মেঘবৃত্ত পর্ব_৪৪

মেঘবৃত্ত
পর্ব_৪৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

নতুন অতিথি আসার খুশিতে বৃত্তদের ঘরে যেনো উৎসব লেগে গেছে। মেঘার বাবা মাও আজ এ বাড়ি এসেছেন। পাড়ার চেনা পরিচিত মহিলারা মেঘার মাথায় হাত বুলিয়ে কতশত দোয়া পড়লেন। সর্বোপরি, এক এলাহী কাণ্ড! এসবের মধ্যে বৃত্ত একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। বুকে হাত ভাঁজ করে স্থির দৃষ্টিতে পরখ করছিল সবার খুশি, আনন্দ। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে তার। কি করবে, কোথায় যাবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। মেঘার চিন্তায় চিন্তায় তার মাথাটা মনে হচ্ছে, পেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত, এই মেঘাকে দেখো না? আজ তার মুখ থেকে হাসি সরছেই না। কথা বলছে আর ক্ষণে ক্ষণে হাসছে শুধু। সবার থেকে ক্রমাগত দোয়া নিচ্ছে বাচ্চার জন্যে। এবার যেনো বাচ্চাটার আর কোনো ক্ষতি না হয়! এবার বাচ্চাটার কিছু হলে মেঘাকে বাঁচানো যাবে না একদম। দূর থেকে মেঘার খুশি দেখে বৃত্ত প্রচন্ড কষ্ট হলো। কান্না পাচ্ছে খুব তার। সে বারবার আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। আজ মেঘা বাচ্চাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বৃত্তের দিকে তাকানোর সময় নেই তার। মেঘা ওর মত অনাগত বাচ্চাকে নিয়ে সুন্দর সময় কাটাচ্ছে। বৃত্তের এমন অসহায়ত্ব আর কারো নজরে না পড়লেই বৃত্তের মায়ের নজরে ঠিকই পড়েছে। তিনি দূর থেকে ভ্রু কুঁচকে বৃত্তের দিকে চেয়ে আছেন। বৃত্তের ভেজা চোখ তার মনকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। বৃত্তের মা এগিয়ে আসতে যাবেন, তার আগেই তাকে একজন মহিলা টেনে নিয়ে গেলেন কথা বলার জন্যে। বৃত্তের সাথে কথা বলা আর হলো না তার। তবে মনেমনে তিনি প্রচন্ড উশখুশ করতে লাগলেন। এই মুহূর্তে বৃত্তের সাথে কথা বলাটা খুব দরকার!
_______________________
মধ্য রাত, মেঘা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। এই একটু আগে অব্দি মেঘা মাথা ব্যথায় চিৎকার করে কেঁদেছে। বৃত্ত আর কোনো উপায় না পেয়ে মেঘাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। বৃত্ত মেঘার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। মুগ্ধ হলো সে, প্রিয় মানুষের নিষ্পাপ মুখখানা দেখে!
পৃথিবীর সবচেয়ে সবচেয়ে মুগ্ধকর মুহূর্ত হলো, যখন প্রিয় মানুষটা নিজের পাশে ঘুমিয়ে থাকে। তার একেকটা নিঃশ্বাস জানান দেয়, মানুষটার প্রতি এক বুক ভালোবাসা! তার বুজে থাকা চোখ জানান দেয় প্রিয় মানুষটাকে ঘিরে থাকা তার নিদারুণ ভরসা। ঘুমন্ত অবস্থায় এই পৃথিবীর সকল প্রিয় মানুষকেই সুন্দর লাগে।

বৃত্ত মাথা ঝুঁকে মেঘার কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো। মেঘা ঘুমের মধ্যেই বৃত্তের হাত ছুঁয়ে একটু নড়েচড়ে আবার শুয়ে পড়লো। বৃত্ত সরে এলো। শীত প্রায় কমে এসেছে। ঈষৎ গরম পড়েছে দেশে। বৃত্ত মেঘার গা কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিলো। অতঃপর, সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

বৃত্তদের ঘরের ড্রইং রুমে এক বড় বারান্দা আছে। বৃত্ত সে বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেলো। নিজের ঘরে সিগারেট খেলে মেঘার ঘুমে সমস্যা হতে পারে। মাথা ব্যথাটাও আবার চাড়া দিতে পারে। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে আগুন ধরালো। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বৃত্ত ভাবলো খুব। এই বাচ্চাটা তার চাই, তেমন করে মেঘাকেও তার চাই। কোন মুখে সে মেঘাকে বলবে, বাচ্চা অ্যাবোরেশনের কথা! মেঘা তো ওকে মেরেই ফেলবে। একবার বাচ্চা হারিয়ে মেঘার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। মেঘার কষ্টের সাক্ষী স্বয়ং সে নিজেই। আরো একবার বাচ্চা স্বেচ্ছায় নষ্ট করার কথা বললে, মেঘা হয়তো সারাজীবনের জন্যে বৃত্তের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে। তখন, বৃত্ত বাঁচবে কাকে নিয়ে? উফ, বৃত্তের মাথা ধরে যাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় বৃত্তের চোখ জ্বলছে। তবুও সে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে।

— এসব কি, বৃত্ত? তুই এই মাঝরাতে সিগারেট খেয়ে ঘর ধোঁয়া করছিস কেনো? তোর বাবা দেখলে কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে।

