয়ে গেলো কেনো? মেঘা তার উত্তরের অপেক্ষা করলো না। বরং, নিজের মনেই উত্তর সাজালো, ‘ ভাগ্যের দোষে! ‘
বৃত্ত নিজেও গম্ভীর মুখে বসে আছে চেয়ারে। পুরো ব্যাপারটা তার মাথায় ঠিক জায়গা করতে পারছে না। বৃত্ত এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। মেঘার নত হয়ে থাকা মুখশ্রীর দিকে চেয়ে ডাক দিলো,
— ” মেঘ! ”
মেঘা তাকালো। তার চোখে জল। অন্যসময় বৃত্ত একজন বেস্ট ফ্রেন্ডস্বরূপ সেই জল মুছে টিটকারী কাটতো। বলতো,
‘ তুই আস্ত এক ছিঁচকাদুনে রে মেঘ। তোর জামাইর ভবিষ্যত কি হবে, সেটা ভেবেই আমার দুঃখ পাচ্ছে। ‘
কিন্তু, আজ? আজ মেঘার চোখে জল দেখেও বৃত্ত কিচ্ছুটি বলতে পারছে না। সেই অধিকার, সেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হারিয়েছে বৃত্ত। বৃত্ত এবার গলা খাঁকারি দিলো। মেঘা এখনো ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে বৃত্তের দিকে। বৃত্ত সুধালো,
— ” আ’ম সরি রে। আমি বুঝতে পারিনি সেদিন ড্রাংক হয়ে তোর সাথে… ”
বৃত্ত আর বলতে পারলো না। তার আগেই চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টানলো। মেঘার সাথেই এমন মাফ-অযোগ্য অন্যায় করার পর অপরাধবোধে বৃত্তের বুকটা হাহাকার করছে। বৃত্তর গলা ধরে এলো। আজ ওর একটা ভুলের জন্যে মেঘা এতটা কষ্ট পাচ্ছে। একজন বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে বৃত্ত সেটা মেনে নিতে পারছে না। মেঘা এতক্ষণে মুখ খুললো। ধরা গলায় জানালো,
— ” আমি তোকে অনেক বাঁধা দিয়েছিলাম। কিন্তু, তুই? তুই এতটাই পাগল হয়ে গিয়েছিলি, আমার এত বারন, এত আহাজারি কিছুই তোর কানে যায়নি। তুই অনেক খারাপ বৃত্ত! আমায় আজ এমন একটা জায়গায় দাঁড় করিয়েছিস যে, এখন আমার নিজের দিকে তাকাতে অব্দি ঘৃনা করে। ”
মেঘা এবার কান্নায় ভেঙে পড়লো। আর যায় হোক, বৃত্তের কাছ এমন আচরণ সে মোটেও আশা করেনি। সে তো সেদিনের কথা ভুলে যেতে চাইছিল, কিন্তু একটা রিপোর্ট অতীতের সব জঘন্য কথা মনে করিয়ে দিলো। মেঘা এবার চেয়ার ছাড়লো। বৃত্ত এখনো ঠায় বসে আছে চেয়ারে। মেঘা বৃত্তের দিকে চেয়ে রাগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
— ” একটা কথা রাখবি, বৃত্ত? ”
বৃত্ত মাথা উচুঁ করে তাকালো মেঘার দিকে। সরু চোখে স্পষ্ট অপরাধবোধ। মেঘা ঠোঁট চিপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। তবে, ব্যর্থ হলো সে। চোখের কোণা বেয়ে গড়ালো অজস্র জলের রেখা। মেঘা ভেজা কণ্ঠে বললো,
— ” যদি কোনোদিন আমার মরার খবর পাস, প্লিজ তখন আমার লাশ দেখতে আসিস না। আমি সহ্য করতে পারবো না। ”
বৃত্ত চোখে এবার জল জমছে। এই জঘন্য কথাটা মেঘা বললো? বৃত্তের বিশ্বাস হচ্ছে না। এই মেঘা কে সে চিনে না। একদমই চিনে না। এই মেঘা তো কোনো অন্য! তবে, এর বেশি মেঘার থেকে কি’বা আশা করা যায়?
