মেঘের পরে রংধনু পর্ব-১০

0
1380

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১০
লিখা: Sidratul Muntaz

ইলহান অরিনের দেওয়া খামচির আঘাতের কোনো তোয়াক্কাই করলো না। জোর করে অরিনকে সিটবেল্ট বেঁধে দিল। তারপর নিজে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো। অরিন রাগে,জেদে ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। তার ইচ্ছে করছে ইলহানের ব্রাউনিশ চুলগুলো একটানে ছিঁড়ে ফেলতে। এই ছেলে কথায় কথায় শুধু জোর খাটাতে চায় কেনো? সে কি অরিনকে পুতুল পেয়েছে? যখন ইচ্ছা তুলে আনবে, গায়ে হাত তুলবে, ধমকাবে আবার জোর করে গাড়িতে এনে বসাবে। অরিনের ইচ্ছার কি কোনো দাম নেই? ইলহান নির্লিপ্তভাবে গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে যাচ্ছে। ওর কি হাতে একটু ব্যথাও লাগছে না? ফরসা হাতে লাল টকটকে জখমের দাগ কত গাঢ়ভাবে ফুটে উঠেছে। ভয়ংকর দেখাচ্ছে! এইগুলো অরিনের নখের আঁচড়। অথচ দেখে মনে হচ্ছে কোনো হিংস্র পশুর থাবা। অরিন মনে মনে চিন্তা করলো, বাসায় গিয়ে নখগুলো কাটতে হবে। কিন্তু আসল সমস্যা তো বাসায় যাওয়া নিয়েই। ইলহান তো তাকে এখন ধানমন্ডি নিয়ে যাবে। কারণ সে জানে অরিনদের বাসা ধানমন্ডি সাতাইশে। অথচ অরিন থাকে উত্তরার পাঁচ নং সেক্টরে। সে ইচ্ছে করেই ইলহানকে ভুল ঠিকানা দিয়ে রেখেছে। তার এলাকায় এসে ইলহান হাঙ্গামা করবে, সাইকোগিরি দেখাবে, এলাকার মানুষজন হাসি-তামাশা করবে এসব অরিন চায় না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না চাইলেও ইলহানকে আসল ঠিকানা জানাতে হবে। নাহলে ধানমন্ডি গিয়ে অরিন করবেটা কি? ভ্রুম ভ্রুম শব্দ হচ্ছে কোথা থেকে যেনো। অরিন শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখলো ইলহানের পকেটে মোবাইল বাজছে। ইলহান মোবাইলটা বের করে রিসিভ করলো।
” হ্যালো শ্যান।”
অরিন প্রচন্ড উদ্দীপ্ত হয়ে ইলহানের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিল। ইলহান চমকে উঠলো। কিন্তু কিছু বললো না। অরিন একটু দূরে সরে ফিসফিস করে বললো,
” হ্যালো শ্যানিন, তুই কেনো ফোন করেছিস?”
” আমি তো ভাইয়াকে ফোন করেছি। তুই কেনো ধরেছিস?”
” তুই তোর ভাইয়াকে কেনো ফোন করেছিস সেটাই জানতে চাইছি।”
” তোদের বাসার এড্রেস দেওয়ার জন্য।”
অরিন ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল। এজন্যই তো ইলহানের থেকে খাবল মেরে ফোনটা নিয়েছে। অরিন বললো,
” কেনো? এড্রেস আমি বলতে পারি না? ”
” তুই যেই ঘাড়ত্যাড়া। ভাইয়া তোকে ধানমন্ডি রেখে আসলেও মুখ খুলবি না। আমি খুব ভালো করে চিনি তোকে। ভাইয়াকে ফোনটা দে।”
” দ্যাখ, তোকে কিচ্ছু বলতে হবে না। আই উইল ম্যানেজ। তুই কিন্তু ভুলেও ঝামেলা পাকাবি না।”
” তুই কি পেয়েছিস বলতো? ফাজলামি? আমার ভাই কি গুন্ডা না মাস্তান যে তোর বাসার ঠিকানা জানলে সমস্যা হয়ে যাবে? সে কি তোকে বাসা থেকে তুলে আনতে যাবে? তাছাড়া ইদানীং ডিওএইচএস থেকে ধানমন্ডি জার্ণি করতে করতে ভাইয়া পাগল হয়ে যাচ্ছে। আমি এমনিতেও ভেবেছিলাম সত্যিটা তাকে বলে দিবো। আমার ভাইয়া খামোখা কেনো এতো কষ্ট করবে?”
