”মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”
১২.
কে এই আগন্তুক! যার আগামাথা পুরোটাই ঘোলাটে।
কিন্তু রোদসী এতোটাও নির্বোধ নয় যে চিঠির ভেতরের ইঙ্গিত টুকু সে ধরতে পারবেনা। চিঠিতে লাইনগুলো দেখেই রোদসীর মাথায় যার জন্য সন্দেহ দানা বেঁধে গেলো সে হচ্ছে ‘শহর ‘। রোদসী চিঠিটা পড়ে নিজের ব্যাগে ভরে রাখলো। ঠিক করলো, বাড়িতে গিয়েই সবার প্রথমে আগের চিঠির সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে।
রোদসীর নজর পড়ে ধূসর বিষন্ন আকাশে। টনক নড়লো, এই ভেবে যে কাকতালীয় হলেও বিষয়টা অদ্ভুত। চিঠি প্রথম যেদিন এসেছিলো, সেদিনও একদল আবছায়া মেঘ আকাশে হানা দিয়েছিলো। আজও তেমনই মেঘভেলা উড়ছে দূরদূরান্তে। রোদসী কী ভেবে যেনো বারান্দায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিরবির করে বলল,
‘তবে কী সত্যিই আমার দূরত্বে কারো শহরে অভিমানের বৃষ্টি নেমে আসার প্রস্তুতি চলছে! ‘
_
রাতে টিভির সামনে বসে সব ভাই বোন মিলে ভৌতিক সিনেমা দেখছিলো। অবনী ভয়ে রোদসীর সঙ্গে চেপে জড়সড় হয়ে বসেছে। রোদসী একবার ওর দিকে তাকিয়ে ভাবে, ওর মতো বয়সে রোদসীও এমন করে ভয় পেতো। এখন আর সেসব ভূত টূতে ভয় লাগেনা।
হাতের মোবাইলটা ঘরে রেখে এসেছিলো রোদসী।
সব কিছু নীরব থাকায় ঘর থেকে রোদসীর ফোনের আওয়াজটা সহজেই কানে এসে লাগলো। রোদসী সবার মাঝে থেকে উঠে চুপচাপ ঘরে এসে খাট থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে রিসিভ করলো। ভ্রু কুঞ্চন করে আছে সে। কারণ কলদাতার নামটা। ‘বেয়াড়া ‘ নাম দিয়ে সেভ করা। কানে মোবাইলটা লাগাতেই ভেসে এলো কর্কশ কন্ঠ,
‘এই মেয়ে এই! এতো জ্বালাচ্ছো কেনো তুমি? ‘
রোদসী কী বলবে, কথা খুঁজে পেলো না। সে কীভাবে জ্বালালো শহরকে। তার সাথে এভাবে আচরণ করার মানে কী! নাকি রোদসী মেজাজ দেখাচ্ছে না বলে ভাব বেড়েছে ছেলেটার? রোদসী দ্বিগুণ বড় গলায় বলল,
‘মানে? আমি কীভাবে জ্বালিয়েছি? আমি তো আজ দশদিন যাবৎ বাড়িতেই নেই। ‘
‘সেটাই তো সমস্যা! ‘
‘কীহ! ‘
‘তা নয় তো কী? দেখো রোদচশমা, তোমার ফুটুসকে বলবে সে যেনো আমাকে না জ্বালায়! ‘
‘খবরদার! ওটাকে ফুটুস বলবেন না। ওর নাম তিতুস। আর আমার তিতুস করেছেটা কী? ‘
‘আরে ভাই, তোমার ফুটুস দিন নেই রাত নেই চিৎকার করে বেয়াড়া ছেলে বলে আমার কান নষ্ট করে দিচ্ছে।’
‘বাহ, করেছে তো বেশ করেছে। ‘
‘যাই হোক, শোনো কালকের মধ্যে যদি তুমি তোমার ফুটুসকে এসে চুপ না করাও, আমি ওটাকে লেজ কাটা বানিয়ে ছাড়বো। ‘
রোদসী চিৎকার করে বলল,
‘একদম শেষ করে ফেলবো আপনাকে, আমার তিতুসকে হাতও লাগাবেননা আপনি। ‘
‘লাগাবো না মানে! কালকেই শুভ কাজটা করবো আমি । ‘
কল কেটে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। রোদসী হা করলো ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবতে লাগলো, কতটা অভদ্র হলে কেউ ফোন দিয়ে কেমন আছো, কোথায় আছো জিজ্ঞেস না করেই কতটা কর্কশ শব্দে হুমকি বার্তা দেয়! আচ্ছা, এই যে রোদসী এতোদিন ধরে যে ও বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে তাতে কী ঐ অভদ্র ছেলেটার একটুও মনে পড়েনি? একবিন্দুও না? রোদসীর তো মনে পড়েছে! সে যখন ভাই বোনদের সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ দুষ্টুমি করে