মেঘভেলায় প্রেমচিঠি” পর্ব ১৬

0
350

“মেঘভেলায় প্রেমচিঠি ”

১৬.

ঘুমের ঘোরে উঠে বসে চোখ মুখ কচলে বসলো রোদসী। ঘুম ভেঙে তেমন কিছু মনে করতে পারছিলো না। কিন্তু অন্য দিনের তুলনায় নিজের রুমের পরিবর্তে অন্য রুম দেখে দুই মিনিট থম মেরে বসে থাকলো। তারপর বুঝতে পারলো, সে এখন বিবাহিত। আর রুমটা শহরের। তড়িৎ গতিতে মনে পড়লো, শহর কোথায়? এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখলো। রোদসী চমকে উঠলো এই দেখে, যে শহর খাট থেকে গড়িয়ে নিচে গিয়ে পড়ে আছে। সম্পূর্ণ পড়েনি। পা দুটো খাটেই। এই অদ্ভুত মানুষটার অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তি দেখে যারপরনাই হতাশ ও অবাক হলো। হতাশ হওয়ার কারণ, এই যে রোদসী যেখানে ঘুমে বিন্দু মাত্র নড়াচড়া করেনা সেখানে শহরবাবু নড়েচড়ে খাট থেকেই পড়ে গেছে। হায় কপাল! বলতে বলতেই কপাল চাপড়ে নিলো সে। হামাগুড়ি দিয়ে শহরে পা টেনে ধরলো। শহর তখন আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ কারো টান খেয়ে হকচকিয়ে গেল। পা দুটো এর ফলে ফ্লোরে পড়ে গেলো। রোদসী পুরো দৃশ্যটা দেখে মুখ হাত ঢেকে হেঁসে উঠলো। হাসতে হাসতে পেট চেপে বলল,

‘ছি ছি! এতো বড় হয়েও কীভাবে খাট থেকে পড়ে যায়! ‘

শহর তখন কোমর চেপে ব্যাথায় উহঃ করছিলো। ঘুম ভেঙে সদ্য ওঠায় সাধারণত তাঁর মেজাজ খুব একটা ভালো থাকেনা। তার উপর রোদসীর তাচ্ছিল্যে তাঁর মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। এলোমেলো চুল আর জামা কাপড় ঠিক করে নিলো। যতযাই হোক, সে তো নতুন জামাই। আর নতুন জামাইয়ের একটা প্রেস্টিজ আছে না! শহর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে বলল,

‘হয়েছে হয়েছে, এতো হাসতে হবে না। তুমি যে রাতের বেলা কী কান্ড ঘটিয়েছো, দেখেছি আমি। ‘

রোদসী ভড়কে গেলো। তাঁর জানামতে সে ঘুমানোর সময় বেশি নড়াচড়া করেনা। তাহলে কীসের কথা বলছে শহর? শহর আড়ালে দুষ্ট হাসি দিলো। এবার একটু আচ্ছা করে জ্বালিয়ে নিবে। সুযোগ পেয়ে সে মোটেও ছাড়বেনা। রোদসী আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

‘কী করেছি আমি?’

‘করেছো মানে! আমার বেচারা বালিশটাকে তো মুখের লোল দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছো। আচ্ছা, এতোবার মুখ বন্ধ করিয়ে দিলাম। তুমি বললে,তুমি নাকি হা করেই ঘুমাবে। ‘

‘ইয়াক ছি! আমি জীবনেও বিশ্বাস করিনা। ‘

‘তা করবে কেনো! আমি কালকে ছবি তুলে রাখবো তখন দেখে নিও। ‘

‘আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলেছি, যে হা করে ঘুমাবো! ‘

‘আরে হ্যা, তুমিই তো বললে। আমি যেই আরেকবার মুখ বন্ধ করালাম, এতেই তুমি রেগে লাথি দিয়ে আমাকে খাট থেকে নিচে ফেলে দিলে! ‘

রোদসী অবাক হয়ে তাকালো। শহর নিষ্পাপ মুখ করে থাকলেও আড়ালেও হাসিটা চোখে পড়ে গেলো রোদসীর। সে বুঝতে পারলো শহর তাঁর সঙ্গে ফাজলামো করছে। রেগে মেগে হাতের কাছের বালিশটা ছুঁড়ে দিতেই শহর সেটা ক্যাচ করে হাসতে হাসতে বলল,

‘এমন হয় হয়, থাক ছোট মানুষ। ‘

রোদসী আরও রেগে তেড়ে এলো। শহরের চুল ধরে টানতে নিলেই শহর দৌড়ে রুমের অন্য সাইডে চলে গেলো। রুমটা মোটামুটি বড় হওয়ায় রোদসী শহরকে নাগালে পেলো না। শহর অন্য পাশে দাঁড়িয়ে হো হো করে হেঁসে মজা নিচ্ছে। রোদসী হার মেনে চলে যাওয়া ভান করতেই শহর সত্যি ভেবে কাছে আসতেই রোদসী শয়তানি হাসি দিয়ে চুল ধরে এলোমেলো করে দিলো। শহর এর বিপরীতে খপ করে রোদসীর হাত দুটো ধরে ফেললো। রোদসী দৌড়ে পালাচ্ছিলো। তৎক্ষনাৎ ধরে ফেলায় পাখির মতো ছটফট করে উঠলো। শহরের শান্ত দৃষ্টি তখন তাঁর মুখের দিকে। শহর আচমকা রোদসীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