” তুই যদি সত্যি বলিস তাহলে তোর-আমার ফ্রেন্ডশীপ এখানেই শেষ। দ্যা ইন্ড।”
” আমার ভাই মরে যাচ্ছে। ফ্রেন্ডশীপ দিয়ে আমি কি করবো? লাগবে না তোর ফ্রেন্ডশীপ আমার। তুই শুধু আমার ভাবী হয়ে যা।”
অরিন ফোন কেটে দিল। শ্যানিনও কথা শোনে না। এই দুই ভাই-বোন মিলে ওর জীবনটা অতিষ্ট বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেনো। শ্যানিন আবার ফোন দিল। অরিন এইবার ফোনটাই বন্ধ করে ফেললো। ইলহান বললো,
” কি হলো এটা? তুমি আমার ফোনের পাওয়ার অফ করলে কেনো?”
অরিন জবাব দিল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে রইল। ইলহান অরিনের হাত থেকে ফোনটা নিতে চাইল। অরিন তাও দিল না। শক্ত করে ধরে রাখলো। ইলহান পরে আর জোরাজুরি করেনি। এটা তো সামান্য একটা মোবাইল। কিন্তু এই মেয়েটা যে ওর গোটা হৃদয়টাকেও এভাবেই হাতের মুঠোয় চেপে ধরে রেখেছে। তা কি মেয়েটা জানে? একটু পর অরিন বললো,
” আমি ধানমন্ডি যাবো না।”
” তাহলে?”
” উত্তরায় যাবো।”
” এই মাঝরাতে উত্তরা কেনো?”
” সেখানে আমার একটা কাজ আছে।”
” এতোরাতে তোমার ওইখানে কি কাজ?”
অরিন অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
” এতো কৈফিয়ৎ আমি আপনাকে কেনো দিবো? উত্তরা নিয়ে যেতে বলেছি নিয়ে চলুন।”
” আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিবো অরিন। অন্যকোথাও নিয়ে যেতে পারবো না।”
আচ্ছা মুশকিল তো! সত্যি সত্যিই ইলহান তাকে ধানমন্ডি নিয়ে যাবে নাকি? সে তো ধানমন্ডির কিছুই চিনে না। অরিন রাগান্বিত হয়ে সিটবেল্ট খুলতে লাগলো। ইলহান বললো,
” কি হয়েছে?”
” আমি নামবো।গাড়ি থামান। আপনার সাথে আমি কোথাও যাবো না।”
” মাঝরাস্তায় নেমে যাবে নাকি? এইটা কোন ধরণের কথা?”
” গাড়ি থামাবেন নাকি আমি লাফ দিবো?”
” চেষ্টা করেই দেখো।”
ইলহান সবকিছু লক করে রেখেছে। হায় আল্লাহ! এইবার কি হবে? ধানমন্ডি অরিন কিছুতেই যেতে চায় না। আজকে মনে হয় একটা বড়সড় বিপদ আছে। অরিন বাধ্য হয়ে বললো,
” আসলে আমার একটা কাজিন উত্তরাতে থাকে। আমাকে তার বাসায় যেতে হবে। সে খুব অসুস্থ। আপনাদের বাসা থেকে ফিরে তাকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। মাকেও বলে এসেছি আমি আজরাতে ফিরবো না। কারণ নৌশিনদের বাসায় থাকবো।”
” কেমন কাজিন?”
