মেঘভেলায় প্রেমচিঠি” পর্ব ১১

0
355

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”

১১.

খাবার টেবিলের মধ্যেখানে বসে আছে রোদসী। তাঁর চারিপাশে ঘিরে আছে মানুষজন। সবাই-ই তাঁর আপনজন। রোদসীর দাদাবাড়ী যেমন ছোট, নানাবাড়ি তাঁর দ্বিগুণ বড়। বড় মামার দুই ছেলে আশরাফ, মাহিন। মেঝো মামার তিন মেয়ে আয়শা, অবনী, অলকা। আর সবার ছোট মামা রোদসীর গুটিকয়েক বছরের বড়। সে এখনো অবিবাহিত। এছাড়াও নানা নানী বেঁচে আছে। ছোট থেকেই পরিবারের সবাই বড্ড আদর করে রোদসীকে। এই যেমন, আজ সকালে যখন গাট্টিবস্তা বেঁধে মুখ ফুলিয়ে হাজির হলো কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করেনি কেনো বাড়ি ছেড়ে এসেছে। বরং প্রথমেই বড় মামী মাথায় হাত বুলিয়ে সবাইকে ডেকে বসিয়ে দিয়ে তাঁর পছন্দের খাবার বানাতে চলে গেলো। তিন বোনই বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে রইলো পাশে। রোদসী এসেছে শুনে মাহিন কলেজ থেকে আর আশরাফ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। মাহিন বয়সে রোদসীর প্রায় সমবয়সী। দুজনের তুই তুকারি সম্পর্ক। অনেক দিন পর দেখা হবে, তাই ওর পছন্দের ক্ষীর মালাই আইসক্রিম নিয়ে এলো। আশরাফ আরও দুই কদম এগিয়ে রসমালাই আর ছানা। নানা কয়েক দিন যাবৎ অসুস্থ তাই তিনি ওকে ঘরেই ডেকে হাতে টাকা গুঁজে দিলেন। নানী নিজের উঠিয়ে রাখা পানের বাক্স নামিয়ে মিষ্টি পান বানিয়ে দিলো। ছোটবেলায় নানাবাড়ি এলেই আবদার করতো মিষ্টি পান খাওয়ার।
নানুর এহেন কার্যে অজান্তেই ছোটবেলার ছোট ছোট স্মৃতি গুলো চোখে ভেসে ওঠে রোদসীর। কী সুন্দর ছিলো শৈশব!

দুপুরের খাবার সবাই আরও আগেই সেরে নেয়। কিন্তু আজ সবার হৈ হুল্লোড়ে দেরি হয়েছে। আশরাফ আর মাহিনের মাঝে বসেছে রোদসী। মাহিন মাঝে মধ্যে তাঁকে এটা ওটা নিয়ে মজা করে খোঁচা দিচ্ছে। আর আশরাফ মাহিনকে ধমকি-ধামকি দিয়ে রোদসীকে খাইয়ে দিচ্ছে। অলকা আর আয়শা দু’জনেই শান্ত স্বভাবের। অবনী কিছুটা চঞ্চল। সবকিছুর মধ্যে রোদসীর মনটা ভালো হয়ে ওঠে। খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যখন নিজের কাজে চলে গেলো তখন রোদসী চুপটি করে আশরাফের ঘরে গেলো। এখানে এলে প্রায় সময়টা এখানেই কাটে রোদসীর। আশরাফের সাজানো ঘরটা শান্তি দেয় ওকে। আশরাফ ফাইলপত্র ঘাঁটছে কিছু। পরেরদিন নিয়ে যাওয়ার জন্য। রোদসীর আগমনে সুন্দর করে হাসলো। রোদসী এগিয়ে আসতেই আশরাফ হাস্যজ্জ্বল গলায় বলল,

‘এদিক আয় তো। ‘

রোদসী নিঃশব্দে এলো। সে জানে এখন কী করতে হবে। অভ্যাস মতোন বিড়ালের মতো মুখ করে আশরাফের পাশে বসে হাঁটুতে মাথা রাখলো। আশরাফ মুচকি হেঁসে রোদসীর চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

‘মন খারাপ বোনু? ‘

‘উহু, ছিলো। তোমাদের কাছে এসে ভালো হয়ে গেছে ভাইয়া। ‘

‘ভালো হলেই ভালো। এতোদিন পর এলি যে! আবার কী নিয়ে ফুপির সঙ্গে ঝগড়া করলি। ‘

‘আমি সবসময় ঝগড়া করি? খুব খারাপ আমি! ‘

‘না, তুই খুব নরম। আমি জানি তো আমার বোনটাকে।
শুধু মাঝে মাঝে মেজাজটা অল্পতেই খারাপ হয়ে যায়।’

‘মেজাজ এমনিতেই খারাপ হয়না ভাইয়া। যথেষ্ট কারণ আছে। আজকেরটা আরও বড় কারণ। ‘

‘কী হয়েছে বলতো? ‘

‘সায়ামের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ‘

‘কোন সায়াম? ‘

‘সূর্যের ছোট ভাই সায়াম। ‘

আশরাফ চমকে গেলো। রোদসী ততক্ষণে মুখ উঠিয়ে সোজা হয়ে বসেছে। আশরাফ হতভম্ব হয়ে বলল,

‘কোথায় দেখা হলো? ‘

‘বাবার অফিসেই নাকি কাজ করে। বাবা ওকে আমার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য দেখা করতে পাঠিয়েছিলো। ‘

