🎑 মেঘের আড়ালে চাঁদ 🎑
(৪)
আমরা আবার বসেছি , মিজানের বক্তব্য লিখতে, আমি আগের লেখা গুলো গুছিয়ে নিয়েছি, খোঁজ খবর ও শুরু করেছি, আমি কোন কাজ হোমওয়ার্ক ছাড়া করিনা। এক ছোট ভাই নিলয় আছে ডিবিতে, তাকে যা যা জেনেছি মেইল করেছি, সে দুইদিন সময় চেয়েছে,
মিজানের ভাষায় লিখছি,
আমি সিলেটগামী বাস ধরতে রাত আটটায় গোলাপবাগ যাব ঠিক করলাম। তখনই এলো আমার বোনের ফোন। ও বলল
আমি যেন কোনভাবেই বাড়ি বা সিলেট কোথাও না যাই।
আমি কি বলব, পুরো অবাক, দুলাভাইয়ের কথায় তো ভয়ের কিছুই মনে হয়নি। আপার হঠাৎ কি হল?
•না ভাই তুই কিছুতেই আসিস না ভাই। দূরে কোথাও চইলা যা।
•কিন্তু কেন? কি হয়েছে বলবে তো?
•বাবা তোর দুলাভাইয়ের কাছ থেকে কসম নিছে, কিন্তু আমাকে কিছু কয় নাই তাই আমি বলতেছি,
•কি হয়েছে আব্বার?
•আম্মা আর মোহনারে আগেই আমার মামা শ্বশুরবাড়ি পাঠায়ে দিল, আব্বা কিছুতেই তার ফসল ফেলে যাবে না। কি আর করা। আপা ফোঁপাতে লাগলো….
•আপা প্লিজ কেঁদো না, আমাকে বল কি হয়েছে?
•আব্বা ক্ষেতের ফসল তুইলা হাটে গেছিল ভ্যানে কইরা ,হাট থেকে রাইতে ফিরতেছে, আরো তিনজন আছিল। অন্ধকারে একটা মাইক্রোবাস খাড়ায় ছিল, ভ্যান পাশ কাটিয়ে আগায় গেল, মাইক্রোবাস অনেকটা পথ পিছে পিছে আইল, আমগোর গেরামের রাস্তায় ঢোকার আগেই পিছন থেকে দিল ধাক্কা, রাস্তার পাশে ছিল খাদ, চারজনেই খাদে পইড়া গেল, তারপর মাইক্রোবাস দ্রুত পালায় গেল,
•আমাদের গ্রামের রাস্তায় মাইক্রোবাস?
• হ!
• কালেভদ্রে কেউ আনলে আসে, তাছাড়া ঐ রাস্তা দিয়ে মাইক্রোবাস কেন, সিএনজি ও যায় না।
•আমি ভাবছিলাম এক্সিডেন্ট। কিন্তু না তর দুলাভাইয়ের মোবাইলে সমানে ফোন আসে, সে ধরেনা দেখে, আমার মোবাইলে ফোন দিল, আমি ধরার পর বলে, সেদিন জানে বাঁচায় রাখছি, বয়ান ঠিক না করলে বংশের কেউ বাচব না।
•কি বলছ আপা? আব্বা কই?
•আব্বা হাসপাতালে ভর্তি। আল্লাহর দোহাই লাগে, আমার প্যাটের বাচ্চার দোহাই লাগে তুই বয়ান বদলায় দে ভাই। আমাদের মারিস না, আমার বাচ্চাটা….. আমার বাচ্চাটা দুনিয়ার আলো দেখবে না….তা হয় না…..