” মামাতো বোন।
” এইটা এতোক্ষণ বললেই হতো।”
অরিন মনে মনে খুব প্রশান্তির একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। নৌশিনদের বাসা তো তাদের বাসার পাশেই। এখন আর কোনো অসুবিধা নেই। শুধু শ্যানিন ইলহানকে কিছু না বললেই হয়। অরিন ঠিক করেছে বাসাটা চেঞ্জ করে ফেলবে। এরপর শ্যানিনকেও আর ঠিকানা দিবে না। সাধ্য থাকলে অরিন এই দেশ ছেড়েই পালিয়ে যেতো। যদিও নিজের দেশের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা আছে। কিন্তু ইলহানের পিছু ছাঁড়ানোর জন্য সে শুধু দেশ না, পৃথিবী ছাড়তেও রাজি৷ প্রয়োজনে মঙ্গলগ্রহে চলে যাবে। যেহেতু এখন মাঝরাত আর পুরো রাস্তা পরিষ্কার তাই উত্তরা পৌঁছাতে আধঘণ্টার বেশি সময় লাগলো না। অরিন একদম তার বাসার কাছেই নামতে চাইলো। বাসার সামনে বড় একটা পার্কিং লটের মতো জায়গা আছে। সেখানে অনেকগুলো গাড়ি একসাথে হিজিবিজি করে রাখা। সামনে সবুজ ঘাসে মোড়ানো ফাঁকা জায়গা। দেখতে সুন্দর লাগে।বসার জন্য বেঞ্চও আছে। অরিন আর নৌশিন প্রায়ই এই জায়গায় হাঁটতে আসে। ওদের বাসাটা ঠিক পেছনেই। অরিন বরাবর বাসার সামনে না নেমে এখানেই নামলো। ইলহান বললো,
” তোমার কাজিনের বাসা কোনটা?”
” সামনেই।”
” কোথায়? দেখাও আমাকে।”
” আপনার কি আমাকে সন্দেহ হচ্ছে?”
” সন্দেহ হবে কেনো? এমনিই দেখতে চাইলাম।”
” আমি এখন বাসায় যাবো না। এই জায়গায় কিছুক্ষণ বসবো।”
” তাহলে আমিও বসি?”
অরিন এমনভাবে তাকালো যেনো চোখের আগুন দিয়ে ইলহানকে ঝলসে ফেলবে। ইলহানের মনখারাপ হয়ে গেল। সারারাস্তা ওরা তেমন কোনো কথাই বলেনি। ইলহান মাঝে মাঝে দুই-একটা প্রশ্ন করেছিল। ফোন বন্ধ কেনো সেটা জিজ্ঞেস করেছিল। অরিন একদম উত্তর দেয়নি। সে হয়তো খুব রেগে আছে। ইলহানের কি উচিৎ ক্ষমা চাওয়া? অবশ্যই উচিৎ। অরিন খুব দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছিল। ইলহান যেই না পিছু ডাকলো ওমনি অরিন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রাস্তার মাঝে। ইলহান মনে মনে বললো,
” ওহ শিট।”
তারপর গাড়ি থেকে নেমে অরিনের কাছে আসলো। পাথরের খন্ডাংশের সাথে লেগে পায়ে রক্ত জমে গেছে। ইলহান বললো,
” হাঁটতে পারবে?”
” এতো বিরাট কিছুও হয়নি যে হাঁটতেই পারবো না। নিশ্চয়ই পারবো। তাছাড়া এটা আপনার জন্যই হয়েছে। আমাকে পিছু ডাকলেন কেনো?”
” স্যরি। আমার জন্য যখন হয়েছে আমিই ভুল সংশোধন করি?”
” কিভাবে সংশোধন করবেন?”