ঝগড়া করতো তখন তো মনের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা এক স্বত্তা মন খারাপ করে বলতো, শহর থাকলেও হয়তো এমন করেই ঝগড়া লেগে যেতো। এমনকি মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে নিলেও মনে পড়তো, শহর তাঁকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসার সময় দুটো হাওয়াই মিঠাই কিনতো। যদিও রোদসী তেমন একটা পছন্দ করে না। তাই নিতে না করতো, কিন্তু শহর জোর করে হাতে ধরিয়ে দিতো।
মানুষ রাস্তায় কত দামী দামী খাবার খায়। কিন্তু রোদসীর মনে হতো, ঐ দশ টাকার হাওয়াই মিঠাইয়ের সঙ্গে যদি এতো চমৎকার একটা মানুষ পাশে থাকে তখন তুচ্ছ জিনিসটাও অপূর্ব লাগে। কিন্তু আজ! এই মুহুর্তে মনে মনে যত প্রশংসা রোদসী করেছে ঠিক তার দ্বিগুণ খারাপ মনে হলো ছেলেটা। কোনো ভালো পদবিও দিতে ইচ্ছে করলো না। রোদসীর তেঁতে ওঠা জ্বলন্ত মেজাজটা মেঘের আস্তরণে বন্দী হয়ে গেলো। মনটা রেলগাড়ির মতো ঝকঝক করতে করতে বলল,
‘বাড়ি যেতে হবে, বাড়ি যেতে হবে ‘। সেদিনই ব্যাগই গুছিয়ে কারো মানা না শুনেই রওয়ানা হলো নিজের বাড়ির পথে। অলকা, অবনী, আয়শা সহ ভাইরাও হাজারও গাইগুই করেও থামাতে পারেনি তাঁকে। মুখে তখন রোদসীর একটাই কথা, বাড়ি যাবো তিতুসকে দেখবো। কিন্তু সবার অগোচরে মনটা কিচিরমিচির সোনালী ডাক দিয়ে বলল,শহরকে দেখবো। কেনো দেখবো, কী কারণে? রোদসীর মন পাল্টা জবাব দিলো, ‘অতশত জানিনে বাপু! দেখতে হবে ব্যাস। ‘ রোদসী আলুথালু মনে ছুটলো দিশেহারা নাবিকের ন্যায়।
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাসায় আসতেই কেয়া হোসেন ঝাপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। রোদসীর ভেতরের মনটা গলে পানি হয়ে গেলো, ছটফট করে বলল ভালো হয়েছে এসে পড়লাম, কত কষ্ট পাচ্ছিলো মা বাবা! কিন্তু নিজের আবেগটুকু পলকেই লুকিয়ে আঁধারে নিমজ্জিত করে বলল,
‘হয়েছে হয়েছে। এতো আদিক্ষ্যেতা করতে হবেনা। যাচ্ছি না আর। ‘
গম্ভীর গলায় গমগম করে ঘরে চলে এলো। কেয়া হোসেন মুখে আঁচল গুঁজে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলেন,খুশির কান্না। মনিরুল হোসেনকে খবর দিতেই তিনিও ছুটে এলেন। মেয়েকে বললেন, তিনি আর কিছু চাপিয়ে দিবেন না। মেয়ে যা খুশি করুক।
রোদসী চুপচাপ বসে রইলো। তিতুসের কাছে যেতেই সেটা অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো৷ রোদসী বারকয়েক তিতু বলে ডাকলেও সাড়াশব্দ করলো না।
রোদসী খাঁচা থেকে বের করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেই তিতুস আদুরে ভঙ্গিতে রোদসীর গালে মাথা ঘষলো। কাঁধের কাছে মুখ রেখে বলল,
‘রোদি ব্যাড গার্ল। ‘
রোদসী থতমত খেয়ে গেলো। তিতুস যতযাই করুক। কিন্তু ওকে কথা না শেখালে ও নিজে বলতে পারে না।
কথাটা কী আর্শ শেখালো? রোদসী সন্দিহান মুখে বলল,
‘তিতু এটা তোকে কে শিখিয়েছে?’
তিতুস চুপ করে থাকলো। আরও দুই তিন বার জিজ্ঞেস করতেই চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
‘বেয়াড়া ছেলে, বেয়াড়া ছেলে। ‘
রোদসী মুখটা পানসে করে নিলো। ভাবলো, ছেলেটা বলেছিলো তিতুস নাকি ওকে জ্বালাচ্ছে। অথচ দেখো, নিজেই কয়েকটা দিনে উল্টো পাল্টা শিখিয়ে ফেলেছে ওকে। কীভাবে? তবে কী, শহর রোজ ওর বাসায় আসতো? কিন্তু কেনো?