‘তোমাকে এমন চঞ্চলে দেখতে ভালো লাগে রোদচশমা। ‘

কানের কাছে শিরশিরে অনুভূতি হওয়ায় কেমন লাগলেও। তাঁর চেয়ে বেশি ভয়ের অনুভূতি ডানা মেললো। এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলো রোদসী। এক ঝটকায় শহরকে দূরে সরিয়ে দিলো। হাঁপিয়ে উঠে বলল,

‘আর কক্ষনও আমার কাছে আসবেন না আপনি। একদম স্বামীর অধিকার দেখানোর চেষ্টা করবেন না! ‘

কথাটা বলেই হনহনিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো রোদসী। শহর ওখানেই আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। যদিও সে জানে, তাদের সম্পর্কটা আট দশটা মানুষের সম্পর্কের মতো নয়। শুধু একটু দুষ্টুমি করছিলো সে। কিন্তু এতে যে রোদসী এমন রেগে যাবে ভাবেনি। সম্পর্কটা যাতে স্বাভাবিক থাকে এর জন্যই চেষ্টা করছিলো। রোদসীর ব্যবহারে একটু কষ্টই পেলো সে।
অভিমানের প্রলেপে ঢেকে গেলো হাস্যজ্জ্বল মুখটা। সকালে উঠে রোদসীকে হাসতে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেছিলো। পরমুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেলো। যা ইচ্ছে করুক মেয়েটা। ওকে আর শহর ঘাটবে না। চুপচাপ বাহিরের সাইড ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে ওয়ালেট নিয়ে বেরিয়ে গেলো। দিলারার সকাল বেলা ওকে বের হতে দেখে খটকা লাগলেও কিছু বললেন না। খাবার হাতে নিয়ে রোদসীর কাছে গেলেন। রোদসী গোসল সেরে বের হয়ে গলায় চেইন পড়ছিলো। এসব পড়ার অভ্যাস নেই। তবুও মা আগেই বলে দিয়েছে এটা পড়তে হবে। দিলারা ঢুকে হাসিমুখে বললেন,

‘নাও মা, খেয়ে নাও। ‘

রোদসী তাকিয়ে দেখলো দিলারা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ভালো লাগলো ওর। যদিও আগে থেকেই রোদসী জানে, শহরের মা টিপিকাল শ্বাশুড়ির মতো ব্যবহার কখনো করবেন না। তবুও কেমন এলটা আশঙ্কা কাজ করছিলো মনে। রোদসী দিলারা’কে বলল,

‘মা, আপনি কষ্ট করে আনলেন কেনো? আমি নিচে যাচ্ছিলাম। ‘

‘দরকার কী! বিয়ে হয়েছে বলেই কাজে লেগে যেতে হবে নাকি! তুমি আমার আরেকটা মেয়ে এখন থেকে। ‘

রোদসী মুগ্ধতায় ডুবে গেলো। মানুষটা আসলেই খুব ভালো। তিনি নিজের হাতে রোদসীকে খাইয়ে দিলেন।
খাওয়া শেষে তিনি বললেন,

‘রোদসী মা, শহর কোথায় গেলো কিছু জানো? ‘

রোদসীর মনে পড়লো শহরকে সে কী বলেছিলো। হঠাৎই একটা অপরাধ বোধ তাঁকে জড়িয়ে ধরলো। রাগের মাথায় এমনটা করা উচিত হয়নি। শহর তো আর জানেনা, রোদসীর অমন করার কারণটা। মনে মনে ভাবলো, শহরকে সময় সুযোগ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে। অতীতের বিষাক্ত কথাগুলো এবার না জানালেই নয়। রোদসী মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘না মা, তিনি বলেননি। ‘

দিলারা তেমন কিছু বললেন না। ছেলে যে হুটহাট এমন বেরিয়ে যায় তিনি জানেন। কোনোরূপ সন্দেহ না করেই তিনি রোদসীকে বসতে বলে বেরিয়ে গেলেন।
বসে বসে এটা ওটা করে সময় কাটছিলো রোদসীর। তবে মনটা যেনো অন্য কোথাও। ভালো লাগছে না, ছেলেটা আসছেনা কেনো এখনো! দশটার বেশি বেজে গেলো। সকালের খাবারও তো খায়নি। এতো রাগ, এতো অভিমান! রোদসী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবতে থাকলো, সে কী একটু বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেললো! রোদসীর চিন্তা ভাবনাই এমন। প্রথমে কোনো কিছুতে ভুল করে ঠিকই। কিন্তু পরবর্তীতে তা নিয়ে ভীষণ অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে। রৌদ্রস্নাত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রোদসী অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলো, সে অভিমানী বালকের।

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here