” এসো তোমাকে কোলে করে গেইট পর্যন্ত নিয়ে যাই।”
” একটা থাপ্পড় মারবো।”
অরিন এইবার পাথরের খন্ডাংশ মানে যেটা দিয়ে ওর পায়ে আঘাত লেগেছিল সেটা তুলে বললো,
” এইটা এখন আপনার মাথায় মারবো আমি এমন উল্টা- পাল্টা কথা আরেকবার বললে।”
” আচ্ছা স্যরি, আর বলবো না। অন্তত তোমার ব্যাগটা ধরি? এতো ভারী ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হবে না?”
ব্যাগ তেমন ভারীও না। অরিন তবুও ইলহানের হাতে ব্যাগ দিল। তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেঞ্চ পর্যন্ত গিয়ে সেখানে বসে পরলো। ইলহান বললো,
” বাসায় যাবে না?”
” বললাম তো। এখানে আমি কিছুক্ষণ বসে থাকবো। আপনি যান।”
ইলহান ব্যাগটা অরিনের পাশে রাখলো। তারপর মাথা নিচু করে বিনীত গলায় বললো,
” আই এম স্যরি অরিন।”
অরিন তাকালো না ইলহানের দিকে। রাস্তার একপাশে মুখ ফিরিয়ে রাখলো। ইলহান হাঁটু গেড়ে বসলো অরিনের সামনে। ওর জখম হয়ে যাওয়া পাটা নিয়ে ইলহান নিজের কোলের উপর রাখলো। অরিন ক্ষেপে উঠলো,
” আশ্চর্য, কি করছেন?”
ইলহান কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে অরিনের রক্তজমাট বেঁধে যাওয়া জায়গাটায় চুমু দিল। অরিনের সমস্ত শরীরে যেনো প্রবল বেগে কিছু একটা ঢুকে পড়লো। আর তুমুল গতিতে সেই অদ্ভুত পরশ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো রক্তপ্রবাহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ইলহান মাথা তুলে দেখলো অরিনের বামগালটা একদম লাল হয়ে আছে। এখানেই তো চড় মেরেছিল সে। ইলহান অরিনের চুল ঠিক করে দেওয়ার বাহানায় কাছে এসে হুট করে চুমু দিয়ে ফেললো সেই গালে। অরিন এবার বিস্ময়ের চরম সীমায়। ইলহান আবারও বললো,
” স্যরি, স্যরি, স্যরি। তখনের ঘটনার জন্য অনেকগুলো স্যরি। আর কখনও যদি তোমাকে আঘাত করি তাহলে এই হাত কেটে ফেলো।”
অরিনের চোখ দু’টো এমনভাবে জ্বলছে যেনো অগ্নিশিখা। ইলহান কিছুক্ষণ অরিনের উত্তরের অপেক্ষা করলো। যখন দেখলো অরিন কিছু বলছে না তখন উঠে চলে যেতে লাগলো। অরিন তখন পিছু ডেকে বললো
” এই শুনুন।”
ইলহান দাঁড়ালো একবুক আশা নিয়ে। অরিন বললো,
” এইদিকে আসুন একবার।”
ইলহান কাছে আসলো। অরিন বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়ালো। এখন সে ইলহানের থেকেও কিছুটা লম্বা। অরিন ব্যাগ খুলে পানির বোতল বের করলো। তার ব্যাগে প্রায় সবসময় ঠান্ডা পানির বোতল থাকে। আজকেও আছে। অরিন বোতল খুলে ইলহানের মাথায় সমস্ত পানিটা ঢেলে দিল। তারপর অন্যহাত দিয়ে ইলহানের ভেজা চুল ঘেটে এলোমেলো করে দিল। ইলহান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল একদম। একটু পর একহাতে মুখ মুছে অবাকদৃষ্টিতে অরিনের দিকে তাকালো। অরিন হাত দিয়ে তুরি বাজিয়ে বললো,
” একটু আগে যে অপরাধ করেছেন সেই অপরাধের শাস্তি এটা। মনে থাকবে? আর কখনও এমন দুঃসাহস দেখাবেন না। এখন যান আমার চোখের সামনে থেকে।”