এরপর ঠাস করে শব্দ হয়ে লাইন কেটে গেল। আমি হতবাক। দুলাভাই কল রিসিভ করেন না। আমি ঘরময় পায়চারি করছি, ফোন বেজে উঠল, অনুপমের কল, ভয় পেলাম রিসিভ করলাম না। অফিস থেকে এতদিন কেউ কোন খোঁজ খবর করেনি, হঠাৎ কেন? বাবাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে,আমার মা, বোনরা কতটুকু নিরাপদ? আমি কোন দিশা পাচ্ছিনা। দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ঘরে পায়চারি করছি । হঠাৎ ফেসবুকের এর একটা নোটিফিকেশন এলো ফোনে, তাতে আমার এক স্কুলের বন্ধুর নাম দেখাচ্ছিল, যার বাড়ি দিনাজপুর। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল ,ঝটপট গুগল করে জেনে নিলাম, দিনাজপুরের বাস কোথা থেকে ছাড়ে। খুব সামান্য কটা টাকা পকেটে নিয়ে ঢাকা ছাড়লাম। কারো কাছে সাহায্য চাইলেই বুঝে নেবে আমি আজ শহর ছাড়ছি, তাই কাউকে কিছু বলিনি, নিজেই কল্যাণপুর চলে এলাম, মিরপুর রোডেই অনেক বাস কোম্পানি আছে, আমি বাস থেকে নেমে সোজা কাউন্টারে গেলাম,প্রায় আধা ঘণ্টা পর পরই বাস আছে, সবচেয়ে কম দামী টিকিট কিনে অপেক্ষা করতে লাগলাম, একটা তাবলিগের দল এলো, ওদের মালামাল বাসের উপর তুলল, ভালো হল, ভিড় থাকা ভালো।
আল্লাহর নাম নিয়ে বাসে উঠলাম। রংপুরের বাস। ঢাকা পার হতেই বাতাস হালকা হতে শুরু করল, এটাই মনে হয় ঢাকার বুকে প্রতিটি প্রাণীর দীর্ঘশ্বাস! যা এতক্ষণ গুমোট হয়ে ছিল। সাভার পার হয়ে যেন মুক্তি পেল বাতাস, কিশোরীর মতন খেলে বেড়াতে লাগল বাসময়, অন্ধকারে শুধু দোকানের আলো দেখা যায়, গ্রামের অংশে তাও দেখা যায় না। কিন্তু সুখ স্থায়ী হল না,
এই রাতেও জ্যাম!
কথাটা জোরে বলে ফেলেছি, পাশে বসা বুজুর্গ লোক বললেন, ট্রাকের জ্যাম, সামনে যমুনা ব্রিজ। উনিও মনে হয় তাবলিগে যাচ্ছেন, হাতে তসবিহ, বাকিরা ঘুমাচ্ছে, আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। উনি খুব মৃদু শব্দে জিকির করছেন, বারবার আল্লাহর নাম কানে আসায় যেন একটু সাহস বাড়ছে,
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা, ঘুম ভাঙল ব্রিজের শুরুতে, রাতের আলোকিত ব্রিজ আসলেই অপরূপ! মালার মত সোডিয়াম বাতি গুলো জ্বলছে, যে কেউ প্রেয়সীর গলায় এমন মালা দেখার স্বপ্ন দেখবে…..
•বেশি সাহিত্য করে ফেলছি?
•হুম? কই? নাহ! আমি মুগ্ধ হয়ে মিজানের কথা শুনছি আর টাইপ করে যাচ্ছি। ডিবি পুলিশ নিলয়ের ফোন এলো,
আমি আসছি বলে, উঠে এলাম।
•হ্যালো, নিলয় বল।
•কেমন আছেন আপু?
•ভালো, এই নিলয় ছেলেটা কখনো শুরুতেই মোদ্দা কথায় আসেনা।
•মিজানুর রহমানের প্রতিটি কথা সত্য!
•কি?
•জি আপু। তার অফিসের একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে, রেপ করে, মার্ডার করে বডি ডাম্প করা হয়েছে গাজিপুরের কালিগঞ্জে!
•ও যা যা বলেছে, সব সত্য।
•হ্যা, কিন্তু সে প্রমাণ করতে পারেনি অফিসের ঐ তিন ব্যক্তি ফারহান শিকদার, কনক হাসান, আহসান হাবীব জড়িত, কারণ অফিসের বাকিরা কেউ তাকে সাপোর্ট করেনি। সবাই এক বয়ান দিয়েছে, একমাত্র সে সত্য বয়ান দিয়েছে।
•কিভাবে এত শিওর হলে?
•আমি সিসিটিভি ফুটেজ কিছুটা উদ্ধার করেছি, অফিসেরটা নাই, কিন্তু আশেপাশের সব দোকান, রেস্তোরাঁ থেকে সিসিটিভি ফুটেজে তাদের স্পষ্ট গাড়িতে দেখা যাচ্ছে।
•এতে তো প্রমাণিত হয়না, যে তারাই……
•হ্যা, তার জন্য ফরেনসিক তদন্তের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে আমাদের।
•ফরেনসিক রিপোর্ট তো তেমন কিছু পায়নি, পুলিশ কেস ক্লোজ করে দিয়েছে।
•কেস রিওপেন হবে।
•সত্যিই?