আগের রুটিন অনুযায়ী রোদসী হাতে বই চাপিয়ে ছাঁদে গেলো। ওখানে গিয়েই দেখলো, শহর কবুতরগুলোকে খাবার দিচ্ছে। রোদসী প্রথমে কিছু বলতে নিলেও তারপর চুপচাপ বসে কিনারায় বই পড়তে থাকলো৷ কিন্তু মন কেনো জানি বইয়ের মধ্যে না থেকে ছুটে এসে শহরের কাছে চলে যাচ্ছে। রোদসী ভেবেছিলো নিজে না বললেও, শহর যেমন আগে নিজ থেকে কথা বলতে আসতো তেমনই এবারও আসবে৷ কিন্তু যখন বুঝলো, রোদসীকে দেখেও শহর না দেখার ভান করছে তখন ক্ষেপে গেলো। আরও নাক ফুলিয়ে নিলো যখন শহর ওকে কিছু না বলেই ছাঁদ থেকে চলে যাচ্ছে। রোদসী জোড় গলায় বলল,
‘দাঁড়ান বলছি। ‘
শহর চলে গিয়েও ফিরে এলো। মুখে হাসি নেই দেখে রোদসীর একটু অদ্ভুত লাগলো। শহরকে আজ পর্যন্ত হাসি ছাড়া দেখেনি ও। তবে আজ কী হলো! রোদসী আবারও বলল,
‘সমস্যা কী আপনার?’
‘আমার কোনো সমস্যা, আমি বলেছি? ‘
‘আমাকে ফোন করে যে বললেন, আমার তিতুস আপনাকে জ্বালাচ্ছে! ‘
‘হুম, সত্যি বলেছি। ‘
‘আপনি ওকে শিখিয়েছেন ওসব?’
‘কোন সব?’
‘ঐ যে, রোদসী ব্যাড গার্ল। ‘
‘হ্যা, আমিই শিখিয়েছি। সরি। ‘
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেই চলে যাচ্ছিলো শহর। রোদসী বুঝতে পারলো, শহর তাঁর সঙ্গে কোনো কারণে রেগে আছে। কিন্তু এমন কী করলো সে? দশদিন ধরে তো বাড়িতেই ছিলো না। শহরের চলে যাওয়া দেখে ভাবলো, ছেলেটার কীসের এতো অভিমান? রোদসী দৌড়ে নিচে নেমে শহরকে পিছুডাক দিয়ে বলল,
‘শুনুন। ‘
শহর তাকালো। কী হলো, কে জানে! সে ধীর পায়ে এসে রোদসীর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গেলো। একহাতের চেয়েও কম দূরত্ব হওয়ায় একটু অস্বস্তি হলো রোদসীর। শহর মন্থর কন্ঠে বলল,
‘কী? ‘
‘মিস করেছেন আমাকে? ‘
‘আমি কেনো তোমাকে মিস করতে যাবো? ‘
‘একদমই করেননি? ‘
‘না। আমি কেনো তোমাকে মিস করবো? ‘
রোদসী মনে মনে আহত হয়ে গেছে । শহর চলে গেছে নিঃশব্দে। রোদসীর খুব খুব কান্না পেয়ে গেলো। অজান্তেই ভিজে ওঠা চোখে ভাবলো, নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টার প্রয়োজন ছিলো না। মনের অবাধ্যতায় শক্ত লাগাম টেনে নিলো। রোদসী চোখ মুছে ঘরে চলে গেলো। সেদিনের ঘটনার সুত্রপাতে জঘন্য ভাবে দুটো মানুষের অদৃশ্য সুতো ছিঁড়ে গেলো। রোদসীর আবছা অনুভূতি গুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। কোনো রেশ সেখানে অবশিষ্ট রইলো না। শহর নামের ব্যাক্তিটিকে একপ্রকার ভুলেই গেলো। আগের মতোই যান্ত্রিক অনুভূতিহীন হয়েই জীবনের গতিপথ বয়ে চললো। কিন্তু ভুলতে পারলো না শহর, তারপর দিন রোদসীর কাছে আসতে চাইলেও রোদসীর তীব্র অনীহায় দূরে যেতে বাধ্য হলো। হয়তো ভাগ্যের উত্থান পতনে অলিখিত ভাঙ্গনে নিভৃতে মুছে গেলো গল্পটা।
চলবে-
লেখিকা – নাঈমা হোসেন রোদসী।