ইলহান ভেজা চুলগুলো কয়েকবার ব্যাক ব্রাশ করলো। অরিন ভেবেছিল সে ইলহানকে শায়েস্তা করতে পেরেছে। কিন্তু না, ইলহান যাওয়ার আগে এমনভাবে একটা হাসি দিল যে অরিনের সম্পূর্ণ শরীর লজ্জায় লালবর্ণ হয়ে গেল। অরিন খুব ভালো করেই বুঝলো ইলহানের হাসির কারণটা। সাতমাস আগে ঠিক এভাবেই উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে অরিন অন্যরকম একটা কান্ড ঘটিয়ে ছিল। এখন তো অরিন বেঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তখন দাঁড়িয়েছিল চেয়ারে। আসলে ইলহান এতোটাই লম্বা যে উঁচু জায়গায় না দাঁড়ালে ওকে ছোঁয়া যায় না। আর অরিনের মতো পাঁচফুট তিন সাইজের লিলিপুটের পক্ষে তো তা একেবারে অসম্ভব। যদিও বাংলাদেশী পরিসংখ্যান অনুযায়ী অরিনকে মোটামুটি লম্বা বলা যায়। কিন্তু ইলহানের তুলনায় সে তো লিলিপুট! সেদিনের সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে অরিনের শরীর আজও ঈষৎ কাঁপে!

সেদিন বান্ধুবিরা সবাই মিলে যাচ্ছিল শ্যানিনের ছোটচাচার ছেলের বিয়েতে চট্টগ্রাম। ট্রেনে করে ভ্রমণ। ইলহানের সাথে প্রথম দেখাটা হয় ট্রেনেই। অরিন ইলহানকে প্রথম দর্শনেই চড় মেরেছিল। দ্বিতীয় দর্শনেও সেই চড়। এই নিয়ে যে বিয়েবাড়িতে কত ঝামেলা আর হট্টগোল হলো! একটা দামড়া টাইপ ছেলেকে নিয়ে যে মানুষ এতো বেশি আহ্লাদ করতে পারে ইলহানকে চড় না মারলে অরিন সেটা কখনও জানতো না। সে অবশ্য শ্যানিনের কাছে আগেই প্রমিস করেছিল চড় মারার জন্য ইলহানের কাছে ক্ষমা চাইবে। যদিও প্রথম চড়টা অরিন স্বাভাবিক অবস্থায় দেয়নি। তখন সে মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত ছিল। রায়হানের বিয়ের খবর অরিনের পুরো পৃথিবীটাই যেনো ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় চড়টা সে সজ্ঞানে দিয়েছিল। যা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। ট্রেন থেকে নামার পর সেই কথা অরিনের আর মনে নেই। রায়হানের শোকে সে পুনরায় ডুবে গেল। বিয়েবাড়ির গমগমে পরিবেশ তার অসহ্য লাগছিল। তারা যেখানে এসেছে সেটা বিয়ের পাত্রীদের নিজস্ব বাগানবাড়ি৷ কি যে বিশাল আর সুন্দর! এতো দীর্ঘযাত্রা করে সবাই মোটামুটি ক্লান্ত ছিল। তাও কেউ রেস্ট না নিয়ে গোটা বাগানবাড়ি ঘুরতে বের হয়ে গেল। বাড়ির পেছনে একটা বড় পাহাড় তার পেছনে বিস্তৃত মাঠ। পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে মাঠে নেমে পড়া যায়। সেইখানে আবার গরু মহিষ বেঁধে রাখা। উৎসবের আমেজে সম্পূর্ণ বাড়ি অদ্ভুত সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। অরিনকে ঘুরতে বের হওয়ার জন্য সবাই অনেক জোর করেছিল। কিন্তু অরিন যায়নি। তার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মনে তখন প্রবল বেগে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছিল। অরিন না