মেঘবৃত্ত পর্ব_৪৩

#মেঘবৃত্ত
পর্ব_৪৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— কংগ্রাচুলেশন, ইউ আর গোইং টু বি অ্যা ফাদার।
বৃত্ত হেসে ফেললো। মাথা চুলকে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
— থ্যাংকস!
— বাট, মিস্টার বৃত্ত। আই অ্যাম সরি টু সে দ্যাট, আপনার স্ত্রীর একটা ম্যাজর রোগ হয়েছে। সেই প্রবলেম তার লাইফকে অব্দি রিস্কে ফেলে দিতে পারে।

ডাক্তারের এহেন কথা শুনে বৃত্তের মাথা মুহূর্তেই যেনো ঘুরে গেলো। হাত দিয়ে শক্ত করে চেয়ারটা খামচে ধরে সে বললো,
— ক-কি রোগ হয়েছে আমার মেঘের?

মধ্যবয়সি ডাক্তার বৃত্তের এমন ভেঙে পড়া দেখে নিজেও একটুখানি অবাক হলেন। স্বামীকে তার স্ত্রীর এই মরণঘাতী রোগ সম্পর্কে জানানো, বেশ জটিল ব্যাপার বটে। ডাক্তার একটু নড়েচড়ে বসলেন। অতঃপর বেশ শান্ত সুরে বললেন,
— শি হ্যাজ এ ম্যাজর ব্রেইন টিউমার!

‘ব্রেইন টিউমার’ মত বিশ্রী শব্দটা বৃত্তকে বুকে ছুরি চালালো অজস্রবার। হুট করেই বৃত্তের মনে হলো, ‘ ব্রেইন টিউমার’ শব্দটা কোনো হালকা শব্দ নয়, বরং আসমান সমতুল্য ভারী এক শব্দ। যার ভার বৃত্তের দ্বারা বহন করা সম্ভব না। সে মরে যাবে! মেঘবিহীন বৃত্ত ঝড়ে যাবে, নিঃশেষে হয়ে যাবে, ক্ষয় হয়ে যাবে। বৃত্ত ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— এই রোগ কি নিরাময়যোগ্য না? মেঘ ভালো হয়ে যাবে, এই আশা আপনি কি আমাকে দিতে পারবেন না? বলেন?

ডাক্তার লোকটা বুঝতে পারলো বৃত্তের কষ্ট। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেঘার মাথার সিটিস্ক্যান বৃত্তের দিকে তুলে সেটাতে একটা অংশ ইঙ্গিত করে দেখালেন! বললেন,
— মিস.মেঘার মাথার ঠিক সেন্ট্রালে এই টিউমারটা রয়েছে। টিউমার অপারেশন করা যাবে, তবে তাতে মেঘার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। এই ধরেন, ৫%! তবে, এই অপারেশন বাচ্চা পেটে থাকাকালীন করা যাবে না। এতে বাচ্চাটা মারা যাবে নিশ্চিত! মেঘার অ্যাবোরেশন করিয়ে অপারেশন করতে হবে। তবে ওই যে বললাম, টিউমারটা একদম সেন্ট্রাল হওয়ায় মেঘার অপারেশন সাক্সেসফুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

এটুকু বলে থামলেন ডাক্তার। বৃত্ত হতবম্ব। এসব কথা শুনে তার কথা হারিয়ে গেছে। চোখ দুটোতে মনে হচ্ছে, কেউ আগুন ঢুকিয়ে দিয়েছে। মরিচের ন্যায় জ্বলছে তার চোখ। যেকোনো মুর্হুতে বৃত্তের সব বাঁধা উপেক্ষা করে তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়বে। বৃত্ত খুব কষ্টে মুখ খুললো,
— বাঁচার কি কোনো চান্স নেই, ডক্তর?

কথাটা বললে বৃত্তের যে দমবন্ধ হয়ে আসছে, ডাক্তার সেটা হলপ করে বলতে পারেন। ডাক্তার লোকটা বললেন,
— আছে! বাচ্চাটা অ্যাবোরেশন করে তারপর একটা ম্যাজর অপারেশন করতে পারলে মেঘার বাঁচার সম্ভাবনা ৫%! আর যদি এই অপারেশনটা একমাসের মধ্যে না করান, তবে আপনার স্ত্রী বড়জোর ছ মাসের মত বেঁচে থাকবেন। যেহেতু আপনার স্ত্রীর গর্বের বাচ্চার বয়স মাত্র দুই মাস। এই আট মাসে বাচ্চাটা আদৌ জন্ম নিতে পারবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এবার আপনি ঠিক করুন কি করবেন? তবে আপনার বাচ্চার অ্যাবরেশনের সিদ্ধান্ত একা আপনার হলে হবে না, বরং আপনার স্ত্রীর এতে সম্মতি থাকতে হবে। বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলেছি?