‘কী বলিস! ফুপা খোঁজ নেয়নি কেনো? ‘

‘তাদের পুরনো স্বভাব পাল্টায়নি এখনো। মানুষের কথায় কান দিয়ে এখনো কাজ করে। ‘

‘আর ওই হারামজাদার ব্যাপারে কিছু বলেছে তোকে?
সায়াম উল্টো পাল্টা কিছু বলেছে? বল আমাকে, মেরে ফেলবো ওটাকে। ‘

রোদসীর দুই চোখ তখন নোনাপানির আবির্ভাব ঘটেছে। চোখ বন্ধ করে নেয় সে। আশরাফ বুঝতে পেরে বলল,

‘না কাঁদতে কাঁদতে, পাথর হয়ে গেছিস তুই। একটু কেঁদে মন হালকা করতে পারিস তো। ‘

রোদসী কাঁদে না বরং অদ্ভুত ভাবে হাসে। উঠে ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। যাওয়ার আগে ম্লান কন্ঠে বলে,

‘অমানুষদের জন্য কেঁদে নিজেকে সস্তা বানাবো না আমি। ‘

আশরাফ পেছনে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মনে মনে প্রার্থনার পশরা বসায়, কেউ আসুক। তাঁর গোমড়ামুখী বোনটাকে আগের মতো বানিয়ে দেক। কোনো একদিন আবার আগের মতো এসেই ঝাপ দিয়ে বলুক,

‘আশু ভাই! আমাকে যদি এক্ষুনি রসমালাই না এনে দিলে আমি কিন্তু তোমার আর সঞ্চিতার লাভ স্টোরি সবাইকে শুনিয়ে দেবো। ‘

_

রোদসীর মামাবাড়ি আসার আজ দশদিন পাড় হলো। সে যেমন নরমের নরম তেমন জেদির জেদি। একবার মনে মনে কিছু ঠিক করলে তা দাঁতে দাঁত চেপে করেই ছাড়বে। এই ধরনের মানুষ গুলোকে আশেপাশের মানুষেরা সাধারণত ঘাড়ত্যাড়া বলে সম্বোধন করে। এই যেমন, কেয়া রোজই ফোন করে কান্নাও করছে। মনিরুল হোসেন দুইবার এসেছিলেন নিতে। তবুও ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে খিচিয়ে ছিলো সে। এইসবের মধ্যে হঠাৎ-ই রোদসীর সঙ্গে উদ্ভট সব জিনিস ঘটছে। যেমন, এই বাড়িতে পাঁচ দিনের দিন যখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলো তখন রাত দুইটায় কোথা থেকে আননোন নাম্বার থেকে কল এলো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রিসিভ করে কোনোরকমে কানে দিলো, কিন্তু তাজ্জব হলো তখন, কেউ কোনো কথাই বলছেনা। পর পর চারদিন একই ঘটনা ঘটায় রোদসীর সন্দেহ দানা বেঁধে গেলো মনে। কে এই লোক, যে তাঁর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়! ভাবলেই রাগে খিটমিট করে ওঠে রোদসী। দশদিনের দিন একরকম বিরক্ত হয়েই ফোনটা বন্ধ করে ফেলে রেখে ঘুমালো সে। সকাল বেলা নিশ্চিন্ত মনে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে। তিতুসকে খুব মিস করছে।
অবশ্য মিস সবাইকেই করছে, মা বাবা, আরু। ছোট থেকে আরুকে কোলেপিঠে মানুষ করেছে রোদসী। খুব ভালো বন্ডিং ছিলো দু’জনের। রোদসী একরাতের জন্য কোথাও গেলে আরু কান্নাকাটি করে সারারাত ঘুমাতো না। কীভাবে ঘুমাবে! বোনকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমালে কখনো ঘুম আসতো না। হঠাৎ যেদিন আরু রোদসীর সঙ্গে ঘুমাতে গেছিলো সেদিন ছোট্ট আরু জানতো না কী হলো, যে রোদসী চিৎকার করে বলল,
আর কখনো যেনো তাঁর কাছে কেউ ঘুমাতে না আসে। এরপর একের পর এক পরিবর্তনে আরু গুটিয়ে একাই থাকে। যেমন, রোদসীকে কিছু বলতে নিলেই চুপ করিয়ে পাঠিয়ে দিতো, হাত ধরলেও রেগে যেতো। তারপর ভাই বোনের মাঝেও এক অপার দূরত্ব। ভালোবাসাটা ঘাপটি মেরে বসে আছে আড়ালে। রোদসী বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেসব কথা মনে মনে ভাবছিলো। কতটা বদলে গেছে সে, আর তাঁর জীবনের গতিপথ! হাহ্! দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলেই মনে হলো কিছু একটা তাঁর হাতে বাঁধলো। ভ্রু কুঞ্চন হয়ে এলো। মাথা ঝুঁকিয়ে গ্রিলের দিকে হাত বাড়ালো। অবাক হয়ে গেলো যখন দেখলো, গ্রিলের সঙ্গে কিছু একটা রশি দিয়ে বাঁধা। রশিটা টান দিয়ে উপরে উঠাতেই হাতে আসলো একটা ভাজ করা সাদা কাগজ। রোদসী সেটা খুলেই দেখলো, কারো নামহীন অজ্ঞাত চিঠি। যেখানে লেখা,

‘রৌদ্রানীদের এতো রাগতে নেই। সে কী জানে? রৌদ্রানীর দূরত্বে শহরে অভিমানের বৃষ্টি নামে! ‘

চলবে-
লেখিকা – নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here