পারছিল মনের ঘূর্ণিঝড় সামলাতে আর না পারছিল নিজেকে ঠিক রাখতে। একবার তো মনে হলো, সে সত্যিই আত্মহত্যা করবে। রায়হানহীন এই ব্যথার জীবন তার চাই না। চারপাশের হৈচৈ মেশানো শব্দ তখন বিষের চেয়েও বিষাক্ত লাগছিল অরিনের কাছে। রায়হানের বিয়ের খবরটা যদি সে আরও কয়েক ঘণ্টা আগে জানতে পারতো তাহলে কখনও শ্যানিনের দাওয়াতে আসতো না। ভীড়ের মাঝে নিজেকে প্রচন্ড একা ও নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল অরিনের। যেমনটা প্রায়ই হয়। রায়হান ছিল তার নিঃসঙ্গতার একমাত্র মহৌষধ। আর এখন সেই রায়হানও তার জীবনে নেই। অরিনের বেঁচে থাকার কি সত্যিই কোনো মানে আছে? সারাদিন ঘর থেকে একবারও বের হলো না অরিন। সন্ধ্যায় ঘুম ভেঙে দেখলো যেই রুমে সে একা শুয়েছিল সেখানে এখন মোটামুটি ভীড়। অন্বেষা, তানিশা,ইতি আর মারিয়া একসাথে বসে আছে। একেক-জনের পায়ের সেলোয়ার হাঁটু পর্যন্ত উঠানো। মশার কামড়ে প্রত্যেকের পা ঝাঝরা হয়ে গেছে একদম। অরিন শোয়া থেকে উঠে বসে ঘুমে ঘোর লাগানো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” তোরা কোথায় ছিলি?”
ইতি বললো,” তুই উঠেছিস? খবরদার ঘর থেকে বের হবি না। স্ট্রিক্ট রেস্ট্রিকশন আছে।”
ইতির কথা শেষ হতেই সবাই খিলখিল করে হেসে উঠলো। অরিন বললো,
” মানে বুঝলাম না।”
ইতি মারিয়াকে ইশারা করে বললো,” বোঝা।”
বাকিরা হেসেই চলেছে। মারিয়া অরিনের একটু কাছে এসে বললো,
” ইলহান ভাইয়াকে চড় মেরে তো কেলেংকারী বাঁধিয়েছিস। এখন মনে হচ্ছে বিয়েবাড়িতে যুদ্ধ লাগবে।”
অরিন এবারও নিষ্পাপ মুখে প্রশ্ন করলো,
” কেনো কি হয়েছে?”
তানিশা ফুশ করে হেসে উঠলো। অন্বেষা বললো,
” ইলহান ভাইয়ের একটা দজ্জাল ফুপু আছে। তুই যখন ঘুমিয়েছিলি কি ঘটনা হয়েছে জানিস? আমাদের সবাইকে একত্র করে তিনি জেরা করেছেন। ইলহান ভাইয়ার গালে যে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসেছিল, সেই দাগের সাথে আমাদের হাতের ছাপ মিলিয়ে দেখেছেন। সবারটা মিলিয়েছেন। ভুলবশত তানিশার সাথে অনেকটা মিলে গেছিল। তানিশার তো তখন কলিজার পানি শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।”
তানিশা বুকে হাত দিয়ে বললো,” হ্যাঁ দোস্ত। আমি যে কি ভয় পেয়েছিলাম। উনি বড় বড় চোখ দিয়ে এমনে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আমার কাঁধ চেপে ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বললেন,’ আমার চান্দের মতো পোলার গালে যদি একখান দাগ পড়ে তোমারে আমি জ্যান্ত কুইট্টালামু।’ বাপরে বাপ! সে কি ঝারি! আমার মাথা এখনও দুলছে।”
ইতি আর মারিয়া খুব জোরে হাসতে লাগলো। অরিনের যেনো নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল ভয়ে। অন্বেষা বললো,
” শ্যানিন এসে না বাঁচালে আজকে তোর খবর ছিল তানিশা।”
অরিন ভ্রু কুচকে বললো,
” কিন্তু ওই আন্টি এমন অদ্ভুত কাজ কেনো করলেন?”