বৃত্তকে অপরাধবোধের রাজ্যে ছুঁড়ে ফেলে মেঘা রেস্টুরেন্ট থেকে প্রস্থান করলো। কিন্তু, বৃত্ত? সে, সেখানেই, সেই চেয়ার’টাতেই ঠায় বসে রইলো। মাথা কাজ করছে না তার। সে ঝোঁকের বসে এমন একটা ভুল কিভাবে করে ফেললো? এখন এই ভুলের মাশুল সে কি করে গুনবে? কি করে?
___________________________
বৃত্ত সেদিন আর বাড়িতে গেলো না। সারারাত বাইরে থাকলো। এদিক-সেদিক ঘুরলো, একটা আস্ত সিগারেটের প্যাকেট শেষ করলো, রাস্তার ইট-পাথর লাথি দিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললো, আরো কত কিছুই না করলো। তবুও, মনটা শান্ত হচ্ছে না তার। বুকের ভিতর’টা বড্ড অস্থির অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে, তার লাল রঙা হৃদয়টা এক ভয়ঙ্কর ঘুণ পোকায় টুকটুক করে খেয়ে ফেলছে। অন্যদিন হলে, বৃত্তের যখনই অস্থির লাগতো, সে মেঘাকে ফোন দিত। মেঘার সাথে ঘণ্টার পর ঘন্টা কথোপকথনে, তার অস্থির ভাবটা কখন পালাতো সেই খেয়াল কেই’বা রাখতো! বৃত্ত তো রাখতো’ই না। বৃত্ত হাতের সিগারেট মাটিতে ফেলে জুতো দ্বারা পিষে ফেললো। এক অগোছালো পথিকের মত রাস্তার ফুটপাথে বসলো। পকেট থেকে ফোন বের করে মেঘার মোবাইলে কল দিলো। দুবার রিং বাজার পর ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেলো। মেঘা কেটে দিলো। বৃত্ত আরো দুবার ট্রাই করলো। এবার বন্ধ দেখালো। বৃত্ত হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। ফোনটা নিজের পাশে ধাম করে রেখে দিলো। রাগ উঠছে তার। মেঘা কেনো তাকে বুঝছে না? সে তো ইচ্ছেকৃত ভাবে কিছু করেনি।
সারাটা রাত বৃত্ত এভাবেই অস্থির ভাবেই কাটিয়ে দিলো। সেদিন এক ভয়ানক নির্ঘুম রাত কাটলো বৃত্তের।
সকাল হতেই বৃত্ত এক ভয়ানক প্ল্যান করলো। সে সোজা মেঘার বাসায় চলে গেলো। দরজায় কলিং বেল বাজাতেই মেঘার মা দরজা খুললেন। বৃত্তকে দেখে তার মুখে অমায়িক হাসি ফুটলো। মেঘার মা দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। মুচকি হেসে বললেন,
— ” আসো বৃত্ত। মেঘা তো ঘুমুচ্ছে। দাঁড়াও আমি ডেকে দিচ্ছি। ”
বৃত্ত অস্থির পায়ে সোফায় বসলো। বারবার মেঘার রুমের দিকে তাকাচ্ছে সে। মেঘা এখনো বেরুচ্ছে না কেনো? অতি অস্থিরতায় বৃত্তের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, তৃষ্ণা পাচ্ছে। কিন্তু, সকল তৃষ্ণাকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে সে ঠায় বসে রইলো সোফায়। সোফার সামনে রাখা টিভিতে গান চলছে,’ ইতনা মাজা কিউ আরা হাহে? তুনে হাওয়া মে ভাং মিলায়া। ‘ ‘
আর মজা? শালা! জিন্দেগিই তার সাথে জঘন্য এক মজা করলো। আর কি মজার বাকি আছে? বৃত্ত রেগেমেগে রিমোট হাতে নিয়ে টিভি অফ করে দিল। আহা! এখন শান্তি লাগছে।