•হ্যা কিন্তু তার আগে আমাদের কেসটা মজবুত করে তুলতে হবে, সব এভিডেন্স তো একত্র করতেই হবে, সাথে মিজানের পরিবারের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা এই গ্যাং রেপে জড়িত তারা সহজ বান্দা না!
•হ্যা সে তো বুঝতেই পেরেছি। এখন আমাদের করনীয়?
•আপনি পুরো স্টোরি সুন্দর করে গুছিয়ে লিখে নিন। আমাকে মেইল করুন। ফরেনসিক রিপোর্ট এর বিষয়টি আমি দেখব।
•অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।
•আরে কি বলেন আপু! আপনার জন্য আজ আমার বোন আমাদের মাঝে আছে। সেদিন গভীর রাতে যদি আপনি একা ড্রাইভ করে আমাদের বাসায় এসে, আমাদের না জাগাতেন তাহলে আমার একমাত্র ছোট বোনের স্থান হত কবরে!
•সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
•তা তো অবশ্যই। আপনি সাবধানে থাকবেন। আমি দুজন লোকাল এজেন্ট কে জানিয়েছি, তারা আমাকে রিপোর্ট করছে, তবুও আপনি সাবধানে থাকবেন। আপনি এতে জড়িয়েছেন জানলে এরা আরো মরিয়া হয়ে যাবে।
•মিজানের পরিবার ভালো আছে?
•মিজানের বাবা হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন, ওর বড় বোন খুব অসুস্থ হাসপাতালে ভর্তি , মা, ছোট বোন ভালো আছে।
•তুমি যে গুছিয়ে কাজ কর। সব প্রশ্নের জবাব হাজির!
•আমি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, অগ্রগতি হলে জানাবো।
•আল্লাহ হাফিজ।
•আল্লাহ হাফিজ।
মিজান নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে চা বানাচ্ছে, আমি পিছনে দাড়াতেই হেসে বলল,
•আপনার অনুমতি ছাড়াই রান্নাঘরে কাজ শুরু করলাম….
•না, ঠিক আছে,
•আপনি নেবেন?
•হ্যা দাও।
মিজানের জন্যই তারিককে দিয়ে চা পাতা, গুড়ো দুধ, চিনি আনিয়েছি, সাথে এলাচ, তেজপাতা আর আদা । তারিক জানে আমি মসলা চা খাইনা, কিন্তু কিছু না বলে এনে দিয়েছে, আজ সব উপকরণ দেখে খুশি মনে চা বানাচ্ছে মিজান। ওর উপর দিয়ে যা যাচ্ছে, যে যুদ্ধ ও একা একা এতদিন করে এসেছে, আমি আমার সাধ্যমত ও কে সবরকম সাহায্য করব।
চা বানানো শেষে,
•বাইরে খাবেন?
•হুম খাওয়া যায়
•এক মিনিট,
দুটো চেয়ার আর সোফা সেটের ছোট টেবিলটা বাইরে সেট করে দিল খুব দ্রুত, তাতে ট্রে রেখে আমাকে ডাকল, আমি তো অবাক, ট্রে তে বিস্কুট ও আছে,
আমি বসতেই বলল,
•আপনি কি বিস্কুট খান সে তো জানিনা! বলে ইতস্তত ভঙ্গিতে হাসল। ওর চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল।
আমি জানি, এ ক্ষণিকের মোহ, আসরাফুন্নেসার কেসটা শেষ হলেই আমি আবার আমার অন্ধকারে ডুবে যাব। এবার তো শিশিরকেও পাবো না, আমার সাথে, সেও তো আমার স্মৃতির পাতা থেকে ধীরে ধীরে মলিন হয়ে মিজান কে জায়গা করে দিয়েছে, আবার কি সে ফিরে আসবে?
আবার তার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা যাবে?
•আমি কিছু বলতে পারি?
•হঠাৎ মিজানের কন্ঠে আমার ধ্যান ভঙ্গ হয়। হ্যা বলুন।
•সারাদিন কি নিয়ে এত চিন্তা করেন? লেখা? রাতে ও ঘুমান না? ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেললাম!
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, ও কি আসলেই আমায় জানতে চাইছে? না নিছক কৌতুহল?
•শিশির মানে আমার প্রয়াত হাসব্যান্ড, চলে যাওয়ার আগে থেকেই আমার এই ঘুমের সমস্যা শুরু হয়েছে ,আর সারেনি।
•সারেনি? নাকি সারানোর চেষ্টা ও করেননি?