” তোকে খুঁজে বের করার জন্য। ”
” এইভাবে কেনো খুঁজতে হবে?”
” আরে, ইলহান ভাইয়া তো তোর নাম বলেনি। শুধু বলেছে আমাদের মধ্যে যেকোনো একজন। তাই হাতের ছাপ মিলিয়ে খুঁজেছেন।”
” কি এমন ছাপ পড়েছে উনার গালে? উনি তো অর্ধেক ধুয়েই সব সাফ করে ফেলেছেন।”
” তবুও, তুই দেখিসনি বোধ হয়। গালটা একদম ফুলে গোলাপী হয়েছিল। খুব সুন্দর মানুষ তো।দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কেউ চড় মেরেছে। এজন্যই তো বুড়ি আন্টি আরও ক্ষেপেছেন। নুসাইবা আন্টি প্রায় আধঘণ্টা ছেলের গালে বরফ ডলে দিয়েছেন। কি যে হাঙ্গামা হয়েছে বাড়িতে। তুই ঘুমিয়েছিলি বলে মিস করলি।”
” আমি ঘুমিয়ে না থাকলে তো সব ঝড় আমার উপর দিয়ে যেতো।”
মারিয়া বললো,” উহুম। কিছুই হতো না। আমার মনে হয় ইলহান ভাইয়া তখন তোকেও বাঁচিয়ে দিতেন। এজন্যই তো সবাই এতো জিজ্ঞেস করার পরেও উনি একবারও তোর নাম মুখে নেয়নি। সবাই তো তোকে পাগলের মতো খুঁজেছে।”
” ঢং করে আমার নাম লুকিয়ে রাখার কি দরকার ছিল? এতো দরদ থাকলে চড়ের বিষয়টাও লুকিয়ে রাখতে পারতেন। সেটা বলতে গেলেন কেনো?”
ইতি বললো,” আরে, সেটা তো উনি বলেনি। উনার মুখ দেখেই সবাই বুঝে গেছে। তারপর শ্যানিন স্বীকার করেছে। ইলহান ভাইয়াও তাল মিলিয়েছে। কিন্তু তোর নাম বলতে উনি আমাদের সবাইকে নিষেধ করেছেন। তাহলে বোঝ!”
অরিনের মনে তখনি খটকা লাগলো। উনি কেনো অরিনকে বাঁচাতে চাইলেন?
রাত বারোটা বাজে তখন। বিয়ের আয়োজন প্রায় শেষেরদিকে। সবাই নাচ-গান করে স্টেজ ফাটিয়ে ফেলছে এমন অবস্থা। তখন শ্যানিন মাইকের সামনে গিয়ে ঘোষণা দিল ইলহানকে চড় মারা ব্যক্তিটি তার বেস্টফ্রেন্ড অরিন তাবাসসুম মিষ্টি। সে এখন সবার সামনে ইলহানের কাছে বিনীত অনুরোধে ক্ষমা চাইবে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যেকের শকুনী দৃষ্টি অরিনের উপর এসে পড়লো। ইলহানের সেই দজ্জাল বড়ফুপু এমনভাবে অরিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন যেনো অরিন কাউকে খুন করে ফেলেছে। খুবই বিব্রতকর অবস্থার মধ্য দিয়ে অরিন ক্ষমা চাইলো ইলহানের কাছে। ইলহান কিছু বলার আগেই সে দৌড়ে চলে গেল ওখান থেকে। পুকুর কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালো। জায়গাটা তখন একদম নিরিবিলি। দূর থেকে গান-বাজনার আওয়াজ আসছিল। পুকুরের টলটলে জলগুলোও যেনো ঝলমলে আলোকে সজ্জিত। মোহনীয় পরিবেশ। অরিনের চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছিল। রাগের মাথায় নাহয় দু’টো চড়ই মেরেছে সে। তাই বলে এতো অপমান? অরিন তো ইলহানকে সবার সামনে চড় দেয়নি৷ তাহলে সবার সামনে কেনো ক্ষমা চাইতে হলো? কিছুক্ষণ পর ইলহান আচমকা এসে অরিনের হাত ধরে বললো,
” শন পাপড়ি, এদিকে এসো।”
অরিন হতভম্ব হয়ে বললো,” শন পাপড়িটা কে?”