মায়ের কন্ঠ শুনে বৃত্ত তটস্থ হয়ে উঠলো। চটজলদি হাতের সিগারেটটার আগুন নিভিয়ে বারান্দা দিয়ে ফেলে দিলো। দু চোখ মুছে মায়ের দিকে ফিরল সে। নত কণ্ঠে বললো,
— আসলে, ঘুম আসছিলো না। তাই ভাবলাম….
— মেঘা কোথায়?
— ঘুমাচ্ছে।
— তাহলে, তুই এখানে কি করছিস?
— ঘরে সিগারেট খেলে মেঘার ঘুমাতে প্রবলেম হবে, তাই ভেবেছিলাম এখানে এসে…

কথা অসম্পূর্ণ রেখে বৃত্ত থামলো। বৃত্তের মা এবার দমলেন একটু। হঠাৎ বিকেলের কথা মনে পড়ায় তিনি কালবিলম্ব না করে বললেন,
— তুই কি কোনো কারণে কষ্টে আছিস বৃত্ত? আজ বিকালেও দেখলাম তুই কেমন উদাস। কি হয়েছে মাকে বল। মেঘা কিছু করেছে?

বৃত্ত মায়ের কথা শুনে মুখটা ভার করে ফেললো। কথা এড়িয়ে যাবার চেষ্টায় বললো,
— না, কিছু হয়নি মা। তুমি খামোকা চিন্তা করছ!
— তাই? মাকে মিথ্যা বলছিস? এত সাহস কোথা থেকে এলো তোর, হ্যাঁ?
বৃত্ত অনেক চেষ্টা করলো কথা লুকানোর। কিন্তু মায়ের এমন ভরসার হাত নিজের কাঁধে পেতেই এবার আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। মাকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বললো,
— মা, আমার সব শেষ মা। সব শেষ। তোমার বৃত্ত মরে যাচ্ছে, মা। তুমি কিছু একটা করে আমাকে বাঁচাও প্লিজ। আমি মেঘ ছাড়া শেষ হয়ে যাবো মা। প্লিজ মা, আমার মেঘকে বাঁচাও!

বৃত্তের মা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। বৃত্তের নীরব কান্নার জলের অস্তিত্ব নিজের কাঁধে পেতেই তিনি সম্ভিত ফিরে পেলেন। বৃত্তের পিঠে একহাত রেখে বললেন,
— বৃত্ত, কি হয়েছে মেঘার? বল মাকে।
বৃত্ত থামলো খানিক। ধরা গলায় খুব কষ্টে মুখ খুললো সে। বললো,
— ওর ব্রে-ব্রেইন টিউমার।
বৃত্তের মায়ের হাত থেমে গেলো। অসার হয়ে গেলো সম্পূর্ণ শরীর। নিজের অজান্তেই তার হাত নিচে পড়ে গেল। অবাক কণ্ঠে বললেন তিনি,
— ব্রেইন টিউমার?
— হ্যাঁ! কাল ডাক্তার বলেছে হয় বাচ্চাকে বাঁচাতে নয় মেঘকে। টিউমারের পজিশন এত ক্রিটিকাল যে মেঘের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। মা, ডাক্তার কি করে এমন কথা বলতে পারলো? আমি আর মেঘ মাত্রই তো এক হলাম। এত জলদি দুজন আবার আলাদা হয়ে যাবো কি করে মা? মা প্লিজ, আমার মেঘকে বাঁচাও। আমি মরে যাবো মা। সত্যিই মরে যাবো। আমার কোনো বাচ্চা চাইনা, আমার শুধু মেঘকে চাই, মা। শুধু মেঘকে চাই। আল্লাহ আমাকে এত বড় শাস্তি কি করে দিতে পারলেন, মা?

বৃত্তের মা ছেলের এমন ভেঙে পড়া দেখে কি বলবেন খুঁজে পেলেন না। ছেলের এহেন কষ্টে তার চোখেও জল জমে গেলো। বৃত্ত যথেষ্ট শক্ত এক ছেলে। ছোটবেলা থেকে তার কান্নার অভ্যাস খুব কম। বড় হওয়ার পর থেকে যতই কঠিন পরিস্থিতি হোক না কেনো, বৃত্তের চোখ ভেজে না। সে জানে পরিস্থিতি কি করে সামলাতে হয়। কিন্তু, আজ এক অন্য বৃত্তকে আবিষ্কার করলেন বৃত্তের মা। এই বৃত্ত কাঁদছে, নিজের ভালোবাসার জন্য। হু হা করে কাঁদছে সে। বৃত্তের মা ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে লাগলেন। কিন্তু আজ তিনি নিজেও ভেঙে পড়েছেন। মেঘার এহেন অবস্থা তিনি মোটেও মেনে নিতে পারছেন না। কি থেকে কি হয়ে গেল? তার সাজানো গোছানো সংসারটা এভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখে তার মনটা হাহাকার করে উঠলো।

#চলবে
গল্প সম্বন্ধে পূর্বেই কিছু ভাববেন না। গল্পের স্রোত কোথা থেকে কোথা গড়াবে কেউ বলতে পারে না। তাই বলবো অপেক্ষা করুন।

লেখিকার পাঠকমহল,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/100063985747587/posts/280795524063304/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here