•না….. চেষ্টা….. ডাক্তার দেখাতাম ,আমি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি, আমার স্বামীর মৃত্যুর তিন মাস পর আমার শাশুড়ি ও মারা যান। স্বামীর ক্যান্সার ছিল, তার শেষ সময়টা দেখেই আমার শাশুড়ি বিছানায় পড়েন ,তিন মাস আমাকে এক মুহূর্ত কাছ ছাড়া করতেন না….. আমরা দুজন মিলে রোজ শিশিরের স্মৃতি রোমন্থন করতাম, আমার শ্বশুর এসব পছন্দ করতেন না। আমাকে বাবার বাড়ি পাঠাতেন জোর করে, আমার শাশুড়ি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলে বাধ্য হয়ে আবার আমায় ডাকতেন, আমরা আবার স্মৃতির সাগরে সাতরে বেড়াতাম। তারপর শাশুড়ি ও মারা গেলেন, আমার যেন আর কিছুই রইল না। কেন বাচ্চা নিলাম না সে আক্ষেপ আজো কুরে কুরে খাচ্ছে….. আমার শ্বশুর কদিন আগেও নতুন জীবন শুরু করতে বললেন।
•ঠিকই বলেছেন, কারো স্মৃতি রোমন্থন করে হয়ত জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু সেটা সুস্থ বেঁচে থাকা না, জীবন্ত মানুষের অবলম্বন লাগেই….
•এভাবেই শ্বশুর বুঝালেন। এই বয়সে….
•আপনি বারবার বয়স টেনে আনেন! হলিউডে দেখেন নায়িকারা পঞ্চাশেও বিয়ে করছে, সঙ্গী বদল করছে।
•ওরা অনেক ফিট।
•শুধু শরীরের ফিটনেস না মনের সুস্থতাও জরুরি। যা আমাদের দেশের মেয়েদের নেই। আমার বড় বোন এখনই হাজার রোগ বাধিয়ে বসে আছে, আমার দুলাভাই চমৎকার একজন মানুষ, ও যদি যোগব্যায়াম, ওয়ার্ক আউট করে দুলাভাই খুশিই হবেন।
•খুশি হবেন কিন্তু ঘরের কাজে সাহায্য করবেন না।
•তা ঠিক। এতটা উদারমনা হয়নি আমাদের সমাজ।
•তাও কিন্তু এখন অনেক কিছু বদলেছে।
•বদলেছে মেয়েরাই! কোন কিছু কম্প্রোমাইজ না করে ক্যারিয়ার গুছাতে শুরু করেছে, এতে আসলে স্বামী বা বন্ধুর সাহায্য খুব কম পায় তারা।
•ঠিক, আপনার প্রতিটি কথাই ঠিক। তাই বলে কি সবাই একা থাকছে? একা থাকাটাই সমাধান?
•তা জানিনা। শিশিরের জায়গা নিতে পারার মত কাউকে পাইনি।
•পাবেন ও না। শিশির ভাই আপনার হৃদয়ের অনেকখানি জুড়ে থাকবেন, তিনি আপনার প্রথম প্রেম, কিন্তু হৃদয়ে সামান্য জায়গাতেই হয়ত কেউ নিজের আবাস গড়ে তুলতে পারে…. শুধু হৃদয়ের আগলটা খুলে দিন। যাই মাগরিবের আজান দিচ্ছে, আপনি ভিতরে যান, আমি এসে এগুলো ভিতরে দিয়ে আসব। দরজা লক করে দিন। তারিক ভাইয়ের কাছে চাবি আছে। এক সাথে ঢুকব৷
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। পকেট থেকে টুপি বের করে মাথায় দিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেল মিজান। এই বাসার কাছেই মসজিদ আছে, মেইন রোডের পাশে, কিন্তু ও গ্রামের ভিতরেরটায় যায়। আমি গ্রামের মেঠোপথে তাকিয়ে রইলাম। সূর্য মাত্রই ডুবে গেছে, আকাশে তার রক্তিম আভা রয়ে গেছে। আমিও বাসার ভিতরে গিয়ে স্রষ্টার উপাসনায় মগ্ন হলাম। কিন্তু তাতেও হানা দিচ্ছে মিজান!
🧡🧡🧡যারা আমার লেখা পড়েন, আমাকে ভালোবাসেন, আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে, বিধাতা মঙ্গলময় করুক সবার জীবন 🧡🧡🧡