” তুমি। মিষ্টি শন পাপড়ি।”
এই কথা বলে হাসলো ইলহান। তার ঝলমলে চেহারায় বামপাশের গাঢ় টোলটা স্পষ্ট ভেসে উঠলো। অরিন তখনি আবিষ্কার করেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চেহারার মালিক হলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি। কিন্তু রেলগাড়ীর ওয়াশরুমের দাঁড়িয়ে অরিনকে দেখিয়ে দেখিয়ে মুখ ধোঁয়ার বিষয়টা অরিন তখনও ভুলে যায়নি। সে নাক-মুখ ফুলিয়ে বললো,
” আমার হাত ছাড়ুন। আমি কালো মানুষ। নোংরা লেগে যাবে না আপনার হাতে?”
ইলহান ঠোঁট বাকা করে বললো,” আসলেই তো। আমার হাতে কালো লেগে গেছে৷ ধুঁয়ে ফেলি কি বলো?”
ইলহান পুকুরের পানিতে হাত ধুতে লাগলো। অপমানে অরিনের মুখ চিমসে গেল একদম। এই লোক আস্তো বদমাইশ। ইচ্ছে করে অরিনকে অপমান করছে! সে রেগে-মেগে বললো,
” আমার হাতেও সাদা লেগে গেছে। ছি, আমাকেও হাত ধুতে হবে।”
অরিনও শুরু করলো হাত ধোঁয়া। ইলহান হাসতে হাসতে অরিনকে আবার ছুঁয়ে দিল। অরিনও ইলহানকে ছুঁয়ে দিল। তারপর দুজনই পুনরায় হাত ধোঁয়া শুরু করলো। ঘষে, ডলে,মেজে হাত ধোঁয়া। যেনো যে যত বেশি ডলবে বিপরীত মানুষটি ততবেশি অপমানিত হবে। ইলহান এক পর্যায় উঠে দাঁড়িয়ে অরিনের গাল ছুঁয়ে দিল। অরিনও উঠে পা উঁচু করে ইলহানের গাল ছুঁয়ে দিল। ইলহান ইচ্ছে করেই হঠাৎ অরিনের কপালে চুমু দিল। এইটা তো অরিন করতে পারবে না। কিন্তু অরিনও কিছু কম যায় না। সে উপায়ন্তর না দেখে স্টেজের সামনে থেকে একটা চেয়ার তুলে এনে সেই চেয়ারে উঠে ইলহানের কপালেও একইভাবে চুমু দিল। এতে ইলহান যতটা অবাক হলো তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি অরিন নিজেই অবাক হয়ে থমকে গেল। আচ্ছা, ইলহান কি সেদিনের পর থেকেই অরিনের প্রেমে পড়েছিল? নাকি আরও আগে? ট্রেনে প্রথমবার চড় খেয়েই?

চলবে

( আমার মনে হয় সবাই যদি একটু গঠনমূলক কমেন্ট করতো তাহলে এতো বড় পর্বটা লেখা সার্থক হতো। যারা নিয়মিত কমেন্ট করেন তাদের বলছি না, যারা কমেন্ট করেন না তাদেরকেই বলছি। আসলে রেসপন্স এতো কম দেখলে উৎসাহটাও হারিয়ে যায়। তখন ইচ্ছা করে কোনোমতে একটা এন্ডিং দিয়ে গল্প শেষ করে ফেলতে। আশা করি আমাকে এতোটা হতাশ হতে দিবেন না আপনারা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here