বৃত্ত আর সহ্য করতে পারলো না। টেবিলে হাত ভাঁজ করে মাথাটা নত করে ফেললো সে। বহু কষ্ট আটকে রাখা এক ফোঁটা জল বিসর্জন গেলো তার চোখ বেয়ে। ডাক্তার বৃত্তের এহেন অবস্থা দেখে নিজেও কষ্ট পেলেন। বললেন,
— মিস্টার বৃত্ত, নিজেকে সামলান। সামনের পরিস্থিতিটা আরো বিদঘুটে হয়ে অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে। সামলান নিজেকে।

বৃত্ত মাথা উঁচু করে চেয়ে রইলো মেঘার মাথার সিটিস্ক্যানের দিকে। খুব কান্না পাচ্ছে তার। এ কি দুটানায় পড়লো সে? আল্লাহ তাকে এ কি পরিস্থিতির মধ্যে আটকে দিয়েছেন?

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বিদায় নিয়ে বৃত্ত রাস্তার মোড় ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো। বেশ রাত হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে ঘড়িতে সময় দেখতে ইচ্ছে হলো না বৃত্তের। মনেমনে আন্দাজ করলো সে, ঘড়িতে বোধহয় এগারোটা বাজে। বৃত্ত বারবার শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছছে। তার ভেতরের গুমরে গুমরে কান্নার অভিযোগ শোনাচ্ছে নিজ রবের কাছে। হঠাৎ বৃত্তের ফোন বেজে উঠলো। বৃত্ত গলা খাঁকারি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করলো। ফোন হাতে নিয়ে মেঘার নাম্বার দেখে তার বুকটা আবার ভারী হয়ে উঠলো। সে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে মেঘার উচ্ছল কণ্ঠস্বর কানে এলো তার,
— রিপোর্ট পেয়েছিস, বৃত্ত? কি এসেছে রিপোর্টে? বল না? এই বৃত্ত? হ্যালো, হ্যালো, বৃত্ত?

বৃত্ত চোখ ভারী, ভেজা। সে যথাসম্ভব নিজেকে সামলে বললো,
— হুম, পেয়েছি রিপোর্ট।
— ওহ, কি এলো? বল না? আমি সত্যি সত্যি প্রেগন্যান্ট তো? আরে, বল না জলদি।
বৃত্ত একটু হাসার ভান করে বললো,
— জ্বি, মিসেস উডবি মাম্মাম! আমাদের বাচ্চা আসবে, কনফার্ম।
— সত্যিই?
মেঘা কথাটা শুনে সজোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। চিৎকারের শব্দে বৃত্তের কানের পোকা যেনো আজ বের হয়েই যাবে। বৃত্ত হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
— হুম, সত্যি।
— আল্লাহ, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই আমি মা হবো?
— মেঘ?
— হুম, বল।
— আমার ফিরতে আজ লেইট হবে। তুই খেয়ে নিস। খবরদার না খেয়ে থাকবি তো আজ আমার বুক পেতে দিবো না তোকে। তুই একপাশে ঘুমাবি আর আমি একপাশে। কাছে আসলেই বেদম মাইর খাবি।

মেঘা মুখ ফুলালো। ঠোঁট উল্টে বললো,
— ঠিক আছে। খাবো আমি। তুই কিন্তু বেশি লেইট করবি না। আমি অপেক্ষা করবো তোর জন্যে।
— ঠিক আছে মেরি বউ। এখন যা, খেয়ে নে কিছু। রাখছি।
— হুম, বাই।

বৃত্ত ফোন কেটে দিলো। রাত বেড়ে গেছে। রাস্তার গলিতে মানুষের চলাচল থেমে গেছে। সম্পূর্ণ রাস্তা এখন স্থবির, শান্ত! বৃত্ত রাস্তার ফুটপাতে বসে গেল। মেঘার প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট হাতে নিয়ে কতক্ষণ চেয়ে রইলো সেই রিপোর্টটার দিকে। একসময় বৃত্ত আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। রিপোর্টটার মধ্যে মাথা রেখে পুরুষালি নিয়মের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে। বৃত্তের কান্নার শব্দ নীরব রাস্তাটাকেও কাঁদিয়ে ফেললো। আজ চাঁদ কাঁদলো, আকাশ কাঁদলো, মেঘ কাঁদলো, মেঘের বৃত্ত কাঁদলো। কান্নায় কান্নায় ভারী হলো পৃথিবীর বায়ু। এত কষ্ট কেনো হচ্ছে বৃত্তের?

#চলবে
আজকের পর্বে সবাইকে রেসপন্স করার অনুরোধ!
নেক্সট পর্ব বড় করে দেবো ইন শা আল্লাহ!
লেখিকার পাঠকমহল,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri
আগের পর্ব,
https://www.facebook.com/100063985747587/posts/280019387474251/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here