একটু পর মেঘা ঘুমঘুম চোখ নিয়ে বৃত্তের সামনে এসে দাঁড়ালো। তবে, মেঘা ঘুমের ভান করলেও বৃত্ত স্পষ্ট বুঝতে পারছে, সারারাত মেঘা একবিন্দুও ঘুমায় নি। বরং, মেঘার ফোলা ফোলা চোখ বলে দিচ্ছে, সারাটা রাত কেঁদেছে মেয়েটা। মেঘা বৃত্তের সামনে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক সুরে জিজ্ঞেস করলো,
— ” তুই? এত সকাল? কি হয়েছে? ”
বৃত্ত একবার খাবার ঘরে তাকালো। মেঘার মা, টেবিল ধোঁয়া-মোছা করছেন। মেঘার এমন স্বাভাবিক আচরনের কারণ এবার বুঝলো বৃত্ত। বৃত্ত হাফ ছাড়লো। সোফা থেকে দাড়িয়ে মেঘার উদ্দেশ্যে বললো,
— ” রেডি হ! এক জায়গায় যাবো। ”
মেঘা চোখ রাঙিয়ে তাকালো বৃত্তের দিকে। মা পাশে। তাই, বারণও করতে পারছে না। মেঘা চোখের ইশারায় বৃত্তকে বুঝালো,’ আমি যাবো না। ‘ কিন্তু বৃত্ত মানলে তো? সে সোজা মেঘার মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো। মেঘার মা বৃত্তের দিকে তাকালে বৃত্ত বললো,
— ” আন্টি, আজ ভার্সিটিতে একটা ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। মেঘাকে নিতে এসেছিলাম আমি। কিন্তু ও যেতে চাইছে না। ক্লাসটা মিস হয়ে গেলে …”
বৃত্তের আর বলতে হলো না। মেঘার মা’ই আগবাড়িয়ে মেঘাকে বললেন,
— ” যা রেডি হ। প্রতিদিন শুধু ফাঁকিবাজি।এই বৃত্তকে দেখেও ত কিছু শিখতে পারিস। প্রতিবার কত ভালো রেজাল্ট করে ছেলেটা। আর তুই? ঘোড়ার আন্ডা করিস। যা ক্লাসে যা। ”
মেঘা রাগ নিয়ে তাকালো বৃত্তের দিকে। এই মুহূর্তে তার বৃত্তকে লবণ মরিচ ছাড়া, কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু মায়ের এমন আদিক্ষেতা দেখে সেই ইচ্ছে মাথা ঝাড়া দিলো। বৃত্তের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে, হনহন পায়ে নিজের রুমে চলে গেল।
_______________________
— ” এখানে কেনো নিয়ে এসেছিস আমাকে? ”
মেঘা জিজ্ঞেস করলো। বৃত্ত জিন্সের পকেটে দুহাত গুঁজে পার্কের সাদা মার্ক করা জায়গা পা ফেলতে ফেলতে বললো,
— ” কেনো? আমার সাথে এই জায়গায় আগে আসিস নি? নতুন নাকি? ”
— ” আগেরকার সময় আর বর্তমান, দুটোর মধ্যে অনেক তফাৎ, সেটা তুই ভালো করেই জানিস। ”
মেঘা দাঁতে দাঁত চিঁবিয়ে বললো। বৃত্ত এবার একটু নড়েচড়ে দাড়ালো। দুহাত দিয়ে নিজের ঘন চুলগুলো টেনে ধরলো। চোখে বুজে লম্বা শ্বাস টানলো। মেঘা তুমুল রাগ নিয়ে তাকিয়ে রইলো বৃত্তের মুখের পানে। বৃত্তের এমন হেয়ালিপনা তার ঠিক সহ্য হচ্ছে না। বৃত্ত থামলো এবার। স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, মেঘার দিকে। মেঘার অগোছালো চাহনির দিকে চেয়ে আকস্মিক বলে উঠলো,
— ” মেঘ,চল বিয়ে করে ফেলি। ”
#চলবে
#মেঘবৃত্ত
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#সূচনা_পর্ব
গল্পের শুরুটা গতানুগতিক হলেও, গল্পটা ইউনিক করার ট্রাই করবো। প্রথম পার্ট কেমন লেগেছে, জানাবেন। ভালোবাসা সবাইকে।